ক্যারিয়ার এগিয়ে নিতে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং বা আত্মপ্রচারের ৩টি উপকারিতা


এক নজরে লেখাটির বিষয়ে:

আপনার কি মনে হয় – এ্যাপলের সাথে যদি স্টিভ জবস্ নামটি না থাকতো, অথবা টেসলা বা স্পেস এক্স এর সাথে ইলন মাস্ক নামটি অনুপস্থিত হতো, বা মাইক্রোসফট এর সাথে বিল গেটস্ ও এত বিখ্যাত না হতেন, তবে কি ব্র্যান্ডগুলো এতটা বিখ্যাত হতে পারতো? বিখ্যাত বিজনেসম্যানদের ও তাদের ব্র্যান্ডের অবস্থা বিচার করে এই প্রশ্নটা চলেই আসে, যে সফল ব্র্যান্ড এর নামের সাথে এর সেলিব্রেডি উদ্যোক্তাদের নামও কি ব্যবসার প্রসারে অবদান রাখে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাখে। আর আপনি নিজেও কিভাবে নিজের ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিংকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসাকে আরও এগিয়ে যেতে পারবেন – তা নিয়েই এই লেখায় আলোচনা করব। 


বর্তমানে উদ্যোক্তাদের মাঝে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং বা আত্মপ্রচার নিয়ে বেশ একটা ‘হাইপ’ চলছে। বর্তমান অবস্থা দেখে একটা জিনিস মাথায় আসে যে, আজকাল আর শুধুমাত্র একটি সফল ব্যবসা দাঁড় করানোই যথেষ্ঠ নয়।  একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আপনাকেও আপনার প্রতিষ্ঠান বা ব্র্যান্ডের মতই খ্যাতি অর্জন করতে হবে, এতেকরে ব্যবসার প্রসারও অনেকটা বেড়ে যায়।

হ্যাঁ, এটা ঠিক যে একটি দারুন বিজনেস আইডিয়াকে সঠিক ভাবে কাজে লাগানো গেলে সেই ব্যবসা সফল হবেই; তবুও বর্তমানের ও অতীতের বেশকিছু বিশ্বসেরা কোম্পানীর ইতিহাস বিবেচনা করলে দেখা যায় একটি নতুন কোম্পানীর নামের সাথে যদি তার পেছনের এক বা একাধিক ব্যক্তি নিজে বিখ্যাত হয়ে উঠলে ব্যবসার সাফল্য অনেকটাই গতিশীল হয়।  কিন্তু কি কারনে এই ব্যাপারটি কাজে দেয়? – চলুন জেনে নিই আত্মপ্রচার ব্যবসার জন্য ভাল হওয়ার প্রধান তিনটি কারন:

০১. মানুষ প্রতিষ্ঠানের তুলনায় রক্তমাংসের মানুষকে বেশি বিশ্বাস করে

building trust

বহুকাল ধরেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরে মানুষের বিশ্বাস দিনে দিনে কমে আসছে। এর অন্যতম কারন প্রতিষ্ঠানগুলো বেশিরভাগ সময়েই প্রচারের অতিরিক্ত প্রতিশ্রুতি দেয় যা তারা বাস্তবে ক্রেতাদের দিতে পারে না।  এটা শুধু যে লোকাল ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা নয়। নামীদামী অনেক ব্র্যান্ডকেও মানুষ আজকাল বিশ্বাস করে না। আর এই পরিস্থিতিতে একটি নতুন কোম্পানীকে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলাটা উদ্যোক্তাদের জন্য প্রায়ই কঠিন হয়ে পড়ে।  তবে মানুষের একটি সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট হলো, মানুষ মানুষকে বিশ্বাস না করে বাঁচতে পারে না।

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে মানুষ বিজ্ঞাপনের থেকে সত্যিকার মানুষের মুখে কোনও পন্য বা সেবার ব্যাপারে মতামতের ওপর বেশি নির্ভর করে।  নতুন কিছু কিনতে গেলে তারা শুধুমাত্র চটকদার বিজ্ঞাপনের প্রচারণার ওপর নির্ভর না করে পরিচিতজনদের মতামত নেয়, ইউটিউব বা অন্য ওয়েবসাইটগুলোতে ইউজার রিভিউ দেখে কেনার সিদ্ধান্ত নেয়।  BrightLocal  এর করা একটি জরিপে দেখা যায় আমেরিকা বা ইউকের মত দেশগুলোর ৮৮% ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে দেয়া বিজ্ঞাপনের থেকে ইন্টারনেটে অপরিচিত মানুষের দেয়া রিভিউ বেশি বিশ্বাস করে।  এর মাঝে ৮৫% ক্রেতা একটি প্রোডাক্ট বা সার্ভিসের পেছনে টাকা খরচ করার আগে অন্তত ১০টি রিভিউ পড়ে থাকেন।

একারনে আপনার পন্য ও সেবার ক্ষেত্রে নিজেকে একজন এক্সপার্ট হিসেবে মানুষের সামনে তুলে ধরাটা এতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন একটি আইফোন কিনি, তখন অবচেতনেই স্টিভ জবসের ব্যাপারটা আমাদের মাথায় চলে আসে।  আমরা জানি স্টিভ জবস কত বড় একজন টেক বিশেষজ্ঞ। সেকারনেই চোখ বন্ধ করে আমরা তাঁর পন্যটি কিনতে পারি। আবার দেখুন, বাজারে কিন্তু পে-পাল ছাড়াও অনেক মানি এক্সচেঞ্জ রয়েছে, কিন্তু বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষই পে-পাল এ স্বাচ্ছন্দ  বোধ করে। এর প্রধান একটি কারন, পে-পাল এসেছে ইলন মাস্ক এর হাত ধরে। আবার বেশকিছু অপারেটিং সিস্টেম থাকার পরও মানুষ প্রথমে উইন্ডোজের কথা ভাবে, এর একটি কারন এর সহজ ব্যবহার ও বহুল প্রচলন – তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু বিল গেটস এর ব্যক্তিগত খ্যাতিও এর পেছনে একটি কারন।  

তাদের নিজেদের পন্য ও সেবা ছাড়াও অন্যান্য ব্যাপারেও মানুষ তাঁদের মতামতকে যথেষ্ঠ গুরুত্ব দেয়।  

কাজেই ক্রেতাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য যেমন ভাল পন্য জরুরী তেমনি প্রতিষ্ঠানের পেছনের মানুষগুলোর নিজের খ্যাতিও মানুষের কাছে দারুন গ্রহনযোগ্য।

অন্যদিকে আপনার যদি এমন একটি ফার্ম থাকে, যেটি কনটাক্টে বিভিন্ন কাজ করে, সেক্ষেত্রেও আপনার ব্যক্তিগত খ্যাতি আপনাকে কাজ পেতে অনেক সাহায্য করবে।

মনে করুন, একটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীর মালিক নিজেও যথেষ্ঠ বিখ্যাত। এখন তিনি যদি সেই কোম্পানী থেকে বের হয়ে গিয়ে নিজে আরেকটি কোম্পানী খোলেন, সেটিকে একটি ভাল অবস্থানে নিতে তাঁর খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। অন্যদিকে তিনি নিজে যতি খুব বেশি পরিচিত কেউ না হতেন, তবে এত সহজে তিনি নতুন ব্র্যান্ড দাঁড় করাতে পারতেন না।

০২. ফলোয়ার = বিক্রয়

Image result for facebook followers

আপনি কি কখনও এমন বিজ্ঞাপন টিভিতে বা পত্রিকায় দেখেছেন, যেখানে বলা হয় একটি পন্য কিনলে মিলতে পারে জনপ্রিয় কোনও তারকার সাথে ডিনারের সুযোগ? পরিসংখ্যান অনুযায়ী এতে আসলেই পন্যের কাটতি বেড়ে যায়।  আপনি হয়তো এতে তেমন একটা আগ্রহী না-ও হতে পারেন, কিন্তু বহু মানুষ আছে যারা এমন তারকাদের জীবনের আইডল মনে করে।

আমেরিকাতে কার্দাশিয়ানদের নামে যে ফ্যাশন বা কসমেটিকস পন্যই চালানো হোক না কেন, সেগুলো হটকেকের মত বিক্রী হয়। বিভিন্ন কোম্পানী তাদের বেশ মোটা অংকের টাকা দিয়ে তাদের নামে পন্য বের করার অনুমতি নেয়।  এমন নয় যে পন্যগুলো একদম টপ ক্লাসের, কিন্তু জনপ্রিয় তারকাদের নাম জড়িয়ে থাকায় মানুষ এগুলো বেশি কেনে।

কার্দাশিয়ান বা এই ধরনের তারকাদের সবচেয়ে বড় যে অস্ত্র তা হলো এদের সোশ্যাল মিডিয়ার ফলোয়ার বেস। প্রত্যেকের ইন্সটাগ্রাম, টুইটারে লক্ষ লক্ষ ফলোয়ার, এবং এদের বেশিরভাগই তাদের প্রচার করা পন্যগুলোর ক্রেতায় পরিনত হয়।

আপনার যদি ব্যবসার সার্বিক দিক, বা কোনও একটি পন্য বা সেবার বিষয়ে ভাল জানাশোনা থাকে, আপনিও সোশ্যাল মিডিয়াতে সেগুলো প্রচার করে একটি ভাল প্রোফাইল দাঁড় করাতে পারেন। ধীরে ধীরে আপনার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকবে, এবং সেইসাথে আপনার মতামতও মানুষ গুরুত্বের সাথে নেবে।

এই কারনেই জনপ্রিয় তারকাদের দিয়ে বিজ্ঞাপন বানানো হয়। কিন্তু বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে মানুষ টেলিভিশনের চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার স্ক্রীণের সামনে বেশি সময় কাটায়। আর টেলিভিশনের চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর সুযোগ সুবিধা বেশি। অনেক উদ্যোক্তাই এই কাজটি করছেন।  আপনি যদি নিজের একটি ভাল ফেসবুক পেজ বা ইউটিউব চ্যানেল দিয়ে সাধারন ক্রেতাদের কাছাকাছি থাকতে পারেন, তবে তারাও জানবে যে কোনও সমস্যা হলে তারা সরাসরি আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। এতে করে আপনার ব্যবসার গ্রাহকও বেড়ে যাবে নি:সন্দেহে।

০৩. ফ্রি মার্কেটিং

আপনার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার জনপ্রিয় উপস্থিতি আসলে একটি কার্যকর আত্মপ্রচারের ফলাফল। কিন্তু এর সাথে সোশ্যাল মিডিয়া সবচেয়ে সস্তার একটি মার্কেটিং প্ল্যাটফর্মও বটে।  আগেই বলেছি, টেলিভিশন মিডিয়াতে একটি জনপ্রিয় উপস্থিতি অনেক সময় ও কষ্টের ব্যাপার। আর আপনি যদি সেখানে বিজ্ঞাপন দেয়ার মাধ্যমে ব্র্যান্ডিং করতে চান, তবে আপনার পকেট থেকে বেরিয়ে যাবে অনেকগুলো টাকা। সেদিক দিয়ে বলতে গেলে একটি জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেল বা ফেসবুক পেজ রীতিমত ফ্রি।

যদি সঠিকভাবে এই প্ল্যাটফর্মগুলো আপনি ব্যবহার করতে পারেন, তবে নিজেকে একজন “মাইক্রো ইনফ্লুয়েন্সার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি, বলতে গেলে নামমাত্র খরচে আপনার পন্যের জন্য বিশাল একটি কাস্টোমার বেস সৃষ্টি করতে পারবেন। এক গবেষণায় দেখা যায়, বড় বড় ফান্ড বের করার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এনজিওগুলোর চেয়ে মাইক্রো ইনফ্লুয়েন্সাররা ১০ গুণ বেশি ফান্ড জোগাড় করতে পারেন।  আপনি যে ব্যবসাতেই থাকেন না কেন, একটি পার্সোনাল ব্লগ বা সোশ্যাল পেজ আপনার ব্যবসার প্রচারকে অনেক দূর নিয়ে যাবে।

ইলন মাস্ক বা ডোনাল্ড ট্রাম্প এর মত বড় বড় বিলিওনেয়ার ব্যবসায়িরা নিয়ম করে সোশ্যাল মিডিয়াতে তাঁদের নিজেদের ও ব্যবসার ব্যাপারে পোস্ট দেন এবং ফলোয়ারদের সাথে যোগাযোগ করেন।  ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে যদিও এ ব্যাপারে তাঁকে বেশকিছু বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হচ্ছে। কিন্তু অন্যরা পুরোদমে এই ‘ফ্রি মার্কেটিং’ প্ল্যাটফর্মগুলোতে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

তবে একটি ব্যাপার মনে রাখতে হবে, পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং করার ক্ষেত্রে আপনাকে শুধু নিজের ব্যবসার প্রচার করলেই চলবে না।  তাহলে কিন্তু ফলোয়ার বা ভক্তরা আপনার কথাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেবে না। আপনাকে পুরো ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কথা বলতে হবে। নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে হবে। এর বাইরেও নিজের ব্যক্তিগত ভাবনা, বিভিন্ন ইস্যু ও সামাজিক বিষয় নিয়ে নিজের মতামত, ও নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলতে হবে, পোস্ট করতে হবে।  আপনার ব্যবসার পাশাপাশি আপনার বাগানে ফোটা নতুন ফুলটি নিয়ে পোস্ট দিতে হবে, আপনার বাচ্চার নতুন দুষ্টুমি নিয়ে পোস্ট দিতে হবে। সোজা কথা, ফলোয়াররা যেন আপনাকে আপন ভাবতে পারে। একটি ব্যবসা হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে নিজের প্রচার করুন। প্রথম পয়েন্টেই বলা হয়েছে, মানুষ কোম্পানীকে নয়, মানুষকে বিশ্বাস করে।

পরিশিষ্ট

আজকের দিনে আপনি যদি আপনার ক্যারিয়ারকে সফল ও দীর্ঘমেয়াদী করতে চান, তবে আত্মপ্রচারের পেছনে সময় দেয়াটা অবশ্যই একটি কার্যকর বিনিয়োগ। সফল আত্বপ্রচারের ফলে যেমন আপনার ব্যবসার প্রসার বাড়বে, তেমনি নতুন নতুন ব্যবসায়ে তাড়াতাড়ি সফল হওয়ার পথও সুগম হবে।

লেখাটি ভাল লাগলে কমেন্ট ও লাইকের মাধ্যমে আমাদের জানান। আপনার যদি মনে হয় লেখাটি নতুন উদ্যোক্তাদের সাহায্যে আসবে, তবে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে শেয়ার করুন। সাফল্যের পথে প্রতিটি পদক্ষেপে লড়াকু আপনার সাথে আছে, আপনিও আমাদের সাথে থাকুন।

পোস্টটি শেয়ার করুন !