স্টিভ জবস ; নামটি প্রযুক্তির জগতে সবচেয়ে বিখ্যাত নামের একটি। কম্পিউটার ও প্রযুক্তিকে বর্তমান অবস্থানে নিয়ে আসার পেছনে যাঁদের অবদান সবচেয়ে বেশি, তাদের মাঝে স্টিভ জবস প্রধান এক চরিত্র। এ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমরা সবাই তাকে চিনি। প্রযুক্তিতে তাঁর অবদান কারওই অজানা নয়। কিন্তু ব্যক্তি স্টিভ জবসকে আমরা কয়জন জানি? মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন তিনি? ছেলে হিসেবে, প্রেমিক হিসেবে, বাবা হিসেবে, ব্যবসার পার্টনার বা বন্ধু হিসেবে কেমন ছিলেন? – প্রযুক্তির গল্পের পাশাপাশি এই লেখায় এসব বিষয়ও বিস্তারিত থাকছে।
প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। আমরা সকলেই কম বেশি তাঁর অবদানের কথা জানি। তিনি তাঁর কাজ দিয়ে এক নতুন বিশ্ব সৃষ্টি করে গেছেন। তাঁর জীবন ছিল পৃথিবীকে বদলে দেয়ার এক বৈপ্লবিক যাত্রা। যে যাত্রার শুরু হয়েছিল তাঁর জন্মের সময় থেকেই।
কিন্তু এই মহান মানুষটির অবদান বিষয়ে আমরা যতটা জানি, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কি ততটা আমাদের জানা আছে?
পৃথিবীর চেহারা পাল্টে দেয়ার যাত্রায় তাঁকে কোন ধরনের ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে? কি ধরনের বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে? তাঁর পারিবারিক জীবনই বা কেমন ছিল? স্কুলে কেমন ছাত্র ছিলেন তিনি? বাবা-মায়ের সাথেই বা কেমন সম্পর্ক ছিল তাঁর? তিনি নিজেই বা কেমন বাবা ছিলেন? এ্যাপল ছাড়াও পৃথিবীর অন্যতম বড় একটি কোম্পানীর সিংহভাগ শেয়ারের মালিক ছিলেন তিনি – আপনি কি জানেন সেটি কোন কোম্পানী? মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ কথা কি ছিল?
জবসের জীবন আসলে অনেকটাই সিনেমার গল্পের মত। এবং তাঁকে নিয়ে একাধিক সিনেমা তৈরীও হয়েছে। লেখা হয়েছে বেশ কয়েকটি বই। তবে তাঁর জীবন সম্পর্কে জানতে এই মূহুর্তে দীর্ঘ কয়েকটি সিনেমা ও মোটা মোটা বই না পড়লেও চলবে। এই প্রবন্ধ থেকেই আপনি জানবেন স্টিভ জবসের জীবনের জানা-অজানা ঘটনাবলী।
এক নজরে স্টিভ জবস
স্টিভেন ‘পল’ জবস ছিলেন একজন আমেরিকান উদ্ভাবক, ডিজাইনার; এবং এ্যাপল কম্পিউটারের সহ উদ্যোক্তা, সিইও ও চেয়ারম্যান। এ্যাপল এর বিশ্বখ্যাত পন্য আইপড, আইপ্যাড, আইফোন, আইম্যাককে ধরা হয় বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির শুরুর ধাপ হিসেবে। এর সবগুলোর পেছনেই ছিল তাঁর সরাসরি অবদান।
জবসের জন্ম হয় ১৯৫৫ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারী ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন এর দুইজন গ্রাজুয়েটের সন্তান হিসেবে, যাঁরা জন্মের পরই তাঁদের ছেলেকে এ্যাডাপশন বা দত্তক এর জন্য দিয়ে দেন।
ছোটবেলা থেকেই জবস ছিলেন প্রখর বুদ্ধিমান কিন্তু লক্ষ্যহীন। কলেজ থেকে ড্রপ আউট হয়ে ১৯৭৬ সালে স্টিভ ওজনিয়াকের সাথে এ্যাপল শুরু করার আগ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্ট নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা চালান।
