একনজরে লেখাটির বিষয়ে:
“সফল হতে গেলে ‘না’ বলা শিখতে হয়” – এই কথা আপনি নিশ্চই শুনেছেন। কিন্তু অনেকেই আছেন যাঁরা নিজের জরুরী কাজ ফেলে অন্যের কাজ করে দেন। নিজের কাজ ফেলে হয়তো বন্ধুর বার্থডে পার্টির জন্য কেক কিনতে দৌড়ান, অথবা সিনেমা দেখতে যান, বন্ধুর ফোন পেয়ে কাজ ফেলে আড্ডা মারতে যান। না-বলতে না পারার কারণে আপনার মূল্যবান কাজের সময় নষ্ট হয়। এটা জীবনে সফল হওয়ার পথে বিরাট বাধা। এই বাধা দূর করার উপায় নিয়েই এই লেখা। এই ৬টি টিপস অনুসরন করলে আপনি অনেক সহজে ‘না’ বলতে পারবেন। নিজের কাজ বাদ দিয়ে অন্যের আবদার রাখা বন্ধ করতে পারবেন।
‘না’ বলতে না পারার পেছনে অপরাধবোধের ভূমিকা:
বেশিরভাগ মানুষের জন্য ‘না’ বলাটা একটি কঠিন কাজ। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, অপরাধবোধ, এবং অন্যকে কষ্ট দেয়ার ভয়।
আপনার কি কখনও মনে হয়েছে যে আপনি সব সময়েই হ্যাঁ বলছেন? অনেক সময়েই কষ্ট করে ‘না’ বলে ফেললেও পরে নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হয়। এটা চলতে থাকলে আপনি একটা সময়ে মানসিক চাপে ভুগতে পারেন।
আপনার হাতে যদি বাড়তি সময় থাকে, অথবা আপনার কাছে যদি কারও কোনও উপকার পাওনা থাকে, তবে আপনি হ্যাঁ বলতে পারেন। কেউ খুব বিপদে পড়লে তখন কাজ ফেলে তার উপকার করার একটা যুক্তি আছে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই আমরা আমাদের নিজের কাজ ফেলে অন্যদের এমন সব কাজের পেছনে সময় দিই – যেগুলো আসলে কোনও জরুরী কাজ নয়।
এভাবে আমরা নিজের অজান্তেই পিছিয়ে পড়ি। অনেক সময়ে আমরা বুঝি যে আমাদের ছাড়াও কাজটি হবে, কিন্তু তবুও না- বলতে পারি না। কারণ আমরা অন্যকে কষ্ট দিতে চাই না। কিন্তু সত্যি কথা হলো, আপনি সবাইকে খুশি রেখে চলতে পারবেন না। সেটা করতে গেলে আপনার নিজেরই ক্ষতি হবে।
আপনার সমস্যা হবে বুঝেও যদি কেউ আপনার কাছ থেকে সময় পাওয়ার জন্য জোরাজুরি করে, তবে বুঝতে হবে তার কাছে আপনার কাজের গুরুত্ব নেই। একটু খেয়াল করলে আপনি অনেক মানুষের মাঝেই এমন মনোভাব দেখতে পাবেন। আপনি হয়তো অফিসের খুব জরুরী একটা কাজ করছেন, বা ক্লাসের কোনও এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত আছেন, আপনার বন্ধু আপনাকে তার সাথে সিনেমা দেখতে যাওয়ার জন্য জোর করছে। আপনি ব্যস্ত থাকার কথা বললেও সে ছাড়তে চাইছে না। এমন ভাবে কথা বলছে, যেন আপনি না গেলে তার বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। এর মানে, সে শুধু নিজের দিকটাই দেখছে। আর আপনি তাকে খুশি করতে, এবং অপরাধবোধ থেকে বাঁচতে তার কথা শুনছেন। কিন্তু এই ধরনের মানুষ ইচ্ছা করে আপনার মাঝে এই ধরনের অপরাধবোধ জাগায়। এরা আসলে দারুন স্বার্থপর ধরনের মানুষ। তাই, আপনাকে বুঝতে হবে, কার জন্য আপনি আপনার কাজ ফেলে দৌড়াচ্ছেন।
তাই আমরা আজ এই ৬টি টিপস নিয়ে এসেছি, যেগুলো আপনাকে অপরাধবোধ ছাড়া ‘না’ বলা শিখতে সাহায্য করবে:
০১. আপনার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয় – এটা মাথায় রাখুন
আপনি যদি সব সময়ে হ্যাঁ বলতে থাকেন, তবে নিজের সব কাজ করার জন্য যথেষ্ঠ সময় পাবেন না। এর ফলে আপনি সব সময়ে একটি চাপের মাঝে থাকবেন। কারণ, সব সময়েই কাজের তুলনায় আপনার হাতে সময় কম থাকবে। একটি কাজের জন্য হয়তো ৩ ঘন্টা সময় রেখেছিলেন, এক বন্ধু ফোন দিয়ে বলল তার জন্য একটা সিভি বানিয়ে দিতে। কারণ, তার নিজের ‘অন্য একটা কাজ’ আছে। আপনার হাতে জরুরী কাজ থাকার পরও আপনি তাকে ‘না’ বলতে পারলেন না। সিভি বানাতে গিয়ে আপনার ১ ঘন্টা সময় লাগলো। এবং এরপর ৩ ঘন্টার কাজটি আপনাকে ২ ঘন্টায় করতে হলো। বন্ধুর সময় বাঁচাতে গিয়ে আপনি নিজের সময় নষ্ট করলেন।
তাই হ্যাঁ বলার আগে নিশ্চিত হয়ে নিন যে কাজটি করার জন্য আপনার হাতে যথেষ্ঠ সময় আছে কি না। আর তারচেয়েও বড় কথা, আপনি সেই কাজটি করতে চান কি না।
অন্য আরেকটি পরিস্থিতির কথা বলা যাক, মনে করুন আপনার দুইজন বন্ধু আছে, দুইজনই তার সাথে রাত ৮টায় দেখা করতে বলল। একজন যেতে বলল হাসপাতালে, আরেকজন বলল জন্মদিনে পার্টিতে। আপনি কি দুই জনের সাথে একসাথে দেখা করতে পারবেন? কোনটা বেশি জরুরী – তা বুঝে নিয়ে আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আপনি কোথায় যাবেন। – এবার নিশ্চই বুঝতে পারছেন, কেন আপনার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব না?
আপনি যদি ভালোমত বুঝতে পারেন যে আপনার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়, তাহলে না বলাটা আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে।
০২. বিকল্প সমাধান অফার করুন
বিকল্প সমাধান অফার করাটা ‘না’ বলার একটি দারুন উপায় হতে পারে। এতে করে ‘না’ বলার পাশাপাশি, সামনের মানুষটিকেও কষ্ট দেয়া হবে না। এতে করে আপনার ওপর চাপ কমবে। আপনার কাছে যদি কেউ কোনও সাহায্য চায়, যা এই মূহুর্তে করতে গেলে আপনার নিজের কাজ নষ্ট হবে, তাহলে একটি বিকল্প বুদ্ধি দিলে তারও উপকার হবে, সাথে আপনারও উপকার হবে।
যখন আপনি কার্যকর কোনও বিকল্প সমাধান দেবেন, তখন আপনি নিজের কাজ ঠিক রেখেও মানুষটিকে সাহায্য করছেন। এই উপায়টি না বলাকে আপনার জন্য অনেক সহজ করে দেবে। আপনি ‘হ্যাঁ’ বলা ছাড়াই সমস্যার সমাধানে অবদান রাখছেন, যা অন্য মানুষটিকেও খুশি করবে। এরফলে আপনার মাঝে কোনও ধরনের অপরাধবোধ জাগারও সুযোগ থাকলো না।
০৩. না- বলার পরে ক্ষমা চাইবেন না
না বলার পর ক্ষমা না চাওয়াটা আপনার কাছে প্রথম প্রথম অস্বস্তিকর লাগতে পারে। কিন্তু কিছুদিন অভ্যাস করলেই ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
আপনাকে বুঝতে হবে যে, যদি আপনি কাউকে কোনও ব্যাপারে সাহায্য করতে অপারগ হন, তবে আপনার ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। আপনি তো মিথ্যা বলেননি। ক্ষমা চাওয়ার মানে হলো, আপনি অপরাধ করেছেন, এবং সঠিক কারণে কাউকে ‘না’ বলাটা কোনও অপরাধ না। আপনি ক্ষমা চাইলে একে তো আপনার নিজের মাঝে অপরাধবোধ জাগবে, সেইসাথে যাকে না বলছেন – সে-ও ভাববে যে, আপনি চাইলে কাজটি করে দিতে পারতেন।
এখানে বলে রাখি, আপনার হয়তো মনে হচ্ছে আপনি ক্ষমা না চাইলে সে কষ্ট পেতে পারে। কিন্তু আপনি যদি আগের টিপসটি ফলো করে একটি বিকল্প সমাধান অফার করেন, তাহলে আর এই সমস্যাটি দেখা দেবে না। হয়তো আপনার কোনও বন্ধু আপনাকে ফোন করে বলল যে তারা কয়েকজন মিলে আপনার আরেক বন্ধুর জন্মদিনের সারপ্রাইজ পার্টির প্ল্যান করছে, আপনারও সেখানে থাকা দরকার। কিন্তু আপনি সেই মূহুর্তে খুব জরুরী একটা প্রেজেন্টেশন বা পেপার রেডি করছেন। আপনি বলতে পারেন, এখন আপনার পক্ষে আসা সম্ভব না, কিন্তু কাল বার্থডে কেকটি আপনি কিনে আনবেন। – এতে আপনার বন্ধু মন খারাপ করবে না। কিন্তু আপনি যদি আসতে পারবেন না বলার পর আবার ক্ষমা চান, তাহলে সে ভাববে আপনি না আসার জন্য অজুহাত দিচ্ছেন।
০৪. কেন ‘না’ বলতে পারছেন না, তা খুব ভালভাবে বোঝার চেষ্টা করুন
আপনি যদি ভালভাবে বুঝতে পারেন যে কেন আপনার না বলতে এত সমস্যা হচ্ছে, তবে ব্যাপারটা সামলানো আপনার জন্য আরও সহজ হয়ে যাবে। ঠিক কোন কারণে আপনি ‘না’ বলতে পারেন না, তা খুব মন দিয়ে ভাবুন।
হতে পারে, অন্যের চোখে আপনি নিচে নেমে যাবেন, অথবা আপনাকে মানুষ খারাপ ভাবতে পারে – এই ভয়ে আপনি ‘না’ বলতে পারেন না। নাকি অন্য কোনও কারণ?
খুব ভালভাবে ভেবে কারণটি খুঁজে বের করুন। এরপর ভেবে দেখুন যে আপনার ‘না’ শুনে, আসলেই কেউ আপনার ওপর রাগ করছে অথবা কষ্ট পাচ্ছে কি না। যদি এমনটাই হয়, তবে জেনে রাখুন আপনার সেইসব বন্ধু আসলে শুধু নিজেদেরটাই চিন্তা করে। আপনাকে নিয়ে তাদের তেমন কোনও চিন্তা নেই। এমন বন্ধু থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল।
অন্যদিকে তারা যদি সত্যিকারেই আপনার ভালো চায়, তবে আপনার অসুবিধার কথা বুঝে তারা নিজেরাই বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে নেবে। এবং আপনার ওপর রাগও করবে না, বা কষ্টও পাবে না। আর আপনি যদি ঠিকমত বুঝতে পারেন যে কোন কারণে আপনার না বলতে সমস্যা হয়, তবে অন্যদের রিএ্যাকশন বোঝাও আপনার পক্ষে সহজ হয়ে যাবে।
০৫. নিজের মূল্য বুঝুন
আপনার নিজের মূল্য কতটা, তা আপনার খুব ভাল করে বুঝতে হবে। ‘না’ বলতে না পারার একটি বড় কারণ অনেকেই নিজেকে অন্যের চোখ দিয়ে মাপে। অন্যের কাছে ভালো মানে নিজে ভালো, অন্যের চোখে খারাপ মানেই নিজে খারাপ। এই ধরনের মনোভাব আসলে আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়। অনেকেই চান না অন্যরা তার ওপরে বিরক্ত হোক, বা অপছন্দ করুক, বা তার ওপরে কোনও কারণে হতাশ হোক। কিছু মানুষের জীবনের একমাত্র চাওয়াই অন্যদের কাছে পছন্দের পাত্র হওয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো একজন মানুষের পক্ষে এটা অসম্ভব।
যাই হোক, আপনি যদি অন্যদের চোখে নিজের অবস্থানকে আদর্শ ধরে আপনার নিজেকে পরিমাপ করেন, তাহলে বলতে হয় আপনি নিজের মতামতের থেকে অন্যদের মতামত ও মনোভাবকে বেশি গুরুত্ব দেন। এ থেকে আরও বোঝা যায় যে আপনি নিজের থেকে অন্য যে কাউকে ওপরে স্থান দেন। এটা হতেই পারে যে আমরা আমাদের পিতা মাতা বা কোনও গুরুর চোখে নিজেদের প্রমান করতে চাইবো। কিন্তু এটা যদি সবার ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে আপনার মাঝে আত্মসম্মানের ঘাটতি আছে। প্রতিটি মানুষের নিজস্ব প্রতিভা আর মূল্য আছে। আপনি যদি নিজের মূল্য না বুঝতে পারেন, তবে আপনার মূল্যও কেউ বুঝবে না। আপনাকে বুঝতে হবে আপনার নিজের কাজ ও ব্যক্তিত্বের একটি অনন্য মূল্য আছে। সবার আগে আপনার নিজেকে সম্মান করতে হবে। অন্যের কাজ করে দেয়ার মাঝে একটি মহত্ব নিশ্চই আছে, তবে তা যদি হয় তার কাছে ছোট হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য নিজের সময় নষ্ট করা – তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনাকে সেই জাল কেটে বের হয়ে আসতে হবে। আপনাকে বুঝতে হবে, অন্যের মতামত আপনাকে সঠিক ভাবে কখনওই সংজ্ঞায়িত করতে পারবে না। আপনার নিজেকে বুঝতে হবে আপনার নিজের ও আপনার কাজের মূল্য কতটা। মানুষের কাজই মানুষকে বড় করে, তাই সবার আগে নিজের কাজকে প্রাধান্য দিন। নিজের ইচ্ছাকে মূল্য দিন। তাহলে দেখবেন ‘না’ বলাটা আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে গেছে।
০৬. কি বলবেন আগে থেকেই ঠিক করে রাখুন
আপনার যদি আগে থেকেই জানা থাকে যে আপনাকে কেউ এমন কিছু করতে বলতে পারে, যা করা আপনার জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে – তবে কি উত্তর দেবেন, তা আগেই ঠিক করে রাখুন। হঠাৎ করে কিছু বলতে গেলে অনেক সময়ে আমরা ঠিকমত বুঝিয়ে বলতে পারি না। আর সেই অবস্থায় কাউকে ‘না’ করতে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা হয়। তাই আপনারও যদি এমন কোনও সমস্যা থাকে, তবে আপনার উচিৎ কথাগুলো আগে থেকে গুছিয়ে রাখা। এতেকরে না করাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। প্রয়োজনে আয়নার সামনে প্রাকটিস করুন, যাতে কথাটা শোনা মাত্র জবাব দিতে পারেন। তবে, এটা যে আপনি প্রাকটিস করেছেন, সেটা যেন সামনের মানুষটি বুঝতে না পারে।
শেষ কথা:
শুধুমাত্র না বলতে না পারার জন্য আমাদের জীবনের অনেক সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। অনেক মূল্যবান কাজের সময় হারিয়ে যায়।
আপনার হাতে অলরেডি যদি অনেক কাজ থাকে, তবে চেষ্টা করুন তার মধ্যে অন্য কিছু না ঢোকাতে। যদি হাতে কিছুটা সময় বাড়তি থাকে, তবে হ্যাঁ বলতে পারেন। কিন্তু এটাও জেনে রাখুন, আপনি চাইলে তখনও ‘না’ বলতে পারেন। সময় আপনার, না- বলার অধিকারও আপনার, এতে নিজেকে অপরাধী ভাবার কোনও কারণ নেই। সবার সব কিছু করতে গেলে আপনার নিজের কাজই করা হবে না। কোনটা বেশি জরুরী, আর কোনটা কম জরুরী – তা ঠিকমত বিচার করতে পারলে, না-বলাটা আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে।
আশাকরি লেখাটি আপনার একটু হলেও কাজে লেগেছে। লেখাটির ব্যাপারে আপনার মতামত আমাদের কমেন্টের মাধ্যমে জানান। আপনার যদি মনে হয় লেখাটি মানুষের কাজে আসবে, শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন। সফলতার পথে এগিয়ে যাক প্রতিটি মানুষ এটাই আমাদের উদ্দেশ্য।