এক নজরে লেখাটির বিষয়ে:
কখনও কি ভেবে দেখেছেন, সবাই একই সাথে পড়ছে, একই শিক্ষকের সাথে একই রকমের সময় কাটাচ্ছে – তারপরও কিছু ছাত্র কেন অবিশ্বাস্য রকমের ভালো ফলাফল করে সব সময়ে? আর কিছু ছাত্র কেন সব সময়েই পেছনে থেকে যায়? এর কি কোনও সিক্রেট বা গোপন সূত্র আছে? – সত্যি বলতে কিছু সূত্র তো অবশ্যই আছে, আজ তেমনই ৯টি সেরা টেকনিক আপনাকে জানানো হবে।
কি এমন গোপন রহস্য বা সিক্রেট আছে ‘ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টদের?’ নিয়মিত পড়াশুনা করা, ক্লাসে মনযোগ দেয়া, আত্মবিশ্বাস – ইত্যাদি ইত্যাদি তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু এসবের ব্যবহার আপনি আসলে কিভাবে করবেন, সেটা কিন্তু জানার বিষয়। আর এগুলোই সিক্রেটের ভেতরকার সিক্রেট। এসবই আপনাকে এই লেখায় জানানো হবে, যাতে আপনি জানা-অজানা সব সিক্রেট জানতে তো পারবেনই, সেইসাথে সেগুলো ব্যবহার কিভাবে করবেন, সেই সিক্রেটও।
অনেকগুলো সিক্রেট থেকে বেছে বেছে আমরা আপনার জন্য সেরা ৯টি সিক্রেট এখানে এক করেছি। এই সিক্রেট গুলো যেমন একাডেমিক ক্ষেত্রে, তেমনি বিসিএস বা অন্য চাকরির পরীক্ষার ক্ষেত্রেও কার্যকর।
০১. ভাল ছাত্রদের জটিল বিষয় সহজ লাগার রহস্য:
প্রতিটি ক্লাসেই আমরা কিছুনা কিছু নতুন শিখি।এগুলোর কোনও কোনওটা সহজ, আবার কোনও কোনওটা খুবই জটিল। কিছু কিছু ছাত্র আছে যারা একদম নতুন ও খুবই জটিল বিষয়গুলোকে খুব সহজেই বুঝতে পারে। আর কিছু আছে যারা অনেক মাথা খাটিয়েও বুঝতে পারে না। আমরা সাধারন ভাবে এই দুই ধরনের ছাত্রকে, মেধাবী ও মেধাহীন এই দুই ভাগে ভাগ করে ফেলি। কিন্তু এই তুলনা বেশিরভাগ সময়েই ঠিক না। এরকম হওয়ার একটি গোপন কারন আছে যা বেশিরভাগ মানুষেরই চোখে পড়ে না। সেই গোপন বা সিক্রেট কারনটি হল আত্মবিশ্বাস। আমরা যখন একটি কঠিন বিষয়কেও সহজ ভাবে দেখি তখন আমাদের ব্রেনও সেটাকে সেভাবেই নেয়। আবার অনেক সহজ বিষয়কে কঠিন হিসেবে নিলে আমাদের ব্রেনও তাই ধরে নিয়ে ঠিকভাবে কাজ করে না।
ক্লাসের ভাল ছাত্ররা তাদের নিজেদের বোঝার ক্ষমতার ওপর সব সময়েই আত্মবিশ্বাসী থাকে। এরফলে যত জটিল বিষয়ই তাদের সামনে আসুক না কেন, তারা বিশ্বাস করে এটা তারা বুঝতে পারবে, এবং এই কারনেই জটিল বিষয়গুলো তাদের কাছে সহজ লাগে।
অন্যদিকে যাদেরকে সাধারন ভাষায় ‘খারাপ ছাত্র’ হিসেবে ধরা হয়, তারা আসলে কোনও জটিল বিষয় দেখলে আগে থেকেই ঘাবড়ে যায়। এর ফলে তাদের মস্তিষ্কও বিষয়টিকে সহজ ভাবে নিতে চায় না।