১৯৮৫ সালে তিনি এ্যাপল থেকে বের হয়ে পিক্সার এ্যানিমেশন স্টুডিও শুরু করেন এবং দশ বছর পর আবার সিইও হিসেবে এ্যপলে ফিরে আসেন। ২০১১ সালে অগ্নাশয়ের ক্যান্সারের সাথে দীর্ঘ লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে জবস মৃত্যুবরণ করেন।
মোট সম্পদ
২০১১ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী জবসের আনুমানিক সম্পদের পরিমান ছিল প্রায় এক হাজার দুইশ কোটি মার্কিন ডলার। এই সম্পদের বেশিরভাগই এসেছিল ২০০৬ সালে ওয়াল্ট ডিজনির কাছে পিক্সার স্টুডিও বিক্রয়ের থেকে। কিন্তু ধারণা করা হয়, জবস যদি ১৯৮৫ সালে এ্যাপল ছাড়ার সময়ে তাঁর এ্যাপলের সব শেয়ার বিক্রী না করতেন, তবে তাঁর মোট সম্পদের পরিমান দাঁড়াতো তিন হাজার ছয়শ কোটি মার্কিন ডলারের কাছাকাছি।
স্টিভ জবসকে নিয়ে প্রকাশনা ও সিনেমা
এই টেক আইকনের জীবন কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বেশ কয়েকটি সিনেমা তৈরী হয়েছে। যার মধ্যে ২০১৩ সালে নির্মিত ও অতি সমালোচিত ‘জবস’, এবং ২০১৫ সালে নির্মিত ও ড্যানি বোয়েল পরিচালিত ’স্টিভ জবস’ অন্যতম।
জবস কে নিয়ে বেশ কিছু বইও লেখা হয়েছে। যার মধ্যে ওয়ালটার আইজ্যাকসনের লেখা ২০১১ সালে প্রকাশিত স্টিভ জবসের নিজের অনুমোদিত জীবনী। বইটি এ্যাপলের সিইও হিসেবে জবসের উত্তরসূরী টিম কুক এর প্রতারণার কথা তুলে আনার জন্য আলোচিত হয়। ২০১২ সালে ক্যারেন ব্লুমিনটাল কিশোর-তরুণদের জন্য জবসের আরও একটি জীবনী লেখেন। এবং ২০১৫ সালে ব্রেন্ট স্লেন্ডার এবং রিক টেটজিল যৌথভাবে লেখেন ‘বিকামিং স্টিভ জবস’।
স্ত্রী এবং সন্তান
১৯৯১ সালের ১৮ই মার্চে জবস লরেন পাওয়েলকে বিয়ে করেন। পাওয়েলের সাথে জবসের সাক্ষাৎ হয় ১৯৯০ সালের প্রথম দিকে স্ট্যানফোর্ড বিজনেস স্কুলে। পাওয়েল তখন সেখানে এম বি এ করছিলেন। তাঁদের তিন সন্তানের সাথে ক্যালিফোর্নিয়ার পালো আলটোতে তাঁরা বসবাস করতেন।
যদিও তিনি তাঁর পরিবার সম্পর্কে কাউকেই তেমন কিছু বলতেন না, তবে এটা জানা যায় যে লরেনের সাথে তাঁর তিন সন্তানের বাইরেও ২৩ বছর বয়সে প্রেমিকা ক্রিসান ব্রেনানের গর্ভে লিসা নামে তাঁর একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছিল। আদালতে অবশ্য তিনি নিজেকে সন্তান জন্মদানে অক্ষম দাবী করে লিসার পিতৃত্ব অস্বীকার করেছিলেন। ক্রিসান তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময়েই অর্থনৈতিক অভাবের মধ্যে ছিলেন, এবং জবস তাঁর কন্যা লিসার সাথে তার সাত বছর বয়স হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনও প্রকার যোগাযোগ করেননি। পরবর্তীতে লিসা কিশোর বয়স থেকে বাবার সাথে থাকতে শুরু করেন।
পরিবার ও তারুণ্য
দুইজন ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন গ্রাজুয়েট জোয়ান সিব্ল (পরবর্তীতে জোয়ান সিম্পসন) এবং আব্দুফাত্তাহ “জন” জান্দালি তাদের নামবিহীন পুত্র সন্তানকে তার জন্মের পরপরই দত্তক এর জন্য দিয়ে দেন।
