বারাক ওবামার জীবনী: এক অবিশ্বাস্য সাফল্যের কাহিনী


বারাক ওবামার জীবনী পর্যালোচনা করতে গেলে, প্রথমেই চোখে পড়ে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য একজন মানুষের যতগুলো প্রতিকূলতা পার করে আসা সম্ভব, তারচেয়েও অনেক বেশি প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে বারাক ওবামা হোয়াইট হাউজে বসেছিলেন। যদি একটু চিন্তা করে দেখেন তাহলে উক্তিটিকে অতটা বাড়িয়ে বলা মনে হবে না।

তাঁর না ছিল অর্থ, না ছিল পারিবারিক প্রভাব, না ছিল সামাজিক প্রাধান্য, এমনকি শতভাগ আমেরিকানও তিনি নন। এসব ছাড়াও যে শুধু প্রজ্ঞা, অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর সততা দিয়ে সর্বোচ্চ ক্ষমতা আর সম্মানের আসনে বসা যায় – ওবামা সেটা প্রমাণ করেছেন।

বর্তমান আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত সোনার চামচ মুখে নিয়েও তিনি জন্মাননি, তাঁর নিজের অর্জিত অর্থও ছিল প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পেইন চালানোর পক্ষে অনেক কম। তাঁর পূর্বসূরী জর্জ ডব্লিউ বুশের মত তাঁর বাবা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতিও নন। কেনেডি বা ক্লিনটন পরিবারের সাথে তাঁর কোনওরকম কোনও আত্মীয়তার সম্পর্কও ছিল না। ছোটবেলা থেকেই অর্থনৈতিক অনটন ও শ্বেতাঙ্গ প্রধান সমাজে বঞ্চনার শিকার একজন কেনিয়ান মুসলিম পিতার সন্তান বারাক ওবামার হোয়াইট হাউস জয়ের কাহিনী তাই কল্পকাহিনীকেও হার মানায়।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরও তাঁকে তাঁর পূর্বসূরীর রেখে যাওয়া একটি অস্থির বিশ্বের সাথে সাথে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়া দেশকে সামলাতে হয়েছে। কিন্তু কিভাবে ধাপে ধাপে শুধুমাত্র নিজের মেধা, ইচ্ছাশক্তি আর সততা দিয়ে এই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন ওবামা? চলুন ওবামার জীবনী থেকে আমরাও অনুপ্রেরণা খুঁজে নিই।

এক নজরে বারাক ওবামার জীবন কাহিনী:

১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হনুলুলুতে কৃষ্ণাঙ্গ কেনিয়ান পিতা ও শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান মাতার সন্তান হিসেবে জন্ম নেয়া বারাক ওবামা (জুনিয়র) হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন হার্ভাড ল-রিভিউ এর সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের সিনেটর এবং তারপর ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৪৪ তম আমেরিকান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বপ্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি হিসেবে হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করেন বারাক ওবামা।

জন্ম ও বাল্যকাল:

ভূমিকায় বলা হয়েছিল, বারাক ওবামার জীবন কাহিনী আসলে একটি দারুন সিনেমার গল্প। জন্মের পরপরই যে গল্পের শুরু হয়। গল্পের বাঁকে বাঁকে রয়েছে সব নাটকীয় মোড় এবং চোখে জল আনার মত সব আবেগী দৃশ্য। ওবামার বাবা-মায়ের গল্পও কিন্তু কম বৈচিত্রপূর্ণ নয়।

তাঁর মা এ্যান ডানহাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ক্যানসাসের একটি সেনা শিবিরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পার্ল হারবারে জাপানী সৈন্যদের ভয়াবহ আক্রমণের পর এ্যান এর পিতা স্ট্যানলি ডানহাম সেনাবাহিনীতে যোগদান করে ইউরোপে লড়াই করতে চলে যান।

এ্যান এর মা ম্যাডেলিন একটি বোমার কারখানায় কাজ নেন। যুদ্ধের পর এ্যান এর পিতামাতা ‘জি.আই. বিল’ (যুদ্ধফেরৎ যোদ্ধাদের পূনর্বাসন ও প্রশিক্ষণের জন্য আমেরিকান সরকারি সংস্থা) এ প্রশিক্ষণ নেন এবং সরকারী পূনর্বাসন প্রকল্পের সাহায্য নিয়ে একটি বাড়ি কেনেন। এরপর আরও কিছুদিন এখানে সেখানে অল্প সময়ের জন্য বাস করে ওবামার নানা-নানী শেষ পর্যন্ত হাওয়াইয়ে থিতু হন।

ওবামার পিতা বারাক ওবামা সিনিয়র কেনিয়ার নায়ানযা প্রদেশের লূও গোত্রের সন্তান ছিলেন। তাঁর বাল্য ও কৈশর কেটেছে আফ্রিকার পথে প্রান্তরে ছাগল-ভেড়া চরিয়ে। এক পর্যায়ে তিনি একটি স্কলারশিপ পেয়ে তাঁর কলেজে পড়ার স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইতে পাড়ি জমান।

ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইতে পড়ার সময়ে ওবামা সিনিয়রের পরিচয় ঘটে সহপাঠী সুন্দরী শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান এ্যান ডানহামের সাথে। এ্যান এবং বারাক ওবামা সিনিয়র ১৯৬১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বিয়ে করেন এবং এর ছয় মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের অন্তর্গত হনুলুলু শহরে ৪ আগস্ট বারাক ওবামার জন্ম হয়।

শিশু ওবামার সাথে তাঁর পিতার কোনও প্রকারের সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ হয়নি। ওবামা আঁতুড় ঘর ছাড়ার আগেই তাঁর বাবা হার্ভাডে পিএইচডি করার উদ্দেশ্যে ম্যাসেচুসেটস্ এ চলে যান। এর কয়েক মাস পরই অ্যান ও ওবামা সিনিয়র সামাজিক ভাবে আলাদা হয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে তাঁদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। ওবামা জুনিয়রের বয়স তখন মাত্র ২ বছর। বিচ্ছেদের অল্প পরেই ওবামা সিনিয়র তাঁর নিজের দেশ কেনিয়ায় ফিরে যান।

১৯৬৫ সালে এ্যান ডানহাম লোলো সোইতোরো নামে হাওয়াই ইউনিভার্সিটির এক ইন্দোনেশিয়ান ছাত্রকে বিয়ে করেন। সেই বিয়ের এক বছরের মাথায় পরিবার সহ ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় বসবাসের উদ্দেশ্যে আমেরিকা ত্যাগ করেন। সেখানেই ১৯৭০ সালে ওবামার সৎবোন মায়া সোইতোরোর জন্ম হয়। এর এক বছরের মধ্যেই কিছু ঘটনার কারনে এ্যান ডানহাম ইন্দোনেশিয়ায় তাঁর ছেলের পড়াশুনা ও জীবনের নিরাপত্তার বিষয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। ১০ বছরের বারাক কে নানা-নানীর সাথে বসবাসের জন্য হাওয়াইতে পাঠিয়ে দেন। পরবর্তীতে এ্যান নিজেও মেয়ে মায়াকে নিয়ে হাওয়াইতে ফিরে আসেন।

পিতার দু:খ :

জীবনে বাবার অনুপস্থিতি ওবামার জন্য যথেষ্ঠ বেদনাদায়ক ছিল। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর ওবামা মাত্র একবার তাঁর বাবাকে দেখেছিলেন, ১৯৭১ সালে ওবামা সিনিয়র যখন অতি অল্প সময়ের জন্য হাওয়াইতে এসেছিলেন – তখন।

বাবার প্রসঙ্গে ওবামা বক্তব্য -”আমার বাবা স্বেচ্ছায় স্বর্গ ত্যাগ করেছিলেন, এবং কোনও কিছু বলেই আমার মা অথবা নানা-নানী (আমার মনের) সেই বেদনা ভোলাতে পারেননি। তাঁরা কেউই আমাকে বোঝাতে পারেননি যে, আমার বাবা আমার জীবনে থাকলে আমার জীবনটা কেমন হত।”

obama with father
[১৯৭১ সালে ওবামার সাথে তাঁর বাবার শেষ দেখা হয়]
হাওয়াই ঘুরে যাওয়ার দশ বছর পর ১৯৮১ সালে ওবামা সিনিয়রের জীবনে বিশাল এক বিপদ নেমে আসে। এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি তাঁর দুই পা হারিয়ে হুইলচেয়ারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তাঁর চাকরিও চলে যায়। পরের বছর তিনি আবারও সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েন, এবার তিনি বেঁচে ফিরতে পারেননি। ১৯৮২ সালের ২৪শে নভেম্বর ওবামা সিনিয়র মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর ছেলের বয়স তখন ২১ বছর।

