সফল মানুষের রুটিন: কেন তাঁরা ভোর বেলা ওঠেন?


বেশিরভাগ সফল মানুষের রুটিন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তাঁরা প্রায় সবাই একদম ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। নাকি উল্টো করে বলব? “যাঁরা সকালে ওঠেন, তাঁদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে”।

যেভাবেই বলা হোক, “Early to bed and early to rise, makes a man healthy, wealthy and wise.” – ছোট বেলায় পড়া এই ছড়াটি যে সত্যি, সেই প্রমাণই পাওয়া যায়।

তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়া ও তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা মানুষগুলো স্বাস্থ্যবান, ধনী ও জ্ঞানী হন।

সবাই যে একসাথে তিনটি পান – তা নয়, তবে এগুলোর যে কোনও একটা বা সবগুলোই তাঁদের দখলে থাকে, অন্তত পক্ষে অন্যদের চেয়ে এঁরা সুস্থ হন।  জীবনে যা-ই পেতে চান না কেন, এই একটি অভ্যাস রপ্ত করতে পারলে আপনি অন্যদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারবেন।

wake up early, get success

এই যে আজকাল আমরা এত সহজে দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়ি, এর পেছনে কি আমাদের ঘুমানোর অভ্যাসের কোনও দায় নেই?

আমাদের দেশেই আগের যুগের মানুষদের অভ্যাস ছিল আটটা নয়টার মাঝে ঘুমিয়ে পড়া আর অন্ধকার থাকতে ঘুম থেকে ওঠা।

আজও গ্রামাঞ্চলে ৮০-৯০ বছর বয়সের এমন মানুষ আছেন যাঁদের দেখলে আপনার মনে হবে তাঁদের বয়স ৫০ এর আশেপাশে। এই সময়ের অনেক তরুণের চেয়ে তাঁরা এখনও সুঠাম ও সুস্থ।

আমি বলছি না যে এর পেছনে শুধু সকালে ওঠার অভ্যাসেরই কৃতিত্ব – তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে তাঁদের চম‌ৎকার স্বাস্থ্যের পেছনে এই অভ্যাসের একটি বড় অবদান আছে।

এবং শুধু স্বাস্থ্য নয়,  অর্থনৈতিক সাফল্য, ভালো কাজের কারণে বিশ্বজোড়া খ্যাতি যাঁদের আছে – তাঁদের সবার মাঝেই ভোরে ওঠার অভ্যাস দেখতে পাওয়া যায়।

রেঁনেসাসের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি থেকে শুরু করে আজকের ওবামা, ওয়ারেন বাফেট, জেফ বিজোস, স্টিভ জবস, বিল গেটস, রিচার্ড ব্রানসন, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো – বিশ্বখ্যাত ভোরের পাখিদের সবার নাম লিখতে গেলে এই লেখার কলেবরেও ধরবে না।

কিন্তু কেন সকালে ওঠার অভ্যাসটি সফলদের মাঝে এতটা কমন? পৃথিবীর বেশিরভাগ যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন কেন এই অসাধারণ সফল মানুষগুলো হাতের মুঠোয় পৃথিবী পাওয়ার পরও কষ্ট করে বিছানা ছেড়ে দিনের শুরু করেন?


চলুন ভোর ৪টার আগে ঘুম থেকে ওঠা কিছু বিশ্বখ্যাত সফল মানুষের কাছ থেকে ব্যাপারটা আরেকটু ভালো ভাবে জেনে আসি:


এ্যাপল এর বর্তমান সিইও টিম কুক প্রতিদিন ঠিক ভোর ৩:৪৫ এ বিছানা ছাড়েন।  পেপসির সিইও ইন্দ্রা নূয়েই ঠিক ৪টার সময়ে ঘুম থেকে ওঠেন।  এছাড়া সাবেক ওয়াল স্ট্রিট জায়ান্ট এবং এলিভেস্ট এর সিইও শ্যালি ক্রাওচেক, জনপ্রিয় গাড়ির ব্র্যান্ড Chrysler এর সিইও সার্জিও মার্কোনী, জেনারেল মটরস এর সিইও ড্যান এ্যাকারসন, ডিজনি সিইও রবার্ট ইগার, ইউনিলিভার সিইও পল পোলম্যান – সবাই ভোর ৪টার আগে বা সাড়ে চারটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে পড়েন।  এই নামগুলো বললাম কারণ, এই নামগুলো বেশিরভাগ মানুষের চেনা – এর বাইরেও অজস্র সফল মানুষ রয়েছেন যাঁরা এই সময়ে ঘুম থেকে ওঠেন।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সময়টা হল দিনের সবচেয়ে ‘প্রোডাক্টিভ’ সময়।  কারণ, এই সময়টিতে বাইরের সমস্যা ও কোলাহল পুরোপুরি বন্ধ থাকে।

