অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, একজন মানুষের জীবনের সাফল্য, শান্তি, সম্পর্ক আর উন্নতির ক্ষেত্রে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার গড় (EQ) তার মোট সাধারন বুদ্ধিমত্তার গড় বা IQ এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আজ আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা কি, এবং নেতিবাচক আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার উপায় হিসেবে এটা কিভাবে কাজে লাগে তা বিস্তারিত জানবো। তবে সেই আলোচনার আগে চলুন একটি গল্প শোনা যাক:
“ইসমাইল সাহেবের EQ” গল্পের প্রথম অংশ:
সকাল থেকে ইসমাইল সাহেবের মেজাজ বেশ খানিকটা খারাপ। কিছুই ভালো লাগছে না।
শুরুটা অবশ্য গতরাত থেকেই হয়েছে। তিনি এমন অবাক আর অপ্রস্তুত খুব কমই হয়েছেন।
গতরাতে স্ত্রী তাঁর ওপর সামান্য কারণে ভয়ানক চিল্লাপাল্লা করেছেন, যার রেশ আজ সকালেও ছিল। এই সামান্য ব্যাপারে যে মলি বেগম সকালেও রেগে থাকবেন, ব্যাপারটা অদ্ভূত।
হঠাৎ করে ব্যাপারটা শুরু হওয়ার আগে তিনি ভাবতেও পারেননি এত সামান্য কারণে তাঁর স্ত্রী তাঁর ওপর এভাবে চড়াও হবেন। আসলে সপ্তাহখানেক হলো, বিরানব্বই হাজার টাকা দিয়ে একটা বিদেশী কুকুর এনে মহিলা সেটাকে নিয়ে সারাদিন আদিখ্যেতা করেন।
প্রথম দিকে ব্যাপারটা চোখে না বাধলেও ইদানিং সেটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে। বাসার কাজের মানুষরাও আড়ালে আবডালে এটা নিয়ে হাসাহাসি করে। ইসমাইল সাহেবের চোখ কান খুব খোলা থাকায়, বিষয়টি তাঁর নজর এড়ায়নি। রাতে খাবার সময়ে তিনি খুব শান্ত ভাবেই কুকুর নিয়ে মলি বেগমের এই বাড়াবাড়ির কথা পাড়লেন। তিনি বোধহয় দশটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারেননি, মহিলা ভয়ানক চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন।
ইসমাইল সাহেবের অতি প্রিয় পাবদা মাছের তরকারী তাঁর মুখে কাঁচা করলার মতো লাগতে শুরু করল। তবে তিনি সেই মূহুর্তে স্ত্রীকে কিছু বললেন না। বললে যে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো, সেই ব্যাপারে তাঁর কোনও সন্দেহ ছিল না। সংসারের পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য তিনি একটি বিষয় মেনে চলেন। ব্যাপারটা অবশ্য অঘোষিত। তিনি যদি স্ত্রীর মতামতকে পাশ কাটিয়ে একটা কিছু করেন, পরে স্ত্রীকেও একটি ব্যাপারে ছাড় দিয়ে দেন। এই যেমন, তিনি কুকুর দুই চোখে দেখতে পারেন না – কিন্তু আগের ঘটনায় তিনি জোর করে মতামত প্রতিষ্ঠা করেছেন বিধায় এই ব্যাপারে স্ত্রীকে তাঁর মনমতো কাজ করতে দিয়েছেন। আগের ঘটনাটা কি – সেটা যথাসময়ে বলা হবে।
কাল রাতের ঝড়ের পর সকালে উঠেও দেখলেন স্ত্রীর চেহারা অন্ধকার হয়ে আছে। ইসমাইল সাহেব খুবই অবাক হলেন। পনেরো বছরের সংসার জীবনে তাঁর স্ত্রী আগে কখনও এমনটা করেছেন বলে তাঁর মনে পড়ে না। তিনি মলি বেগমের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন – কিন্তু মলি বেগম গম্ভীর হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এবার ইসমাইল সাহেবের মেজাজও খারাপ হতে শুরু করলো। বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ে সেই কুকুরটি তাঁর সামনে পড়লো। তিনি কষে সেটাকে একটা লাথি মেরে দিলেন। বিরানব্বই হাজার টাকার গায়ে লাথি দিতে বুকের পাটা লাগে। ইসমাইল সাহেবের সেই বুকের পাটা আছে। তাঁর মোট টাকার পরিমান বিরানব্বই লক্ষ টাকারও বেশি। যে জুতা দিয়ে তিনি লাথি মেরেছেন, তার দাম তাঁর ড্রাইভার নজরুলের এক মাসের বেতনের সমান। ঘটনার একমাত্র উপস্থিত সাক্ষী নজরুল খুবই অবাক হয়ে স্যারের এই কান্ড দেখলো। এতদিনের ড্রাইভারি জীবনে সে স্যারকে এমন থমথমে আর রাগী অবস্থায় দেখেননি। রাস্তায় বের হবার পর দেখা গেল, ভয়াবহ জ্যাম। তাঁকে সকাল দশটার মধ্যে জেড এক্স লিমিটেডের অফিসে পৌঁছাতে হবে। তাঁর ব্যবসায়িক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় কনট্র্যাক্টটির জন্য আজ তাঁকে সেখানে প্রেজেন্টেশন দিতে হবে।
একটু গড়মিল হলে এতবড় ডিলটা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। এমনিতেই মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। জ্যামে বসে থাকতে থাকতে তাঁর মেজাজ আরও চড়ে যেতে লাগলো। ওদিকে নজরুল বেশি চালাকি করতে গিয়ে গাড়িকে আরও জটিল অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। গাড়ি এগুতেও পারছে না, পেছাতেও পারছে না। তাঁর ইচ্ছে হলো নজরুলকে একটা কড়া ধমক দিতে। কিন্তু সেটা তিনি করলেন না, কারণ এতে নজরুল আরও বেশি ভড়কে যাবে – গাড়ি চালাতে তার আরও বেশি অসুবিধা হবে। ইসমাইল সাহেব আজকের প্রেজেন্টেশন নিয়ে ভাবতে লাগলেন। কিন্তু চিন্তা ভাবনা সব এলোমেলো হয়ে আছে। বারবার বাসার ঝামেলার কথা আর জ্যামের কথা মনে হচ্ছে। ঘাড়ের কাছটায় একটা জ্বলুনি অনুভব করছেন। তিনি বুঝলেন এই মূহুর্তে কাজের বিষয় চিন্তা করতে গেলে মাথা কাজ করবে না। আর এই জ্যাম ছাড়ানোর ক্ষমতা তাঁর নেই, তাই শুধু শুধু মেজাজ খারাপ করার কোনও মানে হয় না। তিনি চোখ বন্ধ করে মাথাটাকে একদম চিন্তা মুক্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। মাঝে মাঝে স্ত্রীর রাগের চিন্তা তাঁর মাথায় এল। নিশ্চই মলির আচরণের কোনও কারণ আছে, কিন্তু কি সেই কারণ? – “এটা নিয়ে চিন্তা পরে করলেও চলবে, এখন আগের চিন্তা আগে” – নিজেকে এই বলে তিনি চোখ বন্ধ করে সব চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। দশ মিনিট পর মনে হলো, ঘাড়ের কাছের জ্বলুনিটা চলে গেছে। মাথাটাও একটু ভালো কাজ করছে। জ্যাম ছেড়ে দিলো, তিনি কাজের কথা চিন্তা করতে করতে চললেন। — গাড়ি যখন গন্তব্যে পৌঁছালো, তখন এগারোটা।
ইসমাইল সাহেব একটু নার্ভাস বোধ করতে লাগলেন। তবে সেটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামালেন না – এখন তো আর কিছু করার নেই। শুধু শুধু টেনশন করে লাভ কি? তিনি অল্প কথায় জেড এক্স এর লোকদের তাঁর দেরির কারণ বুঝিয়ে বলে প্রেজেন্টেশন শুরু করলেন। তাঁর ভয় ছিল যে বাসার চিন্তা এই কাজে আবার বাধার সৃষ্টি না করে। কিন্তু তিনি সেই চিন্তাকে কাছে ঘেঁষতে না দিয়ে একদম প্রফেশনাল ভাবে, পুরো ফোকাস রেখে প্রেজেন্টেশন শুরু ও শেষ করলেন। শেষ করে ক্লায়েন্টের প্রতিক্রিয়া আর কথাবার্তায় বুঝলেন কাজটা তিনি পেয়ে যাবেন। খুশি মনে তিনি নিজের অফিসের দিকে যাত্রা করলেন।
এই যে ইসমাইল সাহেব বাজে ভাবে একটি দিনের শুরু করেও সফল ভাবে তাঁর কাজ করতে পারলেন, এর পেছনে কোন জিনিসটি তাঁকে সবচেয়ে সাহায্য করেছে বলতে পারেন? – এর নাম আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বা Emotional Intelligence; এই ব্যাপারটি স্পষ্ট করে বোঝাতেই আসলে এত বড় গল্প বলা। বিষয়টি জানতে জানতে আপনি ইসমাইল সাহেবের ঘটনাগুলোকে মেলাতে পারবেন। এটা আপনাকে পুরো ব্যাপারটি বুঝতে ও কাজে লাগাতে দারুন সাহায্য করবে।
লেখাটির শেষে ইসমাইল সাহেব আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করে কি কি সমস্যা সমাধান করেছেন – তা নির্দিষ্ট করে আপনি জানতে পারবেন। যাতে আপনি নিজেও এই ধরনের পরিস্থিতিতে এগুলো কাজে লাগাতে পারেন।
কিন্তু তাঁর স্ত্রীর সাথে ঝামেলার কি হল? তিনি এর আগে স্ত্রীর কথার বাইরে গিয়েই বা কি করেছিলেন?
এটা আমরা যথাসময়ে জানবো। এটাও তিনি দারুন ভাবে সমাধান করেছেন। কিন্তু সেটা জানার আগে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার বেসিক বিষয়গুলো জেনে নিলে আপনার জন্য অনেক সুবিধা হবে। চলুন সেটাই আগে জেনে নেয়া যাক।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বা ‘Emotional Intelligence’ আসলে কি?
২০ শতকের মধ্যভাগের আগে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বা emotional intelligence কথাটির উৎপত্তি। প্রথমে একে বলা হত, সামাজিক বা যোগাযোগ বুদ্ধিমত্তা (social intelligence), ১৯৩০ এর দিকে বলা হত আবেগীয় ক্ষমতা (emotional strength) – তবে যে নামেই ডাকা হোক, বিষয় মোটামুটি একই। তবে দিনে দিনে এই বিষয়টি সম্পর্কে ধারনা স্পষ্টতর হওয়ার কারণে তার সাথে মানানসই নামকরণ করা হয়েছে।
মোটামুটি ভাবে, একজন মানুষের নিজের ও অন্যের আবেগ বুঝতে পারা, এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সেই আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে ও কাজে লাগিয়ে লক্ষ্য অর্জন করার ক্ষমতার নামই আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা।
বিস্তারিত ভাবে বলতে গেলে, এটি আমাদের নিচের কয়েকটি কাজ করার ক্ষমতা:
১. নিজের আবেগ এবং সেই আবেগের প্রতিক্রিয়াকে নির্দিষ্ট ভাবে চিনে নেয়ার ক্ষমতা (আত্ম সচেতনতা)
২. নিজের আবেগ, মুড এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের প্রতিক্রিয়াকে (reaction) নিয়ন্ত্রণ ও ম্যানেজ করার ক্ষমতা (আত্ম নিয়ন্ত্রণ)
৩. পজিটিভ বা ইতিবাচক আবেগগুলোকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে দিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করানো ও লক্ষ্য অর্জন করানোর ক্ষমতা (মোটিভেশন)
৪. অন্যদের আবেগ-অনুভূতিকে সঠিক ভাবে বুঝতে পারা ও সেগুলো কাজে লাগিয়ে তাদের সাথে আরও ভালোভাবে সম্পর্ক স্থাপন করার ক্ষমতা (সহানুভূতি)
৫. অন্যদের ও নিজের অনুভুতি বুঝে যে কোনও পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিয়ে সামাজিক পরিবেশে মেশা, অন্যদের নেতৃত্ব দেয়া, বিবাদ মেটানো, এবং কোনও টিমের অংশ হয়ে কাজ করার ক্ষমতা। (সামাজিক দক্ষতা)
যেসব কারণে মানুষের মাঝে উচ্চ আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা থাকা জরুরী:
আপনি যদি ভেবে থাকেন যে, যাদের সব সময়ে অন্যদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে হয় আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা শুধু তাদেরই দরকার – তাহলে আরেকটু গভীর ভাবে চিন্তা করুন।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা আসলে একটি গোছানো জীবনের উপায়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আপনার এটির প্রয়োজন হতে পারে। আপনার বোঝার সুবিধার্থে জীবনযাপনের কয়েকটি দিকে এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছি। তবে এর বাইরেও অনেক ক্ষেত্রেই আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা আপনাকে সাহায্য করবে।
শারীরিক সুস্থতা:
আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত মানসিক চাপ আসে। প্রতিদিনই আমরা ছোট বড় মানসিকচাপ সামলাই। এই মানসিক চাপ আমাদের শারীরিক সুস্থতার ওপর অনেক বড় প্রভাব ফেলে।অনেক মানুষ সবকিছু ঠিক থাকার পরও শুধু এই মানসিক চাপ না সামলাতে পেরে শারীরিক ভাবে পুরো সুস্থ থাকতে পারেন না।
একজন মানুষের emotional intelligence যত বেশি থাকবে, তার মানসিক চাপকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও তত বেশি হবে। আর মানসিক চাপ যত কম থাকবে, আপনার সুস্থ থাকার সম্ভাবনাও ততই বেড়ে যাবে। হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ সহ বেশ কিছু বড় বড় রোগের মূল কারণই কিন্তু মানসিক চাপ।
মানসিক সুস্থতা:
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা জীবনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীকে আর আচরণকে প্রভাবিত করে। জীবন সব সময়ে একই তালে চলে না। এখানে সুখের মূহুর্ত যেমন আসে, তেমনি আসে হতাশা আর বেদনার মূহুর্ত। হতাশা, নিজের অনুভূতির ওপর নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারা – ইত্যাদি আমাদের মাঝে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে। এর কোনওটা ছোট, আবার কোনওটা জীবনের গতিপথই বদলে দেয়।
তাই নিজের মানসিক সুস্থতার জন্য বিভিন্ন ঘটনায় নিজের মাঝে জন্ম নেয়া আবেগ আর দৃষ্টিভঙ্গীকে নিয়ন্ত্রণ করাটা জরুরী। নিজের আবেগ আর অনুভূতির কারণ বুঝতে পারা, এবং সেগুলোকে প্রশ্রয় দেয়া কতটা যৌক্তিক তা বুঝে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আবেগ আমাদের ওপর খারাপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
সুসম্পর্ক:
আমাদের জীবনের সুখ শান্তি, এবং সাফল্য অনেকটাই আমাদের সম্পর্কগুলোর ওপর নির্ভরশীল। নিজের ও অন্যের আবেগ অনুভূতি বুঝে সেই অনুযায়ী আচরণ করতে পারলে আমাদের সম্পর্কগুলো আমরা অনেক ভালোভাবে ধরে রাখতে পারবো। সেই সাথে নতুন নতুন সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রেও আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার এই দিকটি দারুন ভাবে সাহায্য করে।
বিতর্ক ও বিবাদ দূর করা:
অপরের আবেগ ও চিন্তাধারা যদি ঠিকমত বোঝা যায়, তবে তার সাথে বিতর্ক ও বিবাদ দূর করা, এবং শুরুর আগেই তাকে এড়ানোর সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। বিচক্ষণ মানুষ বিতর্কে জেতার বদলে বিতর্ক এড়ানোতে তার বুদ্ধিকে বেশি কাজে লাগায়। অপর পাশের মানুষটি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে তার মতামত দিচ্ছে – এটা বুঝলে অনেক ভুল বোঝাবুঝি এড়ানো সম্ভব।
আর এই বিচক্ষণতার একটি মূল উপাদানই হল উচ্চ আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা। কারও কারও মতে, এটাই আসলে একজন মানুষের বিচক্ষণতার মাপকাঠি।
সাফল্য:
আপনি যে ক্ষেত্রেই সাফল্য চান না কেন, আপনার মাঝে যদি উচ্চ মাত্রার আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা থাকে, আপনার সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যাবে।
অন্যদের মানসিকতা বুঝতে পারার ক্ষমতার কারণে যেমন আপনি আরও ভালোভাবে তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন, এবং নিজের মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন; – তেমনি নিজের আবেগের ব্যাপারে সচেতন থাকা ও এর ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকলে নিজের আচার আচরণ, অভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করা আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে।
যে কোনও ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে গেলে একাগ্র মনযোগ ও পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়। অনেক সময়ে যথেষ্ঠ জ্ঞান ও দক্ষতা থাকার পরও আমরা নিজেদের মুডকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে কাজে মনযোগ দিতে পারি না। অনেক সময়ে নিজের ইচ্ছার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আমরা কাজে ঢিলেমি বা দীর্ঘসূত্রিতা করে নিজেদের সাফল্যের সম্ভাবনাকে নিজেরাই শেষ করে দিই। অনেক সময় লক্ষ্য অর্জনের পথে প্রাথমিক ব্যর্থতার পরই আমরা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিই। এই ক্ষেত্রে নিজেকে অনুপ্রাণিত করে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার জন্যও আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা অনেক সহায়ক হয়। আপনার মাঝে যদি আত্ম নিয়ন্ত্রণের গুণ থাকে, তবে আপনি নিজের আবেগ ও ইচ্ছার লাগাম টেনে ধরে নিজেকে সাফল্যের পথে পরিচালিত করতে পারবেন।
নেতৃত্ব:
সার্থক নেতা হওয়ার প্রধান শর্তই হলো অনুসারীদের অনুভূতি ও তাদের চাওয়া পাওয়া বুঝতে পারা, এবং সেই অনুযায়ী তাদের পরিচালিত করা।
কোন বিষয়টি টিম মেম্বার অথবা অনুসারীদের সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে সেটা বুঝে তাকে ইতিবাচক ভাবে কাজে লাগানো, এবং তাদের সাথে একটি দৃঢ় বন্ধন সৃষ্টি করার পেছনে একজন নেতার আবেগীয় বুদ্ধিমত্তাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
একজন কার্যকর নেতা তাঁর অনুসারীদের প্রয়োজনগুলো খুব ভালোভাবে বুঝতে পারেন এবং সেগুলোর সমাধান এমন ভাবে করেন, যে তাঁর টিমের সদস্য বা কর্মক্ষেত্রের কর্মীদের কাজের উৎসাহ অনেক বেড়ে যায়। একজন উচ্চ আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন নেতার পক্ষে সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ও কার্যকর টিম গড়া সম্ভব।
উচ্চ আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা কি জন্মগত, নাকি এটা অর্জন করা সম্ভব?
হাই আইকিউ বা উচ্চ সাধারণ বুদ্ধিমত্তা মূলত জন্মগত। ক্ষেত্রবিশেষে এটা বাড়ানো সম্ভব, তবে বিষয়টি ততটা সহজ নয়। অন্যদিকে উচ্চ আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বা ‘ই-কিউ’ কিছু বিষয় চর্চা করলে বেশ সহজেই অর্জন করা ও বাড়ানো যায়।
এর আরও একটি ভালো দিক হল, এটা বাড়ানোর কোনও বয়স সীমা নেই। বরং বয়স ও অভিজ্ঞতার সাথে স্বাভাবিক ভাবেই এর মাত্রা বাড়ে।
Emotional intelligence অর্জন ও চর্চার ক্ষেত্রে নিচের ৪টি টিপস বেশ কাজে আসে:
০১. নিজের অনুভূতির দিকে সচেতন নজর রাখুন
আমাদের মধ্যে যখন কোনও অনুভূতির জন্ম হয়, আমরা তখন বেশির ভাগ সময়ে সেই অনুভূতির বিপরীতে কি প্রতিক্রিয়া দেখাবো – সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। অনুভূতির দিকে সত্যিকার অর্থে তাকাই না।
আবার কোনও নেতিবাচক অনুভূতির জন্ম হলে, আমরা গোড়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা না করে তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার বা তাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করি
আবার কোনও নেতিবাচক অনুভূতির জন্ম হলে, আমরা গোড়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা না করে তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার বা দমিয়ে রাখার চেষ্টা করি। দীর্ঘ মেয়াদে এটা আসলে পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যায়। আমরা আমাদের আবেগ যত চেপে রাখার চেষ্টা করবো, ততই সে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
যখনই আমরা কোনও ব্যাপারে ইমোশনাল রিএ্যাকশন দেখাই, বেশিরভাগ সময়েই এর কারণ হয় কোনও সমাধান না হওয়া সমস্যা। কাজেই এর পর যখনই আপনি আপনার মাঝে কোনও নেতিবাচক অনুভূতির জন্ম নেবে – সেটার প্রতিক্রিয়ায় কিছু করার আগে চিন্তা করুন ঠিক কি কারণে আপনার এই প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। আপনার কাছে বিষয়টি কঠিন মনে হতে পারে। তবে এটা চেষ্টা করলে দেখবেন, কাজটা বেশ সহজই। আরেকটু সহজ করার জন্য ঠান্ডা মাথায় বসে বড় বড় করে কয়েকবার বুক ভরে শ্বাস নিন। এরপর একটি কাগজে আপনার অনুভূতির বর্ণনা ও তার সম্ভাব্য কারণ লিখুন।
লিখে ফেলার পর আপনি আপনার আবেগ আর তার কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট একটি ধারণা পাবেন। এবং সেই কারণকে দূর করার জন্য যে আপনার আবেগীয় প্রতিক্রিয়া যথেষ্ঠ নয় – সেটাও বুঝতে পারবেন। এতে করে আপনি প্রতিক্রিয়া দেখানোর চেয়ে সমস্যা সমাধানে বেশি মনযোগী হবেন। যদি সমাধান আপনার হাতে থাকে, তবে আপনি তা করার পদক্ষেপ নিতে পারবেন। আর যদি তা না হয় – তবে আপনি বুঝতে পারবেন যে, শুধু শুধু প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আসলে কোনওই লাভ নেই। তাতে নিজের কষ্ট আর মানসিক চাপই বাড়ে। এই সময়টাকে আপনি ভালো কিছুর জন্য কাজে লাগাতে পারবেন।
এই পদ্ধতি অনুশীলন করতে করতে একটা সময়ে আপনার আর কাগজ কলমের প্রয়োজন হবে না। নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগে, আপনার মাথায় এমনিতেই এর কারণগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। অহেতুক রাগ দেখানো, দু:খ পাওয়া বা মন খারাপ করে থাকা, হতাশ হওয়া – ইত্যাদি নেতিবাচক বিষয় আপনার থেকে অনেক দূরে চলে যাবে। সেখানে জায়গা করে নেবে দারুন এক বিচক্ষণতা।
০২. নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখান
কোনও ঘটনা বা পরিস্থিতিতে আমরা সাধারণত আমাদের আবেগকে প্রকাশ করি। এটা আমরা সচেতন ভাবে করি না। এটা অনেক সময়েই আমাদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে শত আফসোস করেও বেশিরভাগ সময়ে এই ক্ষতি পোষানো যায় না। এর বদলে আমরা যদি কোনও আবেগ-অনুভূতি মনের মাঝে উপস্থিত হলে তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার ফলাফল নিয়ে একটু চিন্তা করি এবং তা নিয়ন্ত্রণ করে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারি – তবে সহজেই অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব।
আপনি যদি বোঝেন যে আপনার নেতিবাচক বা Negative প্রতিক্রিয়াগুলো কোন কোন পরিস্থিতিতে বেশি প্রকাশ পায় – তাহলে সেইসব পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রস্তুতি আগেই নিয়ে রাখতে পারবেন।
মনে করুন আপনি খুব সহজেই রেগে যান। বিশেষ করে কোনও মানসিক চাপের মাঝে থাকলে আপনার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, এবং আপনি প্রায় সবার সাথেই বাজে ব্যবহার করেন। তবে পরবর্তীতে এটা নিয়ে আপনার আফসোস হয় – কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েই যায়।
এর সমাধানে আপনাকে খুব ভালোমত ভেবে দেখতে হবে যে কোন কোন পরিস্থিতিতে আপনার রাগ বেশি হয়। এবং এর ফলে আপনার কি কি ক্ষতি হতে পারে। এগুলো ভেবে নেয়ার পর, আপনি ভেবে দেখুন রাগ প্রকাশ করার বদলে আপনি আর কি করতে পারেন।
এই ক্ষেত্রে, যার ওপর আপনি অহেতুক রাগ ঝাড়ছেন – তার মানসিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে একটু চিন্তা করুন। এবং এই প্রতিক্রিয়ার ফলে তার সাথে আপনার সম্পর্কের কি ক্ষতি হচ্ছে সেটাও ভেবে বের করার চেষ্টা করুন।
অহেতুক রাগ ঝাড়ার বদলে আপনি খুব ঠান্ডা মাথায় তাকে বলতে পারেন যে আপনার এখন ভালো লাগছে না – সে যেন একটু পরে এসে আপনার সাথে কথা বলে, অথবা আপনি নিজেই তার কাছে যাবেন।
অহেতুক রেগে যাওয়ার অভ্যাস থাকলে, রাগ ওঠার সাথে সাথে মুখে একটা হাসি এনে ফেলতে পারেন। এটা খুবই কাজে দেয়। আপনার যদি অফিসে রাগারাগি করার অভ্যাস থাকে, তবে আপনার ডেস্কে সুন্দর একটি ফুলের গাছ, অথবা দেয়ালে বা টেবিলে খুব সুন্দর কোনও দৃশ্যের ছবি রাখতে পারেন। যখনই বুঝতে পারবেন যে আপনার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে – সাথে সাথে আপনার সমস্ত মনযোগ সেই সুন্দর দৃশ্যের ওপর দিন। এতে আপনার রাগ অনেকটাই কমে যাবে।
আপনি যদি খুব অল্পতেই হতাশ হয়ে পড়েন – তবে এমন কোনও ঘটনা ঘটলেই, আপনার জীবনের সবচেয়ে ভাল দিক গুলো নিয়ে চিন্তা করুন। অন্য অনেক মানুষের তুলনায় আপনি কতটা ভালো আছেন – তা নিয়ে চিন্তা করুন। আপনার চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি থেকে উঠে এসে বহু মানুষ অনেক বড় বড় অর্জন করেছেন – তাদের কথা ভাবুন। দেখবেন মন আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এসেছে।
অন্য সবকিছুর মত নিজের অনুভূতির প্রতিক্রিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারাও একটা চর্চার ব্যাপার। একবারে এটা রপ্ত করা যায় না। তবে চর্চা করতে থাকলে একটা সময়ে এটা আপনার স্বভাবের অংশে পরিনত হবে।
০৩. বিনয়ী থাকার চেষ্টা করুন
আপনার মাথায় যখন এই ভাবনা থাকবে যে, আপনি অন্যদের চেয়ে ভালো, অথবা আপনি সবার চেয়ে বেশি জানেন বা বোঝেন – তখন আপনার পক্ষে নিজের ভুল ধরা প্রায় অসম্ভব। কেউ আপনার কোনও ভুল বা কমতি ধরিয়ে দিলে, বা আপনার বিপক্ষে যুক্তি দিলে সেটা খতিয়ে দেখার বদলে আপনি আবেগী হয়ে পড়বেন। আপনার মাঝে অভিমান, রাগ, হতাশা ইত্যাদি নেতিবাচক আবেগী প্রতিক্রিয়া বেশি করে জন্ম নেবে।
কিছু মানুষ নিজেদের অন্যদের চেয়ে বুদ্ধিমান ও দক্ষ ভাবে, এবং কিছু ক্ষেত্রে সেটা সত্যিও। কিন্তু নিজেকে বড় ভাবা এই মানুষগুলোর আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা খুবই নিন্ম পর্যায়ের। একারণে এমন অনেকেই যথেষ্ঠ প্রতিভা ও দক্ষতা থাকার পরও তেমন কিছু অর্জন করতে পারে না।
আপনার মাঝে যদি এমন সমস্যা থেকে থাকে, তবে আপনাকে প্রথমেই যেটা করতে হবে, সেটা হচ্ছে নিজের ইগোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। মানুষ মাত্রই ভুল করে, আপনারও ভুল হতে পারে – এটা সব সময়ে মাথায় রাখতে হবে। নিজের ভুল ধরতে ও স্বীকার করতে না পারলে আপনি যেখানে আছেন, সেখানেই থেমে থাকবেন। নিজের কমতিগুলো দূর করার জন্য নিজের ভুল বুঝতে পারার কোনও বিকল্প নেই।
যে কোনও বিষয়কে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখার চেষ্টা করুন। একজন আপনাকে একটি কথা বললে – সে কি বলল, তার ওপর ফোকাস করে প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগে, সে ‘কেন’ কথাটি বলল – তার ওপর ফোকাস করুন, এবং অপর ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গী বোঝার চেষ্টা করুন।
এই প্রক্রিয়ায় আপনি অন্যের চিন্তা ও অনুভূতিকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন, এবং তা কাজে লাগিয়ে অন্যদের সাথে আরও ভালোভাবে সম্পর্ক গড়তে পারবেন।
প্রতিটি মানুষ প্রতিটি মানুষের চেয়ে আলাদা। আপনি অন্যদের চেয়ে ভালো, এই চিন্তা করার বদলে চিন্তা করুন, আপনি অন্যদের চেয়ে আলাদা, এবং অন্যরাও আপনার চেয়ে আলাদা। প্রত্যেকের আলাদা দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে – সেগুলোকে বুঝুন ও সম্মান দেখান। এভাবে মানুষ আপনাকেও সম্মানের চোখে দেখবে, এবং আপনার মতামতের গুরুত্ব দেবে।
যোগাযোগ একটি দ্বিপাক্ষিক বিষয়। আপনি যখন অন্যের কথার গুরুত্ব দেবেন, তার বিনিময়ে আপনার কথাও গুরুত্ব পাবে।
০৪. নিয়ন্ত্রিত ভাবে আবেগের প্রতিক্রিয়া দেখানোর চেষ্টা করুন
কখনও কখনও আবেগ আমাদের এমন ভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে, যে সেটা না প্রকাশ করতে পারলে আমাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। ইতিবাচক আবেগের ক্ষেত্রে তা প্রকাশ করায় কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু নেতিবাচক আবেগ, যেমন রাগ, ক্ষোভ, হিংসা, হতাশা – এগুলোর প্রকাশ হওয়া উচিৎ নিয়ন্ত্রিত। এগুলো যদি একদমই আপনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, এবং এটা প্রকাশ না করার ফলে আপনার মানসিক যন্ত্রণা হয় – তবে এগুলো প্রকাশ করুন। তবে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত ভাবে। নিয়ন্ত্রিত প্রকাশ বলতে বোঝানো হচ্ছে এমন ভাবে প্রকাশ করা যেন তাতে আপনার, আপনার কাজের ও আপনার আশপাশের মানুষের কোনও ক্ষতি না হয়।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, আপনি একটি প্রজেক্টের জন্য একজন ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়োগ দিয়েছেন। কালকের মধ্যে প্রজেক্ট শেষ করতে হবে। কাজেরও বেশি বাকি নেই। এমন সময়ে কোনও কারণে ইঞ্জিনিয়ারের সাথে আপনার কোনও একটি মতবিরোধ হলো। আপনি ভয়ানক রেগে গেলেন – আপনার ঘাড়ের কাছে একটা শিরশিরে জ্বলুনি, কান দু’টো গরম হয়ে উঠছে, এবং আপনার ইচ্ছে করছে এই লোককে এই মূহুর্তে চূড়ান্ত অপমান করে বের করে দেয়া উচিৎ। একজন উচ্চ আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার মানুষ হিসেবে কি আপনার সেটা করা উচিৎ হবে? নিশ্চই না!
আপনি যদি রাগ সামলাতে না-ই পারেন, এবং রাগ প্রকাশ করা ছাড়া ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে না পারেন, তবে তক্ষুনি রুম থেকে বের হয়ে যান। অবশ্যই রাগ দেখিয়ে নয়। শান্ত ভাবে বলুন আপনার কিছুটা সময় দরকার, একটু পরে ফিরবেন। এরপর একা একা বসে সেই লোককে যা বলতে চান, তা একটি কাগজে লিখে ফেলুন। যা যা বলতে চান সব। লেখা শেষে দেখবেন আপনার রাগ বেশ কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। হাতের কাছে একাধিক কলম বা পেন্সিল রাখুন – যাতে করে জোরে চাপ দিয়ে লেখার সময়ে একটি কলম বা পেন্সিলের শীষ ভেঙে গেলে হাতের কাছে আরেকটা পাওয়া যায়। লেখা শেষ হয়ে গেলে প্রবল আক্রোশে সম্ভব হলে কাজগটি পুড়িয়ে ফেলুন, না হলে কুটি কুটি করে ছিঁড়ে টয়লেটে ফেলে দিন।
এরপর শান্ত হয়ে বসে চোখ বন্ধ করে বড় বড় করে কয়েকবার বুক ভরে শ্বাস নিন এবং ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ুন। আপনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করবেন – আপনার মাথা ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসছে এবং আপনি পরিস্কার ভাবে চিন্তা করতে পারছেন। এবার চোখ বন্ধ করে চিন্তা করার চেষ্টা করুন, সেই লোককে বের করে দিলে আপনার কি কি ক্ষতি হবে। এবং সেই সাথে সে ঠিক কোন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে তার কথাগুলো বলেছে, এবং সেখানে আপনার ভূমিকা কি, সেটাও চিন্তা করে বের করার চেষ্টা করুন। এই বিষয়গুলো পরিস্কার হয়ে উঠলে আপনি নিজেই বুঝবেন রাগ প্রকাশ করাটা সেই মূহুর্তে যতটা যুক্তিসঙ্গত মনে হচ্ছিল, এখন আর হচ্ছে না। এরপর আপনি ফিরে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় কাজে মনযোগ দিতে পারবেন।
“ইসমাইল সাহেবের EQ” গল্পের দ্বিতীয় অংশ:
ইসমাইল সাহেব নিজের অফিসে গিয়ে দিনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বেশ কয়েকটা মিটিং করলেন। নতুন ডিলটির ব্যাপারে টিমকে যথাযথ নির্দেশনা দিলেন। মাঝে মাঝে বাসার চিন্তা তার মনে উঁকি দিতে চাইলেও তিনি সেটাকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দিলেন না। ‘কাজকর্ম শেষ করে বা কাজের মাঝে ফ্রি টাইম পেলে এ নিয়ে চিন্তা করা যাবে। – একটা সমাধান বের না করে শুধুশুধু চিন্তা করলে এখনকার কাজটাই মাটি হবে’ – এই বলে তিনি তাঁর মনকে নিয়ন্ত্রণ করলেন।
লাঞ্চের পর তিনি আধঘন্টার জন্য তাঁর অফিস কামরার সাথে লাগোয়া ছোট্ট কেবিনে বিশ্রাম নেন। আজ সেখানে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে তিনি চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলেন। তাঁর মনে হলো মলি বেগমকে একটা কল দেয়া উচিৎ। তিনি ফোনের দিকে হাত বাড়িয়েও কয়েক মূহুর্তের জন্য থেমে গেলেন। হঠাৎ করেই ব্যাপারটা তাঁর কাছে পরিস্কার হয়ে গেলো। স্ত্রীর অদ্ভূত আচরণের কারণ ও তার সমাধান বোধহয় তিনি পেয়ে গেছেন। তিনি ফোনটি হাতে নিয়ে স্ত্রীকে ফোন করার বদলে আজকের শিডিউল চেক করতে শুরু করলেন। আজকে তাঁর আর অফিসে না থাকলেও চলছে। তাঁকে অন্য একটা জায়গায় যেতে হবে। কিন্তু এটা কি আসলেই সঠিক সিদ্ধান্ত? এতে কি তিনি যে ভুল ছিলেন তা প্রমাণিত হবে না? তিনি বেশ কিছুক্ষণ ধরে পুরো ব্যাপারটা গোড়া চিন্তা করলেন, এবং ইন্টারনেটে বিষয়টি নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করার পর সিদ্ধান্ত নিলেন – তিনি আসলে ভুলই করেছিলেন। সঠিক কাজটা এখনই করে ফেলতে হবে।