শিক্ষা:

নানা-নানীর সাথে থাকার সময়ে ওবামা হাওয়াইয়ের বিখ্যাত পূনাহু একাডেমিতে ভর্তি হন। সেখানে ভালো ছাত্রের পাশাপাশি ভালো একজন বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবেও প্রশংসা কুড়ান।

১৯৭৯ সালে তিনি দারুন ফলাফল করে একাডেমি থেকে পাশ করেন। একাডেমীতে পড়া মাত্র তিনজন কালো শিক্ষার্থীর একজন হিসেবে তিনি বর্ণবাদের বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠেন এবং সেইসাথে একজন আফ্রিকান আমেরিকান হওয়া বলতে কি বোঝায় তা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করেন।

নিজের বহুজাতিক পরিচয়ের সাথে তাঁর আত্মপরিচয়কে খাপ খাওয়ানোটা তাঁর জন্য কতটা কঠিন ছিল, পরবর্তীতে তিনি তাঁর লেখায় বর্ণনা করেছেন । তিনি লিখেছেন – “আমি লক্ষ্য করেছিলাম ক্রিসমাস ক্যাটালগে আমার মত দেখতে কেউ নেই … এবং সান্তাক্লজও একজন শ্বেতাঙ্গ মানুষ।”

তিনি আরও লিখেছেন “আমি (একদিন) বাথরুমে গিয়ে সম্পূর্ণ সচেতন অবস্থায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিদিন দেখা প্রতিচ্ছবির দিকে আরও ভালো করে তাকালাম, আমার ভাবনা হচ্ছিল, আমার ভেতরে হয়তো কোনও সমস্যা আছে।”

হাইস্কুল শেষ করার পর লস এ্যাঞ্জেলস এর অকসিডেন্টাল কলেজে দুই বছর পড়াশুনা করেন ওবামা। এরপর তিনি নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে স্থানান্তরিত হন, এবং সেখান থেকেই ১৯৮৩ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন।

এরপর ব্যবসায়িক জগতে দুই বছর কাজ করার পর তিনি শিকাগোতে চলে যান এবং সেখানে একজন সমাজ ব্যবস্থাপক হিসেবে নিন্ম আয়ে মানুষের জন্য কাজ করেন।

আইন ক্যারিয়ার ও সংসার:

আইনে ক্যারিয়ার শুরুর সময়টিতেই “ধার্মিক পরিবেশে বড় না হওয়া” বারাক ওবামা ট্রিনিটি চার্চের সদস্য হন। সেই সময়ে তিনি তাঁর কেনিয়ান আত্মীয়স্বজনদের সাথেও দেখা করেন এবং বাবা ও দাদার কবর দেখতে যান। এই প্রসঙ্গে ওবামা লিখেছিলেন –

আমি দু’টি কবরের মাঝে বসে অনেক্ষণ ধরে কেঁদেছিলাম। আমি আমার আমেরিকান জীবনের কথা ভাবছিলাম, যেখানে জীবন সাদা আর কালো রঙে বিভক্ত। বাল্যকালে প্রত্যক্ষ করা আমার বঞ্চনার অনুভূতি, শিকাগোয় আমার অনুভূত সেই হতাশা আর আশা – সবই সাগর মহাসাগরের দূরত্বে থাকা এই দুই টুকরো জমির সাথে জড়িয়ে আছে।”

কেনিয়া থেকে নতুন এক মনোভাব নিয়ে ফেরত এসে ওবামা ১৯৮৮ সালে হার্ভার্ডের আইন বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরের বছর তাঁর পরিচয় হয় সাংবিধানিক আইনের অধ্যাপক লরেন্স ট্রাইবের সাথে। ট্রাইব ওবামার সাথে কথা বলার পর তার ওপর এতটাই মুগ্ধ হন যে গবেষণা সহকারী হিসেবে তাঁর টিমে যুক্ত হওয়ার ওবামার অনুরোধ ট্রাইব একবাক্যে মেনে নেন।

২০১২ সালে ফ্রন্টলাইনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাইব ওবামার প্রসঙ্গে বলেছিলেন – “হার্ভার্ড আইন বিদ্যালয়ে সে (ওবামা) যত ভালো করতে লাগল, মানুষও তার ওপর ততবেশি মুগ্ধ হতে লাগল। এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে সে যা চাইবে তাই সে পাবে। কিন্তু এটাও স্পষ্ট ছিল যে, সে মানুষের জন্য কাজ করতে চায়, সমাজের অবস্থার পরিবর্তন করতে চায়।

ট্রাইবের দলে যোগ দেয়ার বছরই ওবামা ‘শিকাগো ল-ফার্ম অব সিডলি অস্টিন’ এ একজন সহকারী হিসেবে যোগদান করেন এবং মিশেল রবিনসন নামে একজন তরুণী আইনজীবি সেখানে তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি ভালোলাগা সৃষ্টি হয়।

১৯৯০ সালের ফ্রেবুয়ারীতে প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান হিসেবে ওবামা ‘হার্ভার্ড ল-রিভিউ’ এর সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯১ সালে ভালো ফলের রেকর্ড গড়ে হার্ভার্ড থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে বের হন।

হার্ভার্ড থেকে বের হওয়ার পর ওবামা আবার শিকাগোতে ফিরে যান এবং গণ অধিকার বিষয়ক আইনজীবি হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। সেই সময়ে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবিধানিক আইন পড়ানোও শুরু করেন।

সেখানে তিনি প্রভাষক থেকে এক সময়ে অধ্যাপকে উন্নীত হন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ১৯৯২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছিলেন।১৯৯২ সালে বিল ক্লিন্টনের নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে ভোটার নিবন্ধন প্রকৃয়ায় প্রত্যক্ষ সহায়তা করেছিলেন।

সেই একই বছর ৩ অক্টোবর ওবামা মিশেল রবিনসনকে বিয়ে করেন, এবং শিকাগোর দক্ষিনে কেনউডে বসবাস শুরু করেন। ১৯৯৮ সালে তাঁদের প্রথম কন্যাসন্তান মালিয়া, এবং ২০০১ সালে সাশা জন্মগ্রহণ করে।

ইলিনয়ের রাজনীতিতে প্রবেশ:

১৯৯৫ সালে বারাক ওবামা “আমার পিতার স্বপ্ন: একটি গোত্র ও উত্তরাধিকারের গল্প (Dreams from My Father: A Story of Race and Inheritance)” শিরোনামে একটি আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। বইটি দারুন ভাবে সাহিত্যিকদের প্রশংসা পায় এবং এখন পর্যন্ত মোট ২৫টি ভাষায় বইটি অনূদিত হয়েছে।

২০০৪ সালে বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয়, এবং সেবছরই শিশুদের উপযোগী করে বইটির আরেকটি সংস্করণ বের হয়। ২০০৬ সালে ওবামার নিজের কন্ঠে বর্ণিত বইটির অডিও সংস্করণ শ্রেষ্ঠ আবৃত্তি বিভাগে গ্রামি পুরস্কার লাভ করে।

বইটি বের হওয়ার পর ওবামার নাম জনসাধারণের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে এবং পরিচিত গন্ডির বাইরের মানুষ তাঁকে চিনতে শুরু করে। সেইসাথে গণ অধিকার বিষয়ক আইনজীবি হওয়ায় এবং সমাজসেবামূলক কাজের জন্য সাধারনের মাঝে তাঁর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছিল। ১৯৯৬ সালে তিনি ডেমোক্রেট পার্টির হয়ে ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের স্থানীয় সিনেটে একটি আসনের জন্য নির্বাচনে দাঁড়ান এবং জয়লাভ করেন।

রাজ্যের একজন সিনেটর হিসেবে নৈতিকতাকে আইনে পরিনত করার বিষয়ে ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকান – দুই দলের সাথে মিলেই কাজ করেন। এছাড়াও তিনি সিনেটর থাকাকালীন স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পগুলোর উন্নয়ন এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার ব্যাপারেও কাজ করেন।