জবসের জন্মদাতা পিতা জান্দালি একজন সিরিয়ান রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন, তাঁর জন্মদাত্রী মা জোয়ান ছিলেন একজন স্পিচ থেরাপিস্ট। জবসকে দত্তক হিসেবে দেয়ার অল্প কিছুদিন পরেই এই দুইজন বিয়ে করেন এবং মোনা সিম্পসন নামে তাঁদের এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।
জবস তাঁর ২৭ বছর বয়সে নিজের জন্মদাতা পিতা-মাতার ব্যাপারে সব তথ্য জানতে পারেন।
সেই সময়ে জবস এবং বোন মোনা যখন পরস্পরকে খুঁজে পান, দুই ভাইবোন একটি মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মোনা এক পর্যায়ে তাঁদের জন্মদাতা জান্দালিকে খুঁজে বের করেন। জান্দালি তখন একটি কফি শপ চালাতেন। মোনা নিজের পরিচয় না দিয়ে বাবার সাথে কথা বলেন। কথার এক পর্যায়ে জান্দালি মোনাকে বলেছিলেন – “সিলিকন ভ্যালিতে আমার এর আগে অনেক বড় একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। (সেখানকার) সবাই সেখানে খেতে আসত। এমনকি স্টিভ জবসও প্রায়ই আসত। সে সবসময়েই মোটা বকশিশ দিতো।” – এই কথা শোনার পরও মোনা বলেননি যে এই মোটা বকশিশ দেয়া বিখ্যাত লোকটি আসলে জান্দালির ছেলে।
মোনা পরবর্তীতে তাঁর ভাইকে যখন জান্দালির কথা বলেন – জবস তাঁর বাবাকে সত্য কথা বলতে মোনাকে সোজা মানা করে দেন। জন্মদাতার প্রতি একটা অভিমান জবস সারাজীবনই পুষে রেখেছিলেন। মা জোয়ানের প্রতি অবশ্য তাঁর এই মনোভাব ছিল না। কারণ তিনি জানতে পেরেছিলেন জিন্দালির জোরাজুরিতেই আসলে জোয়ান ছেলেকে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
নাম না রেখেই দত্তকের জন্য ত্যাগ করা নবজাতক জবসকে দত্তক হিসেবে নিয়েছিলেন পল এবং ক্লারা জবস নামের এক দম্পতি। তাঁরা তাঁদের পালক পুত্রের নাম রাখেন স্টিভেন ‘পল’ জবস।
ক্লারা ছিলেন একজন হিসাবরক্ষক, এবং সাবেক কোস্টগার্ড পল তখন একজন মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। পল ও ক্লারা দম্পতি তাদের পুত্রকে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন ভিউ এলাকায় বসবাস করতেন।
তাঁরা যেখানে বসবাস করতেন সেই এলাকাটি পরবর্তীতে সিলিকন ভ্যালি হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। বাল্যকালে জবস তাঁর পালক পিতার সাথে তাঁদের পারিবারিক গ্যারেজে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতেন।
পল তাঁর পালক পুত্রকে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি খোলা ও লাগানোর বিভিন্ন কৌশল দেখান, যা বালক জবসের ভেতরে যন্ত্র ও কারিগরি বিষয়ে আগ্রহ ও আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করেছিল।
শিক্ষা
যদিও জবস সব সময়েই প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন ও উদ্ভাক মনোভাবের ছিলেন, তাঁর বাল্য ও কৈশর কালে তিনি কখনওই সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। কিন্ডারগার্ডেন পর্যায়ে তিনি বিরক্তি কাটাতে স্কুলে নানান ধরনের দুষ্টুমি করতেন। তাঁকে পড়াশুনা করানোর জন্য তাঁর চতুর্থ শ্রেণীর এক শিক্ষক তাঁকে ঘুষ পর্যন্ত দিয়েছিলেন।