বেশিরভাগ ছাত্র বিষয় বা টপিকটি কতটা জটিল এই বিষয়ে চিন্তা করতে করতে মাথা খারাপ করে ফেলে। তাদের চিন্তা থাকে কোনওরকমে নাকে মুখে ব্যাপারটি বুঝে বা মুখস্থ করে পার পেয়ে গেলেই বাঁচা যায়। অন্যদিকে টপাররা সাধারনত শেখার ও জানার আগ্রহ নিয়ে বিষয়গুলোর দিকে আত্মবিশ্বাসের সাথে নজর দেয় এবং এই কারনে তারা বিষয়গুলো ভালভাবে বুঝতে ও মনে রাখতে পারে।
কম আত্মবিশ্বাসী ছাত্রদের চিন্তা থাকে কিভাবে এর থেকে বেঁচে বা এই জটিল বিষয়কে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায়। আর এটা তাদের মনে একটি ভয় সৃষ্টি করে রাকে, যার ফলে তারা ব্যাপারটি পুরোপুরি বোঝার চেয়ে তার থেকে বাঁচার উপায় খুঁজতে থাকে। অন্যদিকে আত্মবিশ্বাসী ছাত্ররা আগ্রহের সাথে জটিল বিষয়ের সমাধান নিয়ে ভাবে। তারা বিশ্বাস করে ঠিকমত মনযোগ দিলে যে কোনও জটিল টপিকই সমাধান ও আত্মস্থ করা সম্ভব। আর এই কারনেই জটিল বিষয়ও তাদের কাছে সহজ মনে হয়।
এই সিক্রেটকে যদি কাজে লাগাতে চান তাহলে আপনাকে প্রথমেই যেটা করতে হবে, একটি বিষয় বা টপিক কতটা জটিল তা নিয়ে না ভেবে, এর সমাধান আপনি কতটা সহজে করতে পারবেন তা নিয়ে ভাবা। সমস্যা নিয়ে না ভেবে সমাধান নিয়ে ভাবুন, টপিকটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বোঝার চেষ্টা করুন। দেখবেন কঠিন বিষয়ও ধীরে ধীরে সহজ হয়ে আসছে।
০২. ভাল ছাত্ররা যে লক্ষ্যে পড়াশুনা করে:
একটি ক্লাসের বেশিরভাগ ছাত্রই পড়তে হবে বলে পড়াশুনা করে। পাশ করার জন্য পড়াশুনা করে। অনেকে আশপাশের চাপে, শিক্ষকের ভয়ে, বাবা-মায়ের ভয়ে পড়াশুনা করে। কিন্তু টপার অর্থাৎ সেরা ছাত্রদের যদি প্রশ্ন করা হয় তারা কেন পড়াশুনা করছে – বেশিরভাগের থেকেই উত্তর আসে, তারা কেউ ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়, কেউ বিদেশে স্কলারশিপ চায়, কেউ দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পছন্দের বিষয়ে পড়তে চায়, কেউ বড় সরকারি বা কর্পোরেট কর্মকর্তা হতে চায়, কেউ অনেক বড় বিজনেস ম্যাগনেট হতে চায় – ইত্যাদি ইত্যাদি।
টপাররা সব সময়ে একটি লক্ষ্যস্থির করে পড়াশুনা করে। আর এই লক্ষ্যগুলোই তাদের সব সময়ে ভাল ফলাফল করার জন্য উৎসাহিত করে। পড়াশুনা ও ভাল ফলাফল করার যদি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে নেয়া যায় তবে নিজের ভেতর থেকেই ঠিকমত পড়াশুনা করার একটি তাগাদা থাকে।
০৩. ধারাবাহিকতার সূত্র:
অনেকেই মনে করেন ভাল ছাত্র হওয়া মানে দিন রাত ঘাড় গুঁজে পড়াশুনা করা ‘নার্ড’ বিশেষ। কিন্তু অল্প কিছু বাদে, ভাল ফলাফল করা ছাত্ররাও অন্যসব সাধারন ছাত্রের মতই জীবনযাপন করে। তারাও টিভি দেখে, খেলাধুলা করে। এমন অনেক টপার আছে যাদের ধ্যান জ্ঞান সব কম্পিউটার গেম কে ঘিরে।
তাহলে তাদের পড়াশুনার সিক্রেটা কি? – সিক্রেট একটাই। তারা ধারাবাহিকতার সূত্র মেনে পড়াশুনা করে। একবারে অনেকখানি পড়ার থেকে প্রতিদিন একটু একটু করে পড়া তৈরী করে রাখে। ক্লাসের পর সারাদিনে কিছুটা সময় তারা অন্যান্য কাজের পাশাপাশি নিয়ম করে পড়ার জন্য রাখে। এতে করে পরীক্ষার আগে তাদের কোনও বাড়তি চাপ নিতে হয় না।
কিছু ছাত্র আছে যারা কিনা পুরো টার্ম শুধু ক্লাসই করে যায়, কিন্তু এমনিতে পড়ার জন্য কোনও সময় বরাদ্দ রাখে না। বাড়িতে বাবা-মায়ের ভয়ে হয়তো টেবিলে বই নিয়ে বসে – কিন্তু সেই পড়ায় তাদের মনযোগ থাকে না। আর পরীক্ষা আসলে দেখা যায় নাকে মুখে পড়া গিলতে। কিন্তু টেনশন নিয়ে পড়ার কারনে পড়া তাদের মাথায় সেভাবে থাকে না। ওদিকে টপাররা, অর্থাৎ যারা ধীরে ধীরে প্রতিদিন কিছু কিছু করে পড়া নিজেদের মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েছে – তারা খুব সহজেই ভাল রেজাল্ট করে ফেলে।
ইংরেজীতে একটি কথা আছে “Consistency is Key” – অর্থাৎ, ”ধারাবাহিকতাই (সাফল্যের) চাবি”। একটি বিষয় যদি প্রতিদিন কিছু কিছু করে অনুশীলন করা যায়, তবে কিছুদিনের মধ্যেই সেই বিষয়ে যে কেউ মাস্টার হয়ে উঠতে পারে। সেরা ছাত্ররা এই সূত্রকেই কাজে লাগায়। অন্য সবকিছুর পাশাপাশি তারা প্রতিদিন একটু একটু করে হলেও প্রতিটি বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করে। পড়াশুনার ক্ষেত্রে সময়ের quantity থেকে সময়ের quality আর consistency অনেক বেশি জরুরী। পরীক্ষার আগের দশ দিনে ১০ ঘন্টা করে ১০০ ঘন্টা পড়ার থেকে পরীক্ষার আগের ৫০ দিনে ২ ঘন্টা করে পড়লে সেটা বেশি কাজে লাগে। তাই সিক্রেটটি হল ভাল ফলাফল করার জন্য সারাদিন বই নিয়ে পড়ে থাকার দরকার নেই, তাহলে অনেকের ক্ষেত্রেই হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শুধু প্রতিদিন নিয়ম করে একটু একটু করে বিষয়গুলোকে ঝালাই করলেই ভাল রেজাল্ট করা সম্ভব।
০৪. খোলা জানালা ও খোলা কান:
ক্লাসে শিক্ষক গূরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লেকচার দিচ্ছেন, আর ছাত্রের চোখ চলে গেছে খোলা জানালা দিয়ে সবুজ মাঠের দিকে। চোখ গেলে সমস্যা নেই, কিন্তু চোখের সাথে মনটাও চলে যায় আর সেইসাথে কানটা যায় বন্ধ হয়ে।
আমাদের কান আসলে শুধু শব্দ গ্রহণই করে। কিন্তু আমরা আসলে শুনি মন দিয়ে। মন দিয়ে যা না শোনা হয় তা বোঝা ও মনে রাখা একরকম অসম্ভবের পর্যায়েই পড়ে।
এরকম ছাত্র খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব যে কিনা ক্লাসের সেরা রেজাল্ট করা ছাত্রদের একজন, কিন্তু তার উপস্থিতি কম। সেরা ছাত্রদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট হল তারা ক্লাসে সবথেকে বেশি উপস্থিত থাকে আর সেইসাথে তারা ক্লাসে দারুন মনযোগীও থাকে। ক্লাসে যাদের মনযোগ আর উপস্থিতি কম থাকে তাদের নম্বরও রেজাল্ট কার্ডে কমই থাকে।