নিন্ম আয়ের কর্মীদের আয়কর প্রদানের জন্য তিনি রাজ্য হতবিল থেকে ঋণ দেয়ারও ব্যবস্থা করেন। বেশ কয়েকজন মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত কয়েদির পরবর্তীতে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের সিনেটের সদস্য হিসেবে ওবামা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তদের সাথে মিলে সব প্রধান মামলার জিজ্ঞাসাবাদ ও স্বিকারোক্তির ভিডিও রেকর্ড সংগ্রহ করার বিষয়ে কাজ করেন।

২০০০ সালে ৪ বারের নির্বাচিত ববি রাশ এর বিপরীতে আমেরিকান হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ এর একটি আসন জেতার জন্য লড়াই করে পরাজিত হন। এরপর ২০০২ সালে প্রায় নিরবেই তিনি ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য রাষ্ট্রীয় সিনেট নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য তহবিল গঠনে প্রচারণা শুরু করেন। রাজনৈতিক পরামর্শক ডেভিড এ্যাক্সেলরডের সহায়তায় সিনেটে আসন জয়ের সম্ভাবনা যাচাই করতে শুরু করেন।

২০০১ সালে ৯/১১ এর ফলশ্রুতিতে জর্জ ডব্লিউ বুশের নেয়া ইরাক আক্রমণের উদ্যোগের প্রথম বিরোধিতা করা রাজনীতিকদের মধ্যে ওবামা একজন। ২০০২ সালের অক্টোবরে, ওবামা যখন শুধুই একজন রাজ্য সিনেটের সদস্য তখনই শিকাগোর ফেডারেল প্লাজায় দেয়া এক ভাষণে তিনি বুশের ইরাক আক্রমণ অনুমোদন প্রস্তাবের সরাসরি বিরোধিতা করে বলেন –

“আমি যৌক্তিক লড়াইয়ের বিরুদ্ধে নই, আমি শুধু অযথা যুদ্ধের বিপক্ষে। আমার অবস্থান রিচার্ড পার্লে, পল উলফউইজ এবং বড় আসনে বসা আরেকটি লোকের অসুস্থ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে। যারা আসলে প্রশাসনে বসে থাকা অবসরে যাওয়া সৈনিক। তারা তাদের নিজস্ব দর্শন আমাদেরকে জোর করে গেলাতে চাইছে। এটা করতে গিয়ে কতগুলো মূল্যবান জীবন ঝরে যাবে এবং কতটা দুর্ভোগ মানুষকে পোহাতে হবে, সেই ব্যাপারে তাদের কোনও মাথাব্যাথা নেই।”

তবে ওবামা ও আরও অনেক রাজনীতিবিদের বিরোধিতার পরও ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ শুরু করেছিল তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন।

সিনেটর হিসেবে বারাক ওবামার ক্যারিয়ার:

প্রাথমিক জরিপের ফলাফল ভালো দেখে রিপাবলিকান পিটার ফিটজেরাল্ড এর খালি সিনেট আসনে লড়ার সিদ্ধান্ত নেন ওবামা । ২০০৪ সালে ৫২ শতাংশ ভোট নিয়ে তিনি ধনকুবের ব্যবসায়ী ব্লায়ের হলকে পরাজিত করে ডেমোক্রেট পার্টির মনোনয়ন জিতে নেন।

সেবছর গ্রিষ্মেই বোস্টনে আয়োজিত ডেমোক্রেটিক পার্টির বার্ষিক জাতীয় সম্মেলনে জন কেরির সমর্থনে সম্পূরক ভাষণ দেয়ার জন্য আমন্ত্রিত হন। ওবামা তাঁর ভাষণে একতাবদ্ধ থাকার প্রয়োজনীয়তার প্রতি গুরুত্ব দেন এবং ইঙ্গিতে বুশ প্রশাসনের সমালোচনা করেন।

সম্মেলন থেকে ফিরে ওবামা সিনেট নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে আবার ইলিনয়ে ফিরে আসেন। সাধারন নির্বাচনে রিপাবলিকানদের মনোনীত প্রার্থী ধনী ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার জ্যাক রায়ানের সাথে তাঁর লড়ার কথা থাকলেও ২০০৪ সালের জুন মাসে রায়ান নির্বাচন থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন।

২০০৪ এর আগস্টে সাবেক কূটনীতিক এবং প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী অ্যালান কেইস রায়ানের জায়গায় রিপাবলিকান পার্টির হয়ে নির্বাচনের মনোনয়ন পান। গণমাধ্যমে প্রচারিত তিনটি বিতর্কে ওবামা এবং কেইস স্ট্রিম সেলের বিষয়ে গবেষণা, গর্ভপাত, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, স্কুল ভাউচার এবং কর মওকুফের বিষয়ে নিজেদের বিপরীত অবস্থান ব্যাক্ত করেন।

নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ইলিনয়ের ৭০ শতাংশ ভোটার ওবামাকে ব্যালটে সমর্থন দেয়। কেইসের ভাগে পড়ে মাত্র ২৭ শতাংশ ভোট। ইলিনয়ের নির্বাচনী ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ ব্যবধানে জয়ের রেকর্ড। এবং এই জয়ের ফলে মাত্র তৃতীয় আফ্রিকান আমেরিকান হিসেবে তিনি আমেরিকান রাষ্টীয় সিনেটে স্থান করে নেন।

২০০৫ সালের ৩ জানুয়ারি শপথ গ্রহণের পর ওবামা ইন্ডিয়ানা থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান সিনেটর রিচার্ড লুগারের সাথে মিলে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের গণবিধ্বংসী অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণের প্রক্রিয়া জোরদার করার বিষয়ে একটি বিল নিয়ে কাজ করেন।

এরপর আরও একজন রিপাবলিকান সিনেটর, ওকলাহামা থেকে নির্বাচিত টম কবরোনের সাথে মিলে একটি ওয়েবসাইট তৈরী করেন যেটি সবধরনের সরকারি খরচের ওপরে নজরদারী করবে। এছাড়াও তিনি হ্যারিকেন ক্যাটরিনা দূর্গতদের পক্ষে কথা বলেন, বিকল্প জ্বালানীর বিষয়ে জোর দেন এবং যুদ্ধফেরৎ সৈনিকদের সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর ব্যাপারে কাজ করেন।

২০০৬ সালে তাঁর দ্বিতীয় বই “The Audacity of Hope: Thoughts on Reclaiming the American Dream” প্রকাশিত হয়। এই বইতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎতের ব্যাপারে নিজের দর্শন নিয়ে আলোচনা করেন। যার অনেকগুলোই পরে তাঁর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার বক্তব্যের বিষয় ছিল। প্রকাশের অল্প পরেই তাঁর বইটি নিউ ইয়র্ক টাইমস ও আমাজনের বেস্ট সেলার বইয়ের তালিকায় এক নম্বরে উঠে আসে।

২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন:

২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে পরবর্তী বছর অনুষ্ঠিতব্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়নের লড়াইয়ে নামার ঘোষণা দিয়ে ওবামা সংবাদের শিরোনামে উঠে আসেন ।

মনোনয়নের লড়াইয়ে তাঁর শক্ত প্রতিদ্বন্দী ছিলেন সাবেক ফার্স্টলেডি, এবং তৎকালীন নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত সিনেটর হিলারি ক্লিনটন। ২০০৮ সালের জুন মাসে ওবামা ডেমোক্রেটিক পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান এবং হিলারি তাঁকে পূর্ণ সমর্থন দেন।

২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর ওবামা ৫২.৯ শতাংশ ভোট নিয়ে ৪৫.৭ শতাংশ ভোট পাওয়া রিপাবলিকান প্রার্থী জন কেরিকে পরাজিত করে ৪৪ তম আমেরিকান প্রেসিডেন্ট, এবং প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হয়ে ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন।

নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় তাঁকে সর্বাত্মক সহায়তাকারী ডেলওয়ারের সিনেটর জো বিডেনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে সঙ্গে নিয়ে পরবর্তী বছরের ২০ জানুয়ারি ওবামা হোয়াইট হাউজের কার্যক্রম শুরু করেন।

ওবামা যখন হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসেন তখন তিনি পূর্বসূরী বুশের রেখে যাওয়া দুইটি চলমান বৈদেশিক যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বকালের সবচেয়ে নিন্ম পর্যায়ের আন্তর্জাতিক গ্রহনযোগ্যতার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক মন্দার মাঝে এসে পড়েন।

