অনেক খারাপ ছাত্র কেন উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হন?


এক নজরে লেখাটির বিষয়ে:

এইতো সেদিনই এসএসসি পরীক্ষার ফল বের হলো। ভাল ফলাফল করা ছাত্রছাত্রীরা যেমন উল্লাসে ফেটে পড়ছে। তেমনি কিছু খারাপ ফল করা ছাত্রছাত্রী লজ্জায় মুখ লুকানোর চেষ্টা করছে। আর আজকাল তো জিপিএ ৫ এর নিচে রেজাল্ট হলেই সেটাকে ‘খারাপ’ ফলাফল হিসেবে ধরে নেয়া হয়। তাদের বাবা-মা সহ অনেকেরই ধারনা এরা জীবনে কিছু করতে পারবে না। এমনকি এই ধারনা তাদের নিজেদেরও পেয়ে বসেছে। আজ যারা ভাল ফলাফল করেছে, তাদের সবাই হয়তো অনেক ভাল ভাল ক্যারিয়ার গড়বে। সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অনেক বড় বড় পদে আসীন হবে – কিন্তু সত্যিকথা বলতে, ভবিষ্যতের সফল উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগই কিন্তু লুকিয়ে আছে এইসব ‘অমনযোগী’ ‘দুষ্টু’ ছেলেমেয়ের মাঝে।


ম্যাথু টরেন একজন আমেরিকান উদ্যোক্তা। তিনি এবং তাঁর ভাই এ্যাডম টরেন মিলে বেশ কিছু সফল ব্যবসা দাঁড় করিয়েছেন। সেইসাথে তাঁরা Youngenterpreneur.com এরও প্রতিষ্ঠাতা।
ম্যাথু গবেষণা করে দেখেছেন বেশিরভাগ ব্যবসায়ী, যাঁরা নিজের চেষ্টায় বড় হয়েছেন – তাঁদের বেশিরভাগই পড়াশুনায় হয় খারাপ ছিলেন, আর নাহয় পড়াশুনায় আগ্রহী ছিলেন না। আজকের বিশ্বের বড় বড় কোম্পানীগুলোর মালিকদের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় তাঁরা বেশিরভাগই হয় কলেজে পড়েননি, অথবা কলেজে ভর্তি হয়ে একটা পর্যায়ে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছেন। স্টিভ জবস, বিল গেটস, ইলন মাস্ক, জুকারবার্গ – এঁদের ব্যাপারে তো সবাই জানে। কিন্তু এর বাইরেও অনেকে আছেন যাঁরা ক্লাসরুমের পেছনের সারির ছাত্র হলেও পরবর্তীতে সামনের সারির ছাত্রদের ‘বস্’ হয়ে বসেছেন। কিন্তু কেন এমনটা হয়? কেন ভবিষ্য‌ৎ উদ্যোক্তারা শিক্ষাজীবনে ফলাফলের দিক থেকে পিছিয়ে থাকেন? অন্যকথায়, যাঁরা শিক্ষাজীবনে পিছিয়ে থাকেন, তাঁরা কেন পরবর্তীতে গিয়ে বড় উদ্যোক্তা বনে যান?

সফল উদ্যোক্তা ও লেখক ম্যাথু টরেন এর ৫টি কারন খুঁজে পেয়েছেন। চলুন কারনগুলি জেনে নেয়া যাক।

০১. তাঁরা সাধারন ধ্যানধারনার বাইরে গিয়ে চিন্তা করেন:

সাধারন মানুষ যেভাবে চিন্তা ও কাজ করে, সেভাবে চিন্তা বা কাজ করে আপনি কখনওই অসাধারন সাফল্যের দেখা পাবেন না।  টরেন বলেন, “যখন আমার ক্লাসমেটরা পড়াশুনা বা খেলাধুলায় সেরা হওয়ার চেষ্টা করতো, তখন আমি ও আমার ভাই পরবর্তী বড় ব্যবসার পুঁজি যোগাড়ের জন্য বাইরে থেকে আমদানী করা ইলেকট্রনিক্স পন্য বিক্রী করার চেষ্টা করতাম।  দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে বেশিরভাগ স্কুল সব ছেলেমেয়েকে একই পদ্ধতি আর নিয়ম মানতে শেখায়। এই সংস্কৃতির কারনে, যারা সৃষ্টিশীল বা উদ্যোগমূলক কিছু করতে চায়, বা নতুন কিছু করে দেখাতে চায়, তারা স্কুলে নিজেদের তেমন একটা মেলে ধরতে পারে না”।

