বিপদে মানুষ চেনা যায় – এটা যে শুধু বিপদের বন্ধুর ক্ষেত্রেই খাটে তা নয়। যে বিপদে পড়েছে, তার ক্ষেত্রেও খাটে। কিছু মানুষ বিপদে পড়লে একদম ভেঙে পড়ে, আর কিছু মানুষ মাথা ঠান্ডা রেখে সেই সমস্যার সমাধান করে।
২০০০ সালের ১লা জুন এয়ার ফ্রান্স এর “ফ্লাইট ৪৪৭” ব্রাজিল থেকে প্যারিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিল। যাত্রা শুরুর কয়েক মিনিটের মাথায়ই বিমানটি একটি ঝড়ের কবলে পড়ে গেল ঝড়ের আঘাতে হঠাৎ করেই প্লেনটির অটোপাইলট কাজ করা বন্ধ করে দিল এবং সেটি এক দিকে কাৎ হয়ে উড়তে লাগল। প্রবল ঝড়ের প্রভাবে প্লেনটি উল্টোপাল্টা ভাবে ওড়ার কারনে তার স্পিড মিটার ঠিকভাবে কাজ করছিলনা, এবং দ্বিধাগ্রস্থ পাইলটরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না যে তারা প্লেনটির গতি বাড়াবে না কমাবে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে পাইলটদের উচিৎ ছিল প্লেনের মাথাটি নিচের দিকে চালিত করে স্পিড বাড়িয়ে দেয়া। পাইলরা সেই বিষয়ে ট্রেনিং পাওয়া সত্ত্বেও পরিস্থিতির চাপে ভীত ও দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে গিয়েছিল। এবং সেই কারনে প্লেনটির নিয়ন্ত্রণও তারা ঠিকমত করতে পারছিল না। প্লেনটিকে তারা ওপরে ওঠানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল যার ফলে তার গতি কমে আসছিল। গতি কমতে কমতে প্লেনটি এক পর্যায়ে থেমে গিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে পতিত হয়েছিল। সেই দুর্ঘটনায় পাইলটসহ সব যাত্রীরই করুণ মৃত্যু হয়েছিল।
এবার আর একটি দুর্ঘটনার কথা বলা যাক, যাত্রী বোঝাই ক্যানটাস এয়ারওয়েজ এর ফ্লাইট৩২ সিঙ্গাপুর থেকে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে যাচ্ছিল। যাত্রা শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যে দেখা গেল প্লেনটির ইঞ্জিনে আগুন ধরে গেছে। যার ফলে ইঞ্জিনটি বিস্ফোরিত হয়। এই ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই পাইলট অটোপাইলট নিজের হাতে বন্ধ করে প্লেনটির নিয়ন্ত্রণ নিজে নিয়ে নেয়। পাইলট প্লেনের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সাথে সাথেই ককপিটের স্ক্রিণে এরর সিগন্যাল দেখা গেল এবং প্লেনের মাঝে ডেঞ্জার এলার্ম বেজে উঠল। যাত্রীরা ভয়ে আধমরা হয়ে এমন চেঁচামেচি শুরু করে দিল যে তাদের কোনওভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। সেইসাথে প্লেনের নিয়ন্ত্রণও একটু পর পরই হারিয়ে যাচ্ছিল। এতসব ঝামেলার মাঝেও পাইলট মাথা ঠান্ডা রেখে তাঁর কাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। দাঁতে দাঁত পিষে তিনি নিজের সাহস ধরে রেখে প্লেনটিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ল্যান্ড করতে সমর্থ হলেন; আর সেই সাথে বেঁচে গেল বেশকিছু মানুষের জীবন।
এইযে দু’টি ঘটনা বলা হল, দুটিতেই প্লেন দুর্ঘটনার মুখে পড়েছিল। আপনার ভাবনায় হয়তো ধরা দিয়ে থাকবে, প্রথম দুর্ঘটনার থেকে দ্বিতীয়টি বেশি বিপজ্জনক ছিল। প্রথম প্লেনটির পাইলট সাহস না হারালে দ্বিতীয় প্লেনের পাইলটের থেকে সহজে তাঁর প্লেনটি বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু তিনি বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে না পারার কারনেই নিজেদের সাথে বহু যাত্রীকে চরম বিপদে ফেলেছিলেন। ফ্লাইট ৪৪৭, অর্থাৎ প্রথম বিমানটির পাইলটের যা হয়েছিল তাকে ইংরেজীতে বলে “cognitive tunneling” – এই অবস্থা তখন হয়, যখন একজন মানুষ রিল্যাক্সড অবস্থা থেকে হঠাৎ করেই কোনও একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। বিপদটা যখন একটি চমকের মত করে সামনে হাজির হয়, তখন অনেক মানুষের মাথাই ঠিকমত কাজ করে না। কোনওভাবেই তাঁরা কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না। আর এই সিদ্ধান্তহীনতার ফলেই ঘটে যায় চরম কোনও দুর্ঘটনা।
অন্যদিকে ক্যানটাস, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিমান এর পাইলট তুলনামূলক বেশি বিপজ্জনক অবস্থায় থাকার পরও মাথা ঠান্ডা রাখতে পেরেছিলেন কারন তিনি একটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। এই পদ্ধতিকে ইংরেজীতে বলে “Mental Modeling” – অর্থাৎ মনস্তত্বকে সাজিয়ে নেয়া। এটি একধরনের সাজানো কল্পনা বলা যায়। এই পদ্ধতিতে একজন মানুষ কোনও কাজ শুরুর আগে নিজের মনে কল্পনা করে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি ছক সাজিয়ে নেন। এই ছকের মাঝে কোনও অপ্রত্যাশিত বিপদ আসলে কি করবেন – সেই ব্যাপারটিও ভেবে নেয়া থাকে। এতেকরে কাজের প্রতিটি পদক্ষেপের ব্যাপারে যিনি কাজ করছেন, তাঁর একটি মানসিক প্রস্তুতি থাকে। যদি সত্যিকারেই কোনও অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে যায়, তখন আর সেটি পুরোপুরি চমক থাকে না – কারন হুবহু একই ঘটনা না হলেও – কোনও একটি বাধা বা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতে পারে, তা আগে থেকেই জানা থাকে।
যাঁরা সর্বোচ্চ প্রোডাক্টিভিটির সাথে কাজ করে থাকেন, তাঁরা কোনও একটি কাজ শুরুর আগে সেই কাজের প্রতিটি ধাপের একটি করে মনস্তাত্বিক ছবি (Mental image) সৃষ্টি করে নেন। এতেকরে কাজের চাপ অনেকটা কম অনুভূত হয়। দিনের শুরুতে যদি আপনি আপনার সারাদিনের কাজের ছকটি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে এভাবে কল্পনা করেন তাহলে সারাদিন সেটি একটি ম্যাপ এর মত কাজ করবে। শুধু সেই ম্যাপ ধরে ধরে এগুলেই চলবে। এর মাঝে যদি কোনও প্রকারের বাধা আসে, তবে সেই অবস্থায় মাথা ঠান্ডা রেখে সমস্যা সমাধানের বিষয়টিও মাথায় গেঁথে নিতে হবে। এতে করে সারাদিনে সব পরিস্থিতিতেই আপনি ঠান্ডা মাথায় গুছিয়ে কাজ করতে পারবেন।
দ্বিতীয় প্লেনটির পাইলট প্রতিবার ফ্লাই করার আগে এই কাজটি করে নিতেন। প্রতিবারই তিনি তাঁর ফ্লাই এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি মেন্টাল মডেলিং করে তারপর প্লেনে উঠতেন। এর মাঝে যদি কোনও অপ্রত্যাশিত বিপদ আসে, তবে তিনি সেগুলোকে কিভাবে সামলাবেন – সেই ব্যাপারটিও তিনি আগে থেকেই ভেবে রাখতেন। আর এই মেন্টাল মডেলিং এর কারনেই তিনি চরম বিপদে পড়েও মাথা ঠান্ডা রাখতে পেরেছিলেন।
তবে কোনও প্রকারের বিপদ না হলেও কাজের ক্ষেত্রে আপনার মাথায় যদি একটি মেন্টাল মডেল সৃষ্টি করা থাকে, তবে কাজটি সাধারন অবস্থার থেকে অনেক বেশি গোছানো হবে।
একটি সহজ উদাহরনের সাথে আপনাকে ব্যাপারটি বোঝাই। ধরুন আপনি আপনার একজন বন্ধুর বাড়িতে যাবেন। সেখানে যাওয়ার দু’টি পথ আছে। একটি পথে আপনি আগেও চলেছেন, তাই সেটি আপনার মোটামুটি চেনা। অন্য পথটিতে আপনি জীবনেও যাননি, কাজেই সেই পথের রাস্তা-অলিগলি কিছুই আপনার চেনা নেই। আপনার কি মনে হয়, কোন পথে গেলে আপনি সহজে ও বিনা ঝঞ্ঝাটে আপনার বন্ধুর বাড়ি যেতে পারবেন?
আসলেই তাই। যে পথে আপনি আগে গিয়েছেন, সেই পথেই সহজে যাওয়া যাবে। মেন্টাল মডেলিং এর ব্যাপারটিও অনেকটা এভাবেই কাজ করে। আগেই বলেছি আমাদের ব্রেন কল্পনা ও বাস্তবের ঘটনায় একই রকমের প্রতিক্রিয়া দেখায়। গোলাপ ফুল সামনে দেখলে আপনার যেমন একটি সুন্দর অনুভূতি হবে, ফুলের ছবি কল্পনায় ভেসে উঠলেও তার কাছাকাছিই একটি অনুভূতি হবে। এখন আপনি যখন একটি কাজের খুঁটিনাটি সবকিছু গোছানো কল্পনায় দেখে নিয়ে তারপর কাজে নামবেন, আপনার মস্তিষ্ক ধরে নেবে যে সে এই কাজটি আগেও করেছে। এবং অবচেতন ভাবেই আপনি অনেক স্বস্তির সাথে কাজটি করতে পারবেন। কোনও বাধা বিপত্তি এলেও আপনার অবচেতন মন ভড়কে যাবে না। অবচেতন স্থির থাকার ফলে আপনার চেতন মনেও সেই প্রভাব পড়বে এবং আপনি সহজেই বাধা বিপত্তির মুখে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করে সেগুলো উতরে যেতে পারবেন। আপনার প্রতিটি কাজ হবে আরও গতিশীল ও সহজ।
লেখাটি ভালো লাগলে লাইক ও কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান। যদি মনে হয় এই লেখার মাধ্যমে অন্যরাও উপকৃত হবে, তবে শেয়ার করার মাধ্যমে তাদের দেখার সুযোগ করে দিন।
চাপের মাঝেও সেরা পারফর্ম করার অন্যসব উপায় জানতে আমাদের: স্মার্টার ফাস্টার বেটার লেখাটি পড়তে পারেন।