তিনি একটি উচ্চাভিলাষী ভবিষ্যৎ কর্ম পরিকল্পনা করেন, যার মধ্যে ছিল অর্থনৈতিক পরিবর্তন, বিকল্প জ্বালানী এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় বিপূল পরিবর্তন আনা- এবং এসবের সাথে রাষ্ট্রীয় ঋণের পরিমানকে কমিয়ে আনা।

তিনি বিশ্বাস করতেন, এর সবই জনগণের ও দেশের ভালোর সাথে জড়িত, এবং এর সবগুলোই একই সময়ে তাঁর প্রশাসনকে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করার আগের ভাষণে তখনকার বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে ওবামা বলেছিলেন –

“আজ আমি আপনাদের বলতে চাই আমাদের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে তার সবগুলোই বাস্তব। সেগুলো সংখ্যায় অনেক এবং প্রত্যেকটিই কঠিন। স্বল্প সময়ে এবং সহজে সেগুলোর সমাধান করা সম্ভব নয়। কিন্তু আপনারা জেনে রাখুন: সমাধান হবেই।”

প্রথম ১০০ দিন ও শান্তিতে নোবেল জয়:

যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউজে বসার পর থেকে পরবর্তী ১০০ দিনকে খুব গূরুত্বপূর্ণ ধরা হয়। অনেকের মতে এই ১০০ দিনের কাজেই বোঝা যায় প্রেসিডেন্টের শাসনকাল কেমন হতে যাচ্ছে।

অফিসে বসার দিন থেকে ২০০৯ সালের ২৯শে এপ্রিল – এই ১০০ দিনের মাঝে ওবামা প্রশাসন বেশ কয়েকটি উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য উঠেপড়ে লাগে। ওবামা শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যবিমার সেবার আওতা বাড়ানোর জন্য এবং সমান বেতনের জন্য যেসব নারী কর্মী দাবি উত্থাপন করছেন তাদের আইনি সহায়তা দেয়ার জন্য কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানান।

স্বল্পমেয়াদী আর্থিক উন্নয়নকে গতিশীল করতে ৭৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি বিল পাশ হয় প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রথম ১০০ দিনে। এই কার্যক্রমের এক বছরের মাথায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অভাবনীয় গতি আসে এবং ২০১০ এর মধ্যে আমেরিকার বাজারে প্রায় ৩৭ লাখ বেসরকারী চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়। একটি বাজারভিত্তিক পরিকল্পনার আওতায় আমেরিকান ব্যাংকগুলোর অব্যবহৃত সম্পদগুলোকে কিনে নেয়ার মাধ্যমে নির্মান ও ঋণ বাজারকে আবার জাগিয়ে তোলা হয়।

অটোমেটিক কারখানাগুলোর জন্য ঋণের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি ওয়াল স্ট্রিটের জন্য নতুন আইন পাশ করে অর্থনীতিতে স্থিরতা আনার চেষ্টা করে ওবামা প্রশাসন।

এছাড়াও ওবামার প্রশাসন শ্রমজীবি পরিবার, ক্ষূদ্র ব্যবসা, ও প্রথমবারের মত যারা বাড়ি কিনছেন – তাদের কর মওকুফ অথবা কমানোর ব্যবস্থা করেন। তখন পর্যন্ত নিষিদ্ধ থাকা ভ্রুণভিত্তিক স্টিমসেল গবেষণার ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে সাড়ে তিন হাজার কোটি ডলারের একটি বাজেট পরিকল্পনা করে কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে ওবামা প্রশাসন।

আভ্যন্তরীণ বিষয়াদি ছাড়াও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর প্রথম ১০০ দিনের কাজের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেন।

তিনি ইউরোপ, চীন ও রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি ইরান, ভেনিজুয়েলা এবং কিউবার মত সরাসরি বৈরী দেশগুলোকে আলোচনার টেবিলে আমন্ত্রণ জানান। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে মিত্র দেশগুলোকে সাথে নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি আফগানিস্তানে ২১০০০ অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের পাশাপাশি ২০১০ এর আগস্টের মধ্যে ইরাক থেকে প্রায় সব সেনা প্রত্যাহারের আশা ব্যক্ত করেন। এছাড়াও তিনি সোমালিয়ার উপকূলের জলদস্যুদের ওপর আক্রমণের প্রায় নাটকীয় একটি নির্দেশ জারির পাশাপাশি সোয়াইন ফ্লু মহামারী মোকাবিলার জন্য জনগনকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে বলেন। জিজ্ঞাসাবাদের নির্দয় ও অমানবিক প্রক্রিয়াগুলোকে নিষিদ্ধ করে তিনি একটি আদেশনামায় সই করেন এবং কিউবার কুখ্যাত “গুয়ান্তানামো বে” নামক মার্কিন সামরিক কারাগারটি বন্ধ করার জন্য এক বছর সময় বেঁধে দেন (যদিও শেষ পর্যন্ত তা বন্ধ হয়নি)। গুয়ান্তানামো বন্ধের চেষ্টা এবং তাঁর অন্যান্য জনহিতকর কাজের জন্য ২০০৯ সালে ওবামাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।

প্রথম মেয়াদের কাজ ও অর্জন:

প্রথম মেয়াদে ওবামা বিকল্প জ্বালানীর উৎপাদন ও ব্যবহার দুই গুন বাড়ানোর ব্যাপারে উদ্যোগ নেন। ২০০৯ সালে তিনি সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানকে পরিবেশ দুষণ কমিয়ে আনার জন্য ২০২০ সাল পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। এর মধ্যে পেট্রলজাত জ্বালানীর ব্যবহার ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনার এবং পানির সরবরাহ ২৬ শতাংশ পরিমান উন্নত করার নির্দেশও ছিল। ২০১০ সালে ক্রেতা নিরাপত্তা (consumer protection) আইন স্বাক্ষর করে ওবামা সাধারণ মানুষের কাছে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

সেই সময়ে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর কথা মাথায় রেখে তিনি শিক্ষার খরচ হ্রাসের ব্যাপারে উদ্যোগ নেন। সেই বছরই বারাক ওবামা বাজেট কন্ট্রোল এ্যাক্ট ২০১১ স্বাক্ষর করার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় খরচ নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি প্রশানের আর্থিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেন।

ওবামার প্রথম মেয়াদের দ্বিতীয় ভাগে নিজের উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি সফল হয়েছিলেন। যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে তাঁকে সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হয়েছিল, তার মধ্যে বিখ্যাত ‘ওবামা কেয়ার’ অন্যতম। কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্য এবং টি-পার্টি মুভমেন্টের ঘোর বিরোধিতার পরও তিনি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনায় স্বাক্ষর করেন।

এর মাধ্যমে তিনি ”সাশ্রয়ী চিকিৎসা সেবা (affordable healthcare) আইন” কে অবশ্য পালনীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই আইনটিকেই “ওবামা কেয়ার” নামে ডাকা হয়।

এই আইনের মাধ্যমে ২৬ বছরের কম বয়সী যে কোনও নাগরিককে তাদের পিতামাতার স্বাস্থ্য বীমার অধীনেই বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিতে সব চিকিৎসা সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়ে পড়ে।

সেইসাথে স্বাস্থ্য বীমায় পাওয়া সেবার আওতাও এই আইনের কারণে অনেকখানি বেড়ে যায় এবং আগের চেয়ে অনেক বেশি নাগরিক বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসে। এই আইনের বিরোধীরা দাবি করে যে ইতোমধ্যেই অনেক বেশি হয়ে যাওয়া জাতীয় বাজেটের অনেকটাই এই আইন বাস্তবায়নে লেগে যাবে। তাছাড়া এই আইন সংবিধানেরও পরিপন্থী। কারণ সেখানে বলা আছে প্রতিটি নাগরিকের নিজস্ব বীমা থাকতে হবে। তারা এটাও দাবী করে যে সরকার আসলে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবসার দখল নিতে চায়। বলা বাহুল্য, এই বিরোধীদের বেশিরভাগই স্বাস্থ্যসেবাকে ব্যবসার মুনাফা আয়ের একটি মাধ্যম হিসেবে দেখতো।

protesting trump for obamacare
[ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের ওবামাকেয়ার বাতিলের পদক্ষেপের প্রতিবাদে আমেরিকান নাগরিকরা ]
অর্থনৈতিক দিক দিয়েও ওবামাকে বেশ বড় বড় চ্যালেঞ্জ পার করতে হয়েছে। ২০১১ সালের বাজেট নিয়ন্ত্রণ আইন পাশ করাতে গিয়ে তাঁকে আমেরিকান হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের নিয়ন্ত্রণকারী রিপাবলিকানদের সাথে প্রচুর দর কষাকষি করতে হয়।

দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট:

২০০৮ সালের মতই ২০১২ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি সাধারণ মানুষের সুবিধা অসুবিধাকে গূরুত্ব দেন। বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় হলিউড তারকা তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়ে এবং তহবিল গঠনে কাজ করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

২০১২ সালের জুনে মেরিল্যান্ডে একটি নির্বাচনী সভায় ওবামা বলেন – “আমি আপনাদের নিশ্চিত করছি, আমরা এই দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাব। আমরা যা শুরু করেছিলাম তা শেষ করব এবং পুরো বিশ্বকে আরও একবার মনে করিয়ে দেব কেন আমেরিকানরা পৃথিবীর জাতিগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ।”

দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনে ওবামার প্রধান প্রতিদ্বন্দী ছিলেন রিপাবলিকান মনোনীত মিট রমনি। ২০১২ সালের ৬ নভেম্বরের নির্বাচনে রমনির চেয়ে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ ভোট বেশি পেয়ে ওবামা দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হন।

দ্বিতীয় মেয়াদের উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ও অর্জন:

২০১৩ সালের ২১শে জানুয়ারী ওবামা পাকাপাকি ভাবে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের কাজ শুরু করেন। শপথ অনুষ্ঠানের ভাষণে ওবামা জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্যসেবা অধিকারের প্রতি জনগনকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান।

প্রাক নির্বাচনী প্রচারণার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ওবামা অতিরিক্ত সম্পদের মালিকদের কর বৃদ্ধি করে একটি আইন পাশ করেন। যার ফলে বছরে ৪ লক্ষ ডলার বা তার বেশি অর্থ আয়কারীদের ওপর আরও বেশি কর আরোপ করা সম্ভব হয় এবং সরকারী খরচের ঘাটতি মেটাতে এই টাকা কাজে লাগানো হয়। যদিও এই বিলকে আইন বানানোয় রিপাবলিকানদের রাজি করাতে ওবামার বেশ খানিকটা ঝামেলা পার করতে হয়েছিল।

দেশের মধ্যে ওবামার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ১৫ই এপ্রিল, ২০১৩ সালে বোস্টন ম্যারাথনে সংঘটিত সন্ত্রাসী বোমাহামলা সামাল দেয়া।

এই হামলায় ৩ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি ২০০ জন গুরুতর আহত হয়। হামলার তিনদিন পরে একটি স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে ওবামা বলেন- “আপনাদের দেশ আপনাদের সাথে আছে। আমরা আপনাদের সাথেই থাকবো। আপনারা আবার উঠে দাঁড়াতে শিখবেন। সেই বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। বোস্টনবাসী, আপনারা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন যে আমেরিকানরা চরম দু:সময়েও ভালোটা তুলে ধরতে জানে। নিষ্ঠুরতার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা দয়া প্রদর্শন করব।”

boston attack obama
[বোস্টন হামলার পর বিবৃতি দিচ্ছেন ওবামা]
সেই মাসেই ওবামার আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা কংগ্রেসের অনুমোদন পেতে ব্যর্থ হয়। তিনি অস্ত্র বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সব ক্রেতার অতীত কর্মকান্ড সম্পর্কে ভালোমত খোঁজ নেয়া, সর্ব প্রকারের মারণাস্ত্র বিক্রয়ের ওপরে নিষেধাজ্ঞা, এবং বেশি গুলি ধরে – এমন ম্যাগজিন বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার পক্ষে ছিলেন। বিলটি ব্যর্থ ও প্রত্যাহার হওয়ার পর ওবামার ভাষ্য ছিল – “ওয়াশিংটনের জন্য আজকের দিনটি লজ্জার।”

সেই বছরের জুন মাসের মধ্যে ওবামার ওপর আবার বিপদ নেমে আসে। সি এন এন এবং ও আর সি এর একটি যৌথ আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা যায় তাঁর আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার রেটিং বেশ খানিকটা নেমে গেছে। সরকারি কর সংস্থা রক্ষণশীল যেসব রাজনৈতিক সংস্থা করের আওতার বাইরে থাকার আবেদন করছে সেগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে, এবং লিবিয়ায় আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টোফার স্টিভেন্স এবং আরও তিনজন আমেরিকানের নিহত হওয়াকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে ওবামা প্রশাসন – এই ধরনের অভিযোগ ওঠায় এই ওবামার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার রেটিংয়ে এতটা ভাটা পড়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছিল।

ওবামার রেটিং আগের ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিন্ম ৪৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। বিশেষজ্ঞতের মতে, জনপ্রিয়তায় এই ভাটা পড়ার আরেকটি কারণ ছিল আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (NSA) এর সাধারনের ওপর নজরদারীর নতুন পদক্ষেপ। তবে, ওবামা বলেছিলেন এই পদক্ষেপের ফলে তখন পর্যন্ত প্রায় ৫০টি নাশকতার প্রচেষ্টা তাঁরা ব্যর্থ করতে পেরেছিলেন।

২০১৩ সালের জুলাই এর প্রথম ভাগে ওবামা আরও একবার ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সাথে আফ্রিকায় সাক্ষাৎ করে। এই সাক্ষাতের উদ্দেশ্য ছিল আল কায়েদার প্রথম কোনও আমেরিকান স্থাপনায় আঘাত হানার ১৫ বছর পূর্তি। এই উপলক্ষে তাঁরা একসাথে তানজানিয়া ও কেনিয়ার আমেরিকান দূতাবাস পরিদর্শন করেন। সাক্ষাতের মধ্যদিয়ে কোনও হামলার স্মৃতিচারণের উদ্দেশ্যে প্রথমবার দুইজন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট দেশের বাইরে মিলিত হন।

আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ:

২০১৩ সালের আগস্টের শেষ দিকে জানা যায়, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ তাঁর দেশের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছেন যাতে চারশ’র বেশি শিশু হাজারের ওপরে নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে। ওবামা সিরিয়ান কতৃপক্ষের এই কাজের নিন্দা করে বলেন – “আমেরিকা এবং সেই (সিরিয়ার আশপাশের) অঞ্চলের জন্য এটি মারাত্মক হুমকি। এবং আসাদ ও সিরিয়াকে এর জন্য বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।”

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ওবামা সিরিয়ায় অভিযান চালাতে সমর্থন আদায়ের জন্য কংগ্রেস ও আন্তর্জাতিক মহলের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল ও কংগ্রেসের বেশিরভাগ সদস্যই সেনা অভিযানের বিপক্ষে অবস্থান নেন।

পরবর্তীতে ২০১০ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর ওবামা বাশার আল আসাদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন: সিরিয়া যদি রাশিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি মেনে নেয়, তাহলে আমেরিকার পক্ষ থেকে আর কোনও আক্রমণের চেষ্টা করা হবে না। পরবর্তীতে বাশার আল আসাদ রাশিয়ার প্রস্তাব মেনে নেন।

সেই মাসেই ওবামা ইরানের সাথে তাঁর দেশের সমস্যার কূটনীতিক সমাধানের উদ্যোগ নেন। তিনি ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রোহাইনির সাথে ফোনে কথা বলেন, যা ঐ দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ৩০ বছরের মধ্যে প্রথম সরাসরি কথপোকথন।

অনেকের মতে, সেটি ছিল দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের শীতলতা কমিয়ে আনার একটি শুভ লক্ষণ। ওবামা আলোচনা-পরবর্তী একটি সংবাদ সম্মেলনে আশা প্রকাশ করে বলেন, ইরান যদি তাদের পরমাণু প্রকল্প বন্ধ করে তাহলে তাদের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়ার একটি ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।

ওবামা কেয়ার এবং আভ্যন্তরীন সমস্যা:

২০১৩ সালের অক্টোবরে ওবামা বড় একটি আভ্যন্তরীন প্রশাসনিক সমস্যায় পড়েন। রাষ্ট্রীয় বাজেট নিয়ে মতভেদ এবং সাশ্রয়ী চিকিৎসা সেবা আইন (ওবামা কেয়ার) বাতিলের সজন্য রিপাবলিকানদের সাথে মতবিরোধের জের ধরে ১৬ দিনের জন্য মার্কিন প্রশাসন অকেজো হয়ে পড়ে।