এখন আপনি হয়তো বলবেন, মনযোগ আর উপস্থিতির সাথে শোনার সম্পর্ক কি? প্রথম পয়েন্ট আর এই পয়েন্টের প্রথম প্যারাটি যদি আপনি মনযোগের সাথে পড়ে থাকেন তাহলে এই সম্পর্কটি বুঝতে আপনার তেমন কষ্ট হওয়ার কথা নয়। যেসব ছাত্র শেখার ও বোঝার আগ্রহে শিক্ষকের লেকচার মনযোগ দিয়ে শোনে তাহলে তাদের জন্য বিষয়টি বোঝা অনেক বেশি সহজ হয়ে যায়। ক্লাসে উপস্থিত থাকলে শিক্ষকের কথা শোনার সুযোগ বেড়ে যায়, আর মনযোগী থাকলে কথা কানে ঢোকার সাথে সাথে মাথায়ও ঢোকে।
পড়ে মুখস্থ করা স্মৃতি থেকে আমাদের দেখা ও শোনা স্মৃতি অনেক বেশি মনে থাকে। তাই অনেক সময়ে বইয়ের পড়া ভুলে গেলেও পরীক্ষার সময়ে শিক্ষকের লেকচারের দৃশ্য মনের পর্দায় ভেসে উঠলে অনেক কিছু মনে পড়ে যায়।
আর একটি ব্যাপার, লেকচার দেয়ার সময়ে প্রতিটি শিক্ষই সেই টপিকের ব্যাপারে তার নিজস্ব কিছু দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ করেন। ক্লাসের সেরা ছাত্রদের নোটগুলো এজন্যই অন্য সবার থেকে ভাল হয় কারন তারা কোনও বিষয়ে নিজের ধারনার সাথে সাথে শিক্ষকের নিজের ধারনাও কাজে লাগায়।
একজন ছাত্র যদি মনযোগের সাথে শিক্ষকের লেকচার শোনে তাহলে কোনও বিষয় বুঝতে না পারলে সে শিক্ষককে প্রশ্ন করে বিষয়টি ভালভাবে জেনে নিতে পারে। এতেকরে তার পড়া অনেকখানি এগিয়ে যায়, যার প্রতিফলন দেখা যায় রেজাল্ট কার্ডে।
শিক্ষক লেকচার দেয়ার সময়ে সহপাঠীর সাথে গল্প করার তো একটা দারুন মজা আছেই। কিন্তু শিক্ষকের মথা মনযোগের সাথে শুনে যখন আপনার হাতে একটি দারুন রেজাল্ট কার্ড আসবে, তখন সেই মজা গল্পের মজার থেকেও বেশি হবে।
৫. কপি রহস্য:
ধরুন সুমনের সব থেকে ভাল বন্ধু রিয়াদ। রিয়াদ একজন, যাকে বলে ‘তুখোড়’ ছাত্র। সুমন অবশ্য এতটা ভাল ছাত্র নয়। রিয়াদের রোল যদি এক থেকে তিন এর ভেতর ওঠানামা করে, সুমনের রোল নম্বর ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের ভেতরে ঘোরাফেরা করে।
এই নিয়ে সুমনের যন্ত্রণার শেষ নেই। সে তার বন্ধুকে হিংসা না করলেও, তার বাবা-মা’র আচরনে মনে হয় তারা সেটাই করেন। দিন রাত “রিয়াদ এই করে, রিয়াদ সেই করে- তুই ওর মত করতে পারিস না?” – এই এক ভাঙা রেকর্ড সুমনের কানের কাছে বাজতেই থাকে।
মজার ব্যাপার হল সুমন কিন্তু পড়াশুনার ক্ষেত্রে রিয়াদকে অন্ধের মত ফলো করে। রিয়াদ রাত জেগে পড়ে বলে সুমনও তাই করে। রিয়াদ যতক্ষণ বাইরে খেলে, সুমনও তাই করে। রিয়াদ যখন পড়তে বসে, সুমনও কাঁটায় কাঁটায় তখই পড়তে বসে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। তাহলে কি সুমনের থেকে রিয়াদের মেধা বেশি?