পড়াশুনা না করলেও ফলাফল তাঁর বরাবরই ভালো ছিল এবং স্কুল কতৃপক্ষ বয়স হওয়ার আগেই তাঁর বাবা-মায়ের কাছে তাঁকে হাইস্কুলে উঠিয়ে দেয়ার প্রস্তাব রাখেন । কিন্তু পল ও ক্লারা সেই প্রস্তাবে সাড়া দেননি।
হাইস্কুল শেষ করার পর জবস পোর্টল্যান্ড, ওরিগন এ অবস্থিত রিড কলেজে ভর্তি হন কিন্তু ৬ মাসের মধ্যেই কলেজ ছেড়ে দিয়ে পরবর্তী আঠারো মাস বিভিন্ন ক্রিয়েটিভ কোর্স করেন। জবস পরবর্তীতে বলেছিলেন যে ক্যালিগ্রাফির ওপর একটি কোর্স করতে গিয়ে টাইপোগ্রাফির প্রতি তাঁর প্রথম আগ্রহ জন্মেছিল।
১৯৭৪ সালে জবস ’আটারি’র হয়ে একজন ভিডিও গেম ডিজাইনার হিসেবে যোগ দেন। কয়েক মাস পরে তিনি কোম্পানী ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক মুক্তি খোঁজার জন্য ভারতে পাড়ি জমান।
স্টিভ ওজনিয়াকের সাথে পরিচয় (আপেলের চারা!)
হোমস্টেড হাইস্কুলে ভর্তির সময়ে জবস তাঁর ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক অংশীদার ও এ্যাপল কম্পিউটারের সহ উদ্যোক্তা স্টিভ ওজনিয়াকের সাথে পরিচিত হন। ওজনিয়াক তখন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ছাত্র ছিলেন।
কেন তিনি এবং জবস এত ভালভাবে একসাথে কাজ করতে পেরেছিলেন তা ওজনিয়াক ২০০৭ সালে ’পিসি ওয়ার্ল্ড’ এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন: “আমরা দুজনেই ইলেক্ট্রনিকস ও ডিজিটাল যন্ত্রপাতি জোড়া লাগানোর ব্যাপারটা ভালবাসতাম। বিশেষ করে সেই সময়ে ডিজিটাল চিপস কি করতে পারে, সেই বিষয়ে খুব অল্প মানুষেরই ধারনা ছিল। আমি আগে বহু কম্পিউটার ডিজাইন করেছিলাম, কাজেই আমি ইলেক্ট্রনিকস ও কম্পিউটার ডিজাইনের ব্যাপারে তার (জবস এর) থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলাম, কিন্তু আমাদের দু’জনের আগ্রহের জায়গা একই ছিল। জীবনের প্রতি আমাদের দুজনেরই অন্য রকমের একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শন ছিল। ”
এ্যাপল কম্পিউটার
১৯৭৬ সালে জবসের বয়স যখন মাত্র ২১, ওজনিয়াকের সাথে মিলে তিনি তাঁদের পারিবারিক গ্যারেজে এ্যাপল কম্পিউটার শুরু করেন। জবস নিজের ভোক্সওয়াগন গাড়ি, এবং ওজনিয়াক নিজের প্রিয় সাইন্টিফিক ক্যালকুলেটর বিক্রি করে এ্যাপলের প্রাথমিক মূলধনের যোগান দেন।
প্রযুক্তি ব্যবহারে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা,এবং ছোট আকৃতির, দামে সস্তা ও সহজে ব্যবহার করা যায় – এমন কম্পিউটার ও এর যন্ত্রাংশ তৈরী করার মাধ্যমে কম্পিউটার ইন্ডাস্ট্রিতে বিপ্লব ঘটানোর কৃতিত্ব দেয়ার হয় জবস ও ওজনিয়াককে।
ওজনিয়াক ধারাবাহিক ভাবে বেশ কিছু সহজে ব্যবহার যোগ্য কম্পিউটার তৈরী করেন, এবং জবসের দূরদর্শী মার্কেটিং এর ফলে এ্যাপলের প্রতিটি কম্পিউটার সেই সময়ে ৬৬৬.৬৬ মার্কিন ডলারে বিক্রয় করা হত।