এই অবস্থার সমাধানে একটি চুক্তি করার পর ওবামা তাঁর সাপ্তাহিক ভাষণে সেই পরিস্থিতিতে তাঁর হতাশা ও রাজনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন: “ওয়াশিংটনে যেভাবে কার্যক্রম চলছে তার পরিবর্তন হওয়াটা জরুরী। আপাতত যেহেতু দুর্যোগের মেঘ সরেছে, আমেরিকার জনগোষ্ঠী আমাদের কেন এখানে পাঠিছেন সেই বিষয়ে আবারও আমাদের ভাবা দরকার – তাঁরা আমাদের এখানে পাঠিয়েছেন অর্থনীতির উন্নয়ন, ভালো কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মধ্যবিত্ত সমাজের শক্তিবৃদ্ধি, উন্নত জীবনযাত্রা ও প্রযুক্তির ভিত তৈরী করতে, এবং সব ক্ষেত্রে দেশের ভিত মজবুত ও টেকসই করতে।”

সেই অক্টোবর মাসেই ওবামা কেয়ার আরও ঝামেলায় পড়ে। নতুন চালু করা সরকারী স্বাস্থ্যসেবার ওয়েবসাইটটি (healthcare.gov) ঠিক মত কাজ করতে ব্যর্থ হয়। উদ্বোধনের প্রথম সপ্তাহ থেকেই গ্রাহকরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে শুরু করেন।

ওয়েবসাইটটির সমস্যা সমাধানের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে। ওবামার নতুন স্বাস্থ্যসেবা আইনকেও অনেকে এই বলে আক্রমণ করতে থাকেন যে, এই আইনের ফলে অনেক পুরাতন স্বাস্থ্যবীমার অধিকারী তাঁদের বীমা হারিয়ে ফেলছেন। যদিও ওবামা বারংবার নিশ্চিত করেছেন – ওই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই।

শিকাগো ট্রিবিউনের তথ্য অনুযায়ী – ওবামা জোর দিয়ে বলেছেন যে, আইন নয়, বীমা কোম্পানীগুলোই এই সমস্যার জন্য দায়ী। এই বিষয়ে ওবামার বক্তব্য ছিল – “মনে করে দেখুন, সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা আইনের আগে অতিমুনাফাভোগী বীমাকারীরা কিভাবে প্রতি বছর আপনি কতটা সেবা নিতে পারবেন – তার ওপর নিয়ন্ত্রণের ছড়ি ঘোরাতো। তারা আপনার নিয়মিত ছোট ছোট স্বাস্থ্যসমস্যার ব্যাপারেও বিরাট অঙ্কের বিল করে আপনার প্রিমিয়ামের টাকা কেটে নিত।”

নতুন ব্যবস্থার কারণে যারা তাদের বীমা হারিয়ে ফেলেছিলেন, এনবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে ওবামা তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন এই বলে “আমি খুবই দুঃখিত যে আমার কথায় ভরসা করে অনেকেই এই অবস্থায় পড়েছে। আমরা অবশ্যই তাদের এই সমস্যা সমাধানের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করব।”

বৈদেশিক সমস্যার সমাধান:

২০১৩ এর শেষ দিকে ওবামা প্রশাসন আরও একবার বৈদেশিক সম্পর্ক নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ২০১৩ সালের অক্টোবরে তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেলর (সরকার প্রধান) এ্যানজেলা মর্কেল দাবি করেন যে আমেরিকার নিরাপত্তা সংস্থা তাঁর মোবাইল ফোনে আড়ি পেতেছে।

তিনি ইউরোপিয়ান নেতৃবৃন্দের একটি সম্মেলনে সবার সামনে বলেন – “বন্ধুদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি কখনওই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।” এই ঘটনার আলোকে ২০১৩ এর নভেম্বরে ওবামার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার রেটিং আগের চেয়েও নিচে চলে যায়। সিবিএস নিউজের জরিপে দেখা যায় মাত্র ৩৭ শতাংশ আমেরিকান মনে করছেন যে ওবামা প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করার যোগ্য, আর ৫৭ শতাংশ মানুষের মতে তিনি সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না।

পরের বছর রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল ও ইউক্রেনের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির পট পরিবর্তনের ফলেও ওবামাকে বেশ চাপ নিতে হয়। এছাড়া ২০১৪ সালে ইজরায়েল ফিলিস্তিনের গাজায় নিরীহ জনসাধারণের ওপর অন্যায় হত্যা নির্যাতন চালিয়ে মার্কিন প্রশাসনকে আরও বিপাকে ফেলে দেয়। এরই মাঝে স্পিকার অব দি হাউস, জন বোহনার বেশ কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতার বাইরে প্রভাব খাটানোর অভিযোগে প্রেসিডেন্ট ওবামার বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিতে থাকেন।

২০১৪ সালের আগস্টে ওবামা প্রথমবারের মত ইরাক, ইরান এবং সিরিয়ার বেশকিছু অংশ দখল করা জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট অথবা আইএস এর বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। পরের মাসেই আমেরিকান বিমানবাহিনী সিরিয়ায় আইএস এর লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করা শুরু করে। যদিও এর আগে ওবামা আমেরিকান সৈন্যদের যুদ্ধে পাঠানোর ব্যাপারে বহুবার অনীহা প্রকাশ করেছেন। আই এস এর বিরুদ্ধে এই অভিযানে বেশ কয়েকটি আরব দেশও আমেরিকার সাথে অংশ নিয়েছিল।

এই অভিযানের ব্যাপারে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে ওবামার বক্তব্য ছিল – “খুনীরা একটি ভাষাই সবচেয়ে ভালো বোঝে, আর সেটি হচ্ছে শক্তির ভাষা। সেই কারনে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের সাথে মিলে এই খুনীচক্রকে ধ্বংস করবে।”

২০১৪ সিনেট নির্বাচন-পরবর্তী অবস্থা:

২০১৪ সালের মার্কিন সিনেট নির্বাচনে বিরোধী রিপাবলিকান পার্টি সিনেটের বেশিরভাগ আসন জিতে নেয়ায় ওবামা নতুন করে আরেকটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। একজন ডেমোক্রেট দলীয় প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি দেখেন কনগ্রেসের দু’টি কক্ষই রিপাবলিকানদের দখলে। দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ ২ বছর তাঁকে এই অবস্থাতেই কাজ করতে হয়েছে।

কিন্তু ওবামার পরবর্তী কার্যক্রম তিনি তাঁর মত করেই করে গেছেন। কিউবার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বন্দী বিনিময়, যার মধ্যে তিনজন কিউবান গুপ্তচরকে মুক্তিদানও ছিল – তা ওবামা সিনেট নির্বাচনের পরেই সম্ভব করেন। তবে এই সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নেয়া তাঁর আরও কয়েকটি পদক্ষেপ রক্ষণশীল রিপাবলিকান সিনেটরদের কারনে শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখতে পায়নি।

তিনি জনগনের কল্যানে ফ্রি কলেজ শিক্ষা ও মধ্যবিত্তদের কর কমিয়ে আনার কাজ করে গেছেন নিজের মত করে। কনগ্রেসের দুই কক্ষ এবং সিনেটে রিপাবলিকানদের প্রাধান্যের কারনে তাঁর চালু করা কিছু আইন বাতিলের সম্ভাবনা দেখা দিলে তিনি তাঁর অধিকারে থাকা রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতার ব্যবহার করবেন বলে সাবধান করে দেন। এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন – “স্বাস্থ্য বীমা প্রত্যাহার করে, অথবা ওয়াল স্ট্রিটের ওপর আরোপ করা নতুন আইন বাতিল করে, অথবা অভিবাসনের বিরুদ্ধে আমাদের পুরাতন লড়াই আবার শুরু করে আমরা আমাদের পরিবারগুলোকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারি না। একটি ভাঙাচোরা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ঠিক করার কাজ এখনও বাকি আছে। এবং, যদি কেউ এসব কাজ করতে চায়- এবং এমন কোনও বিল আমার টেবিলে আসে, আমি অবশ্যই আমার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করব।”

