ঢিলেমি, কাজ ফেলে রাখা বা দীর্ঘসূত্রিতা শুধু একটি বদ অভ্যাসই নয়, এটি একটি অভিশাপ।
আপনি যদি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সময়ের কাজ সময়ে করতে না পারেন, কাজ ফেলে রেখে রেখে একদম শেষ সময় পর্যন্ত নিয়ে আসেন; এবং সামান্য সময়ে অনেক কাজ করতে বাধ্য হন – তবে আপনার মাঝে ঢিলেমির সমস্যা আছে। তবে এই অভিশাপ একমাত্র আপনার ঘাড়ে নয়, পৃথিবীর ২০% মানুষই এই অভিশাপের শিকার।
হাতে জরুরী কাজ থাকা সত্ত্বেও এই ধরনের মানুষেরা অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।একদম শেষ সময়ে গিয়ে এদের টনক নড়ে – আর তখন নাকেমুখে কোনওরকমে কাজটি তারা শেষ করে। অনেক সময়ে কাজ শেষও করতে পারে না।
এর আগে “কাজ ফেলে রাখা বা ঢিলেমির ৮টি ভয়াবহ কুফল” আর্টিকেলে আমরা দেখিয়েছিলাম কিভাবে এই অভ্যাস আপনার ক্যারিয়ার এমনকি জীবনকেও ধ্বংস করে দিতে পারে।
আজকের এই লেখায় আমরা নির্দিষ্ট করে আপনাকে জানাবো যে, কারা আসলে এই ঢিলেমি বেশি করে, এবং এর কারণ কি? – যাতে আপনি বুঝতে পারেন আপনি এদের দলে পড়েন কি-না।এবং সেই সাথে আপনি জানতে পারবেন, এই আলাদা আলাদা ঢিলেমি করা দলের মানুষের সমস্যাগুলোর আলাদা আলাদা সমাধান।
কাজ ফেলে রাখা বা ঢিলেমি আসলে কি?
“The Procrastination Equation: How to Stop Putting Things Off and Start Getting Stuff Done,” বইয়ের লেখক পিয়ার্স স্টিল লিখেছেন, “দেরি করলে ক্ষতি হয়ে যাবে, এটা জানার পরও ইচ্ছে করে সময়ের কাজ সময়ে না করার নামই ঢিলেমি বা দীর্ঘসূত্রিতা”।
অন্যকথায়, ঢিলেমি হলো জরুরী কিন্তু কষ্টকর কাজ বাদ দিয়ে যতক্ষণ পারা যায় সহজ ও বেশি উপভোগ্য কাজ করা। এর ফলে সত্যিকার প্রয়োজনীয় কাজ একদম শেষ সময়ে গিয়ে ঠেকে। এর খুব কমন একটি উদাহরণ হতে পারে পুরো সেমিস্টার মজা ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় কাজ করে একদম পরীক্ষার আগে আগে নাকে মুখে পুরো সিলেবাস কাভার করার চেষ্টা করা।
ঢিলেমি বন্ধ করা / সময়ের কাজ সময়ে করা এত কষ্টকর কেন?
আমরা সবাই কমবেশি ঢিলেমির কুফলগুলো জানি; ঢিলেমি করার খেসারতও প্রায় সবাইকেই জীবনে দিতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও শত চেষ্টা আর ইচ্ছার পরও এটা কেন বন্ধ করা যায় না?
অনেক সময়েই হয়তো আপনি ভেবেছেন, এর পরের সেমিস্টারে আমি ঠিকমত পড়বো, বা এর পরের প্রজেক্টে কাজ ফেলে রেখে সময় নষ্ট করে একদম ডেডলাইনের শেষে নিয়ে যাবো না। কিন্তু সময় আসলে দেখা যায় আপনি ঠিকই অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় নষ্ট করছেন। এতে নিজের ওপর আপনার দারুন রাগ হয়, মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয়। কিন্তু এই অভিশাপ থেকে আপনি মুক্ত হতে পারেন না। দুই একদিন বা সপ্তাহ খানেক চেষ্টা করার পর আবার ‘ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন’ হয়ে যায়।
আপনাকে একটা কথা বলে রাখি, এটা আসলে পুরোপুরি আপনার দোষ নয়। মানুষের জন্মগত স্বভাবই আসলে সহজ জিনিসটি বেছে নেয়া। আমাদের মস্তিষ্কই আমাদের কঠিন কাজ বাদ দিয়ে মজার ও সহজ কাজটি করতে উৎসাহিত করে। আর এই কারণে এ্যাসাইনমেন্ট বা রিসার্চের কাজ করার চেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ইউটিউবে বিড়াল-কুকুরের ফানি ভিডিও দেখতে, বিখ্যাত সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রেটিদের মূল্যহীন কথা শুনে হেসে গড়াগড়ি খেতে আমাদের ভালো লাগে।
আবার দিনের পর দিন এই কাজ করতে করতে সেটা আমাদের অভ্যাসে পরিনত হয়। আর একবার অভ্যাস হয়ে গেলে সেখান থেকে মুক্তি পাওয়াটা শুধু ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করে না, তার জন্য কিছু বিষয় জানা ও কৌশল অবলম্বনের দরকার হয়।
ঢিলেমির সাথে বেশ কিছু মনোদৈহিক বিষয় জড়িত, যা সব সময়ে আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আমেরিকার ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির সাইকোলজির অধ্যাপক ও গবেষক ড.রয় ব্যাউমিইস্টার আত্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বহুদিন ধরে গবেষণা করে আসছেন। তাঁর মতে, মানুষ নিজেকে কতটা বা কতক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে – তার একটা সীমা আছে। কাজ করার এক পর্যায়ে আমাদের পেশী যেমন ক্লান্ত হয়, আত্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও তেমনি ক্লান্ত হয়। আপনি যে ব্যাপারেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান না কেন, মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট অংশকে তার পেছনে খাটতে হয়। মস্তিষ্কেরও একটা এনার্জি লিমিট আছে – এই লিমিট বা সীমা পার হয়ে গেলে সে-ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সে যখন একেবারেই কাজ করতে পারে না, তখন ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুমের আগেও একটু একটু করে যখন তার এনার্জি খরচ হতে থাকে – তখন তার ফাংশানগুলো পুর্ণ ক্ষমতায় কাজ করতে পারে না।
যাই হোক, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে করতে একটা সময়ে হয়তো আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন – আর তখনই মস্তিষ্কের আদিম স্বভাব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে – অর্থাৎ সে আপনাকে আরাম ও আনন্দের দিকে নিয়ে যায়। মস্তিষ্কের গঠনই এমন; সে তার শরীরকে সব সময়ে নিরাপদে ও সুখে রাখতে চায়। বিছানা দেখলেই আমাদের শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হয় – যদি তা আমরা ছবিতেও দেখি – তবুও। কিন্তু যুদ্ধ দেখলে খুব কমই আমাদের তার মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছে হয়। এটা মস্তিষ্কের জন্মগত নিরাপদ থাকতে চাওয়ার প্রক্রিয়া বা Survival instinct.