‘এ্যাপল ১’ তাঁদের প্রতিষ্ঠানের এ্যাকাউন্টে ৭৭৪,০০০ মার্কিন ডলার যোগ করেছিল. এর তিন বছর পর এ্যাপল যখন তাদের দ্বিতীয় মডেল ’এ্যাপল ২’ বাজারে ছাড়লো, কোম্পানীর বিক্রী ৭০০ শতাংশ বেড়ে ১৩৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে গিয়ে পৌঁছালো।
১৯৮০ সালে এ্যাপল পুরোপুরি একটি লিমিটেড কোম্পানী হিসেবে বাজারে নামে। প্রথম দিনেই যার বাজারদর দাঁড়ায় ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। জবস পেপসি কোলার মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ জন সূলিকে এ্যাপলের সিইও পদে বসার জন্য প্রস্তাব করেন।
এ্যাপলের পরবর্তী কয়েকটি পন্য অবশ্য ডিজাইনের সমস্যার কারনে ক্রেতাদের হতাশ করে। সেই সময়ে আইবিএম বিক্রয়ের দিক দিয়ে এ্যাপলকে ছাড়িয়ে যায় এবং এ্যাপলকে আইবিএম কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত বাজারে প্রতিযোগীতা করে টিঁকে থাকতে হয়।
১৯৮৪ সালে এ্যাপল ম্যাকিনটোশ কম্পিউটার বাজারে ছাড়ে, যেটিকে স্রোতের বিপরীতমুখী লাইফস্টাইলের পরিচায়ক হিসেবে সামনে আনা হয়। ম্যাকিনটোশ ছিল রোমান্টিক, তারুণ্য-বান্ধব ও সৃষ্টিশীল একটি পন্য। কিন্তু লাভজনক বিক্রয়ের হার এবং আইবিএম এর কম্পিউটারের চেয়ে কর্মক্ষম হলেও আইবিএম ব্যবহারকারীরা ম্যাকিনটোশে স্বাচ্ছন্দ বোধ করছিলেন না।
মার্কেটের খারাপ অবস্থা চলার সময়ে, জবস এ্যাপলের ক্ষতি করছেন, এই মনগড়া ধারনা থেকে কোম্পানীর এক্সিকিউটিভরা জবসকে আক্রমণ করা শুরু করেন। নিজের গড়ে তোলা কোম্পানীতে নির্দিষ্ট কোনও অফিসিয়াল পদে না থাকায়, তারা জবসকে এমন একটি পরিস্থিতিতে ফেলেন যাতে করে তিনি আর স্বাধীন মত কাজ করতে পারছিলেন না, ফলে ১৯৮৫ সালে জবস এ্যাপল ত্যাগ করেন।
পিক্সার
১৯৮৬ সালে জবস জর্জ লুকাসের কাছ থেকে পিক্সার এ্যানিমেশন কোম্পানী কিনে নেন। এটি পরবর্তীতে পিক্সার স্টুডিওস হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পিক্সারের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দিক বিবেচনা করে জবস তাঁর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কোম্পানীটিতে বিনিয়োগ করেন। পরবর্তীতে স্টুডিওটি থেকে টয় স্টোরি, ফাইন্ডিং নিমো, দি ইনক্রেডিবল্স এর মত জনপ্রিয় সিনেমা বের হয়।
পিক্সার কোম্পানীর নীট আয় দাঁড়ায় ৪ বিলিয়ন ডলারে। ২০০৬ সালে পিক্সার ওয়াল্ট ডিজনির সাথে এক হয়ে যায়। এর ফলে জবস ডিজনির সবচেয়ে বড় শেয়ার হোল্ডারে পরিনত হন।
এ্যাপল পুনুরুদ্ধার
এ্যাপল ছাড়ার পর পিক্সার ছাড়াও জবস NeXT, Inc. নামে নতুন একটি হার্ডওয়ার ও সফটঅয়্যার কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমেরিকার সাধারণ বাজারে কোম্পানীটি তাদের নিজস্ব নতুন অপারেটিং সিস্টেম বিক্রি করতে গিয়ে কিছু সমস্যার মুখে পড়ে এবং পরবর্তীতে এ্যাপল Next, Inc কে ১৯৯৬ সালে ৪২৯ মিলিয়ন ডলারে কিনে নিয়েছিল।
১৯৯৭ সালে জবস সিইও হিসেবে এ্যাপলে ফিরে আসেন এবং যেভাবে তিনি ৭০ এর দশকে এ্যাপলকে সফলতার পথে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেভাবেই ১৯৯০ এর দশকে এ্যাপলের গৌরব পুনুরুদ্ধার করেন।