Image result for running at dawn in country

এ প্রসঙ্গে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে দেয়া এক সাক্ষা‌ৎকারে প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ও “Two awesome hours” এর লেখক জশ ডেভিস বলেন “পরিবেশ যখন শান্ত ও চুপচাপ থাকে, এবং মানুষ আপনাকে তাদের সমস্যা নিয়ে বিরক্ত করে না, তখন আপনার কাজ ও চিন্তা করার ক্ষমতা নাটকীয় মাত্রায় বেশি কাজ করে!”

সূর্য ওঠার আগে জাগলে, টেক্সট মেসেজ, মেইল, ফোনকল, সোশ্যাল মিডিয়া নোটিফিকেশন – ইত্যাদির হাত থেকে আপনি বেশ কিছুটা সময়ের জন্য মুক্ত থাকেন, এবং পুরোপুরি নিজের কাজে মনযোগ দিতে পারেন।

এ প্রসঙ্গে ডেভিস বলেন: “ভোর চারটার সময়ে কেউই আপনাকে মেসেজ দেয়া বা ফোন করার কথা ভাববে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব কম লোকই পোস্ট করবে।  ভেতরের ও বাইরের মনযোগ নষ্টকারী ব্যাপারগুলো থেকে আপনি অনেকটাই মুক্ত থাকবেন। “

সবার দিন শুরু হওয়ার আগে আপনি কিছু জরুরী কাজ সেরে রাখতে পারলে আপনার নিজের জীবনের ওপর আপনার আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ থাকবে।

লেখক ও গবেষক থমাস সি. কোরলি ৫ বছর ধরে ১৭৭ জন মিলিওনেয়ারের ওপর গবেষণা করে দেখেছেন এঁদের সাফল্যের পেছনে সকালে ওঠার অভ্যাসের অবদান অনেকখানি।

এই অভ্যাসের ফলে তাঁরা তাঁদের জীবণন একটি দারুন শৃঙ্খলা নিয়ে আসতে পেরেছেন, যার ফলে তাঁদের অন্য কাজ গুলোও নিয়ম মাফিক চলেছে।

সাধারণ ওয়ার্কিং আওয়ার শুরু হওয়ার ৩ ঘন্টা আগে কাজ শুরু করতে পারলে আপনি অন্যদের চেয়ে এমনিতেই এগিয়ে যাবেন।

এমনটা প্রায়ই দেখা যায় আমরা দিনে কি কি করব, তার একটা পরিকল্পনা নিয়ে দিন শুরু করি।  কিন্তু হঠা‌ৎ করে আসা বিভিন্ন বিঘ্নের কারণে সবগুলো কাজ করা হয়ে ওঠে না, যার জন্য আমাদের আবার পরে সময় বের করতে হয়। এটা অবশ্যই আমাদের পিছিয়ে দেয়।

৫ মিনিট ১০ মিনিট করে দেড় দুই ঘন্টা এমনিতেই নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে কাজ জমতে জমতে আমরা পিছিয়ে পড়ি।  শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, অনেক কাজই আর করা হয়ে ওঠে না। অনেকেই এই কারণে হতাশ হয়ে পড়েন।

কিন্তু এর সমাধান আসলে খুবই সহজ। ভোর বেলা ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করুন।  দিনের কাজ যদি ৩ ঘন্টা আগে শুরু করা যায়, তবে নষ্ট হওয়া সময়টা কাভার করা সম্ভব। 

এই চর্চাটি ঠিক মত করতে পারলে আপনি অনুভব করবেন যে আপনার দৈনন্দিন জীবনের ওপর আপনার একটি নিয়ন্ত্রণ আছে।  আপনার মাঝে এক অন্যরকম আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হবে।  আপনার কাজগুলো আপনি আরও সূচারু ভাবে করতে পারবেন।


এর বাইরেও আপনি ভোরে উঠলে বেশ কিছু জিনিস আরও ভালো ভাবে করতে পারবেন, যার ফলে আপনার দিনটি ভালো যাবে, এবং আপনি সব কাজই সফলতার সাথে শেষ করতে পারবেন:


সকালের নাস্তা:

দিনের সবচেয়ে জরুরী খাবারটা হল সকালের নাস্তা।  এই খাবার আপনার খাওয়া উচি‌ৎ ধীরে সুস্থে।  কিন্তু কাজে যাবার একটু আগে ওঠার কারণে আমাদের বেশিরভাগ সময়েই সকালের নাস্তা তাড়াহুড়া করে শেষ করতে হয়।  এর ফলে দিনের শুরুতে আমাদের শরীর তার প্রয়োজনীয় ফুয়েল পায় না এবং সেই কারণে আমাদের কাজকর্মও যতটা ভালো হতে পারত, ততটা হয় না।

delicious paratha

ভোর বেলা উঠলে আপনি রয়ে সয়ে আপনার পছন্দের আইটেম দিয়ে পেট পুরে সকালের নাস্তা করতে পারবেন, যা আপনাকে পুরো দিনের জন্য চাঙ্গা করে রাখবে।

বের হওয়ার আগে পরিবারের সাথে একটু ভালো সময় কাটাতে পারবেন:

জেফ বিজোস একবার বলেছিলেন:

“আমি যদি অফিসে ভালো সময় কাটাই, তবে একজন ভালো স্বামী, ভালো বাবা হিসেবে ঘরে ফিরি। আবার যখন ঘর থেকে ভালো মন নিয়ে অফিসে যাই, তখন আমি একজন ভালো বস, একজন ভালো সহকর্মী হয়ে উঠি”

এই ব্যাপারটা শুধু পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষটির নয়, সবার ব্যাপারেই খাটে।  ভালো মন নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে পারলে আপনি অফিসেও একটি ভালো মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে পারবেন।  এর ফলে আপনার কাজও ভালো হবে।  ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠলে আপনি অনেকটাই গুছিয়ে নিতে পারবেন, সেই কারণে তাড়াহুড়ার মধ্যে না থেকে আপনি একটি ধীরস্থির অবস্থায় থাকবেন। 

কিছু কাজ শেষ করার ফলে আপনার মনও থাকবে ফুরফুরে।  এই কারণে, স্ত্রী/স্বামী, সন্তান, বা পরিবারের অন্যদের সাথে চনমনে হয়ে কিছুটা সময় কাটাতে পারবেন, এবং ভালো মন নিয়ে ঘর থেকে বের হতে পারবেন।

দিনের বাকি পরিকল্পনা নিয়ে চিন্তা করতে পারবেন:

দিনের শুরুতে কিছুটা কাজ এগিয়ে রাখার পাশাপাশি, যাঁরা ভোর বেলা ওঠেন, তাঁরা বাকি দিনের কাজের পরিকল্পনা নিয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারেন।  একটি সফল দিন কাটানোর জন্য সেই দিনের পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে নামাটা জরুরী। এতে আপনি অনেক বেশি গুছিয়ে কাজ করতে পারবেন।

প্রার্থনা করার সময় ও সুযোগ পাবেন:

মিরাকেল মর্নিং বইয়ের লেখক হাল ইরোল্ড এর মতে, ঘুম থেকে উঠে আমাদের পার্থিব চিন্তা শুরু করার আগে অবশ্যই কিছুক্ষণ ধ্যান বা প্রার্থণা করা উচি‌ৎ।  এতে করে আমাদের মন অনেক শান্ত থাকে।  জীবনের যা অর্জন, তার জন্য যদি আমরা দিনের শুরুতেই সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই – তবে মন অনেক ভালো থাকে, সেই সাথে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে দিন শুরু করা যায়।

আর এই ধ্যান বা প্রার্থনার জন্য ভোর হল সবচেয়ে ভালো সময়।  আপনি যদি দেরি করে ঘুম থেকে ওঠেন, তবে ঘুম থেকে উঠেই কাজ আর ব্যক্তিগত চিন্তা আপনাকে পেয়ে বসবে।  শান্ত সমাহিত ভাবে দিন শুরু করাটা আপনার জন্য কঠিন হয়ে যাবে।  তাই ভোরে উঠলে আপনার এই উপকারটাও হচ্ছে।  পৃথিবীর অনেক সফল মানুষই ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই ধ্যান বা প্রার্থনায় মগ্ন হন।  আপনিও সেই সুযোগ পাবেন।

