দক্ষ ও সফল মানুষদের এই ৭টি অভ্যাস চর্চা করে তাদের মত হয়ে উঠুন – (বুক রিভিউ)


আপনি হয়তো এর আগেও শুনেছেন যে আমাদের জীবন আসলে আমাদের অভ্যাসের ফলাফল। আপনি যদি প্রতিদিন দাঁত মাজার অভ্যাস করেন, তাহলে আপনার সুন্দর দাঁত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আবার যদি আপনার প্রচুর পানি খাওয়ার অভ্যাস থাকে তাহলে অবশ্যই আপনার ত্বক, চুল ও স্বাস্থ্য সুন্দর হবে। যদি সময়ের কাজ সময়ে করার অভ্যাস থাকে, তাহলে অবশ্যই কিছু ক্ষেত্রে আপনি অনেকের থেকেই এগিয়ে থাকবেন।

জীবনে সফল হতে গেলে সময়ের কাজ সময়ে করাটা আসলেই খুব জরুরী। তবে শুধু সময়ের কাজ সময়ে করলেই কিন্তু পূর্ণ সফল হওয়া যায় না। সাথে আরও কিছু জরুরী অভ্যাস রপ্ত করা দরকার।

বেস্ট সেলিং লেখক, শিক্ষক এবং সফল ব্যবসায়ী স্টিফেন কোভি (১৯৩২-২০১২)  তাঁর বিখ্যাত বই “The 7 Habits of Highly Effective Peopleবইয়ে সফল মানুষদের জীবন নিয়ে গবেষণা করে সময়ের কাজ সময়ে করার পাশাপাশি আরও ছয়টি জরুরী অভ্যাসের কথা বলেছেন। এই সাতটি অভ্যাসই আপনার জীবনে সফলতা এনে দেয়ার জন্য অতি জরুরী।  – চলুন জেনে নেয়া যাক সাফল্যের জন্য জরুরী সাতটি অভ্যাস কি কি:

০১. সক্রিয় (Proactive) হোন

proactive vs reactive

ভাবুন আপনি একটি First Class বাসে চড়ে কক্সবাজার যাচ্ছেন। এসির সুন্দর বাতাস আসছে। কানে হেডফোনে চলছে আপনার প্রিয় গান। বাইরের সবুজ প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে মন ফুরফুরে হয়ে আসছে। এমন সময়ে বাসের শান্ত পরিবেশে একটা হৈচৈ শুরু হয়ে গেল।

পাশে তাকিয়ে আপনি দেখতে পেলেন এক মহিলার গায়ে কোথা থেকে একটি তেলাপোকা এসে বসেছে, সে চিল্লাচিল্লি করে বাসের মধ্যে একটা নাশকতা সৃষ্টি করে ফেলেছে। হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করতে করতে দেখাগেল তেলাপোকাটি উড়ে গিয়ে আর এক লোকের গায়ে পড়েছে। লোকটিও একই কান্ড করে চলল। এরপর তেলাপোকাটি উড়ে গিয়ে পড়ল অন্য একজন লোকের গায়ে। – সে কিন্তু অন্যদের মত অস্থির না হয়ে তার হাতের ওপর হাঁটতে থাকা তেলাপোকাটিকে বেশ মনযোগের সাথে কয়েক মূহুর্ত দেখল। তারপর তার সামনের সিটের পেছন থেকে বাস থেকে দেয়া পলিথিনটি অন্য হাতে নিয়ে তেলাপোকাটিকে ধরে ফেলল। তারপর সুন্দর করে উঠে গিয়ে ধীরে সুস্থে বাসের স্টাফকে বলে দরজা খুলিয়ে বাইরে ফেলে দিল।

এই গল্পে আমরা দুই ধরনের মানুষের দেখা পাই। লেখকের মতে এরা হচ্ছে সক্রিয় (proactive) এবং প্রতিক্রিয়াশীল (reactive) ধরনের মানুষ।

প্রথম মহিলা এবং লোকটি প্রতিক্রিয়াশীল ধরনের মানুষ, আর তিন নম্বর লোকটি – যে কিনা ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দিল, সে সক্রিয় ধরনের। লোকটি পরিস্থিতির কারনে প্রভাবিত না হয়ে, ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে একটি সমাধান বের করে সেই অনুযায়ী কাজ করে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রন নিজের হাতে নিয়েছে।

Reactive মানুষেরা সবকিছুর জন্য অন্যের ওপর দোষ চাপায়। দেশ উন্নতি করছে না, তো সরকারের দোষ। সে নিজে উন্নতি করছে না, সেটা তার বসের দোষ। সে সুখে নেই কারন তার আশপাশের মানুষ ভাল না। আর কোনও কারনে দোষ দেয়ার মত কাউকে খুঁজে না পেলে ভাগ্য তো আছেই – সব দোষ গিয়ে পড়ে বেচারা ভাগ্যের ওপর, অন্য কথায় মাথার অংশ কপালের ওপর।

তাদের মতে কোনও কিছু নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। সব পরিস্থিতি আর ভাগ্যের খেলা।  সমস্ত সমস্যা বাইরে থেকেই আসছে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, তাদের এই চিন্তাধারাই আসলে সবথেকে বড় সমস্যা।

তাদের মুখ দিয়ে প্রায়ই শুনতে পাওয়া কথার মধ্যে কয়েকটি এমন: “আমাকে/তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না।“, “কিচ্ছু করার নেই, আমি ছোটবেলা থেকেই এমন।“, “এটা তো কোনওভাবেই সম্ভব না।“, “যদি কোনও ঝামেলা হয়…”, “সব দোষ আমার কপালের।“, “বাঁচার কোনও উপায় নেই ।“, “ওকে দেখলেই মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়।“, “আর ভালো লাগে না/ কিচ্ছু ভাল লাগছে না।“ – ইত্যাদি ইত্যাদি। (আপনার আশপাশে এই ধরনের কথা বলা লোকজন থাকলে, যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করুন।)

এবার আসা যাক Proactive বা সক্রিয় মানুষদের কথায়। এরা প্রতিক্রিয়াশীল মানুষদের সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের মানুষ। এরা নিজেদের পরিস্থিতি ও অনুভূতির নিয়ন্ত্রণ অন্য মানুষ বা অন্য কিছুর হাতে দেয়ার থেকে নিজের হাতে রাখতে বেশি পছন্দ করেন।

তারা তাদের নিজেদের কাজের ও কাজের ফলাফলের ১০০ ভাগ দায়িত্ব নিজে গ্রহন করে।  অবস্থা আর পরিস্থিতিকে গালি দেয়ার বদলে কিভাবে সেই অবস্থাকে ভালর দিকে নিয়ে যাওয়া যায় সেই ব্যাপারে চিন্তা করে। আর শুধু চিন্তা করেই তারা থেমে থাকে না, কাজের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানেরও চেষ্টা করে।

সফল হতে গেলে এই গুনটি থাকা খুবই প্রয়োজন। আপনি সব সময়ে সমস্যার ওপর মনযোগ না রেখে, সমাধান নিয়ে ভেবে তার ওপর মনযোগ দিন। দেখবেন সমস্যা তো আপনার মনে প্রভাব ফেলতে পারছেই না, বরং তার সমাধান করার প্রক্রিয়াটি আপনি উপভোগ করে একটি ভাল সময় পার করছেন।

০২. কোনও কাজ শুরু করার আগে শেষটা ভেবে নিন

কল্পনা করুন একটি শোকসভা চলছে। সেখানে মোটামুটি বেশকিছু লোক আপনার পরিচিত। সেইসাথে বেশকিছু অপরিচিত মানুষও রয়েছে। – শোকসভাটি আর কারও নয়, সেটি আপনার মৃত্যুর পরের শোকসভা।

বিভিন্ন মানুষ আপনার স্মৃতিচারণ করছে। এখন ভাবুনতো আপনার মৃত্যুর পর মানুষ আপনাকে নিয়ে কি কি বললে আপনার সবথেকে ভাল লাগতো। প্রশ্নটি একটু মন দিয়ে ভাবুন।  এই প্রশ্নটি আপনার জীবনকে সাজানোর জন্য খুবই জরুরী একটি প্রশ্ন।

এবার আরেকটু ভাবুন তো আপনার শোকসভায় আপনি যা যা শুনতে চাইবেন, তা শোনার মত কাজ আপনি এই মূহুর্তে কতটা করছেন।

যদি আপনি চান যে সবাই বলুক, আপনি একজন অসাধারন বন্ধু ছিলেন – ভাবুন, আপনি কি সত্যিই সেটা বলার মত বন্ধু হয়ে উঠতে পেরেছেন? – যদি আপনি চান মানুষ বলুক আপনি এক মহান মানুষ ছিলেন, যে কিনা শত শত মানুষের জীবন গড়ার অনুপ্রেরণা হয়েছিল – ভেবে দেখুন, আপনার এখনকার কাজ কি আপনাকে সেইদিকে নিয়ে যাবে?

এভাবে আপনি যেটাই চান, যেখানেই যেতে চান, তা অর্জন করার মত কি কাজ এখন করছেন তা ভেবে দেখুন।

শুধুমাত্র জীবনের শেষটা ভাবলেই চলবে না। আপনার প্রতিটি কাজের শেষ ফলাফলটি আপনাকে আগে থেকেই কল্পনা করে নিতে হবে, এরপর ভেবে দেখতে হবে আসলে আপনি সেই ফলাফল পাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ কাজ করছেন কি-না।

নিজেকে প্রশ্ন করুন কাল অথবা দুই ঘন্টা পর আপনি নিজেকে কোথায় দেখতে চান। এরপর নিজের দিকে তাকান, বিচার করুন, তারপর কাজে নেমে পড়ুন। কোনও কিছু শুরু করার আগে শেষটা ভেবে নিলে কাজের ধরন ও পরিমান সম্পর্কে একটি সুন্দর ধারনা আপনার মাথায় এমনিতেই চলে আসবেন।  পৃথিবীর প্রায় সব সফল মানুষই এই স্টাইলে চিন্তা করেন। আর এই কারনেই তাঁরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সফল হন।

০৩. যেটি আগে করা প্রয়োজন, সেটি আগে করুন

ব্যাপারটা খুব সাধারন। যে কাজটি সবার আগে করা জরুরী, সেই কাজটিই সবার আগে করুন।

তবে ব্যাপারটি শুনতে যতটা সহজ লাগছে, আসলে কিন্তু অতটা সহজ নয়। সময়ের সঠিক ব্যবহার খুব কম মানুষই করতে পারে।

ধরুন আপনি আপনার একজন সহকর্মী বা সহপাঠীর সাথে একসাথে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন। কথায় কথায় সে আপনাকে জানালো সে এখন দারুন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। অনেকদিন ধরেই সে ভাবছে অনলাইনে ইংরেজীর ওপরে একটি কোর্স করবে, কিন্তু সময়ের অভাবে করে উঠতে পারছে না।

হাঁটতে হাঁটতে আপনারা আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখতে পেলেন পুলিশ এক পকেটমারকে ধরেছে। চারিদিকে মানুষের ভিড়, বেশ একটা নাটক জমে উঠেছে। আপনি এক পলক দেখে নিয়ে চলে যেতে গেলেন, কিন্তু আপনার সেই বন্ধু আপনাকে থামিয়ে তামাশা দেখতে লাগল। – এবং দেখতে দেখতে প্রায় আধা ঘন্টার মত পার করে ফেলল।

বাড়ি ফেরার সময়ে আপনি হয়তো আপনার বন্ধুকে বললেন যে তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে এই আধা ঘন্টা তো সে শেখার কাজে লাগাতে পারত। আপনার বন্ধু একটা উল্টো যুক্তি দিয়ে আপনাকে চুপ করিয়ে দিল।

এটা হয়তো ঠিক যে আধা ঘন্টায় তার পুরো লিসনটি নেয়া হত না। কিন্তু আমাদের মাঝে অনেকেই এরকম অদরকারী কাজে সময় নষ্ট করে পরে ভাবে তাদের হাতে আসলে সময় নেই । কিন্তু এরকম অনেক আধা ঘন্টার, এমনকি পাঁচ মিনিটের যোগ করলে দেখা যাবে কতটা কাজের সময় আমাদের এভাবে নষ্ট হয়।

অনেকেই আসলে নিজেকে যতটা ব্যস্ত ভাবে, আসলে ততটা ব্যস্ত থাকে না। কতবার এমন হয় যে কাজের মাঝে একটু “Relax” পাবার আশায় পাঁচ মিনিটের জন্য ফেসবুকটা “একটু” দেখতে গিয়ে বিশ-পঁচিশ মিনিট কেটে যায়।  একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা কোনও কাজের মাঝে থাকা অবস্থায় যদি অন্যদিকে মনযোগ দিই তা গড়ে আমাদের ২৩ মিনিটের মত সময় নষ্ট করে।

যখন আমাদের সামনে কোনও জরুরী কাজ থাকে, সেই কাজের মূল্যবান সময়টি আমরা টিভি দেখে, সিনেমা দেখে বা আজেবাজে চিন্তা করে নষ্ট করে ফেলি। এই বদ অভ্যাসটা খুবই কমন। কিন্তু এই কমন অভ্যাসটি যদি আপনি ধরে রাখেন, তাহলে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে আপনি ‘কমন’ মানুষদের কাতারেই রয়ে যাবেন।

কাজেই আপনি যদি সত্যিই সফল হয়ে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান, তবে সেই কাজগুলোই সবার আগে করুন যেগুলো আপনাকে লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করবে। যে কাজটি আগে করা উচি‌ৎ, পুরো মনযোগের সাথে সেই কাজই আগে শেষ করুন, তারপর বাকি সব।

০৪. নিজে জিতুন অন্যকেও জেতান (Win-Win)

minion high five cheers

ধরুন X এবং Y এর একটি করে সুপারশপ আছে। X এর সুপার শপে খুব চম‌ৎকার টাটকা শব্জী পাওয়া যায়, আর Y এর শপে তাজা মাছ পাওয়া যায়। তাদের দুইজনের শপেই ১০০ জন করে রেগুলার ক্রেতা আছেন।

একদিন X নিজের কিছু দরকারে Y এর দোকানে গেল এবং সেখানকার পরিবেশ ও পন্য তার বেশ ভাল লাগল। এরপর সে তার নিজের শপে আসা ক্রেতাদেরকে বলল যে তাজা মাছের জন্য তারা Y এর দোকানে যেতে পারে।

এরপর Y একদিন X এর শপে আসল, এবং তারও X এর শপটি পছন্দ হল। সে এবার তার নিজের ক্রেতাদেরকে বলল কারও তাজা সব্জী দরকার হলে তারা X এর কাছে যেতে পারে।

এভাবেই X এবং Y এর দু’জনেই ১০০ জন করে নতুন নিয়মিত ক্রেতা পেয়ে গেল।

হয়তো উদাহরনটি বাস্তবে এভাবেই ঘটেনি, কিন্তু সারা বিশ্বে ব্যবসায়ের এটি খুবই কার্যকরী একটি মাধ্যম, যাকে “Win-Win” বলা হয়। এই পদ্ধতিতে দুই পক্ষেরই প্রায় সমান লাভ হয়।

এখন ধরুন আমাদের দেশের ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে যেটা সবথেকে বেশি হয়, X এবং Y ও সেই কাজটিই করল।

X এর মনে হল Y তার একজন প্রতিযোগী, যে করেই হোক প্রতিযোগীর বাজার নষ্ট করতে হবে। সে বিভিন্ন জায়গায় Y এর দুর্নাম করে বেড়াতে লাগল, এবং আরও কিছু নেগেটিভ মার্কেটিং এর কৌশল অবলম্বন করে তার ক্ষতি করার চেষ্টা করতে লাগল। এবং একটা সময়ে দেখা গেল Y এর জনপ্রিয়তা কিছুটা কমে গেল। কিন্তু অন্যদিকে X এর তেমন কোনও নতুন নিয়মিত ক্রেতা সৃষ্টি হল না।

বিশেষ করে ব্যবসার ক্ষেত্রে আপনি যখন অন্যকে হারিয়ে নিজে জিততে যাবেন তখন আপনার প্রতিযোগীর হয়তো কিছু ক্ষতি করতে পারবেন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে আপনার কোনও লাভ হবে না।

আমাদের মানসিকতাই আজকাল এমন হয়ে গেছে, যে আমরা ভাবি আমাদের জিততে হলে অন্য কাউকে অবশ্যই হারতে হবে। যদি অপরজন কিছু পেয়ে যায়, তো আমি পাব না। শুধু ব্যবসার ক্ষেত্রে নয়, সব ক্ষেত্রেই এমনটা চলছে। একজন যদি একটা বিষয়ে দক্ষ হয়ে থাকে, তবে সে কোনওভাবেই তা অন্যকে শেখাতে চায় না। কিন্তু অন্যকে শেখাতে গেলে, সে-ও আপনাকে তার নিজস্ব কিছু জিনিস শেখাতে পারে – এটা বেশিরভাগ মানুষেরই মাথায় থাকে না।

তাই নিজে জেতার পাশাপাশি অন্যকেও জিততে দিন, দিন শেষে লাভ আপনারই হবে। যে কোনও প্রকারের ডিল করতে গিয়ে যদি আপনি এই “win-win situation” সৃষ্টি করতে পারেন, তাহলে দেখবেন ডিলটাও অনেক সহজে হয়ে যাচ্ছে এবং আপনার লাভও বেশি হচ্ছে।

০৫. আগে বুঝুন, পরে বোঝান

একটি গাঁজাখুরি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক: মনে করুন আপনি বেশ কিছুদিন ধরে চোখের সমস্যায় ভুগছেন। আগের মত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না। তো উপায় না দেখে আপনি গেলেন এক চোখের ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার আপনার সমস্যার কথা কোনওরকমে শুনে নিজের চোখের চশমাটি খুলে আপনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন: “এই চশমাটা আমি বহুদিন ধরে ব্যবহার করছি, সবকিছু একদম ক্লিয়ার দেখা যায়। আপনিও এটাই পরুন।“

কিন্তু সেই চশমা আপনি চোখে দিয়ে কিছুই দেখতে পেলেন না। সেটা ডাক্তারকে বলার পর তিনি তারপরও সেই চশমার গুনাগুণ সম্পর্কে অনেক কথা বলে আপনাকে সেটাই নেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। – বলুন, এরপরও কি আপনি ওই ডাক্তারের কাছে যাবেন?

গল্পটি আসলেই অবাস্তব। কোনও ভাল ডাক্তারই আপনাকে ভাল মত পরীক্ষা না করে নিজের চশমা দিয়ে দেবে না। আবার তার নিজের গ্যাসের সমস্যায় পেটে ব্যাথা হয়, এই কারনে আপনার পেটের ব্যাথাও গ্যাসের কারনে ধরে নিয়ে একপাতা এন্টাসিড ধরিয়ে দেবে না।

তবুও গল্পটি আপনাকে বলার কারন, আমরা প্রতিনিয়তই সেই গল্পের ডাক্তারের মত কাজ করে থাকি। কিভাবে? – আমরা যখন কারও সাথে কথা বলি, তখন তাদের সমস্যা বা যুক্তিকে ভালমত খেয়াল করে না বুঝেই আমরা আমাদের মতামত আর পরামর্শ দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আরেকজনের বক্তব্য ভালমত না বুঝেই আমরা তর্ক শুরু করে দিই। এর কারন আমরা বেশিরভাগ সময়েই নিজের দিক থেকে চিন্তা করি, অন্যের মানসিকতা বা যুক্তি বুঝতে চাই না।  আর এর কারনে কিন্তু মানুষও আমাদের থেকে দূরে চলে যায়। আমরা প্রায়ই বলি, কেউ আমাদের বোঝেনা – কিন্তু আমরা নিজেরাও বেশিরভাগ সময়ে সামনের মানুষটির অনুভূতিও বুঝতে চাই না।

অন্যের কথা বা কাজ বিচার করার সময়ে মানুষ বেশিরভাগ সময়েই ভাবে “সে এটা কি বলল/করল?” ; খুব কম মানুষই আছে যে চিন্তা করে “সে এটা কেন বলল/করল?”। মজার ব্যাপার হচ্ছে পৃথিবীর সবথেকে খ্যাতিমান ডিটেকটিভ, ডাক্তার, এমনকি ব্যবসায়ী বা ম্যানেজাররা এই দ্বিতীয় চিন্তার মানুষ। তারা কারও আচরণ বা কথা বিচার করার আগে মানুষটির চিন্তা ও অনুভূতিকে গভীর ভাবে বুঝতে চেষ্টা করেন। আর এই গুনটিই তাঁদের অন্যদের থেকে আলাদা করে; সাধারনের থেকে অসাধারনের পর্যায়ে নিয়ে যায়।

আপনি যখন কারও কথা শুনবেন, চেষ্টা করুন শুধুমাত্র উত্তর দেয়ার জন্য না শুনে সেটা বোঝার। এবং সামনের মানুষটি যেন বোঝে আপনি সত্যিই  তার অনুভূতি আর কথাগুলো বুঝতে পারছেন। তর্কে না জড়িয়ে যদি আপনি কারও কথাগুলো ভাল মত বুঝে তার যুক্তিতেই কথা বলেন তবে একটা পর্যায়ে সে আপনার মতামতে চলে আসবে। আপনি যখন সত্যিই অন্যকে বুঝতে শুরু করবেন, তখন অন্যরাও আপনাকে বুঝতে শুরু করবে।

৬. মিলেমিশে কাজ করুন

ভাবুন একটি পুকুরের দুই পাড়ে দু’টি করে বড় গাছ রয়েছে। এক পাড়ে একটি গাছ আরেকটি গাছের থেকে বেশ দূরে। একটা সময়ে দারুন বর্ষা নামতে শুরু করল। টানা কয়েকদিন একনাগাড়ে বৃষ্টির ফলে দূরে দূরে থাকা দু’টি গাছই এক সময়ে নরম মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে ভেঙে পড়ে গেল।

ওদিকে অন্য পাড়ে একই আকারেরই দু’টি গাছ একদম গায়ে গায়ে লাগানো ছিল। দু’টি গাছের শেকড় মিলেমিশে তাদের আশপাশের মাটির বন্ধনকে অনেক শক্ত করে রেখেছিল, কাজেই অপর পাড়ের দু’টি গাছ পড়ে গেলেও কাছাকাছি থাকা গাছ দু’টি সেই বর্ষায় টিঁকে গেল।

কয়েকজন মানুষ যখন একটি টিম হয়ে একই লক্ষ্যে কাজ করতে থাকে তখন তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা ও পরিমান দুটোই বেড়ে যায়। অনেক সময়ে দেখা যায় দুইজন মানুষ আলাদা আলাদা ভাবে একটি কাজ করতে চেষ্টা করেও সফল হচ্ছে না। এরপর তারা যখন একটি টিম হয়ে কাজ করতে শুরু করে তখন দেখা যায় তারা সেই কাজে সফল হয়ে গেছে।

মনে করুন দুইজন লোক আলাদা আলাদা ভাবে একটি উঁচু গাছ থেকে আম পাড়তে চেষ্টা করছে। কিন্তু কেউই আমের নাগাল পাচ্ছে না। এদের কেউ গাছে চড়তে জানে না। এরপর তারা ঠিক করল তারা একসাথে কাজটি করবে। এরপর তুলনামূলক হালকা পাতলা লোকটি তার থেকে বড়সড় লোকটির কাঁধে চড়ল, এবং দেখা গেল এবার গাছের আমের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে।

একজন মানুষের একার ক্ষমতা যদি ১ হয়, সে যখন সমান ক্ষমতার একজনের সাথে যোগ দেয় তখন তা ২ না হয়ে ৩ হয়ে যায়। বহু ক্ষেত্রেই এমনটা দেখা গেছে। তাই সব সময়ে চেষ্টা করুন যে কোনও কাজেই অন্তত একজন সমমনা ও দক্ষ মানুষকে খুঁজে বের করতে যে আপনার কাজের গতি বাড়িয়ে দেবে অনেকগুন।

০৭. আগে অস্ত্রে ধার দিন

না- আপনাকে ডাকাতির প্রস্তুতি নিতে বলা হচ্ছে না। ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য আরও একটি উদাহরন দেয়ার প্রস্তুটি এটা।