একটি নতুন ম্যানেজমেন্ট টিমকে সাথে নিয়ে স্টক অপশনে পরিবর্তন ঘটিয়ে এবং নিজের ঠিক করা ১ ডলারের বার্ষিক বেতনের বিনিময়ে জবস এ্যাপলকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনেন।
জবসের জিনিয়াস বুদ্ধিমত্তার ফসল আইম্যাক এর মত অসাধারন সব পন্য, দারুন ডিজাইন এবং চমকপ্রদ ব্র্যান্ডিং ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে এ্যাপল আরেকবার ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়।
পরের বছরগুলোতে, ম্যাকবুক এয়ার, আইপড এবং আইফোনের মত আলোড়ন ঘটানো সব পন্য নিয়ে এসে প্রযুক্তি জগতে বিপ্লব সৃষ্টি করে এ্যাপল।
ব্যাপার এমন দাঁড়ায় যে এ্যাপল একটি নতুন পন্য বাজারে আনার সাথেসাথেই অন্যান্য প্রতিযোগী কোম্পানীগুলো সেই আদলে পন্য তৈরীর জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। প্রযুক্তির বাজারে এ্যাপল একটি অনন্য অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম হয় জবসের হাত ধরেই।
২০০৭ সালের ভেতর এ্যাপলের কোয়ার্টার বৎসরের হিসেবে উল্লেখযোগ্য পজিটিভ পরির্তন আসে। প্রতিটি শেয়ারের মূল্য দাঁড়ায় ১৯৯.৯৯ মার্কিন ডলার যা সেই সময়ের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল। কোম্পানীর লাভের খাতায় জমা হয়েছিল দেড় বিলিয়নের বেশি ডলার, ব্যাংকে জমা হয়েছিল ১৮ বিলিয়ন ডলার এবং কোম্পানীর ঋণের খাতা ছিল শূণ্য!
২০০৮ সালে আইপড ও আইটিউনস্ এর তুমুল জনপ্রিয়তার ফলে ওয়ালমার্টের পরেই এ্যাপল আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহৎ মিউজিক রিটেইলার হিসেবে জায়গা করে নেয়। ফরচুন ম্যাগাজিনের আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় কোম্পানীর তালিকায় এ্যাপলের স্থান হয় ১ নম্বরে। সেই সাথে একই ম্যাগাজিনের শেয়ার হোল্ডারদের সবচেয়ে বেশি লভ্যাংশ দেয়া ৫০০ কোম্পানীর তালিকায়ও এ্যাপল ১ নম্বরে স্থান করে নেয়।
ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ
২০০৩ সালে জবস জানতে পারেন তাঁর নিউরোইনডক্রিন টিউমার হয়েছে যা কিনা অগ্নাশয়ের একটি দুর্লভ কিন্তু অপারেশনযোগ্য ক্যান্সার। জানার সাথেসাথেই অপারেশন করার বদলে জবস তার নিরামিষভোজী খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনেন এবং প্রাচ্যের চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করতে থাকেন। এভাবে তিনি অস্ত্রোপচার প্রকৃয়াকে নয় মাস দীর্ঘায়িত করেন – এবং এ্যাপলের বোর্ড অব ডাইরেক্টরদের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেন।
এ্যাপলের এক্সিকিউটিভরা ভয় করছিলেন জবসের অসুস্থতার খবর জানাজানি হলে শেয়ারহোল্ডাররা তাদের স্টক প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। শেষ পর্যন্ত শেয়ারহোল্ডারদের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার ভয়ে নয়, জবসের নিজের ইচ্ছায়ই তার অসুস্থতার খবর গোপন রাখা হয়। ২০০৪ সালে সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জবসের টিউমার অপসারণ করা হয়। স্বভাবগত ভাবেই জবস পরবর্তী বছরগুলোতে তাঁর স্বাস্থের ব্যাপারে খুব কম তথ্য বাইরের মানুষকে জানিয়েছিলেন।
