আমরা সবাই বহুবার শুনেছি যে, “পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি”। পরিশ্রম করলে সাফল্য আসবে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও উদ্যোক্তা টমাস আলভা এডিসন বলেছিলেন: “জিনিয়াস হলো ১% ইচ্ছা, আর ৯৯% পরিশ্রম”।
শিক্ষক, অভিভাবক, বন্ধু – যারাই আমাদের ভালো চায়, তারাই বলে পরিশ্রম করার কথা। এটা প্রমাণিত যে, পরিশ্রম করলে সাফল্য আসবেই। আপনি যতই প্রতিভাবান, শক্তিশালী আর যোগ্য হন না কেন – আপনি যদি পরিশ্রম না করেন, তবে আপনার চেয়ে কম যোগ্যতা নিয়েও অনেকে আপনাকে টপকে যাবে। এর কারণ, পরিশ্রম না করলে প্রতিভা শেষ হয়ে যায়। আর পরিশ্রম করলে প্রতিভা না থাকলেও প্রতিভা জন্ম নেয়।
আমরা পরিশ্রমের সাথে সাফল্যের সম্পর্কের কথা জানলেও, ঠিক কিভাবে আমাদের সাফল্য পেতে সাহায্য করে – তা কেউ আমাদের ব্যাখ্যা করেনি।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে, এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা হয়েছে। পরিশ্রমের ফলে ঠিক কি কি কারণে সাফল্য আসে, এবং কঠোর পরিশ্রম ঠিক কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনে – এসবই সেই গবেষণায় উঠে এসেছে।
২০১৪ সালে “The 4 Hour Work Week” ম্যাগাজিনে এই বিষয়ে একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়, যেখানে কঠোর পরিশ্রমের ফলে ঠিক কি কারণে মানুষ সফল হয় – তা খুব সুন্দর ভাবে সেখানে তুলে ধরা হয়। আজ আমরা সেই আর্টিকেল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আপনার সামনে সেই বিষয়গুলো তুলে ধরছি।
কঠোর পরিশ্রম করলে একজন মানুষের জীবনে মোট ৫টি পরিবর্তন আসে, এই পরিবর্তনগুলোই মূলত তার সাফল্যের কারণ হয়ে ওঠে। চলুন জেনে নিই এই ৫টি কারণ।
০১. আপনি প্রতিযোগীতায় এগিয়ে থাকবেন
আপনি হয়তো সবার চেয়ে প্রতিভাবান, সবচেয়ে বুদ্ধিমান, সবচেয়ে শক্তিশালী হতে পারবেন না – কিন্তু তারপরও আপনি অন্যদের প্রতিযোগীতায় হারাতে পারবেন। আপনি যদি অন্যদের চেয়ে বেশি কাজ করেন তবে অন্যদের চেয়ে অনেক বিষয়ে কমতি থাকলেও আপনি তাদের চেয়ে এগিয়ে থাকতে পারবেন।
অনেক সময়ে আমরা নিজেরাই লক্ষ্য করি না যে যাদের আমরা প্রতিযোগীতায় পেছনে ফেলছি, তারা আসলে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ট্যালেন্টেড, কিন্তু আমরা শুধু পরিশ্রমের জোরে তাদের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।
আবার যদি আপনি ভাবেন যে অন্য কেউ আপনার চেয়ে শক্তিশালী, ধনী, প্রতিভাবান – এবং আপনি তাকে হারাতে পারবেন না – তাহলে ভুল করবেন। আজকের পৃথিবীতে যারাই নিজের চেষ্টায় বড় হয়েছেন, সবাই একটা কথাই বলেন, আপনি যদি সবার চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে পারেন – তবে আপনি সবার চেয়ে এগিয়ে থাকবেন।
একটি ক্লাসে যে ছেলে বা মেয়েটি প্রথম হয়, সে-ই যে সবার চেয়ে ট্যালেন্ট – এই কথা কখনওই বলা যাবে না। কিন্তু সে যে সবার চেয়ে বেশি পরিশ্রমী – এই কথা প্রায় নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।
ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে করা গবেষণায় দেখা যায়, সেরা ট্যালেন্ট অথবা আইকিউ এর অধিকারীরা প্রায় সময়েই খুব বেশি ভালো রেজাল্ট করে না। ভালো রেজাল্ট তারাই করে, যারা নিয়মিত পড়াশুনা করে, এবং পড়ার পেছনে শ্রম দেয়।
কর্মজীবনেও সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করা মানুষটিই সবার চেয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
আপনি হয়তো কখনওই আপনার ক্লাসের বা অফিসের সবচেয়ে ট্যালেন্ট মানুষ হতে পারবেন না – কিন্তু আপনি চেষ্টা করলেই সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করা মানুষটি হতে পারবেন। অন্যরা যদি ৮ ঘন্টা পরিশ্রম করে – আর আপনি যদি ৯ ঘন্টাও পরিশ্রম করেন – তাহলেই পরিবর্তনটা টের পাওয়া শুরু করবেন। পড়াশুনা হোক, বা কাজের ক্ষেত্রেই হোক – একটু একটু করে আপনি অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যাবেন।
সর্বকালের সেরা বাস্কেটবল খেলোয়াড় মাইকেল জর্ডান স্কুল টিম থেকে বাদ পড়েছিলেন। কারণ তিনি আসলেই ভালো খেলতেন না। এরপর তিনি জেদের বশে সারদিন বাস্কেটবল চর্চা করতে লাগলেন। এবং এক সময়ে নিজের স্কিল দেখিয়ে সবাইকে অবাক করে দিলেন।
বড় খেলোয়াড় হওয়ার পরও তিনি এই অভ্যাস চালু রেখেছেন। অফ সিজনে অন্য খেলোয়াড়রা যখন ছুটি কাটাতো, তিনি তখনও একা একা প্রাকটিস করতেন। আর এভাবেই প্রতিভা নিয়ে না জন্মেও তিনি সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় হতে পেরেছিলেন। তাঁরচেয়ে অনেক বেশি প্রতিভা নিয়ে জন্মেও হয়তো অনেক খেলোয়াড় ফার্স্ট ডিভিশনই খেলতে পারেননি।
আপনি যখন সবার চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে শুরু করবেন, তখন আপনার কাজের মানও ভালো হতে থাকবে, এবং আপনি অন্যদের চোখে পড়বেন। ধীরে ধীরে সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাবেন। অনেক সময়ে হয়তো আপনি বুঝতেও পারবেন না যে, আপনি অন্য সবাইকে কখন ছাড়িয়ে গেছেন।
০২. কঠোর পরিশ্রম আত্মবিশ্বাস বাড়ায়
সফল হওয়ার জন্য আত্মবিশ্বাসের কোনও বিকল্প নেই। আপনি হয়তো একটি বড় লক্ষ্য ঠিক করেছেন, কিন্তু সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পারবেন কিনা – সেই বিষয়য়ে আপনার কিছুটা হলেও সন্দেহ আছে। মানে, আপনার আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি আছে।
যদি কখনও নিজের আত্মবিশ্বাসে কমতি দেখেন, তখন পরিশ্রমের মাত্রা বাড়িয়ে দিন। পরিশ্রম টেনশন ভুলিয়ে দেয়। পরিস্থিতি যত খারাপই হোক না কেন, পরিশ্রম করা বন্ধ করবেন না।
অনেকেই আছেন, পরিস্থিতি একটু খারাপ হলে, বা ছোটখাট ব্যর্থতা এলে কাজ করা বন্ধ করে দেন, বা কাজে ঢিল দেন। কারণ এইসব পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাস একটু কমে যায়। এবং এটা খুব স্বাভাবিক। একটি কাজ করে সফল হওয়ার আশা করে যদি দেখেন আপনি ব্যর্থ হয়েছেন – তবে নিজের যোগ্যতার ব্যাপারে সন্দেহ জাগতেই পারে। কিন্তু এই সন্দেহ শুধুই একটি অনুভূতি। যদি ডানের রাস্তা ভুল হয়, আপনি সব সময়েই আবার ফিরে গিয়ে বাঁয়ের রাস্তায় চলতে পারবেন।