ব্যাপার কিন্তু মেধার নয়। ব্যাপার হচ্ছে এক একজন মানুষের পড়তে বসার ও পড়া মাথায় ঢোকার সময় ও পরিস্থিতি একই রকম। অনেক ভাল ছাত্রই বলে যে তার বন্ধুরা তাকে হুবহু কপি করতে গিয়ে ভালর থেকে নিজের ক্ষতিই বেশি করেছে।
আসলে পড়াশুনা বা অন্য যে কোনও ক্ষেত্রে অন্যের কাছ থেকে আপনি আইডিয়া আর টিপস নিতে পারেন কিন্তু সেগুলো কাজে লাগানোর জন্য অবশ্যই আপনার নিজস্ব কিছু পদ্ধতি বের করতে হবে। আপনাকে বুঝতে হবে আপনার জন্য রাতে পড়া ভাল, নাকি ভোরে উঠে পড়া ভাল। আপনার মনযোগ কোন সময়ে সবথেকে বেশি কাজ করে সেটা আপনাকেই খুঁজে বের করতে হবে।
কারও কারও সন্ধ্যায় পড়লে বেশি ভাল হয়, কারও বা রাতে, কারও বা ভোরে। এটা এক একজন মানুষের শারীরীক ও মানসিক গড়নের ওপর নির্ভর করে।
কারও পড়া তিন ঘন্টায় শেষ হয়ে যায়, কারও সাড়ে তিন ঘন্টা লাগে। আপনি যদি আপনার বন্ধুর দেখাদেখি তিন ঘন্টা ধরেই পড়েন, অথচ আপনার লাগবে সাড়ে তিন ঘন্টা – তাহলে কিন্তু আপনার পড়ায় ঘাটতি থেকেই যাবে। যার ফলে নম্বরেও আপনি তার থেকে পিছিয়ে থাকবেন।
পড়তে সময় বেশি-কম লাগলেই যে একজনের মেধা কম আর আরেকজনের বেশি – তা নয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে সৃষ্টিশীল মানুষেরা সাধারন মানুষের থেকে একটু কম স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন হয়, কারন তাদের মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আইডিয়া বানাতে ব্যস্ত থাকে।
তবে এসব কথায় আমরা এখন যাচ্ছি না, এসব কথা পরে হবে। আজকের বিষয় যেহেতু কিভাবে ভাল নম্বর পাওয়া যায় – সেহেতু আমরা সেদিকেই নজর দেব।
ভাল নম্বর পেতে গেলে কিছু কিছু জিনিস আপনাকে মুখস্থ করতেই হবে। কিছু কিছু জিনিস সঠিক সময়ে মনে করতেই হবে। আর এই মনে রাখার জন্য সবারই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন ভিন্ন টাইম লিমিট ধরে চর্চা করতে হয়। কাজেই অন্যকে কপি না করে আপনার উচিৎ হবে আপনার জন্য যেটা লাগসই, সেভাবেই পড়ার রুটিন করা। আপনার আশপাশের সব ভাল ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন, বেশিরভাগই বলবে তারা তাদের নিজের মত করেই পড়ার রুটিন ও অভ্যাস বানিয়ে নিয়েছে। সবার শেখার প্রক্রিয়া এক নয়, তাই সবাইকেই নিজের Learning Pattern বুঝতে হবে। অনেক্ষণ ধরে পড়ার থেকে জরুরী কতক্ষণ ধরে পড়লে এবং কিভাবে পড়লে আপনার জন্য সবথেকে ভাল হবে – তা বোঝা। এই ‘কপি রহস্য’ এর মানে হচ্ছে কপি করারই কোনও প্রয়োজন নেই।
৬. প্ল্যান:
যে কোনও টপারের সাফল্যের পেছনে এই প্ল্যানিং অর্থাৎ পরিকল্পনার একটি বিরাট অবদান সব সময়েই থাকে।
ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে – “If you failing to plan, you are planning to fail.” অর্থাৎ পরিকল্পনা করতে ব্যর্থ হওয়া মানে ব্যর্থ হওয়ার পরিকল্পনা করা। জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই বাক্যটি সত্য। আর পড়াশুনার ক্ষেত্রে তো তা আরও সত্য।