অবচেতনে আমরা জানি যে পড়া বা কাজ করার চেয়ে ইউটিউবে ভিডিও দেখা বা ফেসবুকে চ্যাট করা অনেক কম কষ্টের কাজ। আমাদের অবচেতন মন আসলে আমাদের কষ্ট থেকে দূরে রাখতে চায়, আর তাই সে ঢিলেমিকে কাজ এড়ানোর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। সে আমাদের বোঝায় যে কাজতো পরেও করা যাবে, হাতে তো সময় আছেই – এখন একটু সময়ের জন্য উপভোগ করলে তেমন কোনও ক্ষতি নেই।
একারণেই অনেক সময়ে পড়তে বসে আমাদের মনে হয়, খেলার স্কোরটা চট করে একটু দেখে আসি, একটা গান শুনে পড়তে বসি, আর একটা ফান ভিডিও দেখে মনটাকে চাঙ্গা করে নিই।
কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে দেখা যায়, খেলার স্কোর দেখতে গিয়ে পুরো খেলাটাই দেখা হয়ে যায়, একটা গান থেকে পাঁচটা গান হয়ে যায়, একটা ৫ মিনিটের ভিডিও দেখতে গিয়ে মোটামুটি দশ-বারোটি ভিডিও দেখা হয়ে যায়। তারপরও যখন টনক নড়ে – তখন মনে হয়, আর একটু সময় মজা করলে ক্ষতি কি? সময় তো আছেই। আর এভাবেই আপনার নিজের মস্তিষ্ক আপনার সাথে প্রতারণা করতে করতে আপনাকে একদম খাদের কিনারে এনে ফেলে।
কাজেই বুঝতে পারছেন, ঢিলেমি বা দীর্ঘসূত্রিতা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রক্রিয়াটি আসলে মানুষের একদম আদিম বৈশিষ্টের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করা। এটি মানুষের একটি জন্মগত দুর্বলতা, আবার শক্তিও বটে। যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রবণতা কারণে মানুষ যুদ্ধ জয় করে, প্রকৃতির সাথে লড়াই করে টিঁকে থাকে, সেই একই প্রবণতার সাথে যুদ্ধ করে না পেরে আমরা জীবন যুদ্ধে হেরে যাই।
কিন্তু এই হেরে যাওয়াটা আপনার নিয়তি নয়। সঠিক উপায় অবলম্বন করতে পারলে আপনি এই যুদ্ধে জয়ী হয়ে জীবন যুদ্ধেও বিজয়ী হতে পারবেন।
চলুন ধাপে ধাপে আমরা ঢিলেমির শিকার কারা বেশি হয় ও এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের কৌশল জেনে নিই:
৫ ধরনের ঢিলেমি ও এর শিকার হওয়া মানুষ:
এটা জানা আপনার এজন্য দরকার, যাতে করে আপনি বুঝতে পারেন আসলে আপনার ঢিলেমি স্বভাবের উৎস কি? এবং আপনার জন্য কোন ব্যবস্থাটি সবচেয়ে ভালো হবে।
বিভিন্ন ধরনের মানুষ বিভিন্ন কারণে ঢিলেমি করে। মনোবিজ্ঞানীরা মূল ৫টি ক্যাটাগরিতে এদের ভাগ করেছেন। আপনার মাঝে যদি ঢিলেমির স্বভাব থেকে থাকে, তবে দেখে নিন আপনি কোন ক্যাটাগরিতে পড়েন।
ক্যাটাগরি গুলো হলো, পারফেকশনিস্ট, উটপাখি, আত্মবিধ্বংসী, অতি সাহসী, প্রতারক।
০১. পারফেকশনিস্ট
এরা সবকিছু একদম পারফেক্ট ভাবে করতে চায়। কাজের কোথাও কোনও খুঁত থাকা চলবে না। কিন্তু এই স্বভাবের কারণে তারা কাজে ভুল হওয়া বা কাজে খুঁত থাকাকে অতিরিক্ত ভয় পায়। ফলে অনেক সময়েই তারা সময় মতো কোনও কাজ করতে ব্যর্থ হয়, কারণ তাদের চোখে কোনও কাজের আয়জন ও সময় একদম মোক্ষম না হলে তারা কোনও কাজ শুরুই করতে পারে না।
কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই সেই মোক্ষম আয়োজন আর সময় আসে না – তাই কাজও করা হয়ে ওঠে না। ওদিকে সময়ের মতো করে সময় চলে যেতে থাকে। কাজের আয়োজন করা আর ভাবনা ভাবতে ভাবতেই আসল কাজের সময় চলে যেতে থাকে। কিন্তু তারা সেই পারফেকশনের আবর্তেই ঘুরপাক খেতে খেতে সময় নষ্ট করতে থাকে।
উদাহরন হিসেবে একজন বিসিএস ক্যান্ডিডেটের কথা ধরা যাক। তার স্বপ্ন সে সরকারী বড় পদে কাজ করবে। তার মেধা ও যোগ্যতার কোনও অভাবও নেই। কিন্তু প্রতিবারই তার মনে হয়, “এবার দিলে হবে না – আমি এখনও যথেষ্ঠ যোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি। পরের বার চেষ্টা করে দেখবো”। এমন করতে করতে হয়তো দেখা যায়, এই পারফেকশনিস্ট এক বা একাধিক পরীক্ষাই মিস করে ফেলল। এই স্বভাবের কারণে অনেকেই অনেক সুযোগ কাজে লাগাতে পারে না।
০২. উটপাখি
উটপাখির একটা স্বভাব হলো, কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি দেখা দিলে সে বালির মাঝে মাথা ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা তারা করে বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। অবস্থা যত খারাপই হোক না কেন, তারা বালির মাঝে মুখ গুঁজে দিয়ে ভাবে সবকিছু আসলে ঠিকই আছে, কিছুই হয়নি।