২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট থেকে দু’টি বড় জয় পায় ওবামা প্রশাসন। কোর্ট ওবামাকেয়ারের অন্তর্গত স্বাস্থ্যসেবা বীমার ক্ষেত্রে কর ভর্তুকি দেয়ার ব্যবস্থাকে চালু রাখার ব্যাপারে রায় দেয়। এই কর সুবিধা না পেলে আমেরিকার কোটি কোটি জনগনের পক্ষে স্বাস্থ্যবীমা ক্রয় করা বিরাট খরচের বিষয় হয়ে দাঁড়াতো।

২০১৫ সালে ওবামা ঘোষণা দেন যে তাঁর প্রশাসন ইরানের সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর তাদের পারমানবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ পর্যায়ে রাখা এবং ইউরেনিয়াম মজুদের হার আগের থেকে অনেক কমিয়ে নিয়ে আসার ব্যাপারে রাজি করিয়েছেন। তিনি এটা সম্ভব করেছেন ইরানের ওপর থেকে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার ব্যবস্থা করার, তাদের স্থগিত থাকা ব্যাংক এ্যাকাউন্ট গুলোকে চালু করার ও তেলের বিক্রী বাড়ানোর সুযোগের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে।

ওবামার প্রশাসন যখন এই চুক্তি অনুমোদনের জন্য কংগ্রেসে ছুটোছুটি করছিল, তখন ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথমবারের মত তাঁর পিতার দেশ কেনিয়ায় সফর করেন। সেখানে তিনি তাঁর ছত্রিশজন আত্মীর সাথে নৈশভোজে অংশ নেন, যাদের মাঝে কয়েকজনের সাথে সেবারই তাঁর প্রথম দেখা। তিনি গর্বের সাথে তাঁদের বলেন – “কেনিয়া সফর করা প্রথম আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হতে পেরে আমি গর্বিত। আর অবশ্যই আমিই আমেরিকার প্রথম কেনিয়ান-আমেরিকান প্রেসিডেন্ট।”

ক্লিন পাওয়ার প্ল্যান:

২০১৫ এর আগস্টে ওবামা প্রশাসন গ্রীনহাউস গ্যাস পরিবেশে ছড়িয়ে পড়া কমাতে ক্লিন পাওয়ার প্ল্যানের ঘোষণা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মত কার্বন দূষণ রোধ করার জন্য কয়লাজাত বিদ্যুৎ প্রকল্প গুলোকে দূষণের মাত্রা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। ওবামা এটিকে “ ইতিহাসে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমেরিকার নেয়া সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ” বলে অবিহিত করেন।

এই প্রকল্পে পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থার আওতায় কড়া নির্দেশনা দেয়া হয় যে বর্তমান পাওয়ার প্লান্টগুলো তাদের কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরনের মাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যে ৩২ শতাংশ কমিয়ে আনবে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বায়ু এবং সূর্যশক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করবে। এই প্রকল্পের আওতায় আরও একটি আইনগত নির্দেশনা জারি করা হয় যে, প্রতিটি অঙ্গরাজ্য কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনার বিষয়ে ২০১৬ সালের মধ্যে তাদের নিজস্ব প্রাথমিক প্রকল্প এবং ২০১৮ এর মধ্যে চূড়ান্ত প্রকল্প জমা দেবে।

তবে ওবামার এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বেশকিছু সমালোচক তাঁদের বিরোধিতা জানান। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কেনটাকির সিনেটর ও রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেল। তিনি প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের কতৃপক্ষের কাছে এই আইনের প্রতি বশ্যতা প্রদর্শন করতে নিষেধ করে চিঠি পাঠান। যেসব অঙ্গরাজ্য এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান তাদের অর্থ আয়ের জন্য কয়লাজাত বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল তারাও ওবামার পদক্ষেপকে আইনগত ভাবে চ্যালেঞ্জ করার প্রক্রিয়া শুরু করবে বলে আশঙ্কা দেখা দেয়।

তবে এইসব বিরোধিতার পরও বারাক ওবামা জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে তাঁর অবস্থানে অনড় থাকেন। হোয়াইট হাউজে দেয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেন – “আমরা এর আগেও এসব খোঁড়া যুক্তি শুনেছি। প্রতিবারই সেগুলো ভুল প্রমাণিত হয়েছে।” তিনি আরও যোগ করেন – “আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সরাসরি দেখা প্রথম, এবং এই ব্যাপারে কিছু করার মত শেষ প্রজন্ম”

প্যারিস চুক্তি:

২০১৫ সালের নভেম্বরে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলনে প্রায় ২০০টি দেশের প্রতিনিধিদের সামনে ওবামা স্বীকার করেন, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জলবায়ু দূষণকারী দেশ। সেকারণে, এই ব্যাপারে কিছু করাটা তাদের প্রধান একটি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

ওবামা পরবর্তীতে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন যার মধ্যে ছিল সমস্ত অংশগ্রহণকারী দেশ নিজ দায়িত্বে তাদের দেশের গ্রীণহাউস গ্যাসের নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনার পাশাপাশি বিকল্প জ্বালানির বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়নের কাজ করবে।

তিনি ঘোষণা দেন, ২০৩০ এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার পরিবেশ দূষণের মাত্রা ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনবে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্বের দুই প্রধান কার্বন উ‌ৎপাদনকারী দেশ চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তির প্রতি তাদের আনুষ্ঠানিক সমর্থনের ঘোষণা দেয়। এক মাস পর ২০১৬ এর ৫ই অক্টোবর জাতিসংঘ ঘোষণা দেয়, প্যারিস চুক্তির প্রতি যথেষ্ঠ পরিমান দেশ তাদের সমর্থন জানিয়েছে; এবং ২০১৬ এর ৮ নভেম্বর থেকে এই চুক্তির বাস্তবায়ন শুরু হবে।

এই প্রসঙ্গে ওবামা হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেন থেকে বলেন “আজ পৃথিবী সেই বিশেষ মূহুর্তের দেখা পেল। এবং আমরা যদি প্যারিস চুক্তিতে লেখা সেইসব প্রতিশ্রুতি পালন করি, ইতিহাস হয়তো পৃথিবীর এক নতুন যুগের শুরু হিসেবে এই মূহুর্তটিকে মনে রাখবে।” তিনি আরও বলেন – “আমেরিকা যেন এই কাজে পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিতে পারে – আমার এই অফিসে বসতে চাওয়ার পেছনে সেটি একটি বড় কারন ছিল। এটা সম্ভবত আমাদের (মানব জাতির) অধিকারে থাকা একটিমাত্র গ্রহকে রক্ষা করার একমাত্র সুযোগ।

যদিও পরবর্তীতে ২০১৭ সালের জুনে ওবামার উত্তরসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহার করেন।

ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে ওবামার বক্তব্য ছিল – “যেসব দেশ প্যারিস চুক্তির সাথে একাত্ব রয়েছে, তারা নতুন সৃষ্টি হওয়া কর্মক্ষেত্র আর ইনডাস্ট্রির সুবিধা ভোগ করবে। আমি এখনও বিশ্বাস করি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর এই শুভ কাজের নেতৃত্বে থাকা উচিৎ।

কিন্তু আমেরিকান সরকার, এবং আমেরিকার এই প্রশাসন – যারা সেই অল্প কয়েকটি (সই না করা) দেশের সাথে হাত মিলিয়ে ভবিষ্যৎকে প্রত্যাখ্যান করেছে তাদের ছাড়াই – আমাদের অঙ্গরাজ্য, আমাদের শহর এবং আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসবে এবং (আমার পরিকল্পনার চেয়েও) বেশি কাজ করে আমাদের অধিকারে থাকা একমাত্র গ্রহটিকে রক্ষা করার কাজে নেতৃত্ব দেবে।”

আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ:

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর শেষ বছরে প্রবেশ করে ২০১৬ এর জানুয়ারিতে ওবামা একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বেশ কয়েকটি একক নির্দেশনার ঘোষণা দেন।

অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি ২০১২ সালে ঘটে যাওয়া স্যান্ডি হুক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের ওপর বন্দুকধারীর নির্মম হামলার নজির টেনে কংগ্রেস এবং আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের সমর্থকদের কে আহ্বান জানান তাঁর দেশকে আরও নিরাপদ একটি দেশে পরিনত করার কাজে তারা যেন তাঁকে সাহায্য করে।

ওবামার এই উদ্যোগের মধ্যে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র ক্রেতাদের ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারে অনেক বেশি খোঁজখবর করা, আগ্নেয়াস্ত্র আইনের আরও কঠোর প্রয়োগ, বন্দুক-পিস্তল ক্রেতা ও ব্যবসায়িদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আরও বেশি তথ্য সংগ্রহ করার নিয়ম।