উদ্যোক্তারা সব সময়ে পুরাতনকে ভেঙে নতুন কিছু গড়তে চায়।  তারা আর সবার মত প্রচলিত ধ্যানধারনা বা নিয়মকানুনের মাঝে আটকে থাকতে চায় না।  তারা মানুষের সমস্যার এমন সব সমাধান বের করে আনতে চায়, যা এখন পর্যন্ত অন্য কেউ করে দেখাতে পারেনি।  নতুন কিছু করতে পারা, নতুন বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে পারাটা তাদের কাছে ঐসব বিষয়ে ভাল করার চেয়ে অনেক আকর্ষণীয় যেসব বিষয় স্কুল থেকে বের হয়ে সত্যিকারের কোনও কাজে লাগবে না।  হয়তো একটি ছেলে বা মেয়ে টিচারের কথা শুনতে চায় না, স্কুলের নিয়ম মানতে চায় না – এই কারনে পড়াশুনাতেও সে ভাল নয়।  কিন্তু এখন না বোঝা গেলেও হয়তো তার মাঝে এমন একটি আবিষ্কারক, অথবা সৃষ্টিশীল সত্ত্বা লুকিয়ে আছে – যা সে একটা সময় পর্যন্ত নিজেও জানবে না।

০২. তাঁরা সব সময়েই নিজেদের স্বাধীনতার অধিকারকে মূল্য দেন:

Image result for think out of the box

সত্যি কথা বলতে, স্কুল মানেই অন্যের কথামত চলা। অন্য মানুষ যা নিয়ম করে দেবে, সেইসব নিয়ম মেনে চলা।  একজন উদ্যোক্তা স্বভাবগত ভাবেই নিজস্ব ধরনের চিন্তা ও কাজের অধিকারী।  আর তাদের এই স্বভাব পুরোপুরি ডানা মেলতে পারে না, যখন অন্য কেউ তাদের কি করতে হবে, কি বলতে হবে, তা সব সময়ে শিখিয়ে দিতে থাকে।  তারা অন্যের কথায় চলতে কখনওই পছন্দ করে না।  অনেক সময়েই দেখা যায় যে একজন উদ্যোক্তা একদম শেষ বর্ষে এসে পড়াশুনা ছেড়ে দেয়, কারন তার মনে হয় এই সময়টা তার নিজের প্রজেক্টে দিলে তার জন্য বেশি ভাল হবে।  তারা যদি কোনও কাজ সময়ের বা নিয়মের জালে বাঁধতে চায়, তবে সেটা হতে হবে তাদের নিজের বেঁধে দেয়া সময় এবং তাদের নিজের সৃষ্টি করা নিয়ম।  আর এই কারনেই যার মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার গুণ আছে সে প্রায়ই স্কুলের গন্ডিতে নিজেকে বন্দী মনে করে।

কিছু মানুষের জন্মই হয় নতুন নিয়ম সৃষ্টি করার জন্য, পুরনো নিয়ম মানার জন্য নয়। এই কারনেই এই গুণের অধিকারী অনেক ছাত্রছাত্রীকেই দেখা যায় একটি বা দু’টি বিষয়ে ভাল করতে আর বাকি সব গুলোতে সাধারন বা খারাপ ফলাফল করতে। কারন তাদের নিজের কাছে যা ভাল লাগে, এর বাইরে কোনওকিছু করতে তারা উ‌ৎসাহী হয় না।  “স্কুল পালানো ছেলেরাই স্বাধীনতা আনে” কারন তারা প্রকৃত স্বাধীনতার মূল্য বোঝে।

০৩. অনেক সময়েই তাঁরা বইয়ের পড়া মুখস্থ করার চেয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে বেশি পছন্দ করেন:

Image result for learn from experience

কিন্ডারগার্ডেন বা প্রাইমারী থেকে শুরু করে মাস্টার্স পর্যন্ত একজন ছাত্রকে অজস্র তত্ত্ব ও তথ্য মুখস্থ করতে হয়। কিছু কিছু বিষয়ে ভাল করার জন্য মুখস্থ করার কোনও বিকল্প নেই।  বেশিরভাগ বিষয়েই ছাত্রদের বলা হয় বাস্তব প্রয়োগটি ‘কল্পনা’ করতে, কিন্তু বিজ্ঞানের কিছু ব্যবহারিক বিষয় ছাড়া অন্য কোনও বিষয়েই সত্যিকার অর্থে বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে শেখাকে উ‌ৎসাহীত করা হয় না।

যাদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার গুণ আছে, তাদের বেশিরভাগই তথ্য ও তত্ত্ব মুখস্থ করে শেখার চেয়ে বাস্তব জীবন থেকে শেখার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী, এবং সিলেবাস মুখস্থ করে শেখার চেয়ে তারা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শেখা জ্ঞানকে বেশি মূল্য দেয়।  তারা ক্লাসরুমের বাইরে সময় কাটাতে চায় কারন তারা বাস্তব পৃথিবী থেকে অভিজ্ঞতা নিতে চায়, সেখান থেকে শিখতে চায়।  ম্যাথু টরেন লিখেছেন: “এতে কোনওই সন্দেহ নেই যে, আমি এবং এ্যাডাম (ম্যাথু টরেনের ভাই ও ব্যবসায়িক পার্টনার) আমাদের ছোটবেলায় বাস্তবে ব্যবসা করতে গিয়ে এমন অনেক কিছু শিখেছি যা ব্যবসার ক্লাস কখনওই শেখাতে পারতো না”।

সৃষ্টিশীল ছাত্ররা বা উদ্যোক্তা হতে চায়, এমন ছাত্ররা ক্লাসের বইয়ের মাঝে তাদের জীবনকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে না।  অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায় পড়ার বই বাদ দিয়ে অন্য ক্লাসের বা অন্য বিষয়ের বই নিয়ে দিন পার করে দিচ্ছে। অনেক অভিভাবক ও শিক্ষকের চোখে এটা গুরুতর অপরাধ হলেও, সত্যিকার অর্থে তারা সেখান থেকেও জ্ঞান অর্জন করছে।  এবং এই জ্ঞান তাদের কোনও না কোনও সময়ে কাজে লাগেই। ইতিহাসের বড় বড় অনেক লেখক তাঁদের ক্লাসরুমের বাইরে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়া বইয়ের জ্ঞান কাজে লাগিয়েই পরবর্তীতে সফল লেখক হয়েছেন।

০৪. তাঁরা শিক্ষাকে ভালবাসেন, কিন্তু বাঁধাধরা গন্ডির মাঝে থেকে শিখতে পছন্দ করেন না

আগের পয়েন্টের রেশ ধরেই বলা যায়, একজন ছাত্র যদি ক্লাসের পড়া পড়তে না চায় – তবে বলা যাবেনা যে সে পড়াশুনাকে পছন্দ করে না।  একজন উদ্যোক্তা সব সময়েই শিখতে পছন্দ করেন। বিল গেটস অথবা ওয়ারেন বাফেটের মত বড় বড় উদ্যোক্তারা সব সময়েই পড়ার কথা বলেন। কিন্তু সেই পড়া যে ক্লাসের পড়া হতে হবে – এটা জরুরী নয়।  স্কুলের পড়া করলেই যে জীবনে অনেক বড় সাফল্য পাওয়া যাবে, উদ্যোক্তারা সেটা বিশ্বাস করেন না। অনেক উদ্যোক্তা এটা স্কুল থেকে বের হওয়ার পর উপলব্ধি করেন, কিন্তু এই অনুভূতিটা তাদের মাঝে ছোটবেলা থেকেই থাকে।  অনেক উদ্যোক্তাই প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে নিজের মত করে শিখতে পছন্দ করেন। হয়তো ক্লাসের পড়া ধরলে তাঁরা পারবেন না, কিন্তু ক্লাসের বাইরের অনেক বিষয়ে তাঁরা রীতিমত বিশেষজ্ঞ। এর কারন তাঁরা তাঁদের আগ্রহের বিষয়ে নিজের মত করে পড়াশুনা করেছেন।  আর আজকালকার দিনে আগ্রহ থাকলে শেখার জন্য ক্লাসের প্রয়োজন পড়ে না।  ইন্টারনেট ঘাঁটলেই অজস্র বই, কোর্স, আর্টিকেল পাওয়া যায় যা থেকে শেখার অনেক কিছু আছে।  প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে শেখার চেয়ে তাঁরা নিজের মত করে অনেক ভাল শিক্ষা লাভ করতে পারেন।  আর এটা বুঝতে পারার কারনে পৃথিবীর অনেক বড় বড় উদ্যোক্তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং সেই কারনে তাঁদের রেজাল্টও ‘খারাপ’ হয়ে যায়।

কিছু কিছু শিক্ষা পদ্ধতি একজন মানুষকে ক্লাসরুমের থেকে অনেক বেশি শেখাতে পারে, যদি মানুষটি স্বাধীন ভাবে নিজের আগ্রহে শেখে।

০৫. তাঁরা জানেন যে জীবনের সাফল্য রেজাল্ট কার্ডে ‘A+’ এর থেকে বেশি কিছু:

Image result for success wallpaper

একজন উদ্যোক্তাকে সব সময়ে মনে রাখতে হয় যে সে কত টাকা আয় করল, এটাই তার ব্যবসার সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি নয়।  এই একই ব্যাপার পড়াশুনার ক্ষেত্রেও খাটে।  আজকাল অনেক বেশি ছাত্র জ্ঞানটিকে নিজের মাথায় রাখা, নিজের সিভিতে দেয়ার জন্য অভিজ্ঞতা অর্জনের চেয়ে গ্রেড এর পেছনে বেশি ছোটে।

যেসব উদ্যোক্তা পড়াশুনায় খুব একটা সাফল্যের দেখা পান না, তাঁরা প্রায়ই অন্যদিকে সাফল্য পাওয়ায় মনযোগী হন।  উদাহরন হিসেবে বলা যায় নিজের একটি ওয়েবসাইট তৈরী করা, নতুন নতুন দক্ষতা অর্জন করা, সিলেবাসের বাইরেও জ্ঞান অর্জন করার জন্য পড়াশুনা ও কাজ করা – ইত্যাদি।  ম্যাথু লিখেছেন, “আমি ও আমার ভাই ডেভিড এই গ্রেড এর বিষয়টিকে একটি গেম হিসেবে দেখতাম। আমরা দেখেছি অনেক ছাত্রই বিভিন্ন রকম প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তাদের গ্রেড ভালো রাখতো। আমরা কখনওই এই গেম এর মধ্যে আগ্রহের কিছু পাইনি। সত্যি বলতে এটা আপনার রেজাল্ট কার্ডে কিছু লেটার ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের কাছে সেইসব বিষয়ের পেছনে সময় দেয়াটাই বেশি যুক্তিসঙ্গত মনে হতো, যেগুলো থেকে দীর্ঘমেয়াদী কোনও লাভ আসবে”।

পরিশিষ্ট:

আপনি যদি লেখাপড়ায় ভালো রেজাল্ট করাকে আপনার সাফল্যের মাপকাঠি ধরে নেন, সেটা মোটেই খারাপ কিছু নয়।  একজন মানুষের যদি ইচ্ছা থাকে যে সে বড় কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বা এই ধরনের কিছু হবে, তার জন্য ভাল রেজাল্ট করাটা খুবই জরুরী। কিন্তু শুধুমাত্র রেজাল্ট কার্ডে ভাল মার্ক পাওয়াটাই একজন মানুষের জীবনের একমাত্র সাফল্য নয়।  ছাত্র হিসেবে সফল না হলেও একজন মানুষ অন্য অনেক ভাবে সফল হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ স্কুলে টিঁকতে পারেননি, নজরুল স্কুলে যাওয়ারই সুযোগ পাননি। বিল গেটস, জুকারবার্গ স্বেচ্ছায় পড়াশুনা ত্যাগ করেছেন – তাঁদের কাছে সাফল্যের সংজ্ঞা অন্যরকম।  একটি ছেলে বা মেয়ে যদি স্কুলে ভাল রেজাল্ট না করে, পড়াশুনা যদি তার ভাল না লাগে, তাহলে কোনওভাবেই বলা যাবে না যে তার জীবন শেষ। হয়তোবা সেই ডানপিটেমি আর অবাধ্যতার মাঝেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের বিশ্বজয়ী উদ্যোক্তা, আবিষ্কারক বা অন্য বড় কিছু হওয়ার সম্ভাবনা।


লেখাটি কেমন লাগলো তা আমাদের কমেন্ট করে জানান। আপনার প্রতিটি মতামতই আমাদের কাছে অমূল্য পাথেয়। আর যদি মনেহয় এই লেখার মাধ্যমে কেউ তার জীবনের নতুন দিক খুঁজে পাবে, অথবা উ‌ৎসাহিত হবে, তাহলে লেখাটি শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন। আমাদের সাথে থাকুন, সাফল্যের পথে প্রতিটি পদক্ষেপে লড়াকু আপনার সাথে আছে।

পোস্টটি শেয়ার করুন !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *