ইংরেজিতে একটি জনপ্রিয় প্রবাদ আছে “Morning Shows the Day” – অর্থাৎ সকালই বলে দেয় সারাদিন কেমন যাবে। একটি সুন্দর কার্যকর দিন কাটানোর জন্য সকালটা যথার্থ হওয়া জরুরী।
আপনার সকাল যদি শুরু হয় ইতিবাচক মনোভাব ও কাজের মধ্যদিয়ে, তবে আপনার দিনটিও তেমন হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়।
যদিও ইতিবাচক ও কার্যকর একটি দিনের শুরু কিভাবে করতে হয়, তার কোনও ধরাবাঁধা নিয়ম নেই, তবে কিছু কিছু কাজ যেমন, ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা, একটু প্রার্থনা বা মেডিটেশন করা, শরীরচর্চা করা – ইত্যাদি ব্যাপার সর্বজনবিদিত।
পৃথিবীর বেশিরভাগ সফল ব্যক্তিদের, বিশেষ করে সফল উদ্যোক্তাদের নির্দিষ্ট সকালের রুটিন রয়েছে। খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা, দৌড়ানো বা মেডিটেশন করা, অথবা এগুলোর বাইরে বেশ কিছু কাজ করে তাঁদের সকাল শুরু হয়।
চলুন জেনে নেয়া যাক বিশ্বসেরা ৯ সফল উদ্যোক্তার এমনই ৯টি সকালের রুটিন যা আপনারও কাজে লাগতে পারে:
০১. রিচার্ড ব্র্যানসন:
ভার্জিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও রিচার্ড ব্র্যানসনের সকালের রুটিন শুরু হয় খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে। ভোর ৫টার মধ্যে তিনি বিছানা ছাড়েন। ২০১৪ সালের এক ব্লগে তিনি লিখেছিলেন: “ভোরে ওঠার কারণে আমি প্রতিদিন শরীরচর্চা করার সময় পাই। সেই সাথে সময় পাই আমার পরিবারের সাথে কিছু ভালো সময় কাটানোর। এটা আমাকে দিনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে একটি দারুন মনোভাব এনে দেয়”।
০২. জ্যাক ডোরসি:
টুইটার সিইও জ্যাক ডোরসি ভোর ৫টায় উঠে প্রথম যে কাজটি করেন, তা হল ৩০ মিনিট ধ্যান করা।ধ্যান শেষে তিনি কিছুক্ষণ শরীরচর্চা করে তারপর খানিকটা কফি পান করেন।
মেডিটেশনের ফলে তিনি দিনের শুরুতেই নিজের চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নেয়ার পাশাপাশি নিজের মাঝে একটি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে আসতে পারেন। এরপর শরীরচর্চার মাধ্যমে শরীরের সুস্থতা ধরে রাখার পাশাপাশি শরীরের ফিটনেস বাড়িয়ে নেন। আর কফি পান করে পুরোপুরি চাঙ্গা হয়ে দিন শুরু করেন।
০৩. আরিয়ানা হাফিংটন:
আপনি যদি ইন্টারনেটের দুনিয়ার নিয়মিত বাসিন্দা হন তাহলে হাফিংটন পোস্ট এর সাথে অবশ্যই পরিচয় থাকার কথা। পৃথিবীর অন্যতম সেরা এই ম্যাগাজিনের সিইও আরিয়ানা হাফিংটন সকালে ওঠার আগে যথেষ্ঠ পরিমান ঘুমানোর পক্ষে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন :
“রাতে পূর্ণ ও ভালো ঘুম ছাড়া আমি বাঁচতে পারতাম না। কারণ পূর্ণ ঘুম ছাড়া দীর্ঘ সময় কাটানোর চরম মূল্য আমি দিয়ে এসেছি”।
কখন তিনি ঘুম থেকে উঠবেন, সেটা নির্ভর করে তাঁর শিডিউলের ওপর। শিডিউল যা-ই হোক না কেন, তিনি প্রতি রাতেই পূর্ণ একটি ঘুম দেন। এতে পরের দিন অনেক চাঙ্গা হয়ে কাজ করতে পারেন।
তবে প্রতি সকালেই ৩০ মিনিট শরীরচর্চা ও ৩০ মিনিট ধ্যান করেন।
০৪. স্টিভ জবস:
প্রয়াত এ্যাপল সিইও এবং প্রযুক্তি দুনিয়ার প্রবাদ পুরুষ স্টিভ জবস ২০০৫ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন বক্তৃতায় বলেছিলেন:
“প্রতি সকালে উঠে আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, ‘আজকের দিনটি যদি আমার জীবনের শেষ দিন হত, তবে আজ যা করতে যাচ্ছি তা কি আমি সত্যিই করতাম?”