কেউ ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে নাস্তা করেই পরীক্ষার হলে গিয়ে ভাল করে না। এই প্রক্রিয়াটি আসলে বহুদিনের করা পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন।
সত্যি বলতে, সব সফলতার পেছনেই থাকে একটি নিখুঁত পরিকল্পনা। সেরা ছাত্ররা পরীক্ষার অনেক আগে থেকেই কোন কোন বিষয় কতটা কিভাবে পড়বে – তা যথাযথ ভাবে প্ল্যান করে নেয়। সেই প্ল্যান ধরে এগিয়েই তারা পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে।
এমনটা সব সময়েই হবে যে আপনার পরিকল্পনামত সবকিছু হবে না। প্রায়ই আপনার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে বিভিন্ন রকমের বাধা আসবে। কিন্তু আপনার হাতে একটি পরিকল্পনা থাকলে, সেটাকে পরিবর্তনও করতে পারবেন। আর যদি কোনও পরিকল্পনাই না থাকে – তাহলে আপনি কিছুই করতে পারবেন না।
কাজেই আপনার সিলেবাস ও সময় হিসেব করে একটি সুন্দর পরিকল্পনা করুন, আর তা ধরে পড়াশুনা করতে থাকুন। এর মাঝে এমন কিছু যদি হয়েই যায় যা আপনি কোনওভাবেই এড়াতে পারছেন না। পরিকল্পনায় একটু পরিবর্তন এনে সেই গ্যাপ পূরণ করে নিন। কিন্তু একদমই কোনও পরিকল্পনা না থাকলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূণ্যের কোঠায় নেমে আসবে – এটাই স্বাভাবিক। হাতে একটি ম্যাপ থাকলে যে কোনও স্থানে খুব সহজেই পৌঁছানো যায়।
০৭. ইচ্ছা ও প্রয়োজন:
ছাত্র হয় ৩ ধরনের। যারা কোনওরকমে পড়ালেখা শেষ করতে পারলেই বাঁচে, যারা ভাল ফলাফল করার ইচ্ছা রাখে, যারা ভাল ফলাফল করে।
শেষ দুই ধরনের ছাত্রের মাঝে একটি সূক্ষ্ন পার্থক্য আছে। যারা ভাল ফলাফল করার ইচ্ছা রাখে তারা কিন্তু সব সময়ে ভাল ফলাফল করতে পারে না। ভাল ফলাফল তারাই করে যারা ইচ্ছার সাথে সাথে সেটিকে নিজেদের প্রয়োজন বানিয়ে ফেলে।
চাইলে আপনি আরও একবার ২ নম্বর পয়েন্টটি দেখে নিতে পারেন। সেখানে বলা হয়েছে যে টপাররা সব সময়ে একটি লক্ষ্য ঠিক করে পড়াশুনা করে। এই লক্ষ্য নির্ধারনের ফলে ভাল ফলাফল করাটা শুধুমাত্র তাদের ইচ্ছা নয় – প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। এই বিষয়টিই তাদের লক্ষ্যে স্থির রাখে।
ইচ্ছা আর প্রয়োজনের মাঝে পার্থক্যটি বুঝতে একটি উদাহরন দেয়া যাক:
ধরুন আপনার কাছ থেকে আপনার পরিচিত একজন মানুষ কিছু টাকা নিল। নেয়ার সময় কথা দিল সে সেটা এক সপ্তাহের মধ্যে ফেরত দিয়ে দেবে। কিন্তু প্রায় এক মাস হয়ে গেলেও আপনাকে সে টাকা দিল না। আর এই মূহুর্তে টাকাটি আপনার ভীষণ প্রয়োজন। তাকে ফোন দিলে সে ফোন ধরছে না। এখন আপনি কি করবেন? – অবশ্যই তার বাসায় গিয়ে তাকে ধরবেন। যে কোনও ভাবে টাকাটি ওঠাবেন। আপনি এটা কেন করবেন? – কারন টাকাটি আপনার প্রয়োজন। টাকাটি উদ্ধার করা আপনার শুধুমাত্র একটি ইচ্ছা নয়, টাকাটি উদ্ধার করা আপনার প্রয়োজন।