বিকেলের নরম হলুদ রোদ রাস্তায় ছড়িয়ে আছে। শহরের পরিবেশও বেশ শান্ত; রাস্তায় তেমন একটা গাড়িটাড়ি নেই। ১২ বছরের রনি হাসি হাসি মুখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। আজ হঠাৎ করেই বাবা তার স্কুলে গিয়ে হাজির। স্যারের সাথে কথা বলে তাকে সাথে করে বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন। ইসমাইল সাহেবও হাসি হাসি মুখে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন।
‘বাবা, আমি যে যাচ্ছি, মা-কি জানে?’ ইসমাইল সাহেব ঘুরে ছেলের দিকে তাকালেন – ‘না, তোর মা’কে সারপ্রাইজ দেব’। ‘গুড, খুব মজা হবে বাবা!’ – ইসমাইল সাহেবও সেটাই আশা করছেন।
ছেলেকে দেখে মলি বেগম আনন্দে প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। ইসমাইল সাহেবের দিকেও কেমন জানি হাসি হাসি মুখে তাকাচ্ছেন। ইসমাইল সাহেবও স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ হাসলেন। তাঁর আইডিয়াই বোধহয় ঠিক ছিল। এরপর মলি বেগম অবাক হয়ে দেখলেন ড্রাইভার নজরুল গাড়ি থেকে বেশ কয়েকটি বড় লাগেজ নামাচ্ছে। সবগুলো রনির। তিনি অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন।
‘ভেবে দেখলাম তোমার কথাই ঠিক। ভালো লেখাপড়ার জন্য বোর্ডিং স্কুলে থাকার কোনও দরকার নেই। বাবা-মায়ের কাছেও তো ছেলেমেয়ের অনেক কিছু শেখার আছে’ – মলির নিরব প্রশ্নে ইসমাইল সাহেবের উত্তর।
মলি হেসে উঠলেন। এমন সময়ে কুকুরটি এসে হাজির। কুকুর দেখেই রনির নাক কুঁচকে গেল। ‘একি মা, কুকুর কেন? এটা কি বাসায় থাকবে?’
মলি মুচকি হেসে ইসমাইল সাহেবের দিকে তাকালেন। ‘আরে নাহ, এটা তোর বাবাকে ক্ষেপানোর জন্য এনেছিলাম’। পুরো একটা দিন পর ইসমাইল সাহেব কোনওকিছুতে মজা পেয়ে হাসলেন।
গল্প এখানেই শেষ। এখন চলুন দেখে নেয়া যাক ইসমাইল সাহেব কোন পরিস্থিতিতে কি করেছেন:
পরিশিষ্ট:
আমাদের আশপাশের মানুষের সাথে আমরা কেমন আচরণ করছি, তার ওপর আমাদের জীবনের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে।
নেতিবাচক আবেগের স্পষ্ট প্রকাশ আসলে কখনওই ভালো ফলাফল বয়ে আনতে পারে না। তাই প্রকাশ করলেও তাকে অন্য উপায় অবলম্বন করে নিয়ন্ত্রিত ভাবে প্রকাশ করুন। শিঘ্রই আমরা শুধু এই বিষয়ের ওপর একটি লেখা প্রকাশ করব। সময় মত লেখাটি পাওয়ার জন্য নিয়মিত আমাদের সাথে থাকতে ভুলবেন না।
—
লেখাটির বিষয়ে আপনার ভাবনা আমাদের অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। আর যদি মনে হয় এই লেখাটি অন্যদের কাজে লাগতে পারে, তবে শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন। আমাদের সাথে থাকুন; সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার সাথে আছে।
আপনার জন্য:
⇒ সেরা সফল উদ্যোক্তাদের ১০টি চারিত্রিক বৈশিষ্ট
⇒ ৬টি উপায়ে লিডার হিসেবে কঠিন সিদ্ধান্ত সহজে নিন
⇒ ৭টি বিষয় মাথায় রেখে ভয়কে জয় করে লক্ষ্য অর্জন করুন
⇒ পরিকল্পনা ছাড়া কেন জীবনে বড় অর্জন সম্ভব নয়?
⇒ ৯টি সাধারন কাজ, যা একটু অন্যভাবে করলে আপনার মস্তিষ্কের ক্ষমতা আর স্মৃতিশক্তি অনেক বেড়ে যাবে