যদি পর পর কয়েকদিন এই প্রশ্নের উত্তর “না” হত, তবে তিনি বুঝতেন যে তাঁকে কিছু জিনিস পরিবর্তন করতে হবে।
আসলে সময় ও কাজের ফলাফলই জীবন। আর জীবনে আমাদের সেইসব কাজই করা উচিৎ, যা আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন যদি একজন মানুষ নিজেকে এই প্রশ্নটি করে, তবে সে তার জীবন থেকে আসলেই কি চায়, তা তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা ও সেই লক্ষ্য পূরণে কাজ করা সহজ হয়ে যাবে। কাজেই আপনার সকালের রুটিনে এই ভাবনাটি রাখতে পারেন।
০৫. ইলন মাস্ক:
তাঁর সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক জগতের সুপারস্টার ইলন মাস্ক একজন জিনিয়াস বিলিওনেয়ার। কাল্পনিক সুপার হিরো আয়রন ম্যানের চেয়ে তিনি কোনও অংশে কম নন।
সাধারন মানুষের চেয়ে বেশি কাজ করতে পারার একটি সুখ্যাতি আছে তাঁর। সাধারন মানুষ যেখানে সপ্তাহে ৪৮-৫০ ঘন্টা কাজ করে, মাস্ক সেখানে ৮০ থেকে ১০০ ঘন্টা পর্যন্ত নিয়মিত কাজ করতে পারেন!
তিনি সকাল ৭টার মধ্যে নিয়মিত ঘুম থেকে ওঠেন এবং খানিকটা সময় প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করে কাটান। এতে তাঁর মন চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ডিম ও কফি দিয়ে নাস্তা সেরে সকাল ১০টার আগে অফিসে চলে যান। সেখানে তিনি প্রথমেই ছোটখাট কাজগুলো সারেন। সাংবাদিক ও চাকরি প্রার্থীদের ফোন করা এবং কনফারেন্স কল এ যোগ দেয়ার মাধ্যমে তাঁর দাপ্তরিক কাজ শুরু হয়।
০৬. জেফ বিজোস:
বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি তিনি। আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বিজোস পরিবারের সবার সাথে সকালের নাস্তা করার চেষ্টা করেন। তিনি খুব সকালে কোনও মিটিং বা অফিসিয়াল কাজ রাখেন না। তিনি চান সকালটা যেন পরিবারের সাথে সুন্দর কিছু মূহুর্ত নিয়ে কাটে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন:
“আমি যদি অফিসে ভালো সময় কাটাই, তবে একজন ভালো স্বামী, ভালো বাবা হিসেবে ঘরে ফিরি। আবার যখন ঘর থেকে ভালো মন নিয়ে অফিসে যাই, তখন আমি একজন ভালো বস, একজন ভালো সহকর্মী হয়ে উঠি”
একটি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে দিন শুরু করতে পারলে, সারাটা দিনই তার প্রভাব একজন মানুষের ওপর থেকে যায়। যে কোনও কাজই সাধারন অবস্থার চেয়ে ভালো হতে বাধ্য। একারণেই জেফ দিনের শুরুটা করেন সুন্দর কিছু মূহুর্ত নিয়ে।
০৭. কেনেথ চেনাল্ট:
আমেরিকান এক্সপ্রেসের সিইও প্রতি রাতে অফিস থেকে বের হওয়ার আগে একটি কাগজে পরের দিনের প্রধান ৩টি করনীয় একটি কাগজে লিখে রাখেন। পরদিন সকালে উঠে সেই কাগজে আরও একবার চোখ বুলিয়ে তিনি দিনের কাজ শুরু করেন। এতে করে সারাদিন তাঁর প্রধান কাজগুলো সব সময়ে তাঁর মাথায় থাকে।
০৮. মার্ক জুকারবার্গ:
নি:সন্দেহে তিনি এ পর্যন্ত এই শতকের সবচেয়ে সফল উদ্যোক্তা। মার্ক জুকারবার্গ পুরো পৃথিবীর চিত্রই বদলে দিয়েছেন তাঁর ফেসবুক দিয়ে।
এতবড় একটি প্রতিষ্ঠান চালানোর ভার যে মানুষটির ওপর, তিনি চেষ্টা করেন ছোটখাট অদরকারী বিষয় নিয়ে যতটা সম্ভব কম চিন্তা করতে। আমাদের ছোটখাট সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়াও আমাদের মস্তিষ্ককে যথেষ্ঠ দুর্বল করে, যার ফলে বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ে আমরা আমাদের মস্তিষ্ককে পুরো মাত্রায় এ্যাকটিভ পাই না।
মার্ক অন্যদের মত সকালে উঠে অফিস যাওয়ার আগে কি পোশাক পরবেন, চুলের স্টাইল কেমন হবে – এসব নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামান না। কারণ, এরচেয়ে জরুরী কাজ তাঁর সামনে থাকে, এবং তিনি তাঁর মস্তিষ্ককে পুরোপুরি এ্যাকটিভ চান। তাঁর একই রঙের অনেকগুলো জামা আছে, যাতে সকালবেলা কি পোশাক পরবে তা নির্বাচন করতে তাকে খুব একটা চিন্তা করতে না হয়।
০৯. বিল গেটস:
মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস প্রতিদিন সকালে তাঁর শরীরের সাথে মনকেও ঝালিয়ে নেয়ার পক্ষে। সকালে উঠে শরীরচর্চার পাশাপাশি তিনি ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল, ইকোনোমিস্ট – ইত্যাদি ব্যবসায়িক ম্যাগাজিন ও পেপার পড়েন। যাতে ব্যবসায়িক জগতের একদম আপডেট তথ্য তাঁর কাছে থাকে।
পরিশিষ্ট:
দিনের শুরুতেই কাজের জন্য একটি যথার্থ মনোভাব সৃষ্টি করাটা খুবই জরুরী। সেইসাথে শরীরও যাতে চাঙ্গা থাকে, সেইদিকেও খেয়াল রাখতে হয়। সফল ব্যক্তিরা নিজের মত করে এই কাজটি করেন। তবে বেশিরভাগই মনকে একটি ইতিবাচক প্রভাবের মধ্যে নিয়ে আসেন, এবং সকাল সকাল জাগেন।
সকালবেলাটি একটি ইতিবাচক অবস্থায় শুরু করতে পারলে, আপনি সারাদিনের জন্যই ইতিবাচক, চাঙ্গা ও আত্মবিশ্বাসী থাকবেন। জীবন তো আসলে দিনেরই যোগফল, যার শুরু হয় সকাল দিয়ে। আপনি যদি প্রতিটি দিনই সেরা অবস্থায় থেকে আপনার সেরাটা দিতে পারেন, আপনার সফল হওয়াটা শুধুই সময়েরর ব্যাপার।
এখানে যে ৯জন উদ্যোক্তার সকালের রুটিনের কথা বলা হয়েছে, তার কোনগুলো আপনার সাথে সবচেয়ে ভালো যায়, এটা বুঝে নিজের মত করে একটি সকালের রুটিন তৈরী করে নিতে পারেন। আর তা করার ক্ষেত্রে এই লেখাটি যদি সামান্য হলেও আপনার কাজে আসে, তাহলেই আমাদের চেষ্টা সার্থক হবে।
লেখাটি কেমন, লাগলো তা আমাদের কমেন্ট করে জানান। যদি মনে হয় এই লেখা থেকে অন্যরাও উপকৃত হবেন, তাহলে শেয়ার করার মাধ্যমে তাদের দেখার সুযোগ করে দিন। আমাদের সাথে থাকুন। সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার সাথে আছে।