ইচ্ছার একটি বড় সমস্যা হল, ইচ্ছা পূরণের জন্য মানুষ বেশিরভাগ সময়েই ভাগ্যের অপেক্ষায় বসে থাকে। কিন্তু যখন সেটি প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায় তখন সে তা পূরণের জন্য পদক্ষেপ নেয়, কাজ করে। আর টপারদের ভাল ফলাফল করাটা শুধুমাত্র তাদের ইচ্ছা নয়, এটাকে তারা প্রয়োজন বানিয়ে ফেলে আর সেই কারনেই তার জন্য তারা পরিকল্পনা করে আর তা বাস্তবায়নের জন্য পরিশ্রম করে।
রেজাল্ট হাতে পাওয়ার পর অনেক ছাত্রকেই বলতে শোনা যায় এবার যা হওয়ার হয়েছে, পরেরবার ভাল করার চেষ্টা করব। কিন্তু একজন টপারের মাথায় থাকে তাকে যেভাবেই হোক ভাল ফলাফল করতেই হবে। যদি তা না হয় তাহলে সে লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাবে।
৮. গোঁজামিলের ফাঁদ:
কখনও কি ভেবে দেখেছেন যে বেশিরভাগ ভাল বিতার্কিক কেন পড়াশুনায় ভাল হয়? কারন তারা শুধু পড়াশুনা করে – তাই না, তারা যে কোনও বিষয়কে ভালকরে বুঝতে চায়। কাজেই সব বিষয়ের প্রতিটি দিকই তাদের মাথায় থাকে।
তারা যেটাই পড়ুক না কেন, কখনওই গোঁজামিল দিয়ে তালি মারার চেষ্টা করে না। কম নম্বর পাওয়া ছাত্রদের নম্বর কম হওয়ার একটি প্রধান কারন তারা প্রায় সবকিছুই গোঁজামিল দিয়ে কোনওরকমে মাথায় নিতে পারলেই খুশি।
যে কোনও বিষয় ভালভাবে বুঝতে হলে তার গভীরে ঢুকতে হয়। আর কোনও বিষয় ভালভাবে নিজে না বুঝলে অন্যকেও বোঝানো যায় না। পরীক্ষককেও না।
আরও একটি বড় বিষয় যে টপিক আপনি গোঁজামিল দিয়ে কোনওরকমে মুখস্থ করেছেন, পরীক্ষা শেষ হলে সেটা মনে করার চেষ্টা করে দেখবেন – কিছুতেই ভালভাবে মনে আসছে না। এমনকি ইতিহাসের মত বিষয়েও চিন্তার ও বোঝার বিষয় আছে। শুধু সাল-তারিখ মুখস্থ করার জায়গায় বিষয়টি যদি আপনি সময় নিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন তাহলে আপনার মনে বিষয়টি খুব ভালভাবে গেঁথে যাবে নি:সন্দেহে। আর এর ফলাফল পরীক্ষার খাতাতেও আপনি ভালভাবে পাবেন। আপনার সামনে যদি বিসিএস পরীক্ষা থাকে, তাহলে সাধারন জ্ঞানের প্রতিটি বিষয় নিয়ে আর একটু বিস্তারিত ঘাঁটাঘাঁটি করুন না। দেখবেন গোঁজামিল দিয়ে মুখস্থ করার থেকে তা অনেক বেশি মনে থাকবে। স্ট্যাচু অব লিবার্টি কত সালে স্থাপিত হয়েছে, এটুকু মনে রাখার পাশাপাশি যদি আপনি নেটে একটু সার্চ দিয়ে এর পুরো ইতিহাসে একবার চোখ বুলিয়ে নেন তাহলে পুরো বিষয়টির একটি ছবি আপনার মনে গেঁথে যাবে। এতেকরে মনে রাখা সহজ হওয়ার পাশাপাশি আরও কয়েকটি জিনিস আপনার জানা হয়ে যাবে। হয়তোবা এগুলো পরীক্ষার প্রশ্নেও এসে যেতে পারে।
একটি মজার ব্যাপার হচ্ছে টপাররাও কিন্তু সব বিষয়ে ভাল হয় না। তাদেরও কিছু কিছু বিষয়ে দুর্বলতা থাকে। এগুলো তারা কাটিয়ে ওঠে বিষয়গুলো নিয়ে আরেকটু গভীর চিন্তা আর গবেষণা করে। আপনার প্রিয় বিষয়ে হয়তো আপনি অনেক সময় দিচ্ছেন কিন্তু দেখা যাচ্ছে দুর্বল বা কিছুটা অপছন্দের বিষয়গুলোকে গোঁজামিল দিয়ে পাশ করবেন – এই মনে করে ফেলে রাখছেন। এটা করলে আপনি কখনওই টপার হতে পারবেন না।