শরীরচর্চার সুযোগ:

শরীর ঠিক রাখার জন্য প্রতিদিন কিছু না কিছু শরীরচর্চা করাটা জরুরী।  কিন্তু অনেকেই সময়ের অভাবে এই কাজটি করতে পারেন না।  এক্ষেত্রে আপনার দিনটি যদি একটু আগে শুরু হয়, এবং সেই সময়টা আপনি শরীরচর্চায় ব্যয় করেন, তবে তা আপনার জন্য খুবই ভালো।  এর ফলে আপনি সারাদিন চাঙ্গা থাকতে পারবেন।  সেই সাথে আপনার শরীরও সুস্থ থাকবে।

আমেরিকান অনলাইন সার্ভিস Haro এর প্রতিষ্ঠাতা-সিইও এবং বেস্ট সেলিং “Faster Than Normalএর লেখক পিটার স্যাংকম্যান প্রতিদিন ভোর চারটার সময়ে ওঠেন এবং উঠেই ছয় মাইল দৌড়ান।  তিনি রাতেই ট্রাকস্যুট পরে ঘুমান, এবং ঘুম ভাঙার ১০ সেকেন্ডের মাঝে বিছানার পাশে রাখা কেডস পরে ফেলেন।  নিজেকে অলসতা করার কোনও সুযোগই তিনি দেন না।

পরিশিষ্ট:

ভোর বেলা ঘুম থেকে ওঠা মানুষেরা অন্যদের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকেন।  অন্যরা কর্মক্ষেত্রে ছুটতে শুরু করার অনেক আগেই তাঁরা নিজেদের গুছিয়ে নেন, দিনের বেশ কিছুটা কাজ তাঁরা আগেই করে রাখেন।  প্রতিদিনকার রুটিন এ এই একটু একটু করে এগিয়ে থাকাই শেষ পর্যন্ত তাঁদের একদম ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যায়।

শুধু যে সফল উদ্যোক্তারাই ভোরে ওঠার সুফল পান – তা নয়।  বড় বড় শিল্পী, লেখক, নেতা – এঁদের বেশিরভাগই অন্যদের চেয়ে অনেক আগে তাঁদের দিন শুরু করেন।  ভিঞ্চি সন্ধ্যার পরপর ঘুমিয়ে গিয়ে গভীর রাতে উঠে কাজ করতেন।  ইতিহাস ঘাঁটলে এমন আরও বহু বিশ্বজয়ীর কাহিনী পাওয়া যাবে।

আপনিও যদি আজ থেকে এই অভ্যাস শুরু করেন, কে বলতে পারে, এটাই হয়তো হবে আপনার বিশ্বজয়ের প্রথম পদক্ষেপ!


লেখাটি কেমন লেগেছে তা আমাদের কমেন্ট করে জানান। আমাদের প্রতি আপনার কোনও পরামর্শ বা চাওয়া থাকলে তা-ও কমেন্টে জানান। আপনার প্রতিটি মতামতই আমাদের কাছে অমূল্য। আর যদি মনে হয় লেখাটি পড়ে অন্যরাও উপকৃত হবেন, তাহলে শেয়ার করে তাদের দেখার সুযোগ করে দিন। আমাদের ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে যোগ দিয়ে আমাদের সাথে থাকুন। সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার সাথে আছে।


আপনার জন্য: 

 সকালে ঘুম থেকে ওঠা এবং আরওকিছু জরুরী অভ্যাস সহজে রপ্ত করার কৌশল

 হাই পারফর্মারদের ৬টি অভ্যাস: যেভাবেসাধারন মানুষেরা অসাধারন হয়ে ওঠেন

⇒ সাধারন মানুষের ১৫টি কাজ যা ধনীও সফল মানুষেরা কখনও করেন না

⇒ সফল ও দক্ষ মানুষদের ৭টি কমন অভ্যাস

⇒ “GTD মেথড”-আলস্যকে চিরতরে বিদায় জানান

⇒ ঢিলেমি বা দীর্ঘসূত্রিতার ৮টি ভয়াবহ কুফল

পোস্টটি শেয়ার করুন !