২০০৯ এর শুরুর দিকে জবসের ওজনহ্রাসের ব্যাপারে কথা হতে থাকে। কেউ কেউ ধারনা করতে থাকেন তাঁর স্বাস্থ্য সমস্যা আবার দেখা দিয়েছে। তাঁকে নাকি লিভার ট্রান্সপ্লান্টও করাতে হয়েছে। কিন্তু এসব কানাঘুষার জবাবে জবস বলেছিলেন তিনি আসলে হরমোনের অনুপাত জনিত সমস্যায় ভুগছেন – এর বেশিকিছু নয়।
কিন্তু কিছুদিন পরই তিনি কাজ থেকে ছয় মাসের ছুটি নেন। একটি ইমেইল মেসেজে তিনি তাঁর সহকর্মীদের বলেছিলেন, তাঁর স্বাস্থ্য সমস্যা আসলে সাধারন পর্যায়ের নয়। তিনি এ্যাপলের তৎকালীন চিফ অপারেটিং অফিসার টিম কুককে তাঁর বদলে এ্যাপলের দৈনন্দিন কার্যক্রম দেখার দায়িত্ব দেন।
প্রায় এক বছরের মত সময় ধরে পাদপ্রদীপের বাইরে থাকার পর ২০০৯ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর শুধুমাত্র আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য একটি এ্যাপল ইভেন্টে বক্তৃতা করেন। তিনি ২০১০ সালের প্রায় পুরোটা জুড়েই এ্যাপলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হিসেবে কাজ করে যান, যার মধ্যে আইপ্যাডের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানও ছিল। কিন্তু ২০১১ সালের জানুয়ারিতে জবস ঘোষণা দেন, তিনি অসুস্থকালীন ছুটিতে যাচ্ছেন। অগাস্টে তিনি এ্যাপলের সিইও পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং পাকাপাকি ভাবে টিম কুকের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করেন।এক মাস পরেই তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটে।
স্টিভ জবসের মৃত্যু ও শেষ বাক্য
২০১১ সালের ৫ই অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের পালো আলটোতে ৫৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন প্রযুক্তি জগতের প্রবাদ পুরুষ। তিনি প্রায় এক দশক যাবৎ অগ্নাশয়ের ক্যান্সারের সাথে লড়াই করছিলেন।
মোনা সিম্পসনের ভাষ্য অনুযায়ী, মৃত্যুর মূহুর্তে জবস তাঁর বোন, স্ত্রী ও সন্তানদের দিকে তাকিয়ে বলেন “OH WOW. OH WOW. OH WOW.” যার বাংলা করলে দাঁড়ায় “চমৎকার! চমৎকার! চমৎকার!”
তিনি কেন এই কথা বলেছিলেন তার কোনও সঠিক ব্যাখ্যা নেই। তবে এটা সত্যি যে তিনি তাঁর জীবনে অজস্র ‘চমৎকার’ ঘটিয়ে গেছেন।
স্টিভ জবসের জীবনী সম্পর্কে আপনার আর কি কি জানা আছে তা কমেন্টে লিখুন, তাতে এই লেখাটি আরও সমৃদ্ধ হবে। সেই সাথে লেখাটি ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন।
আমাদের চাওয়া থাকবে জবসের গল্পে অনুপ্রাণিত হয়ে আপনিও নিজের অবস্থা ও পৃথিবীকে বদলানোর প্রেরণা পাবেন। জবস খুব সাধারণ একজন মেশিন অপারেটরের পুত্র হয়ে বিশ্বের সেরা কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করতে পারলে আপনি কেন পারবেন না নিজের স্বপ্নকে সফল করতে?