আপনার হয়তো কাঁচা ছোলা খেতে ভাল লাগে, কিন্তু ব্যায়াম করতে ভাল লাগে না। কিন্তু আপনি যদি বডি বিল্ডার হতে চান তবে আপনাকে ছোলাও খেতে হবে, ব্যায়ামও করতে হবে।
কাজেই গোঁজামিলের ফাঁদে না পড়ে, সেরা ছাত্রদের মত প্রতিটি বিষয় নিয়ে একটু বিস্তারিত চিন্তা ও রিসার্চ করুন। জ্ঞান কখনও বৃথা যায় না।
৯. স্বস্তির গূরুত্ব বোঝা:
আপনাকে এখন যে সিক্রেটটা বলব, তা শুধু সফল ছাত্রছাত্রীদের নয়, প্রতিটি সফল মানুষেরই সাফল্যের সিক্রেট।
আপনি যদি সারাটা দিন চাপের মাঝে কাটান তাহলে কিন্তু হিতে বিপরীত হওয়ার একটা ভাল সম্ভাবনা থাকে। সারাদিনই যদি আপনি কাজের মাঝে থাকেন তাহলে সেটা আপনার শরীর ও মনের জন্য ক্ষতিকর।
যারা ভাবেন টপার ছাত্ররা সারাটা দিনই কোনও বিশ্রাম ও বিনোদন ছাড়া পড়াশুনা করে কাটায় – তারা আসলে ভুল বলেন। টপারটাও দিনে অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য রিল্যাক্স করেন।
আরও জরুরী বিষয়, টপাররা পরীক্ষার আগ দিয়ে বেশি relaxed থাকেন। কারন পরীক্ষার আগে যদি মন স্বস্তিতে না থাকে তবে পরীক্ষার সময়ে আপনি আপনার সেরাটা দিতে পারবেন না।
কিন্তু পরীক্ষার আগে তো টেনশন হবেই। টপাররা তাহলে কিভাবে স্বস্তিতে থাকে?
টপাররা শুধু পরীক্ষার আগেই স্বস্তিতে থাকে না। তারা সব সময়েই স্বস্তিতে থাকে। এর গোপন রহস্য খুবই সাধারন। তারা সময়ের পড়াটা সময়ে করে রাখে। দিনের পড়া দিনে করে রাখে। পড়ার যে প্ল্যান তারা করে রেখেছে, যে কোনও ভাবেই সেই পথে তারা চলে।
মন অস্বস্তিতে থাকলে আপনি পাশ হয়তো করতে পারবেন কিন্তু টপার হতে পারবেন না। অনেক সময়ে দেখা যায় টেনশনের কারনে পরীক্ষার হলে জানা জিনিসও মনে পড়ে না। কিন্তু আপনার যদি সেটা বারবার প্রাকটিস করা থাকে, তাহলে একটা বিশ্বাস থাকে যে আপনি সেটা পারবেন।
আর শুধু পরীক্ষার আগে নয়, টপাররা প্রতিদিনই নিজেদের মনের ও শরীরের স্বস্তি নিশ্চিত করে। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তারা আধাঘন্টার মত একটি ব্রেক নিয়ে আবার পড়তে বসে। জোর করে পড়লে সেটা কখনওই ভালভাবে মনে থাকে না। পরীক্ষার আগ দিয়ে বা সাধারন সময়ে – দুই ক্ষেত্রেই এই একই কথা খাটে।
পরিশিষ্ট:
এমন কথা কোথাও লেখা নেই যে জীবনে সফল হতে গেলে পড়াশুনায় টপার হতেই হবে। অনেক টপারই তাদের অনেক নিচের ছাত্রদের অধীনে কাজ করে। কিন্তু যাদের লক্ষ্যই টপার হওয়া, তারা যদি এই সিক্রেটগুলোর সবগুলো না হলেও, কিছু কিছু কাজে লাগায় – তাহলেই তারা পড়াশুনায় অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে।
আশা করি আপনিও ভালো ফলাফল করার এই টেকনিক গুলো ঠিকমত বুঝতে ও কাজে লাগাতে পারবেন। এই বিষয়ে আপনার যদি কোনও প্রশ্ন বা মতামত থাকে, অবশ্যই তা আমাদের কমেন্ট করে জানান। যদি মনেহয় লেখাটি অন্যদেরও কাজে লাগবে, তবে আপনার সোশ্যাল মিডিয়া পেজ বা প্রোফাইলে শেয়ার করুন। সাফল্যের পথে প্রতিটি পদক্ষেপে লড়াকু আপনার সাথে আছে।