একজন কাঠুরে তার কুড়াল দিয়ে অনেক্ষণ ধরে একটি গাছের ডাল কাটার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কোনওভাবেই ডালটি সে কাটতে পারছিল না। ক্লান্তিতে তার হাত অবশ হয়ে আসছিল।  – তার এই অবস্থা দেখে পাশ দিয়ে যাওয়া আরেক অভিজ্ঞ কাঠুরে তাকে পরামর্শ দিল আগে তার কুড়ালটিকে ধার দিয়ে আনতে। কিন্তু এই পরামর্শ শুনে প্রথম কাঠুরের জবাব ছিল: “কিন্তু তাতে তো অনেক সময় নষ্ট হয়ে যাবে!”

ঠিক ধরেছেন, প্রথম কাঠুরেটি একটা মহা বোকা। তাকে তিন বেলা হরলিক্সের সাথে বুদ্ধি গুলিয়ে খাওয়ানো উচি‌‌ৎ। কিন্তু সেই একই ওষুধ যে আমাদের অনেকেরও দরকার – সেটা কি ভেবে দেখেছেন?

আমরা আমাদের শরীর ভাল রাখার জন্য ব্যায়ামের ৩০ মিনিট সময় বের করতে পারি না; জ্ঞান বাড়ানোর জন্য দিনে মাত্র ১৫ মিনিট সময় বের করে একটি বইয়ে চোখ বুলাতে পারি না। যতক্ষণ না আমরা নিজেদেরকে আরও উন্নত করতে পারছি, আমাদের পরিস্থিতির উন্নতি হবে – এটা আশা করা বোকামী। আপনি আসলে নিজেই একটি অস্ত্র, যার যত্ন নিলে সে যে কোনও যুদ্ধ জয় করতে পারে। শুধু নিয়মিত একটু ধার দেয়া প্রয়োজন।

সবশেষে একটি হতাশার কথা:

অভ্যাসের কথা তো বলা হল কিন্তু একটি হতাশার কথা হল “মানুষ অভ্যাসের দাস” – আমরা যতই মোটিভেশনাল কথা শুনি আর বই পড়িনা কেন, কিছু সময় পরে আমরা আমাদের পুরনো অভ্যাসের কাছেই ফিরে যেতে বাধ্য হই। এটা অবশ্য দোষের কিছু নয়।

অভ্যাসের প্রক্রিয়াটাই এমন যে তাকে পরিবর্তন করাটা খুবই কঠিন ব্যাপার। তবে আপনি যদি জানেন যে অভ্যাস আসলে কিভাবে সৃষ্টি হয় এবং কি পদ্ধতিতে সেগুলো অন্য অভ্যাস দিয়ে overwrite করা যায়, তাহলে নতুন অভ্যাস করাটা আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে। এই কারনেই আপনি যদি এই আর্টিকেলের লিসন গুলো ঠিকমত কাজে লাগাতে চান তাহলে অভ্যাস পরিবর্তনের সেই কৌশলগুলো রপ্ত করুন। এখন হয়তো ভাবছেন “সেই জিনিস আবার কোথায় পাব?”

তা আপনি এখানেই পাবেন, আর আপনাকে কষ্ট করে সাইট ঘাঁটতেও হবে না, “যেভাবে আমাদের অভ্যাস গড়ে ওঠে ও পরিবর্তন হয়” – লেখাটির ওপর ক্লিক করলেই নতুন অভ্যাস সপ্ত করার সহজ কৌশলের কাছে পৌঁছে যাবেন আপনি। নতুন অভ্যাস রপ্ত করে আপনি সাফল্যের পথে এগিয়ে গেলেই আমরা সার্থক।

লেখাটি যদি কাজের মনেহয় তো শেয়ার করুন। ভাল লাগলে লাইক ও কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান। ভাল না লাগলেও কমেন্ট করে জানান। আপনাদের সব মতামতই আমাদের কাছে অমূল্য। সাফল্যযাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপে লড়াকু  আপনার সাথে আছে।

পোস্টটি শেয়ার করুন !