যারা পরিশ্রম করতে ভালোবাসেন, এবং সব সময়ে কঠোর পরিশ্রম করেন – তাঁরা কখনও হতাশ হয়ে কাজ বন্ধ করেন না। আপনি যখন সব পরিস্থিতিতে কাজ করে যেতে পারবেন – তখন দেখবেন আপনার নিজের প্রতি বিশ্বাস নষ্ট হচ্ছে না। আপনি সব ধরনের ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে পারবেন – ফলে আপনার নিজের প্রতি বিশ্বাস দিনে দিনে বাড়তে থাকবে। এবং এই বিশ্বাস না হারিয়ে পরিশ্রম করে যাওয়ার অভ্যাসই আপনাকে শত ব্যর্থতার পরও সফল করবে।
বিশ্ব বিখ্যাত বিজনেস কোচ টনি রবিন্স একবার সেরা উদ্যোক্তাদের মনোভাব নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলেন। তাঁর গবেষণার মূল সাবজেক্ট ছিলেন, স্টিভ জবস, রিচার্ড ব্র্যানসন, এবং বিল গেটস।
টনি এই তিনজনের মধ্যে একটি কমন গুণ দেখতে পান। গুণটি ছিল, যে কোনও পরিস্থিতিতে হাল না ছেড়ে পরিশ্রম করে যাওয়ার অভ্যাস। তাঁরা তিনজনই স্বীকার করেছেন, যে কোনও পরিস্থিতিতে কাজ করে যাওয়ার অভ্যাসই তাঁদের আত্মবিশ্বাসী থাকতে সাহায্য করেছে।
কাজেই নিজের লক্ষ্য পূরণের পথে যদি আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে চান, তবে সব অবস্থাতেই কঠোর পরিশ্রম করে যান। তাহলেই সফল হবেন।
০৩. আপনি সব সময়ে খুশী থাকবেন
কঠোর পরিশ্রম করলে শরীর ও মন – দুটোই ভালো থাকে। আপনি যখন নিয়মিত নিজের লক্ষ্য পূরণের জন্য কাজ করবেন – তখন নিজের মধ্যে একটা খুশী খুশী ভাব সব সময়েই অনুভব করবেন।
এই মানসিক শান্তি আপনার চেহারা ও আচরণে ফুটে উঠবে, ফলে আশপাশের মানুষ আপনাকে আরও বেশি পছন্দ করা শুরু করবে।
আমরা সবাই জানি সফল হতে গেলে ভালো কমিউনিকেশনের কোনও বিকল্প নেই। আপনি যদি সব সময়ে মানুষের সাথে হাসিমুখে ও আন্তরিকতার সাথে কথা বলেন – তখন দেখবেন অন্যদের সাথে আপনার যোগাযোগ ভালো হচ্ছে। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও কাজের সম্পর্ক – দুই দিকেই উন্নতি হচ্ছে।
আর এই মানসিক প্রশান্তি ও অন্যদের সাথে ভালো সম্পর্ক একটা সময়ে দিয়ে চূড়ান্ত সাফল্য অর্জনে বিশাল অবদান রাখে।
০৪. আপনি যে কোনও কাজে দক্ষ হয়ে যাবেন
ইংরেজীতে একটি জনপ্রিয় প্রবাদ আছে “practice makes one perfect”। সোজা বাংলায়, অনুশীলনই দক্ষ হওয়ার সেরা উপায়।
আপনি জীবনে যা-ই হতে চান না কেন, আপনাকে সেই বিষয়ে মাস্টার হতে হবে। এবং এই মাস্টার হওয়ার জন্য গভীর অনুশীলনের কোনও বিকল্প নেই।
আমরা যে কাজেই দক্ষ বা বিশেষজ্ঞ হতে চাই না কেন, প্রথমে আমাদের একদম শুরু থেকে শুরু করতে হয়। বার বার প্রাকটিস করে করে সেই বিষয়টিতে এক্সপার্ট হয়ে উঠতে হয়। আর এর জন্য দরকার কঠোর পরিশ্রম করার ইচ্ছা।
মাইকেল জর্ডানের কথায় আবার ফিরে আসি, তিনি প্রথম দিকে তেমন ভালো বাস্কেটবল খেলতে পারতেন না। টিম থেকে বের করে দেয়ার পর তিনি নিজে নিজে দিন রাত পরিশ্রম করে প্রাকটিস করতে থাকেন – এবং এক সময়ে বিশ্বের ইতিহাসের সেরা একজন বাস্কেটবল খেলোয়াড়ে পরিনত হন।
আপনি যে বিষয় নিয়েই কঠোর পরিশ্রম করেন না কেন, একটা সময়ে আপনি সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবেনই।
আপনি হয়তো একজন ক্রিকেটার হতে চান, কিন্তু আপনি ঠিকমত ব্যাটই ধরতে পারেন না। অন্যরা হয়তো আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, মজা নেয়। কিন্তু আপনি যদি এই বিষয়ে দীর্ঘ সময় ধরে নিয়মিত কঠোর পরিশ্রম করেন – তবে যারা আপনাকে নিয়ে হাসছে, তারাই এক সময়ে আপনাকে গুরু মানবে।
ক্রিকেট খেলাটা শুধু উদাহরণ দেয়ার জন্য বলা। জীবনে আপনি যেটাই হতে চান না কেন, নিয়মিত কঠোর পরিশ্রম আর অনুশীলন করলে আপনি যে কোনও কিছু হতে পারবেন।
বাংলাদেশ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের প্রধান শহীদ আল বুখারীর মন্তব্য: “আপনি যোগ্য কি যোগ্য নন, তারচেয়ে বড় কথা হলো, কাজের প্রতি আপনার আন্তরিকতা ও কঠোর পরিশ্রম করার ইচ্ছা।”
আপনি যদি কোনও কাজের প্রতি আন্তরিক থেকে কঠোর পরিশ্রম করেন, তবে যোগ্য হওয়া শুধুই সময়ের ব্যাপার। আর একবার যোগ্য হয়ে উঠলে, ধরে নেবেন সাফল্য খুব তাড়াতাড়িই আসছে।
০৫. আপনি অন্যদের মোটিভেট করবেন
জীবনে বড় হতে গেলে নেতৃত্ব দিতে পারাটা খুব জরুরী। আপনি যদি পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের ক্ষেত্রে ভালো পারফর্ম করতে পারেন, তবে অন্যরা আপনার ওপর ভরসা করা শুরু করবে। আপনার কথা মানতে শুরু করবে। কঠোর পরিশ্রমী মানুষেরা সব সময়েই নিজেদের কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার মাঝে রাখেন। তারা কখনও কাজের সময়ে অন্য কিছু করে সময় নষ্ট করেন না। এবং তাঁদের দেখে অন্যরাও নিজেদের সেরাটা দিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা পায়।
আগেই বলেছি, একজন মানুষ যদি নিজের লক্ষ্য পূরণের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে, তার মাঝে দারুন আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়। নিজের প্রতি এই আস্থার কারণে অন্যরাও তার ওপর বিশ্বাস রাখার সাহস পায়। তার কাজ দেখে অন্যরা মোটিভেট হয়। এই কারণে ধীরে ধীরে সে অন্যদের নেতা হয়ে ওঠে। অন্যরা তার কথা মানে, এবং তার যে কোনও প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
লক্ষ্যে অটল থেকে কঠোর পরিশ্রম করে যাওয়ার ক্ষমতাই জ্যাক মা, বারাক ওবামা অথবা মার্ক জুকারবার্গ এর মত মানুষদের সাধারণ অবস্থা থেকে এত বড় সফল করেছে।
আপনিও যদি নিজের লক্ষ্যের প্রতি অটল থেকে পরিশ্রম করে যেতে পারেন, তবে আপনিও অন্যদের অনুপ্রেরণা দিতে পারবেন। যার ফলে আপনিও একদিন সফল হবেন।
শেষ কথা:
পরিশ্রম যে সাফল্য আনে – শুধু এই একটি কথার ওপর ভিত্তি করে হয়তো আপনি দিন রাত আপনার লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যাচ্ছিলেন। সেই পথে আরও একটু উৎসাহ দেয়ার জন্য আমাদের এই প্রচেষ্টা। যাতে আপনি সাফল্য পাওয়ার জন্য পরিশ্রমের গুরুত্বকে আরও ভালো ভাবে বুঝতে পারেন।
এই লেখা পড়ে যদি আপনার পরিশ্রম করার ও সফল হওয়ার উৎসাহ একটুও বাড়ে – তাহলেই আমাদের প্রচেষ্টা সফল।
আমরা কতটা সফল হয়েছি, তা আমাদের কমেন্ট করে জানান। আপনার প্রতিটি মতামতই আমাদের কাছে অমূল্য।
আর যদি মনে হয় এই লেখাটি পড়ে অন্যরাও উপকৃত হবেন – তাহলে শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন।
এই ধরনের আরও লেখার জন্য নিয়মিত আমাদের সাথে থাকুন। সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার সাথে থাকতে চায়।