বর্তমান সময়ে কোনও কাজ বা পড়াশুনায় গভীর মনযোগ দেয়াটা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।কিন্তু কোনও কাজ সফল ভাবে করতে গেলে গভীর মনযোগী হওয়ার কোনও বিকল্প নেই। আশপাশের মানুষজন তো আছেই, সেইসাথে রয়েছে ফেসবুক, ইউটিউব, সিনেমা – ইত্যাদি হাজারটা মনযোগ নষ্ট করার উপায়।চাইলেও মনযোগ দেয়াটা যেন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তবে আজ আপনাকে কাজে মনযোগী হওয়ার যে ৬টি উপায় বলব, এর মাধ্যমে আপনি কয়েক মিনিটের মধ্যেই যে কোনও কাজে পূর্ণ মনযোগ দিতে পারবেন।
০১. মিউজিক
টিভির পর্দায় অথবা বাস্তবেও হয়তো দেখে থাকবেন, এ্যাথলেটরা খেলতে নামার আগে বা অনুশীলনের সময়ে কানে হেডফোন দিয়ে রাখেন। তাদের চেহারাতেও একটা প্রত্যয়ী ভাব দেখা যায়। অনেকেই হয়তো জানেন না, এটা তাঁরা করেন ফোকাস ঠিক করার জন্য।তাঁরা সেইসব গান শোনেন যেগুলো তাঁদের সেরা পারফর্মেন্স দিতে উৎসাহ দেয়। যেগুলো তাঁদের মন ও শরীরকে চাঙ্গা করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব কর্মী কাজের সময়ে বা আগে গান/ইন্সট্রুমেন্টাল শোনেন তারা অন্যদের চেয়ে ৪০% বেশি কাজ করতে পারেন।আপনার মুড খারাপ থাকলে আপনার প্রিয় কোনও গান কয়েকবার শুনলেই দেখবেন মুড ভাল হয়ে যাচ্ছে। কাজের অনাগ্রহটি আগ্রহে পরিনত হচ্ছে। লেখালেখি বা এই ধরনের কোনও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করার সময়ে হাল্কা ভলিউমে সফট ইন্সট্রুমেন্টাল চালিয়ে রাখতে পারেন – দেখবেন মুড ভাল থাকার পাশাপাশি কাজে মনযোগও অনেকটাই বেড়ে গেছে।
০২. আনুষ্ঠানিকতা
আনুষ্ঠানিকতা বা ‘Ritual’ অল্প সময়ের মধ্যে মনযোগ সৃষ্টি করতে দারুন সাহায্য করতে পারে।এই আনুষ্ঠানিকতা আপনাকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গভীর মনযোগের জগতে ঢুকতে সাহায্য করবে। আনুষ্ঠানিকতা বলতে এখানে কোনও একটি নির্দিষ্ট কাজ বোঝাচ্ছি – যেটি আপনি কোনও কাজে মনযোগ দেয়ার আগে নিয়মিত করবেন। সেটা হতে পারে কাজের আগে এক কাপ চা খাওয়া, নিজের পছন্দের এক বা একাধিক গান শোনা, হাল্কা শরীরচর্চা করা, ধ্যান করা। কাজের আগে এগুলো করার সময়ে মনে মনে বলবেন এই আনুষ্ঠানিকতার শেষে যে কোনও কাজে আপনার পূর্ণ মনযোগ চলে আসবে। প্রথম দিকে পূর্ণ মনযোগ না আসলেও একটা সময়ে আপনার মস্তিষ্ক এতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে – এবং আপনি আপনার নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পর যে কাজেই চাইবেন, সেই কাজেই পূর্ণ মনযোগ দিতে পারবেন।
০৩. যেখানে স্বস্তি পান, সেখানেই কাজ করুন
আমাদের মধ্যে একটা ধারনা আছে যে পড়াশুনা বা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের জন্য চেয়ার টেবিলে বসাটা জরুরী। গবেষণায় দেখা গেছে এই ধারনাটি ঠিক নয়। আসলে আপনার যেখানে বসে কাজ করতে ভাল লাগবে, সেখানে কাজ করলেই সবচেয়ে ভালোভাবে মনযোগী হওয়া যায়। আপনার যদি ভালোলাগে বিছানায় বসে পড়তে, কিন্তু ‘নিয়ম মানতে’ গিয়ে যদি আপনি জোর করে চেয়ার টেবিলে বসেন – তবে মনযোগ বার বার ছুটে যাবে। নিজের পছন্দ মত জায়গায় কাজ না করতে পারলে মুড ঠিক থাকে না। এবং মুড ঠিক করার অজুহাতে আমরা কাজ থেকে সরে যাই। কাজেই মনযোগ ধরে রাখার জন্য চেয়ার টেবিল জরুরী নয়, জরুরী হচ্ছে আপনি কোন অবস্থানে কাজ করতে পছন্দ করেন – সেটা।
০৪. মনযোগ নষ্ট করে এমন জিনিসপত্র দূরে রাখুন
আমরা হয়তো তেমন একটা গুরুত্ব দিই না, কিন্তু মোবাইলের মেসেজ, সোশ্যাল মিডিয়ার নোটিফিকেশন – ইত্যাদি দারুন ভাবে মনযোগ নষ্ট করে। আপনি হয়তো খেয়াল করেন না, কিন্তু এসবের কারনেই আপনার যে কাজ আধা ঘন্টায় হয়ে যাওয়ার কথা, সেই কাজ করতেই প্রায় এক ঘন্টা লেগে যায়। কোনও কাজের থেকে একবার মনযোগ ঘুরে গেলে সেই মনযোগ ফিরে পেতে গড়ে ২৩ মিনিটের মত সময় লাগে। সেকারনে, কোনও কাজে পূর্ণ মনযোগ দিতে চাইলে আপনার মোবাইল ফোনটি দূরে সরিয়ে রাখুন, আর সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল লগ আউট করুন। প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তি হলেও অচিরেই এই অস্বস্তি কেটে যাবে।
০৫. আবেগের শক্তিকে (Emotional Energy) কাজে লাগান
গভীর মনযোগ দেয়ার জন্য অনেকটা মানসিক শক্তির প্রয়োজন হয়। আপনার মনযোগ কেমন হবে, তার অনেকটাই নির্ভর করে সেই সময়ে আপনি কেমন অনুভব করছেন তার ওপর। সত্যি কথা বলতে রাগ, দু:খ বা আনন্দ – এর সবগুলোই এক একটি আবেগ, এবং এদের প্রতিটির মধ্যেই একটা আবেগীয় মানসিক শক্তি লুকিয়ে আছে। আমরা অনেক সময়ে আবেগী অবস্থায় থাকলে কাজে মন দিতে পারি না। কিন্তু এই আবেগগুলোকে আমরা চাইলে আমাদের পক্ষে কাজে লাগাতে পারি। মনযোগ নষ্ট করার বদলে এগুলো আপনাকে মনযোগ বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। সেরা প্রেমের গানগুলো কিন্তু চরম আবেগের সময়েই লেখা হয়। বহু খেলোয়াড়ের সেরা খেলাটি বের হয়ে এসেছে তাঁদের চরম আবেগের মূহুর্ত গুলোতে। আপনার বস যদি আপনাকে কড়া কথা শোনায় – সেই সময়ে জমে ওঠা রাগকে আপনি জেদে পরিনত করে আপনার সেরা কাজটি তাকে দেখিয়ে দিতে পারেন। আবেগে ভেসে না শুধুমাত্র মনোভাবে একটু পরিবর্তন এনে আপনি এই আবেগ গুলোকে উদ্দীপনায় পরিনত করতে পারেন।
০৬. নেতিবাচক বা নেগেটিভ মনোভাব থেকে বের হয়ে আসুন
একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, আমাদের মন কখনওই চুপ থাকে না। প্রতিনিয়ত হাজারটা কথা মাথার মধ্যে বাজতে থাকে। আর যখনই আমরা কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজে নামি, তখন নানান ধরনের আজেবাজে নেতিবাচক চিন্তা আর কথা মাথার ভেতরে গিজগিজ করতে থাকে। কোনও কাজে হাত দিলে, কাজটা ঠিকমত করতে না পারলে কি হবে, কতটা ক্ষতি হবে – এইসব আগে থেকেই মাথার ভেতরে বাজতে থাকে। এসব নেতিবাচক মনোভাব মনের ভেতরে থাকলে আপনি কখনওই আপনার কাজে পূর্ণ মনযোগ দিতে পারবেন না।
তবে আশার কথা হলো একটু চেষ্টা করলেই মনের মাঝে বাজতে থাকা এইসব নেতিবাচক আওয়াজ থামিয়ে দিয়ে আপনি পূর্ণ মনযোগে আপনার কাজ করতে পারবেন। মনের মাঝে যদি নেতিবাচক কথার উদয় হয়, তবে নিজেকে বলুন এই কাজ তো আপনার আগেও অনেকেই করে সফল হয়েছেন। আপনি যদি একজন প্রোগ্রামার হন, তবে বড় বড় প্রোগ্রামারদের কথা ভাবুন, খেলোয়াড় হলে বড় বড় খেলোয়াড়ের অর্জনের কথা ভাবুন – এভাবে আপনি যা-ই করতে চান না কেন, আপনার আগে বহু মানুষ সেই ক্ষেত্রে বিশাল বিশাল অর্জন করে গেছেন। কাজ শুরুর আগে কয়েক মিনিট এসব ইতিবাচক বিষয় নিয়ে ভাবলে বা পড়লে আপনি দেখবেন আপনার মনের মাঝের দ্বিধা অনেকটাই কেটে গেছে এবং আপনি অনেক বেশি মনযোগের সাথে কাজ করতে পারছেন।
চাইলে কাজ শুরুর আগে আপনি যে কাজ করছেন, সেই ক্ষেত্রে যাঁরা আগে সফল হয়েছেন, তাঁদের বানী পড়তে পারেন, অথবা তাঁদের জীবনীর কিছু অংশ পড়তে পারেন – এতে করেও আপনার মন অনেকটাই চাঙ্গা হয়ে উঠবে। আর এই উৎসাহের ফলেই আপনি দেখবেন আপনার মনযোগ কতটা বেড়ে গেছে।
পরিশিষ্ট:
প্রথমেই বলেছি, কোনও কাজে শতভাগ সাফল্য পেতে হলে অবশ্যই আপনাকে পুরো মনযোগের সাথে কাজ করতে হবে। অব্যহত আর অখন্ড মনযোগ আর নিবিড় পরিশ্রমই আসলে সকল সাফল্যের চাবিকাঠি। কাজেই সাফল্যের জন্য মনযোগের কোনও বিকল্প নেই।
আশাকরি লেখাটি আপনার মনযোগের উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করবে। আপনার যদি মনে হয় এই লেখাটি পড়ে আপনার আশপাশের মানুষও উপকার পেতে পারে, তবে শেয়ার করার মাধ্যমে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন। লেখাটির বিষয়ে যে কোনও মতামত আমাদের কমেন্ট করে জানান। আপনার প্রতিটি মতামতই আমাদের কাছে মূল্যবান। ভাল থাকুন, আমাদের সাথে থাকুন। সাফল্যের পথে প্রতিটি পদক্ষেপে লড়াকু আপনার সাথে আছে।