এইধরনের স্বভাব একদল ঢিলেমি করা মানুষের মাঝেও দেখা যায়। এই ধরনের মানুষ একটি স্বপ্নময় ঘোরের মাঝে থাকতে পছন্দ করে। আশপাশে যা-ই ঘটুকনা কেন, এরা মনে করে সব ঠিকঠাক আছে। এর ফলে তারা সত্যিকার কাজ করা থেকে বিরত থাকে এবং বাস্তব অবস্থায় চলমান চাপ ও নেতিবাচকতা থেকে দূরে থাকে।
এই স্বপ্ন বা ঘোর এই ধরনের মানুষকে একটি মিথ্যা সাফল্য ও অর্জনের অনুভূতি দেয়। তারা বর্তমানে না বেঁচে ভবিষ্যতের সুখ কল্পনায় বাঁচে – এবং সেখানে নিজেকে একজন বিরাট সফল মানুষ হিসেবে দেখে। কিন্তু সত্যিকারে তা অর্জন করতে যেসব কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয় – তা সযত্নে এড়িয়ে যায়। এসব মানুষের বিশ্বাস থাকে, পরিস্থিতি নিজে নিজেই তার অনুকূলে চলে আসবে। তাই বাস্তবতার মুখোমুখী হওয়ার বদলে দিবাস্বপ্ন দেখতে দেখতেই তারা কাজের সময় নষ্ট করে ফেলে। ওদিকে সত্যিকারের কিছুই তারা জীবনে অর্জন করতে পারে না।
০৩. আত্ম বিধ্বংসী
আগের বর্ণনা করা দুই প্রকার মানুষের কিছু কিছু বৈশিষ্ট এদের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায়। উটপাখিরা ভবিষ্যতের সুখস্বপ্নে বিভোর থাকে, এবং কোনও কাজ না করেই মনে করে যে তাদের ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল। আর আত্ম বিধ্বংসীরা মনে করে যে, কিছু না করে বসে থাকলে, লাভ না হলেও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই মিথ্যা নিরাপত্তার আশায় তারা কিছু না করে বসে থাকে।
তাদের মাঝে আরও একটি বৈশিষ্ট্যও দেখা যায়, যেটা খানিকটা পারফেকশনিস্টদের মতো। এরাও একদম শেষ সময় পর্যন্ত কাজ ফেলে রাখে, তবে সেটা ভুল করার ভয়ে নয়, বেশি গা-ছেড়ে দিয়ে থাকার কারণে। কিন্তু একদম শেষে গিয়ে তাদের প্যানিকের মত হয়, এবং তারা নাকে মুখে কাজ করার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে একেবারেই কাজ না করলে ক্ষতি হতে পারে – এই ভয় তাদের মাঝে কাজ করে। তাই একদম শেষ মূহুর্তে গিয়ে তারা পারফেকশনিস্টদের মতো মোক্ষম সময় ও পরিবেশের জন্য বসে থাকতে পারে না – কাজ শেষ করার জন্য উঠেপড়ে লাগে।
০৪. অতি সাহসী
অতি সাহসীদের অতি আত্মবিশ্বাসীও বলা যায়। এরা একদম শেষ পর্যন্ত কাজ ফেলে রাখে কারণ এদের মনে হয় এই কাজের পেছনে এতটা সময় দেয়ার কোনও প্রয়োজন নেই, অল্প সময়েই কাজটি সে করতে পারবে, তাই বাকি সময়টা বিনোদন ও অপ্রয়োজনীয় কাজ করে কাটিয়ে দেয়।
এরা সাধারনত বেশ প্রতিভাধর মানুষ হয়, এবং নিজের ক্ষেত্রে তাদের বেশ দক্ষতা থাকে।কিন্তু এটা তাদের মাঝে একটি অতিরিক্ত সাহসী সত্ত্বার জন্ম দেয় – যা নিজের অজান্তেই তাদের উন্নতির মাত্রাকে অনেক কম করে ফেলে। বহু প্রতিভাবান মানুষ তাদের এই স্বভাবের কারণে যোগ্যতার চেয়ে অনেক কম সাফল্য ও অর্জন নিয়ে জীবন কাটান।
এই ধরনের মানুষ আরও বিশ্বাস করে যে, ডেডলাইনের শেষ প্রান্তে গিয়ে কাজ করলে তাদের কাজ সবচেয়ে ভালো হবে। তাই তারা শিডিউল করে পুরো সময়টি কাজে লাগিয়ে কাজ করার বদলে সময়সীমাকে একদম শেষ পর্যায়ে নিয়ে যায়।
এটি অবশ্য তারা সচেতন ভাবে করে না, কিন্তু মনের মধ্যে তাদের এই অনুভূতিই কাজ করে – “Performing Best Under Pressure” – ইংরেজীতে অতি প্রচলিত এই কথাটি এই ধরনের মানুষের কারণেই প্রচলিত হয়েছে। কিন্তু এই ধরনের মানুষ এই কথা মাথায় রেখে নিজের সময় নষ্ট করাকে বৈধতা দেয়। তাদের মাথায় কাজ করে যে তারা অল্প সময়েই কাজটি শেষ করে ফেলতে পারবে – কাজেই এত চিন্তার কিছু নেই। নিজের ঝুঁকি নেয়ার মানসিকতা ও সাহসের কথা চিন্তা করে আত্মতৃপ্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আসলে ব্যাপারটি মোটেও এরকম নয়। এরকম চলতে চলতে কখন যে তার কাজের মান ও দক্ষতা তলানিতে গিয়ে ঠেকে – সেটা সে নিজেও বুঝতে পারে না।
০৫. প্রতারক
এমন মানুষ হয়তো আপনারও চোখে পড়েছে, যে একদমই নিজের মর্জিমত চলে। যখন যা ইচ্ছা হয় – সেটাই করে। বেশিরভাগ সময়েই সে কারও কথা শোনে না। ‘আমার যখন সময় হবে, তখন আমি করবো’ – এই কথাটা তার মুখে প্রায়ই শোনা যায়। ভাবভঙ্গী দেখে মনে হয়, দারুন স্বাধীনচেতা একজন মানুষ।
তবে সম্ভাবনা আছে, মানুষটি আসলে মারাত্মক ঢিলেমি পূর্ণ স্বভাবের। যখন যেটা মন চায়, তখন সে তা-ই করে (আসলে করতে বাধ্য হয়), কারণ নিজের ইচ্ছার ওপর তার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।
কোন কাজটি এই মূহুর্তে আসলেই করা প্রয়োজন, তা সে ভেবেও দেখে না, অথবা দেখতে চায় না।
মাঝে মাঝে এদের গোঁয়ার ধরনের মানুষ বলে মনে হয়। যেন মর্জির বাইরে এদের দিয়ে কিছুই করানো সম্ভব নয়। নিজেকে তারা এভাবেই জাহির করে, কিন্তু তারা অনেক সময়ে নিজেরাই টের পায় না যে তারা আসলে নিজের আবেগ আর ইচ্ছার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত দুর্বল প্রকৃতির মানুষ। এভাবে তারা নিজের পাশাপাশি আশপাশের মানুষদের সাথেও প্রতারণা করে।
হয়তো মনের গভীরে তারা তাদের দুর্বলতার কথা জানে, কিন্তু নিজের ইগোর কারণে তা নিজেকে ও অন্যদের বুঝতে দেয় না। জরুরী কাজ ফেলে রেখে অদরকারী কাজ করলেও এরা সব সময়ে একটা ব্যস্ততার ভাব ধরে দেখাতে চায় যে তারা অনেক কাজ করছে – কিন্তু আদতে তা সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। এরা অনেক সময়ে নিজেরাও বুঝতে পারেনা, তারা আসলে ঢিলেমি করছে। নিজে যেটা করছে, সেটাই তাদের কাছে জরুরী কাজ বলে মনে হয় – আর এগুলো করতে গিয়ে আসল কাজের সময় চলে যায়।
নিচের ইনফোগ্রাফিক থেকে আপনি এক নজরে কাজ ফেলে রাখাদের প্রকার ও স্বভাব দেখে নিতে পারবেন:
সময়ের কাজ সময়ে করার উপায়
আলাদা আলাদা অসুখের জন্য আলাদা আলাদা ওষুধের প্রয়োজন হয়। ঢিলেমি বা দীর্ঘসূত্রিতার ভিন্ন ভিন্ন কারণের জন্য সময়ের কাজ সময়ে করার আলাদা আলাদা উপায় প্রয়োজন। তবে কিছু আছে যেগুলো সবার ক্ষেত্রেই খাটে। সেগুলো নিয়েও আমরা আলোচনা করব, তবে আগে নির্দিষ্ট করে জেনে নেয়া যাক, কোন ধরনের ঢিলেমির জন্য কোন ধরনের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
পারফেকশনিস্ট:
পারফেকশনিস্টদের সবচেয়ে বড় সমস্যা এরা কাজের প্রস্তুতি নিতেই অনেক সময় নষ্ট করে ফেলে। কাজ শুরুর আগেই তাদের মাথায় চিন্তা থাকে যেন কাজে কোনও ভুল না হয়। এটা আসলে এক প্রকার অসম্ভব।
আপনি যদি একজন পারফেকশনিস্ট ঘরানার ঢিলেমি করা মানুষ হন, তবে আপনাকে একটি কথা খুব ভালোমত মাথায় গেঁথে নিতে হবে। ভুল না করলে কখনও পারফেক্ট হওয়া যায় না। আপনার কাজটি তখনই পারফেক্ট বা নিখুঁত হবে – যখন আপনি সেই কাজ করতে গিয়ে কিছু ভুল করবেন, এবং সেই ভুল গুলোকে শুধরে নিতে পারবেন। পানিতে হাত না দিলে সেটা কত ঠান্ডা বা গরম বোঝা যায় না, এবং সহনীয় তাপমাত্রায় আনার জন্য কতটা তাপ দিতে হবে বা কতক্ষণ ফ্রিজে বা ফ্যানের নিচে রাখতে হবে – আপনি তা কখনওই বুঝতে পারবেন না। কাজ বা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও আপনাকে এই ঝুঁকিটুকু নিতেই হবে।
কাজের সাফল্য ও ফলাফলের পাশাপাশি, কাজ করতে গিয়ে যেসব জিনিস শিখবেন ও যেসব দক্ষতা বাড়বে – সেটাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। মনে রাখতে হবে যে কোনও কাজের ক্ষেত্রেই ভুল শুধরানো যায়। এক্ষেত্রে একটি কাজকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করে প্রতিটি পর্যায়ে আপনি কাজের মান পরীক্ষা করতে পারেন, সেখানে কোনও ভুল থাকলে শুধরে নিয়ে আবারও পরের পর্যায়ের কাজ শুরু করতে পারেন।
আপনার নিশ্চই জানা আছে, কোনও নতুন ওষুধের পরীক্ষা সরাসরি মানুষের ওপর চালানো হয় না। ইঁদুর, বাঁদর – বা এই যাতীয় প্রাণীদের ওপর প্রথমে পরীক্ষা করে দেখা হয় – এটি শরীরের জন্য কতটা নিরাপদ, এবং তারপরই তা মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়। একে বলে হিসেব করা ঝুঁকি বা “Calculated Risk”; সোজা বাংলায় এটি এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে “সাপও মরে, লাঠিও ভাঙে না”।
আপনার কাজগুলোও আপনি এভাবে করতে পারেন। কাজের প্রতিটি পর্যায়ে ছোটখাট পরীক্ষা চালিয়ে দেখতে পারেন, কোনও ভুল আছে কিনা। এভাবে ভুলগুলো শুধরানোর সুযোগ রেখে কাজ করলে আপনার মাঝে ভুল করার ভয়ও কমে যাবে। না হলে কাজ শুরু করাই আপনার জন্য কঠিন হয়ে যাবে।
পারফেকশনিস্ট হওয়াটা দোষের কিছু নয়। বরং পারফেকশনিস্টদের কাজ সব সময়েই ভালো হয়। আপনাকে শুধু চিন্তার ধরনে একটু পরিবর্তন আনতে হবে, তাহলেই আপনি সবাইকে ছাপিয়ে যেতে পারবেন। কাজ শুরুর আগেই তা নিখুঁত করার বদলে কাজ করতে করতে তা নিখুঁত করার মানসিকতা নিয়ে আসতে হবে। ভুল করাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, যদি আপনি সেই ভুল শুধরানোর সুযোগ রেখে কাজ করেন।
উটপাখি:
এই ধরনের ঢিলেমি করা মানুষেরা নিজেদের comfort zone বা নিরাপত্তা বলয় ছেড়ে বেরুতে চায় না। আপনার মাঝে যদি এই সমস্যা থেকে থাকে, তবে আপনাকে প্রথমেই এই বলয় ছেড়ে বের হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। বাস্তবতার মুখোমুখী হয়ে সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে হবে।
তবে এই পরিবর্তন একবারে আসবে না। এটা একটা অভ্যাসের ব্যাপার। আপনাকে ছোট ছোট বিষয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই স্বভাব পরিবর্তন করতে হবে। আপনার যদি ঘুমানোর অভ্যাস হয় রাত ২টায়, সেটাকে ১৫ মিনিট এগিয়ে নিয়ে আসুন। কয়দিন পর আরও ১৫ মিনিট এগিয়ে সময়টিকে দেড়টা করে ফেলুন। এতে আপনার মাঝে পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেয়ার অভ্যাস সৃষ্টি হবে।
সেই সাথে সবচেয়ে কঠিন কাজগুলো আগে করার চেষ্টা করুন। কঠিন কাজগুলো আগে করলে আপনার মাঝে একটা আত্মবিশ্বাস জন্ম নেবে, কঠিন কিছু দেখলে চোখ বন্ধ করে নিজেকে ভুল শান্তনা দেয়ার প্রবণতা কমে আসবে।
আপনার যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয়তা থাকে, এবং আপনি যদি সেটিকে খুব বেশি উপভোগ করেন, তবে সেটা কমিয়ে দিন। ভার্চুয়াল জগতের সাফল্য মানুষকে সত্যিকার জীবনের কঠোরতার মুখোমুখী হওয়া থেকে বিমুখ করে।
ভার্চুয়ালিটির চেয়ে বাস্তব জীবনকে বেশি গুরুত্ব দিন। সত্যিকার জীবনের চ্যালেঞ্জগুলোর সামনে সবকিছুর আগে দাঁড়ান। প্রথমে হয়তো খুবই অসুবিধা হবে – কিন্তু ধীরে ধীরে বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়াটা আপনার সয়ে যাবে। আর একবার এটা হয়ে গেলে, কঠিন কাজ ফেলে রেখে দেয়ার প্রবণতাও আপনার মাঝ থেকে বিদায় নেবে।
আত্ম বিধ্বংসী:
এই ধরনের মানুষেরা একটা পর্যায় পর্যন্ত কোনও জরুরী বিষয়কে যথেষ্ঠ গুরুত্ব না দিয়ে, গা-ছাড়া হয়ে বসে থাকে। সেইসাথে ভবিষ্যতের সুখস্বপ্নে বিভোর থাকে। কিন্তু ডেডলাইন কাছাকাছি হলে কাজ শেষ করার জন্য উঠেপড়ে লাগে।
আপনি যদি এই ধরনের ঢিলেমি করা মানুষ হন, আপনাকে প্রথমেই সময়ের মূল্য বুঝতে হবে। আপনি যদি কাজ ফেলে রেখে শুধু ভবিষ্যতের সুখস্বপ্ন দেখে আর বিনোদন করে সময় কাটিয়ে একদম শেষ পর্যায়ে গিয়ে কাজ করেন – তবে জেনে রাখুন কাজ করার আগের পুরো সময়টাই আপনি নষ্ট করেছেন।
মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করবে, মাঝে মাঝে বিনোদন করবে – এটা খুবই স্বাভাবিক। এবং একটা লেভেল পর্যন্ত এর প্রয়োজনীয়তাও আছে। কিন্তু কোনটার জন্য কতটা সময় দেবেন – এটা আপনাকে ঠিকভাবে বুঝতে হবে।
সময় ও কাজের যোগফলই জীবন, এই কথাটি আপনাকে সব সময়ে মাথায় রাখতে হবে।প্রতিদিন আপনি কোন কাজে কতটা সময় ব্যয় করবেন, তা নির্দিষ্ট ভাবে নোট করে দিনের কাজ শুরু করুন। নোটটি মাঝে মাঝেই দেখুন – যা আপনাকে মনে করিয়ে দেবে আপনার এখন কি করা উচিৎ। নোট করার সময়ে ভাবনার জন্যও আলাদা করে সময় রাখুন – যাতে কাজের সময়ে সেই ভাবনা আপনার মনযোগকে প্রভাবিত করতে না পারে। এর সাথে দিনে কতটা সময় বিনোদন করবেন, সেটাও ঠিক করে রাখুন।
কি করবেন, তা নোট করা ও সেই নোট বা শিডিউল কঠোর ভাবে ফলো করার পাশাপাশি কি কি কাজ করবেন না- সেটাও নোট করে রাখুন। দু’টি নোটেই বেশ কয়েকবার চোখ বুলান। একটি কাজ শেষ করে অন্য কাজটি করার আগে, সেটি কি – তা নিশ্চিত হয়ে নিন। এভাবে নিজেকে শৃঙ্খলার মাঝে আনতে পারলে আপনার ঢিলেমির স্বভাব অনেকটাই দূর হয়ে যাবে। আপনি হয়তো নিজেই আবিষ্কার করে অবাক হবেন যে ঢিলেমি আপনাকে আসলে কতটা পিছিয়ে দিয়েছিলো।
অতি সাহসী:
“অহঙ্কার পতনের মূল” – জনপ্রিয় ও বিখ্যাত এই প্রবাদটি এই ধরনের মানুষের জন্য বেশ মানানসই। অতি সাহস বা অতি আত্মবিশ্বাস আসলে অহঙ্কারের এক প্রকার বহি:প্রকাশ। আগেই বলেছি, সাধারনত এই ধরনের মানুষ বেশ প্রতিভাধর ও দক্ষ হয়। এই উপলব্ধিই তাদের কাজ ফেলে রেখে অহেতুক সময় নষ্ট করার তাগিদ দেয়।
আপনি যদি এই দলে পড়েন তবে আপনাকে বলব, আপনি আজ যে অবস্থানে আছেন, তারচেয়ে অনেক বড় অবস্থানে থাকার যোগ্যতা আপনার আছে। আপনাকে শুধু নিজের মানসিকতায় একটু পরিবর্তন আনতে হবে।
আপনি যদি শেষ সময়ের জন্য কাজ ফেলে রাখেন, এবং এতে আপনার কাজ ঠিকমত না হয় (অথবা আপনার ভাবনায়: ‘হয়’) তবে সময়কে ঘুরিয়ে দিয়ে এর সমাধান করতে পারেন।
ব্যপারটি একটু বুঝিয়ে বলি: আপনি অল্প সময়ে কাজটি করতে পারবেন, এই বিশ্বাস মাথায় রেখে যেহেতু আপনি কাজটি শেষ সময়ের জন্য ফেলে রাখেন; এর উল্টোটাও তো আপনি করতে পারেন!
অর্থাৎ, যেহেতু আপনি অল্প সময়েই কাজটি করতে পারেন, তাহলে বরাদ্দ সময়ের একদম প্রথমেই শেষ করে রেখে তারপর আপনার যা ইচ্ছা তাই করুন না কেন? এতে দু’টো লাভ, আপনি একদম রিল্যাক্সড হয়ে কোনওরকম মানসিক চাপ ছাড়া নিজের মত করে সময় কাটাতে পারবেন, আর সেই সাথে কাজে যদি কোনও খুঁত থাকে বা কোনও পরিবর্তন প্রয়োজন বলে আপনার মনে হয় – সেটা ঠিক করারও সময় পাবেন। তাড়াহুড়ো করে কাজ করলে আপনি যতই প্রতিভাবান হন না কেন, আপনার সেরাটা কখনওই সেই কাজে ফুটে উঠবে না। আর প্রতিভা অনুযায়ী সেরাটা দিতে পারলে আপনার উন্নতি হবেই। তাই শেষে শুরু না করে শুরুতে শেষ করুন। আপনার জীবন আর ক্যারিয়ার দু’টোই বদলে যাবে।
প্রতারক:
কথাটা শুনতে খুবই খারাপ লাগে। নিজেকে প্রতারক হিসেবে স্বীকার করতে কারই বা মন চায়? এই কারণেই আসলে এত কড়া ভাষায় বলা। চাইলে একটু সহনীয় ভাষায় কথাটি বলাই যেতো – কিন্তু এই ক্যাটাগরির ঢিলেমি করা মানুষদের সমস্যাই হলো এরা স্বীকারই করতে চায় না যে এদের আসলে কোনও সমস্যা আছে।
আপনার যদি সামান্যতম সন্দেহও থেকে থাকে যে আপনি এই ক্যাটাগরিতে পড়তে পারেন, তবে আপনার প্রথম কাজ হলো সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গীতে পূর্ণ সততার সাথে নিজেকে বিচার করা।
চিন্তা করবেন যে, আপনি নিজেকে না, অন্য কাউকে বিচার করছেন। মনে মনে তাকে দিয়ে, আপনি যা করেন তা করান। এই চরিত্রটি যে কেউ হতে পারে। আপনার বন্ধু, পরিচিত মানুষ, কোনও তারকা – যে কেউ।
আর যদি কল্পনা করতে কষ্ট হয় তবে কাগজ কলম নিয়ে বসে যান। যে কোনও একজন মানুষের নাম লিখে, তার নিচে তার কাজের ও ঢিলেমির ধরন লিখুন। কিছু প্রশ্ন করুন, যেগুলোর উত্তর আপনাকে ব্যাপারটি বুঝতে সাহায্য করবে। প্রয়োজনে এই লেখার সাথে দেয়া ইনফোগ্রাফিকটি দেখতে পারেন। প্রশ্ন এমন হতে পারে:
- হাতে কাজ থাকলে আমি সব ভুলে সেই কাজে মন দেই?
- যদি না দেই, তবে কি চাইলেই সেটা করতে পারব?
- আমি কি সব সময়ে আমার মন যেটা চায়, কোনও চিন্তা ভাবনা ছাড়া সেটাই করি?
- অন্যের কথায় বেশি যুক্তি থাকলে, বা পরিস্থিতি অনুযায়ী কিছু উপযুক্ত মনে না হলেও কি আমি নিজের জায়গায় অটল থাকি?
- আমি কি মনে করি আমি সবার চেয়ে ব্যস্ত?
- আমি কি চাই যে কাজ না করলেও সবাই যেন আমাকে বাহবা দেয়?
- অন্যরা আমাকে নিয়ে কি ভাবছে, তাতে আমার কতটা আসে যায়?
- কাজ করার চেয়ে নিজেকে ব্যাস্ত দেখাতে কি আমি বেশি সময় ব্যয় করি?
সততার সাথে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করুন। দরকার হলে এই লেখায় এই ধরনের ঢিলেমি করা মানুষদের সংজ্ঞায় ফিরে যান, এবং আপনার উত্তরের সাথে মিলিয়ে দেখুন।
যদি সত্যিই আপনার মধ্যে এই কারণে ঢিলেমি বা দীর্ঘসূত্রিতার দোষ এসে থাকে তবে প্রথমেই নিজের ইগোকে পরাজিত করতে শিখুন। যে কোনও সমস্যা সমাধানের আগে সেটাকে স্বীকার করে নেয়াটা জরুরী। যদি সমস্যাই স্বীকার করতে না চান তবে সমাধানের কথা কল্পনা করাও বোকামী।
কিভাবে ইগোকে জয় করবেন, তা খুব ভালো ভাবে জেনে নিন। তাহলে সমস্যা স্বীকার করতে আপনার সুবিধা হবে।
সমস্যা স্বীকার করার পর আপনাকে প্রথমেই যেটা করতে হবে তা হলো, নিজের ইচ্ছাশক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসা।
কাজের মাঝে যদি ইউটিউব দেখতে ইচ্ছে হয়, অথবা চ্যাট করতে ইচ্ছে হয়, সেটাকে মাত্র ৫ মিনিটের জন্য দমিয়ে রাখুন। অর্থাৎ একবারে নিজের ওপর বেশি জোর খাটাবেন না। এতে কোনও স্থায়ী সমাধান হবে না। একটু একটু করে সমস্যার জাল থেকে বের হয়ে আসুন। মাত্র ৫ মিনিট নিজেকে বিরত রেখে ইচ্ছার কাছে নিজেকে সঁপে দিন ১০ মিনিটের জন্য। তারপর সেখান থেকে বের হয়ে এসে কাজ শুরু করুন। মনে রাখবেন ১০ মিনিট ১২ মিনিট হলেও যেন কোনওভাবেই ১৫ মিনিট না হয়। ৫ মিনিট বিরত থাকার চেয়ে ১০ মিনিট পর সেখান থেকে বের হয়ে আসাটা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। তবে চালিয়ে গেলে এক সময়ে আপনি তা পারবেন।
পাঁচ মিনিটের এই খেলা যখন আপনার কাছে স্বাভাবিক লাগতে থাকবে, তখন সময় বাড়িয়ে দিন। ১০ মিনিট, ২০ মিনিট, ৩০ মিনিট – এভাবে বাড়াতে থাকুন। আর বিপরীত দিক থেকে সময় কমিয়ে আনুন। অর্থাৎ ১০ মিনিট বিরতির বদলে ৯ মিনিট করুন, তারপর ৮ মিনিট – এভাবে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসুন।
একটা সময়ে দেখবেন আপনি দীর্ঘক্ষণ ধরে পূর্ণ মনযোগে কাজ করে যেতে পারছেন। ইচ্ছা আর আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এতে করে আপনি সত্যিকারেই কাজ করতে পারবেন, আপনার পারফর্মেন্স ভালো হতে থাকবে, আপনাকে আর নিজের বা অন্যদের সাথে প্রতারণা করতে হবে না।
সবার জন্য:
আগেই বলেছিলাম কিছু নির্দিষ্ট ধরনের ঢিলেমি বা দীর্ঘসূত্রিতা করা মানুষের জন্য যেমন কিছু নির্দিষ্ট সমাধান রয়েছে, তেমনি এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো চর্চা করলে সব ধরনের ঢিলেমি করা মানুষই উপকার পাবেন। এমনই ৫টি বিষয় দেখে নেয়া যাক:
০১. পরিকল্পনামাফিক ব্রেক নিন:
আলাদা আলাদা পাঁচ প্রকারের ঢিলেমি রুগীর ব্যাপারে পড়তে গিয়ে কিছু বিষয়ে মিল নিশ্চই আপনার নজরে এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম মিল হলো, এরা কেউ সময়ের সদ্ব্যবহার করে না। আসলে এটাই এই রোগের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এরা সবাই বিভিন্ন অজুহাতে কাজ ফেলে রেখে সময় নষ্ট করে। বিভিন্ন কারণে এদের সময়মত কাজ করতে অনীহা সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে প্রধান একটি কারণ কাজে একঘেয়েমি ধরে যাওয়ার কারণে মনযোগ রাখতে না পারা।
সত্যি কথা বলতে, মানুষের মস্তিষ্ক আসলে একই কাজ দীর্ঘ সময় একটানা করে যাওয়ার উপযুক্তই নয়। বিশেষ করে সেই কাজে যদি প্রতিনিয়ত বুদ্ধি খাটাতে হয় (নিশ্চই বুঝতে পারছেন, কিছু মানুষের পড়াশুনা করতে এত সমস্যা কেন হয়?)। মানুষের মস্তিষ্ক খুব সহজেই বোর হয়ে যায়। আর এটা হতে পারে কাজ ফেলে রাখার প্রধান একটি কারণ।
সমাধান? – নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরিকল্পনা মাফিক বিরতি নেয়া। একটি নির্দিষ্ট সময় কাজ করার পর আবার নির্দিষ্ট সময়ের ব্রেক নিলে মস্তিষ্ক মনে করে যে নতুন করে সে কিছু শুরু করছে – এই কারণে সে সহজে একঘেয়েমিতে ভোগে না।
সিনেমা বা গল্পের বইয়ের শুরু এবং শেষটা আমরা সবচেয়ে বেশি মনে রাখতে পারি কারণ কোনকিছুর শুরু এবং শেষে আমাদের মনযোগ সবচেয়ে ভালো থাকে। কাজেই যে কোনও বড় কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে ভাগগুলোর মাঝখানে ছোট ছোট ব্রেক দিলে কাজের প্রতি মনযোগ অনেকটাই বেড়ে যায়।
অনেকেই বোর হবার ভয়ে কাজ শুরুই করতে পারে না। এই পদ্ধতি প্রাকটিস করলে কাজের মাঝে বোর হওয়ার পরিমান অনেক কমে যাবে – এর ফলে তাদের কাজের প্রতি আগ্রহও বাড়বে, এবং কাজ ফেলে রাখার মাত্রা কমবে।
এই ক্ষেত্রে আপনি পমোডরো টাইমার (pomodoro timer) ব্যবহার করতে পারেন। গুগল প্লে স্টোরে সার্চ করলেই দুইশ’র বেশি এ্যাপ পাবেন। এছাড়া কম্পিউটারের জন্যও Focus 10 এ্যাপ্লিকেশনটি ভালো। গুগুলে “free pomodoro timer windows 10” লিখে সার্চ দিলে প্রথম যে লিংকটি আসবে, সেখান থেকেই Focus 10 ডাউনলোড করতে পারবেন। এই টাইমারে প্রতি ২৫ মিনিট পর পর ৫ মিনিটের ব্রেক থাকে। প্রতি ২৫ মিনিট সেশনের পর এলার্ম বাজে। এই টাইমার ব্যবহার করলেই বুঝতে পারবেন ফোকাস রাখা আসলে কতটা সহজ।
০২. নিজেকে পুরস্কৃত করুন অথবা শাস্তি দিন:
কোনওকিছু অর্জন করলে যে তার পুরস্কার অন্য কারও থেকে পেতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। আপনি নিজেও নিজেকে পুরস্কৃত করতে পারেন। এটা করলে আপনার কাজের স্পৃহাও বাড়বে।
ধরা যাক, আপনার হাতে একটি কাজ করার জন্য ৭দিন সময় আছে। আপনি নিজেকে বললেন যে কাজটি পাঁচ দিনে শেষ করতে পারলে বাকি দুই দিন আপনার প্রিয় খাবার বিরিয়ানী খেয়ে কাটাবেন।
আর যদি তা না হয় তবে, আগামী এক মাসে বিরিয়ানী খাবেন না। হাস্যকর মনে হলেও, এই খাবারের তাগিদেই আপনার কাজের গতি বেড়ে যাবে। চাইলে বিরিয়ানীর ছবি সামনে লটকে রাখতে পারেন। এতে দারুন ভাবে আপনার কাজের আগ্রহ বাড়বে। সময় নষ্ট করতে মন চাইবে না। এভাবে প্রতিটি কাজের ছোট ছোট ভাগের জন্য ছোট ছোট পুরস্কার বা শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে পারেন।
অনেক কোম্পানীই কিন্তু তাদের কর্মীদের এভাবে উদ্দীপনা দিয়ে থাকে। সময়ের আগে সেলস টার্গেট পূরণ করতে পারলে বাড়তি বোনাস, সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারলে তারচেয়ে একটু কম, আর না পারলে কোনও বোনাস হবে না – এটা আপনি নিজেই নিজের বস হয়েও করতে পারেন। ব্যাপারটা নিজের ওপর প্রয়োগ করলে নিজের পরিবর্তন দেখে নিজেই অবাক হয়ে যেতে পারেন।
০৪. সময়ের হিসাব রাখুন:
অনেক সময়ে ঢিলেমি করতে করতে কতটা সময় আমরা নষ্ট করছি, তা বুঝতে না পারার কারণে আমরা ঢিলেমি বন্ধ করতে পারি না।
আপনি যদি দেখতে পান যে, কাজের পেছনে আপনি দিনের মাত্র ২০ ভাগ সময় ব্যয় করছেন, আর ঢিলেমি করে বাকি ৬০ ভাগ নষ্ট করছেন – তবে আপনার টনক নড়তে বাধ্য। অনেক সময়ে আমরা চেয়ার টেবিলে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকি কিন্তু পড়াশুনা বা কাজ হয় খুব কম সময়ের। কিন্তু সেই সময় কতটা – তা বুঝতে না পারায় আমরা এটা নিয়ে সচেতন হতে পারি না।
কোথায় কতটা সময় খরচ হচ্ছে – এটা বুঝতে পারলে আপনার পক্ষে নিজের অভ্যাসের পরিবর্তন করা, ও ঠিক কোথায় পরিবর্তন আনতে হবে – তা বুঝতে পারা অনেক সহজ হয়ে যায়।
একথা সত্যি যে, প্রতিটি মিনিটের হিসেব রাখা অসম্ভবের কাছাকাছি একটি ব্যাপার, কিন্তু মিনিট না হলেও ঘন্টার হিসেব রাখাই যায়। আপনি যখন কোনও কাজ শুরু করলেন – তখন হাতে কলমে সেই কাজ কখন শুরু করছেন সেটা কাগজে লিখুন। কাজ করতে করতে যদি অন্যকিছুতে মনযোগ চলে যায় – সেই সময়টিও কাগজে লিখুন, আবার কাজে ফিরে আসার সময়টি কাগজে লিখুন। এভাবে প্রতিবার কাজে মনযোগ দেয়ার সময়ে তখন কয়টা বাজে – এটি লিখে রাখলে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন, ঠিক কতটা সময় আপনি আসলেই কাজ করছেন।
এতে আরেকটি উপকার হবে; আপনি আপনার মনযোগের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠবেন। যখনই মনযোগ অন্যদিকে যাবে, বা আপনি কাজ ফেলে অন্য কোথাও যাবেন – আপনার মনের একটা দিক সব সময়ে কাজের ব্যাপারে সচেতন থাকবে।
যেহেতু আমরা অনেক সময়ে অচেতন ভাবেই কাজ ফেলে সময় নষ্ট করি, সেহেতু এই সচেতন থাকাটা সময় নষ্টের মাত্রা অনেক কমিয়ে আনবে।
০৫. অভ্যাস ফিরে আসা থামান:
সবকিছুর পর দীর্ঘসূত্রিতা বা ঢিলেমি আসলে একটি বদ অভ্যাস। আর অভ্যাসের একটি বদ অভ্যাস হলো চলে গিয়েও ফিরে ফিরে আসা। একটি বদ অভ্যাস হয়তো ত্যাগ করে কিছুদিন ভালো থাকলেন, কোনও না কোনও ছুতোয় সে ফিরে এসে আবার ঘাঁটি গেড়ে বসবে। আর এই ফিরে আসাকে থামানোটা অভ্যাস দূর করার চেয়েও জরুরী।
কাজেই বদ অভ্যাস ত্যাগ করার পর সেটা যেন আবার ফিরে না আসে সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে।
এই কড়া নজর রাখার সময়ে মনে রাখতে হবে, বদ অভ্যাস অনেক সময়ে ছদ্মবেশ ধরে আক্রমণ করে। যেমন ধরুন, আপনার দীর্ঘসূত্রিতার হাতিয়ার ছিলো সারাদিন সিরিয়াল দেখা। সেটা বাদ দিয়ে কয়দিন সময়ের কাজ সময়ে করছিলেন, আবার হঠাৎ করে সিনেমা দেখার প্রতি আপনার ঝোঁক অনেক বেড়ে গেছে। আপনার মন আপনাকে বলবে – আপনি আগের মত সময় নষ্ট করছেন না। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, এটা চা ছেড়ে কফি ধরার মত। চা হোক, কফি হোক – মূল ব্যাপারটা কিন্তু ক্যাফেইন। কাজেই চা ছাড়তে চাইলে বেশি করে পানি খান, কফি খেলে সেই একই ব্যপার ঘটবে। সিগারেট ছাড়তে চাইলে সিগারেট ছাড়ুন, ব্র্যান্ড বদলাবেন না। আর এটা আপনি করছেন কিনা – সেদিকে কড়া নজর অবশ্যই রাখুন।
অভ্যাস একদিনে বদলানো যায় না, একে ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে বদলাতে হয়। কাজেই, একবারে না বদলে কৌশল অবলম্বন করে বদলান। এবং এটা যেন ফিরে না আসে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
পরিশিষ্ট:
এত বড় একটি লেখা পড়ার পর খুব বড় উপসংহার টানার প্রয়োজন মনে করছি না। শুধু এটুকু বলতে চাই, মানুষ চাইলে পারেনা এমন কিছু নেই। সৃষ্টিকর্তা শুধু শুধু মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব করেননি। নিজের আদিম প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণের বুদ্ধি ও ক্ষমতা তিনি মানুষকে দিয়েছেন।
দীর্ঘসূত্রিতা বা ঢিলেমিকে নিয়ন্ত্রণ করা আপাতদৃষ্টিতে যতই কঠিন মনে হোক না কেন, আপনি চাইলে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারবেন। এই একটি মাত্র স্বভাবকে জয় করতে পারলে নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব, যা সাধারনভাবে হয়তো কল্পনাও করা যায় না। আর সেই পথে যদি এই লেখাটি আপনার বিন্দুমাত্র উপকারেও আসে – তাহলেই আমাদের প্রচেষ্টা সফল বলে মনে করবো।
—
লেখাটির বিষয়ে যে কোনও মতামত আমাদের কমেন্ট করে জানান। যদি মনেহয় এই লেখাটি অন্যদেরও কাজে আসবে, তবে শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন। আমাদের নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের গ্রুপ ও পেজে এ্যাকটিভ থাকুন। সাফল্যের পথে প্রতি পদক্ষেপে লড়াকু আপনার সাথে থাকতে চায়।
আপনার জন্য আরও:
⇒ ৬টি সহজ কৌশলে যে কোনও কাজে গভীর মনযোগ নিয়ে আসুন
⇒ কেন এক সময়ে মাত্র একটি কাজেই ফোকাস করা উচিৎ?
⇒ ডিপ ওয়ার্ক: কোলাহলপূর্ণ জগতে কিভাবে পূর্ণ মনযোগে কাজ করা যায়
⇒ ৯ জন বিশ্বসেরা সফল উদ্যোক্তার সকালের রুটিন
⇒ কাজ ফেলে রাখা বা ঢিলেমির ৮টি ভয়াবহ কুফল