এটি বেশকিছু রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক সদস্য, সেইসাথে এন.আর.এ’র মত বেশকিছু আগ্নেয়াস্ত্র সমর্থক গোষ্ঠীর প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়ে। তবে ২০১৫ সালের একটি জরিপে দেখা যায় বেশিরভাগ আমেরিকান নাগরিকই আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রয়ের ব্যাপারে আরও কঠোর আইনের পক্ষে।

আগ্নেয়াস্ত্র বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনের অল্প পরেই ২০১৬ সালের ১২ই জানুয়ারি ওবামা স্টেট অব দি ইউনিয়নে তাঁর শেষ ভাষণ দেন।

১৯২৮ সালের পর প্রথম কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে, ২০ মার্চ ২০১৬ তারিখে কিউবা সফর করেন বারাক ওবামা। তিন দিনের এই সফরে তাঁর সঙ্গী হিসেবে স্ত্রী মিশেল ও দুই মেয়েও ছিলেন।

ওবামার এই সফরের পেছনে দুই দেশের মধ্যে একটি বৃহত্তর সহাবস্থানের ভিত সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য ছিল। এই প্রক্রিয়ার শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে যখন কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রো এবং ওবামা ১৯৬১ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে চলে আসা সম্পর্কের শীতলতার অবসানের প্রক্রিয়া শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন।

বিদায় সম্ভাষণ:

১৯ জানুয়ারী ২০১৭ তারিখে হোয়াইট হাউস ত্যাগ করার আগে, ১০ই জানুয়ারী তিনি তাঁর নিজের শহর শিকাগোতে যান তাঁর বিদায় সম্ভাষণ জানানোর জন্য।

দীর্ঘ ভাষণের এক পর্যায়ে আট বছরে তাঁর অর্জনের জের টেনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বলেন – “যদি আট বছর আগে আমি আপনাদের বলতাম আমেরিকা বিরাট এক অর্থনৈতিক মন্দার মোড় ঘুরিয়ে দেবে, আমাদের মেশিন ইন্ডাস্ট্রির পূনুরুত্থান ঘটাবে, এবং আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মাত্রায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির নজির স্থাপন করবে – আমি যদি আপনাদের বলতাম আমরা কিউবার জনগনের সাথে সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করব, একটি গুলিও না ছুঁড়ে ইরানের পারমানবিক অস্ত্র প্রকল্প বন্ধ করব, ৯/১১ এর অভিযুক্ত মাস্টারমাইন্ডকে শেষ করব – যদি বলতাম আমরা বিবাহ ব্যবস্থায় সমতার অধিকার জিতে নেব এবং দুই কোটি নাগরিককে স্বাস্থ্য বীমার অধিকার বুঝিয়ে দেব – যদি এই সব কথা আমি আট বছর আগে আপনাদের বলতাম, আপনারা হয়তো বলতেন আমাদের অভিলাষ একটু বেশিই উপরে উঠে গেছে। কিন্তু এর সবই আমরা করেছি। এর সবই আপনারা করে দেখিয়েছেন। আপনারাই সবকিছু বদলে দিয়েছেন। আপনাদের আশার ফলেই এবং আপনাদের কারনেই, প্রায় সব দিক দিয়ে আমেরিকা, আমরা যখন শুরু করেছিলাম তার তুলনায় একটি উন্নততর, ও শক্তিশালী দেশ।”

[শিকাগোতে শেষ ভাষণের সময়ে ওবামা]
ভাষণের শেষের দিকে তিনি বলেন “আমি এখানেই থেমে যাব না। সত্যি কথা বলতে, আমার বাকি দিনগুলোয় আমি এখানেই, আপনাদের সাথেই একজন নাগরিক হিসেবে থেকে যাব।

কিন্তু এখনকার জন্য, আপনাদের মধ্যে যারা বয়সে অথবা হৃদয়ে তরুণ রয়েছেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনাদের কাছে আমার একটি শেষ চাওয়া আছে – সেই একই চাওয়া যা আমি চেয়েছিলাম যখন আপনারা ৮ বছর আগে আমার পক্ষে বাজি ধরেছিলেন।

আমি আপনাদের বিশ্বাস করতে অনুরোধ করছি। পরিবর্তন আনার ব্যাপারে আমার ক্ষমতায় বিশ্বাস করতে বলছি না – বলছি আপনাদের নিজেদের ওপর বিশ্বাস করতে।”

হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর শেষ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন – “এই দেশের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। আমি আমেরিকার মানুষের ওপর আস্থাশীল। আমি বিশ্বাস করি মানুষের মধ্যে খারাপের চেয়ে ভালোটাই বেশি।

আমি বিশ্বাস করি, দুঃখজনক ঘটনা ঘটবেই। কিন্তু যদিও পৃথিবীতে খারাপের অস্তিত্ব রয়েছে, কিন্তু দিনের শেষে যদি আমরা পরিশ্রম করি এবং সত্যের প্রতি সৎ থাকি, তাহলে প্রতি মূহুর্তে পৃথিবীটা আরও একটু ভালো জায়গায় পরিনত হবে।

এবং যেসব তরুণের সাথে আমি কাজ করেছি, তাদের মাঝে আমি সেই ভালোর অস্তিত্ব দেখেছি। তাদের নিয়ে আমি দারুন গর্বিত।এবং আমি কোনও নাটকের মঞ্চায়ন করছি না। এসব আমি সত্যিকারেই বিশ্বাস করি।

এটা সত্যি যে আমি জনসম্মুখের থেকে বন্ধ দরজার পেছনে অনেক বেশি বাজে কথা বলি…আমি সবার মতই (কখনও কখনও) রেগে যাই অথবা হতাশ হয়ে পড়ি, কিন্তু আমার অস্তিত্বের গভীরে আমি বিশ্বাস করি আমরা ভালো থাকব।

আমাদের শুধু তারজন্য লড়াই করে যেতে হবে, এবং অদৃষ্টের হাতে সব ছেড়ে না দিয়ে আমাদের পরিশ্রম করতে হবে, এবং আমি জানি আপনারা (তরুণরা) আমাদের এটা অর্জন করতে সাহায্য করবেন।”

২০১৭ সালের ১৯শে জানুয়ারী যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় এবং সফল প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শেষ বারের মত হোয়াইট হাউজে অফিস করেন।

[প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বুঝিয়ে দিয়ে হোয়াইট হাউস ছাড়ছেন বারাক ওবামা]

বারাক ওবামার জীবনী থেকে নেয়া কয়েকটি মজার তথ্য:

# ওবামা যখন কেবলই ১২ বছরের বালক, তাঁর মা ছেলের প্রতিভা দেখে এক বন্ধুকে বলেছিলেন বড় হলে ও একদিন হয়তো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবে। 

# তরুণ বয়সে এক মেয়ের প্রেমে পড়ে তাকে নিয়ে বেশ কয়েকটি কবিতা রচনা করেছিলেন বারাক ওবামা। 

# সোয়াহিলি ভাষায় বারাক শব্দের অর্থ “যার ওপর আশির্বাদ বর্ষিত হয়েছে”

# ইন্দোনেশিয়ায় থাকার সময়ে তাঁর টাটা নামে একটি পোষা শিম্পাঞ্জী ছিল।

# হাইস্কুলে পড়ার সময়ে বাস্কেটবলে দক্ষতার কারনে তাঁকে “ও-বোম্বার” নামে ডাকা হত।

# ওবামা কমিকস বইয়ের দারুন ভক্ত। এছাড়া হ্যারি পটারের সবগুলো বই তাঁর পড়া। তিনি এখনও স্পাইডার ম্যান এবং “কোন্যান দি বারবেরিয়ান” এর কমিক বই সংগ্রহ করেন।

# ইন্দোনেশিয়ায় বসবাসের সময়ে তিনি কুকুরের মাংস, সাপের মাংস এবং ঘাসফড়িং ভাজির মত উদ্ভট খাবার চেখে দেখেছেন।

# ছোটবেলায় তাঁর ডাকনাম ছিল “ব্যারি”। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পরই তাঁকে তাঁর পুরো নামে ডাকা হত।

পোস্টটি শেয়ার করুন !

3 thoughts on “বারাক ওবামার জীবনী: এক অবিশ্বাস্য সাফল্যের কাহিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *