একজন সত্যিকার সফল উদ্যোক্তা তাঁর ব্যবসার উন্নয়নের পাশাপাশি নিজেকেও সব সময়ে উন্নত করার চেষ্টা করেন। সফল উদ্যোক্তা হওয়ার উপায় হিসেবে এর কোনও বিকল্প নেই।
সফল উদ্যোক্তা হতে পারা অবশ্যই দারুন, কিন্তু সেই পথে চ্যালেঞ্জও কম নয়।আর এই চ্যালেঞ্জ জয় করতে সব সময়ে নিজেকে উন্নত করার বিকল্প নেই । বেশিরভাগ সফল উদ্যোক্তা খুবই উৎসাহী ও আশাবাদী ধরনের মানুষ। সেই সাথে তাঁরা জানেন যে, ব্যবসার উন্নতি ঘটানোর পাশাপাশি নিজের দক্ষতা ও জ্ঞানের উন্নতি করা কতটা দরকার।
পৃথিবীর সেরা উদ্যোক্তাদের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাঁরা সব সময়েই নিজেদের আপগ্রেড করার জন্য নতুন নতুন জ্ঞান ও দক্ষতা শেখার চেষ্টা করেন। প্রতিযোগীতায় টিঁকে থাকতে এবং ব্যবসাকে এগিয়ে নেয়ার এটাই সেরা উপায়। শুধু ব্যবসার পেছনে বিনিয়োগ করার বদলে যিনি ব্যবসাটি চালাচ্ছেন, তাঁর পেছনেও বিনিয়োগের দরকার আছে। উদ্যোক্তা নিজে যত উন্নত হবেন, তাঁর ব্যবসাও তত উন্নত হবে।
নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিমাপ করা, নিজের দুর্বল জায়গা গুলো খুঁজে বের করা, দুর্বলতাগুলো দূর করার জন্য নতুন কিছু শেখা – ইত্যাদি কাজ একজন সত্যিকার সফল উদ্যোক্তা সব সময়েই করতে থাকেন।
আর এগুলো তাঁরা সফল হওয়ার আগে থেকেই অভ্যাস করেন। আসলে সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আগেই কিছু বিশেষ গুন ও দক্ষতা অর্জন করা জরুরী। এমনই কয়েকটি টি গুণের কথা আজ আমরা আলোচনা করব।
০১. মাস্টার হতে হবে
আপনি যে ব্যবসাতেই নামেন না কেন, সেই ব্যবসার কোনও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনাকে মাস্টার হতে হবে। ধরুন আপনি টেক্সটাইল সেক্টরে ব্যবসা করতে চান। সেক্ষেত্রে আপনি টেক্সটাইলের যে বিষয়টিতে জোর দিতে চান, সেই বিষয়ে মাস্টার পর্যায়ের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
সেই বিষয়ে আপনাকে যেন কোনও দিক দিয়েই আটকানো না যায়। সেটা হতে পারে মেশিনারিজ সম্পর্কে, ফেব্রিক সম্পর্কে, ডাইং সম্পর্কে। এবং এই মাস্টারিটা যদি আপনি ব্যবসায় নামার আগে অর্জন করতে পারেন – তাহলে ব্যবসা করাটা আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে।
ইলন মাস্ক স্পেস এক্স চালু করার সময়ে তাঁর হাতে এত টাকা ছিল যে তিনি চাইলেই যে কোনও সময়ে অনেক বড় বড় রকেট বিজ্ঞানীকে মোটা বেতনে কাজে লাগিয়ে কোম্পানীর কাজ চালিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে আগে নিজে নিজে পড়াশুনা করে রকেট ও মহাকাশ বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করে তারপরই কাজে নেমেছেন।
সেরা পন্য বা সেবাটি সৃষ্টি করার জন্য সেই বিষয়ে অবশ্যই আপনার সেরা লেভেলের জ্ঞান ও দক্ষতা থাকতে হবে। সফল উদ্যোক্তা হওয়ার সহজ উপায় গুলোর মাঝে এটি অন্যতম।
আপনি যে ব্যবসাই করেন না কেন, তার ওপর আগে মাস্টারি অর্জন করুন। একটা পর্যায় পর্যন্ত জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন করে ব্যবসায় নামলে – এরপর অভিজ্ঞতা থেকে আরও দ্রুত শিখতে পারবেন।
প্রয়োজন হলে যে সেক্টরে কাজ করতে চান, সেই সেক্টরে চাকরি করুন। অভিজ্ঞদের কাছ থেকে শিখুন। কোর্সে ভর্তি হোন বা ইন্টারনেটে বা বই থেকে জ্ঞান নিন। উদ্যোক্তা হিসেবে দীর্ঘ মেয়াদে সফল হওয়ার জন্য এগুলো খুবই জরুরী।
০২. একটি বিষয়ে মাস্টার হলেও, জানতে হবে সবকিছুই
সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আপনার সেক্টরের একটি বিষয়ে মাস্টার হওয়া যেমন জরুরী, তেমনি খুঁটিনাটি সব বিষয়ের বেসিক ব্যাপারগুলো জানা থাকাটাও কম জরুরী নয়।
যদি আপনার কাজের ক্ষেত্রের সব বিষয়ে কিছু কিছু জ্ঞান আপনার না থাকে, তবে তা আপনার নতুন আইডিয়াগুলোকে নিয়ে কাজ করার সময়ে আত্মবিশ্বাস যোগাবে।
এছাড়াও নিজের ক্ষেত্রের বাইরেও যতটা পারা যায় জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এতে অনেক নতুন সুযোগকে কাজে লাগানোটা সহজ হয়ে যায়।নতুন কোনও সেক্টরে কাজ করতে গেলে আপনাকে একদম “অ-আ-ক-খ” লেভেল থেকে শুরু করতে হবে না – এবং বিষয়টি বোঝাও আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে।
একটা উদাহরণ দেয়া যাক; ধরুন আপনি টেক্সটাইল ব্যবসা করছেন। এখন কেমিক্যাল সেক্টরের একটি ভালো সুযোগের কথা আপনাকে কেউ বলল। এখন যদি আপনার কেমিক্যাল ইনডাস্ট্রি নিয়ে কিছুটা জ্ঞান থাকে – তবে আপনি সহজেই ব্যাপারটি বুঝতে পারবেন এবং সুযোগটি নিতে পারবেন। আর যদি একেবারেই কিছু না জেনে সেই ব্যবসায়ে নামেন, তবে সোজা বাংলায় ‘ধরা খাওয়ার’ সম্ভাবনা আছে।
আপনি হয়তো সব বিষয়ে মাস্টার হতে পারবেন না, কিন্তু সব বিষয়ের বেসিক ব্যাপারটা জেনে রাখতে পারবেন। এতে নিজের কাজ ও ব্যবসার ক্ষেত্রেও নতুন নতুন আইডিয়ার সমন্বয় ঘটাতে পারবেন – যা আপনাকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকতে সাহায্য করবে।
০৩. “হাতের মত করে” টিম গড়তে ও ম্যানেজ করতে শিখুন
প্রথম শুরু করার সময়ে আপনাকে বিশাল টিম নিয়ে কাজ করতে হবে না। হয়তোবা প্রথম পর্যায়ে একাই কাজ করবেন। তারপরও ব্যবসা শুরুর আগেই আপনাকে একটি ভালো টিম গড়া ও তা ম্যানেজ করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কোনও না কোনও সময়ে গিয়ে আপনাকে টিম চালাতেই হবে। একা বেশিদূর যাওয়া যায় না।
Quest Alliance এর সিইও আকাশ শেঠির মতে, একটি পারফেক্ট টিম হাতের পাঁচ আঙুলের মত। টিমের সবার একই রকম জ্ঞান ও দক্ষতা থাকলে তাকে কোনওভাবেই ভালো টিম বলা যাবে না।
হাতের পাঁচটি আঙুল সমান হলে কি আমরা এতটা ভালভাবে কাজ করতে পারতাম? সৃষ্টিকর্তা আমাদের হাতের পাঁচটি আঙুলকে আলাদা আকারে বানিয়েছেন, যাতে তাঁর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব অন্য জীবের তুলনায় বেশি দক্ষ ভাবে কাজ করতে পারে।
ভেবে দেখুন, একটি ফুটবল দলের ১১জনই পৃথিবীর সেরা স্ট্রাইকার। কিন্তু সেই দলে কোনও মিডফিল্ডার ও ডিফেন্ডার নেই। শুধু পৃথিবীর সেরা স্ট্রাইকারদের নিয়ে গড়া এই টিম কি কোনও ম্যাচ জিততে পারবে?
তেমনি একটি ভালো টিমেও সবার দক্ষতা ও জ্ঞান সমান হয় না। আলাদা আলাদা বিষয়ে দক্ষদের নিয়ে গড়া টিমই আপনাকে সেরা ফলাফল এনে দিতে পারবে। আর এই দক্ষ লোকগুলো কিভাবে চিনে নিতে হয়, কোন ধরনের মানসিকতার মানুষদের টিম গড়লে সবচেয়ে ভাল কাজ হবে – এসব বিষয়ে আপনাকে আগে থেকেই একটা ভালো আইডিয়া অর্জন করতে হবে।
এছাড়াও একটি টিমের সেরা পারফর্মেন্স বের করে আনার জন্য টিমের মাঝে কি ধরনের পরিবেশ বজায়ে রাখতে হবে, টিম মেম্বারদের কিভাবে ম্যানেজ করতে হবে – একজন উদ্যোক্তা হিসেবে এসবও আপনার জানা থাকা প্রয়োজন। একজন মানুষের সাথে অল্প সময় কাটিয়েই সে কেমন মানুষ – তা বোধার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। পড়াশুনা ও বিভিন্ন মানুষের সাথে মেশার মাধ্যমে মানুষ চেনার দক্ষতা বাড়াতে পারেন। কাকে দিয়ে কি কাজ হবে বা হবে না; কাকে বিশ্বাস করা যাবে, আর কাকে যাবে না – এসব বোঝার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। তাহলেই আপনি সফল ভাবে টিম বানাতে ও ম্যানেজ করতে পারবেন। টিম ম্যানেজ করার উপায় জানা থাকলে, সফল উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যাবে।
০৪. গায়ে কাদা লাগানো শিখতে হবে
ভারতের বাজারে সেরা অনলাইন শপ হলো Flipcart.com. বর্তমানে পুরো ভারতজুড়ে তাদের মাল্টি মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। শুরুতেএই শপের দুই উদ্যোক্তা বিনি বানসাল ও শচীন বানসাল নিজেরাই পন্য ডেলিভারী করতেন। ওয়েব সাইট চালানো থেকে শুরু করে ডেলিভারি ম্যানের কাজও তাঁরা করেছেন। এবং এভাবেই ধীরে ধীরে তাঁরা তাঁদের ব্যবসাকে গড়ে তুলেছেন।
আমাদের অনেকেই মাথায় ভালো ভালো আইডিয়া নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু তাদের অজুহাত: তারা লোকের অভাবে কাজ করতে পারে না। অনেকটা জনপ্রিয় বাংলা প্রবাদ “ধরি মাছ, না ছুঁই পানি” এর মত অবস্থা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মাছ ধরতে হলে আপনাকে হাতে কাদা লাগাতেই হবে। আজকের অনেক বড় বড় সফল উদ্যোক্তা এক সময়ে হকারের মত রাস্তায় রাস্তায় তাঁদের পন্য বিক্রী করেছেন। সফল উদ্যোক্তা হওয়ার একটি প্রধান উপায় হলো, সব ধরনের অহেতুক লজ্জা ঝেড়ে ফেলে শুধু লক্ষ্যের দিকে ফোকাস রাখতে হবে।
সফল উদ্যোক্তা হতে হলে কোনও কাজকেই ছোট ভাবতে পারবেন না। প্রথম দিকে সব কাজেই হাত লাগাতে হবে। আপনাকে একজন ভালো রিসার্চার থেকে শুরু করে একজন ভালো কাস্টোমার ম্যানেজার হতে হবে, প্রয়োজনে একজন ভালো ডেলিভারী ম্যান, এমনকি ঝাড়ুদারও হতে হবে। ব্যবসার প্রয়োজনে আপনাকে সবই করতে হবে। সফল উদ্যোক্তা হওয়ার আর কোনও বিকল্প উপায় নেই।
এবং সবচেয়ে জরুরী বিষয়, ব্যবসায় নামার আগেই এই অভ্যাসটি আপনাকে করে নিতে হবে, যাতে ব্যবসা শুরুর পর এগুলো করতে আপনার মাঝে কোনও প্রকার অনীহা না আসে। “নাচতে নেমে ঘোমটা দেয়া” যাবে না।
০৫. যোগাযোগ দক্ষতা
আপনি যে ব্যবসাই করতে চান না কেন, আপনাকে অবশ্যই কমিউনিকেশনে ভালো হতে হবে।
ক্রেতাদের ইমপ্রেস করা, টিম মেম্বারদের ম্যানেজ করা, ইনভেস্টর ধরে আনা, টাকা ধার করা, ব্যাঙ্কের সাথে সম্পর্ক তৈরী করা, কর্মীদের দিয়ে সেরাটা বের করে আনা – অর্থাৎ একটি নতুন ব্যবসার প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষ যোগাযোগের প্রয়োজন হবে।
মানুষের সাথে কথা বলতে আপনার যদি সমস্যা হয় – তাহলে উদ্যোক্তা হিসেবে আপনার সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু এর মানে এই নয়, আপনার পক্ষে সফল হওয়া সম্ভব নয়। হয়তো মানুষের সাথে কম মেশেন বলে মানুষের সাথে সেভাবে কথা বলতে পারেন না; অথবা পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশের কারণে আপনি তেমন মিশুক হয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু এগুলো একটু চেষ্টা করলেই শেখা সম্ভব।
উদ্যোক্তা হতে হলে ব্যবসা শুরুর আগেই যোগাযোগে অনেকটা দক্ষ হয়ে উঠতে হবে। আর এটা করার জন্য কোনও খরচও করতে হবে না, বা খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। আপনার ভেতরে যদি কোনও রকমের জড়তা বা লজ্জা থাকে – অনুশীলনের মাধ্যমে তাকে আপনি জয় করতে পারেন।
নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হোন, তাদের সাথে কথা বলুন। রাস্তায় কারও পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে তার সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করুন, ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে সামনের মানুষটির সাথে কথা বলুন। ব্যাংকিং ব্যবস্থা, বা আজকের সংবাদের শিরোনাম নিয়ে কথা বলুন।
হয়তো সবাই আপনার সাথে কথা বলবে না, এড়িয়ে যাবে।তা যাক; আপনার উদ্দেশ্য হবে নিজে এগিয়ে গিয়ে মানুষের সাথে কথা বলার অভ্যাস করা। অপরিচিতদের সাথে আলাপ করার অভ্যাস করা। ধীরে ধীরে দেখবেন আপনি কথা বলায় ও সম্পর্ক গড়ায় দক্ষ হয়ে উঠছেন।
অবশ্য অনেক সময়ে এমন হতে পারে যে, আপনি বলার মত কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে মানুষটিকে ভালোমত লক্ষ্য করুন। লক্ষ্য করুন: তার হাতে কি আছে? সে কোনদিকে তাকাচ্ছে? তার হাতে কোনও বিশেষ ব্র্যান্ডের ফোন দেখলে বলুন আপনিও এটি কিনতে চাচ্ছেন, এটার পারফর্মেন্স কেমন? – আবহাওয়া নিয়ে কথা বলুন। সে যদি আপনার সাথে কথা বলতে না চায়, অথবা তার যদি মুড না থাকে – তাহলে ভদ্রভাবে সরে আসুন। মনে রাখুন আপনি এটা করছেন নিজের জড়তা কাটানোর জন্য। কখন কথা বন্ধ করতে হবে, এটা জানাও কিন্তু কমিউনিকেশন স্কিলের একটি অংশ।
একজন মানুষের কাছে নিজেকে বিশ্বস্ত ও পছন্দনীয় করে তোলার জন্য হাসি মুখে মিষ্টি ভাষায় কথা বলা খুব জরুরী। অনেকেই এই কাজটি করতে পারেন না। প্রয়োজন হলে এই গুণ অর্জনের জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রাকটিস করুন। শুধুমাত্র মুখের হাসি আর মিষ্টি ভাষা দিয়ে একজন মানুষের মন কয়েক মূহুর্তেই জয় করে নেয়া যায়।
এর বাইরেও বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে যোগাযোগের দক্ষতাকে বাড়িয়ে নিতে পারেন। এছাড়া কিভাবে মানুষের সাথে কথা বলবেন ও সম্পর্ক তৈরী করবেন – এই বিষয়ে ইন্টারনেটে অনেক ভালো ভালো টিপস পাবেন। কাজেই ইচ্ছা থাকলে এটা রপ্ত করা কোনও ব্যপারই নয়।
০৬. নিজের সমালোচনা করতে শিখুন:
মানুষ ভুল করবেই। ভুল না করা মানুষ পৃথিবীতে একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভুলের উর্ধ্বে মানুষ তখনই উঠতে পারে যখন সে নিজের ভুল বুঝে সেই ভুল থেকে শিখতে পারে।
আপনি যদি সফল উদ্যোক্তা হওয়ার উপায় এর খোঁজে থাকেন, তাহলে নিশ্চই আপনার মাঝে একটি স্বাধীনচেতা মন রয়েছে। এই স্বাধীনচেতা মনটির কিন্তু একটি সমস্যা আছে। সে শুধু নিজের ইচ্ছাতে চলতে চায়। নিজের কাছে যেটা ভালো মনে হয় – সে সেটাই করতে চায়। নতুন কিছু করার জন্য এই মানসিকতা খুবই দরকারী। নাহলে আপনি অন্যের সমালোচনার কারণে থেমে যেতে পারেন। কিন্তু এই মানসিকতা যেন আপনাকে নিজের ভুল দেখা থেকে বিরত না করে।
একজন উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসায় নামার আগে নিজের ভুল ধরায় দক্ষ হওয়াটা খুব জরুরী। সেইসাথে আপনাকে নিজের ভুলগুলো স্বীকার করা শিখতে হবে। প্রথম অবস্থায় যে কোনও কিছু করতে গেলে ভুল হতেই পারে। আর সেগুলোকে স্বীকার করে নিতে হবে, নাহলে বিপদে পড়বেন।
ভুল স্বীকার না করলে সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেয়া বা সেই ভুল ঠিক করা যায় না। তাই নিজের সমালোচনা করতে শিখুন। তাহলে আপনার উন্নতি সব সময়েই অব্যহত থাকবে।
একজন মানুষের ইগো হতে পারে তার সবচেয়ে বড় শত্রু। এই ইগোর কারনে মানুষ নিজের ভুল দেখতে পায় না। আবার দেখতে পেলেও স্বীকার করতে চায় না। খুব ভালো করে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখুন আপনার মাঝে ইগোর কোনও অস্তিত্ব আছে কিনা। যদি থাকে, তবে একে দূর করার চেষ্টা করুন।
ইগোর কারনে আপনি নিজের সমালোচনা করতে পারবেন না, আর সেই সাথে অন্যদের গঠনমূলক সমালোচনাও ভালভাবে নিতে পারবেন না। ইগোর কারণে টিমের মানুষেরাও আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে। এটা উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কাজেই নিজেকে পারফেক্ট না ভেবে, পারফেক্ট মানুষ হওয়ার জন্য সব সময়ে চেষ্টা করুন। ব্যবসা শুরুর আগে, এমনকি একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার পরও এই চর্চা চালিয়ে যান।
০৭. বড় ভাবনা ভাবুন ও তা বিশ্বাস করুন
“মানুষ তার চিন্তার সমান বড়” – এটি একটি দারুন প্রচলিত উক্তি। এবং যুগে যুগে সফল মানুষেরা এই উক্তিকে সত্যি প্রমাণ করেছেন, এবং এখনও করছেন।
নেপোলিয়ন হিল তাঁর Think and Grow Rich বইয়ে ব্যাখ্যা করেছেন যে, মানুষ যে চিন্তায় দিন রাত কাটায়, যে চিন্তা তার অবচেতনে সবচেয়ে বেশি জায়গা নিয়ে থাকে – তার জীবনটা আসলে তেমনই হয়। কেউ যদি সব সময়ে চিন্তা করে যে সে ব্যর্থ হবে, তবে যত ভালো অবস্থাতেই সে থাকুক না কেন – সে ব্যর্থ হবে। কারণ, তখন ছোটখাট কোনও বাধার মুখে পড়লেও সে হাল ছেড়ে দেবে। আর যে বিশ্বাস করে যে সে সফল হবে, সে শত বাধা আর ব্যর্থতার মুখেও চেষ্টা করে যায়। এবং এক সময়ে গিয়ে সফল হয়।
একদম বাজে অবস্থায় থেকেও যদি মনে মনে বিশ্বাস করেন যে আপনি একদিন বিরাট কিছু করবেন – তাহলে যত বাজে অবস্থায়ই শুরু করেন না কেন, আপনাকে দিয়ে তা সম্ভব। একটি চিন্তা বারবার করতে করতে যখন তা বিশ্বাসে রূপ নেয়, তখন তা মানুষকে এক অন্যরকম আত্মবিশ্বাস দান করে। স্বপ্ন যত বিশালই হোক না কেন, যদি সত্যি সত্যি মনের ভেতর বিশ্বাস আনতে পারেন যে আপনি তা পূরণ করতে পারবেন, তবে তা বাস্তবে পরিনত হওয়াটা শুধুই সময়ের ব্যাপার।
নেপলিয়ন হিল বলেন, যদি কেউ প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য তার স্বপ্নের ভবিষ্যৎকে কল্পনা করে; এবং মনে মনে বলে যে, “আমার এই স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে/ আমি ‘অমুক দিন’ এই স্বপ্ন পূরণ করবো” – তাহলে মনে এক অজেয় বিশ্বাসের জন্ম নেবে। নিজে নিজেই একটা সময়ে বুঝবেন যে আপনি কাজটি করতে পারবেন। তাই স্বপ্ন যত বড়ই হোক, বিশ্বাস করুন যে আপনি তা পূরণ করতে পারবেন। কাজে নামার আগে বিশ্বাস করতে শিখুন যে সেই কাজ আপনার দ্বারা সম্ভব – তাহলে যে কোনও বড় স্বপ্ন দেখতে আর তা পূরণে কাজ করতে ভয় করবে না। কোনওকিছু না পারলে শিখে নিয়ে আবার শুরু করবেন, বার বার পড়ে গিয়েও বিশ্বাসের জোরে উঠে দাঁড়াতে পারবেন। আর বার বার উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই আপনি এক সময়ে সফল হবেন। জীবনে বড় কিছু করার গোপন উপায় আসলে এটিই।
০৮. ব্যবসায়ের মূল বিষয় গুলো সম্পর্কে জানুন
যে ব্যবসাই করেন না কেন, আপনাকে হিসাবরক্ষণ (accounting), ব্যাংকিং, মার্কেটিং, ট্যাক্স, ব্যবসায়িক ও মুদ্রা আইন সম্পর্কে জানতে হবে।
আপনি হয়তো রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করতে চান, এবং খাবারের বিষয়টা খুব ভালোকরে জানেন। সেটা অবশ্যই জানতে হবে। কিন্তু ভালোভাবে ব্যবসা করতে হলে আপনাকে হিসাবের ব্যাপারেও পাকা হতে হবে। ব্যাপারটা এমন নয় যে আপনাকে হিসাববিজ্ঞান বা ফাইন্যান্সে ডিগ্রী নিতে হবে – কিন্তু টাকার হিসাব কিভাবে ঠিকমত রাখতে হয়, লাভ ক্ষতি কিভাবে বের করতে হয়, ইত্যাদি ব্যাপারে আইডিয়া থাকতে হবে।
সেইসাথে, ব্যবসার প্রচারের জন্য মার্কেটিং এর জ্ঞান থাকতে হবে। ট্যাক্স ও বিজনেস ল’ সম্পর্কে ধারনা থাকতে হবে। এবং এগুলো থাকতে হবে ব্যবসায়ে নামার আগেই। খুব বেশি এক্সপার্ট না হলেও – সব পরিস্থিতি যেন বুঝতে পারেন – এমন জ্ঞান আপনাকে রাখতে হবে।
এইসব বিষয়ে জ্ঞানের জন্য বইপত্র, পত্রিকা বা ব্লগ পড়তে পারেন। আরও ভাল হয় এইসব ক্ষেত্রে কাজ করে এমন বন্ধু, আত্মীয় বা পরিচিত মানুষের সাথে আলোচনা করা ও তাদের থেকে পরামর্শ নেয়া। প্রাথমিক জ্ঞান থাকলে ব্যবসা পরিচালনা করাটা অনেক সহজ হবে। এরপর ধীরে ধীরে ব্যবসা করতে করতে আপনি নিজেই এগুলো সম্পর্কে আরও অভিজ্ঞ হয়ে যাবেন।
পরিশিষ্ট
নিজের ব্যবসাকে তৈরী করার আগে নিজেকে তৈরী করুন। সফল হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করুন, কিন্তু তার আগে নিজে এমন একজন মানুষ হয়ে উঠুন যে নিজের ও তার আশপাশের অবস্থা বদলানোর ক্ষমতা রাখে। এমন একটি জায়গায় নিজেকে নিয়ে যান, যাতে আপনার ওপর ভরসা করে অন্যরা স্বপ্ন দেখতে পারে। নিজেকে দক্ষ ও যোগ্য করে তুলতে পারলে দেখবেন সবকিছুই অনেক সহজ মনে হচ্ছে। আর সবচেয়ে জরুরী বিষয়, সাফল্য অর্জনের পরও যেন নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা থেমে না যায়। তাহলে আপনি নিজেকে আরও উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবেন। সফল উদ্যোক্তা হওয়ার ও সফল উদ্যোক্তা হিসেবে টিঁকে থাকার সবচেয়ে বড় উপায় এটাই।
আশা করি সফল উদ্যোক্তা হওয়ার পথে এই লেখাটি আপনাকে একটু হলেও সাহায্য করবে। এই লেখা সম্পর্কে যদি আপনার কোনও মতামত থাকে, বা এই লেখায় যদি আরও কিছু যোগ করা যেত বলে আপনার মনে হয় – তবে আমাদের কমেন্ট করে জানান।
আর যদি মনে হয় লেখাটি অন্যদের কাজে আসবে – তবে শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন। আপনার সাফল্যেই আমাদের সার্থকতা।