অপরাহ্ উইনফ্রে শুধু একজন সুপারস্টার নন, তিনি আসলে এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। আমরা অনেক সফল ও বিখ্যাত ব্যক্তির বেলায়ই শুনি তাঁরা একদম শূণ্য থেকে উঠে এসেছেন। যদি বলা হয় এমন একজন মানুষের উদাহরন দিতে, তাহলে মার্কিন বিলিয়নিয়ার মিডিয়া জায়ান্ট এবং জনপ্রিয় টিভি ব্যক্তিত্ব অপরাহ্ উইনফ্রের কথা বলাটাই সবচেয়ে বেশি যুৎসই হবে বোধহয়। কৃষি খামারে আশ্রিত হিসেবে জীবন শুরু করা অপরাহ্ মাত্র তিন যুগের ব্যবধানে শুধুমাত্র নিজের প্রতিভা আর বুদ্ধিকে পুঁজি করে প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থমূল্যের সম্পদের মালিক হয়েছেন! কিভাবে তিনি এতদূর এলেন, সেটাই আমরা আজ জানবো তাঁর জীবনী থেকে।
একজন নারীর জীবনে যত প্রকারের বাধা বিপত্তি আসা সম্ভব সবই তিনি তাঁর বাল্য ও কৈশরে পার করে এসেছেন। শিশুবয়স থেকেই অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থার ভেতর দিয়ে লড়াই করে অপরাহ্ মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ করে কোটি কোটি মানুষের হৃদয় জয় করে নিজেকে এমন একটি উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যা টপকে যাওয়া আপাতদৃষ্টিতে এক প্রকার অসম্ভবই মনে হবে।
প্রচলিত ধারনা অনুযায়ী হলিউডে যদি কোনও নারীকে উচ্চ অবস্থানে পৌঁছাতে হয় তবে তার চোখ ধাঁধানো সুন্দরী হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু মোটাসোটা কৃষ্ণাঙ্গ অপরাহ্ আমেরিকান মিডিয়ার সবথেকে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় একজন ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে সেই ধারণা বদলে দিয়েছেন। তিনি তা সম্ভব করেছেন নিজের অসাধারন ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা, মানসিক শক্তি, লড়াকু মনোভাব আর মানুষকে কাছে টানার প্রতিভা দিয়ে। চলুন এই সফল মানুষটির জীবনের পাতায় একটু চোখ বুলিয়ে আসি।
এক নজরে অপরাহ উইনফ্রে:
অপরাহ উইনফ্রের জন্ম হয়েছিল ১৯৫৪ সালের ২৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি রাজ্যের একটি ছোট্ট শহর কসি-আসকোয়। ১৯৭৬ সালে তিনি বাল্টিমোর শহরে পাড়ি জমান এবং টেলিভিশন টক শো “পিপ্ল আর টকিং” এর উপস্থাপক হিসেবে শো টিকে দারুন জনপ্রিয়তা এনে দেন। এরপর শিকাগো টিভি স্টেশন তাকে নিয়োগ দেয় এবং তিনি যেন নিজের মত করে তার নিজের সকালের শো উপস্থাপনা করতে পারেন সে সুযোগ করে দেয়। পরবর্তীতে তিনি তাঁর নিজের নামে “দি অপরাহ্ উইনফ্রে শো” শুরু করেন, যা ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় একটি টিভি শো। অনুষ্ঠানটি ১৯৮৬ থেকে ২০১১ অবধি পঁচিশ বছর ধরে চলেছিল। ২০১১ সালে অপরাহ্ তাঁর নিজের টিভি নেটওয়ার্ক “অপরাহ্ উইনফ্রে নেটওয়ার্ক (OWN) চালু করেন।
বর্তমানের একজন অত্যান্ত সফল টিভি উপস্থাপক, অভিনেত্রী, প্রযোজক, সফল উদ্যোক্তা, জনহিতৈষী অপরাহ্ উইনফ্রের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে মিসিসিপির একটি ক্ষূদ্র ফার্মিং কমিউনিটিতে মারাত্মক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে। অল্প বয়সেই তাঁর বাবা-মায়ের মাঝে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। প্রথম অবস্থায় যদিও তিনি তার মায়ের সাথে বসবাস শুরু করেন, কিন্তু মায়ের সাথে থাকা অবস্থায় কিশোরী অপরাহ্ তার মায়ের(ভার্নিটা) বিভিন্ন পরিচিত পুরুষ আত্মীয় এবং একাধিক বন্ধুদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছিলেন।। এক পর্যায়ে আর সহ্য করতে না পেরে তিনি মায়ের আশ্রয় ছেড়ে বাবার সাথে বসবাস করার জন্য ন্যাশভিলে পাড়ি জমান। অপরাহ্ এর বাবা ছিলেন একজন নাপিত এবং ব্যবসায়ী। বাবার কাছে আসার পর তাঁর অবস্থা একটু একটু করে ভাল হতে শুরু করে।
১৯৭১ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন এবং ন্যাশভিলের স্থানীয় রেডিও ও টেলিভিশনে ছোটখাট কাজ করতে শুরু করেন।
১৯৭৬ সালে অপরাহ্ মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোরে পাড়ি জমান এবং সেখানেই তিনি তাঁর প্রথম বড় অনুষ্ঠান “People Are Talking” উপস্থাপনা করার সুযোগ পান। অনুষ্ঠানটি দারুন জনপ্রিয়তা পায় এবং উইনফ্রে অনুষ্ঠানে আট বছর কাজ করেন। এরপর শিকাগো টিভি স্টেশন তাঁকে ”এ.এম শিকাগো” অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনার জন্য ডেকে নেয়।
সেই একই সময়ে প্রচারিত হত ফিল ডনাহ্’র একই রকমের একটি অনুষ্ঠান যা তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই অপরাহ্’র মনখোলা, উষ্ণ হৃদয় প্রসূত নিজস্ব স্টাইলের কারনে ডনাহ্’র অনুষ্ঠানের থেকে তাঁর অনুষ্ঠানের নিয়মিত দর্শক সংখ্যা এক লক্ষ বেড়ে যায় এবং র্যাঙ্কিঙের শেষ অবস্থান থেকে অপরাহ্’র উপস্থাপিত অনুষ্ঠানটি এক নম্বরে উঠে আসে। এই সফলতা তাঁকে দেশজোড়া খ্যাতি এনে দেয় এবং তিনি স্টিভেন স্পিলবার্গের “দি কালার পার্পল (১৯৮৫)” সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পান। এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তিনি সেরা পার্শ্বঅভিনেত্রীর অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন।
দি অপরাহ উইনফ্রে শো:
১৯৮৬ সালে উইনফ্রে দেশজুড়ে প্রচার হওয়া অনুষ্ঠান হিসেবে তাঁর নিজের টিভি অনুষ্ঠান “দি অপরাহ্ উইনফ্রে শো” শুরু করেন। ১২০টি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত ও প্রতি পর্বে এক কোটি দর্শক পাওয়া অনুষ্ঠানটির প্রথম বছরের আয় দাঁড়ায় ১২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার ৩০ মিলিয়ন যোগ হয় অপরাহ্’র নিজের এ্যাকাউন্টে! কিছুদিনের মধ্যেই তিনি এবিসি নেটওয়ার্কের থেকে অনুষ্ঠানটির মালিকানা স্বত্ব নিজের করে নেন এবং নিজের প্রযোজনা সংস্থা ”হারপো প্রোডাকশনস্ (অপরাহ্ কে ইংরেজীতে উল্টে লিখলে হারপো [harpo]উচ্চারিত হয়) এর অধীনে অনুষ্ঠানটির নির্মান চালাতে থাকেন, যার ফলে অনুষ্ঠানটি থেকে তাঁর আয় বহুগুনে বেড়ে যায়।
১৯৯৪ সালের দিকে যখন অন্য টক শো গুলোতে খোলামেলা ভাবে বাজে কথার চর্চা দিনে দিনে বাড়তে শুরু করল, উইনফ্রে যাবতীয় বাজে বিষয় থেকে তাঁর শো কে দূরে রাখার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর থাকেন। প্রথম দিকে যদিও এই কারনে রেটিং একটু পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি দর্শকদের থেকে অন্য রকমের সম্মান পেতে শুরু করেন এবং তার অনুষ্ঠান এমনকি আগের থেকেও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
তুমুল জনপ্রিয় অপরাহ্ উইনফ্রে শো ছাড়াও ১৯৮৯ সালে হারপো “দি উইমেন অব ব্রিউস্টার প্লেস” (“Women of Brewster Place”) নামে একটি মিনি সিরিজ প্রযোজনা করে, অপরাহ্ নিজেও এটিতে অভিনয় করেন, এবং সিরিজটি অসাধারন জনপ্রিয়তা পায়। এছাড়াও উইনফ্রে ডিজনির সাথে একাধিক সিনেমার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। তবে সেই প্রকল্পের প্রথম অংশ হিসেবে অপরাহ্ ও ড্যানি গ্লোভার অভিনীত, ১৯৯৮ সালে নির্মিত ”বিলাভেড” যা কিনা টনি মরিসনের পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল – তা মিশ্র প্রতিক্রিয়া লাভ করে এবং দর্শক ও সমালোচকদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়।
তাঁর টক শো গুলোর মত অন্য যে কারনে অপরাহ্ আলোচিত হয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে তাঁর ওজন কমানোর চেষ্টা। ১৯৯৫ সালে তিনি প্রায় নব্বই পাউন্ড ওজন কমিয়ে তাঁর ওজন তাঁর জন্য আদর্শ ১৫০ পাউন্ডে নামিয়ে আনেন এবং সেই বছর ওয়াশিংটন ডি.সি তে অনুষ্ঠিত মেরিন কর্পস ম্যারাথনে অংশ নেন।
ওজন কমানোতে অপরাহ্’র বহুল প্রচারিত সফলতাকে কাজে লাগিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত শেফ রোসি ডালেই এবং ট্রেইনার বব গ্রিন, দুজনেই বেস্ট সেলার বই প্রকাশ করে ফেলেন।
তাঁর টক শো এর অংশ হিসেবে অপরাহ’স বুক ক্লাব শুরু করার মাধ্যমে প্রকাশনা জগতে অপরাহ্ বিশাল অবদান রাখেন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে অনেক অখ্যাত লেখককে তিনি বেস্ট সেলার তালিকার প্রথমে নিয়ে আসেন এবং সেইসাথে পাঠকদের নতুন ধরনের লেখা পড়ার স্বাদ পেতে সাহায্য করেন।
১৯৯৯ সালে তিনি “অক্সিজেন মিডিয়া” নামে একটি কোম্পানী সহপ্রতিষ্ঠা করেন যা নারীদের ভিত্তি করে কেব্ল টিভি অনুষ্ঠান নির্মানে বিশেষ ভাবে নিবেদিত ছিল। এই উদ্যোগের মধ্যদিয়ে অপরাহ্ মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির সবথেকে ক্ষমতাশালী ও সম্পদশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজের জায়গা পাকা করে নেন।
২০০০ সাল থেকে তাঁর ” ‘ও’: দি অপরাহ্ ম্যাগাজিন” প্রকাশিত হতে শুরু করে, এবং অন্যান্য প্রকল্পের মত এটিও অসাধারন সাফল্যের দেখা পায়।
২০০২ সালে তিনি তাঁর নিজস্ব টক শো এর প্রাইম টাইমে (অর্থাৎ যেসময়ে সব থেকে বেশি দর্শক টিভির সামনে থাকে) প্রচারের বিষয়ে নেটওয়ার্কগুলোর সাথে চুক্তি করেন।
২০০৪ সালে তিনি তাঁর নিজস্ব টক শো কে ২০১০-১১ সিজন পর্যন্ত চালিয়ে নেয়ার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হন। সেই সময়ে তাঁর শো প্রায় ২১০টির বেশি আমেরিকান চ্যানেলে এবং পৃথিবীর একশটির বেশি দেশে প্রচারিত হত।
ও ডব্লিউ এন : অপরাহ্ উইনফ্রে নেটওয়ার্ক
২০০৯ সালে অপরাহ্ ঘোষণা দেন যে এবিসির সাথে ২০১১ সাল পর্যন্ত থাকা তার চুক্তিটি শেষ হওয়ার পর তিনি আর তা নবায়ন করবেন না। চুক্তি শেষ হওয়ার পর তিনি ডিসকভারি কমিউনিকেশনস এর সাথে যৌথ উদ্যোগে তাঁর নিজের নেটওয়ার্ক “দি অপরাহ্ উইনফ্রে নেটওয়ার্ক (OWN)” থেকে কাজ করতে শুরু করেন।
শুরুটা যদিও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় তেমন একটা ভাল ছিল না, কিন্তু ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে নেটওয়ার্কটি শিরোনামে উঠে আসতে সমর্থ হয় অপরাহ ও সাত বারের ট্যুর ডি ফ্রান্স বিজয়ী আমেরিকান সাইক্লিস্ট ল্যান্স আর্মস্ট্রং এর সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। আর্মস্ট্রং ২০১২ সালের ট্যুর থেকে বাদ পড়েন ডোপ কেলেঙ্কারীর কারনে। অপরাহ্’র সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেন যে তিনি তাঁর ক্যারিয়ার জুড়েই হরমোন পরির্তনকারী ও পারফর্মেন্স বর্ধক ড্রাগের স্মরনাপন্ন হয়েছেন! অপরাহ্’র কাছে তাঁর এই কাজের কথা অকপটে স্বীকার করে আর্মস্ট্রং বলেছিলেন – “আমি গভীর ভাবে সমস্যাগ্রস্থ…এবং আমি কড়ায় গন্ডায় তার মূল্যও পরিশোধ করছি। আমি মনেকরি এটাই ঠিক। আমি এটারই যোগ্য।” জানা যায় এই একটি সাক্ষাৎকারই নেটওয়ার্কটিকে কয়েক মিলিয়ন ডলারের লাভ এনে দেয়।
আর্মস্ট্রংয়ের সাথে তাঁর সাক্ষাৎকারের বিষয়ে বলতে গিয়ে অপরাহ্ বলেছিলেন – “সে (আর্মস্ট্রং) যেভাবে সবকিছু স্বীকার করেছে, তেমনটা আমি কোনওভাবেই আশা করিনি। ব্যাপারটা আমার কাছে চমকের মত ছিল। আমরা যারা সেখানে উপস্থিত ছিলাম তার কিছু কিছু কথায় রীতিমত হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি তার বলার আকুলতা অনুভব করতে পারছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম সে তখন কতটা সিরিয়াস ছিল। সে অবশ্যই সেই মূহুর্তটার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছিল। আমাকে জিজ্ঞাসা করলে বলব সে (আগে থেকেই জানা থাকা) মূহুর্তটির সাথে মিলিত হয়েছিল মাত্র। সবকিছু শেষ হওয়ার পর আমরা দুজনেই বেশ চাপ ও অস্থিরতা অনুভব করছিলাম।”
ও ডব্লিউ এন এর সফলতার ধারাবাহিকতায় ২০১৫ এর মার্চ মাসে অপরাহ্ ঘোষণা দেন যে সেই বছরের শেষে তাঁর হারপো স্টুডিওস বন্ধ হয়ে তাদের সমস্ত কার্যক্রম ও ডব্লিউ এন হেডকোয়ার্টারের আওতায় নিয়ে আসবে। অপরাহ্’র টেলিভিশন সাম্রাজ্য কিন্তু শুরু হয়েছিল এই স্টুডিওটির হাত ধরেই। স্টুডিও স্থানান্তরের বিষয়ে অপরাহ্ বেশ খানিকটা আবেগ নিয়ে বলেছিলেন -“সময় এসেছে ব্যবসার এই অংশটিকে কাজ থেকে অবসর দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। বিদায় জানানোটা অবশ্যই বেদনাদায়ক হবে, কিন্তু সামনে তাকিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি ভবিষ্যৎ বর্তমানে আমি যা দেখছি তার থেকে অনেক বেশি কিছু সাজিয়ে রেখেছে।”
২০১৬ সালে অপরাহ্ “গ্রিনলিফ” টিভি সিরিজের মাধ্যমে আবার অভিনয়ে ফিরে আসেন। এই পারিবারিক ড্রামা সিরিজেই প্রথমবারের মত টিভিতে ধারাবাহিক উপস্থিতির একটি চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। সিরিজটি ২০১৬ এর জুনে ও ডব্লিউ এন নেটওয়ারর্ক প্রিমিয়ার করে।
২০১৭ এর ডিসেম্বরে ঘোষণা আসে ২৪.৫০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়ার মধ্যদিয়ে ডিসকভারি অপরাহ উইনফ্রে নেটওয়ার্কের সর্বোচ্চ শেয়ারের মালিক বনে গেছে। এই পরিমান শেয়ারের জন্য অপরাহ্কে তারা সাত কোটি মার্কিন ডলার প্রদান করে। এরপরও উইনফ্রের কাছে নেটওয়ার্কের ২৫.৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে এবং চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তিনি এখনও নেটওয়ার্কের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্যানুযায়ী অপরাহ্ উইনফ্রে ২০ শতকের সবথেকে সম্পদশালী আফ্রিকান আমেরিকান। তিনি তিন বছরের জন্য পৃথিবীর একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ বিলিয়নিয়ার ছিলেন। লাইফ ম্যাগাজিন তাঁকে তাঁর যুগের সবথেকে প্রভাবশালী নারী হিসেবে প্রশংসিত করে। ২০০৫ সালে বিজনেস উইক তাঁকে আমেরিকার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ জনহিতৈশী বলে ঘোষণা করে। তাঁর “এ্যাঞ্জেল নেওয়ার্ক” এর মাধ্যমে অপরাহ্ দক্ষিন আফ্রিকার মেয়েদের শিক্ষা ও হ্যারিকেন ক্যাটরিনাদূর্গতদের সাহায্যার্থে পাঁচ কোটি ডলারের বেশি তহবিল গঠন করেন।
তিনি শিশু অধিকার আন্দোলনের একজন সক্রিয় যোদ্ধা। ১৯৯৪ সালে অপ্রাহ্র কনগ্রেসের কাছে প্রস্তাব করা একটি বিল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টন আইন হিসেবে অনুমোদন করেন, যাতে বলা ছিল সারাদেশের শিশু নির্যাতনকারীদের ডাটাবেস সরকারি ভাবে তৈরী করতে হবে এবং নিয়মিত তা নবায়ন করতে হবে। তিনি “Family for Better Lives” ফাউন্ডেশনেরও প্রতিষ্ঠাতা। তিনি নিয়মিত ভাবে তাঁর সাবেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টেনিসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতেও অনুদান দিয়ে থাকেন। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে যখন একাডেমি অব টেলিভিশস আর্টস এ্যান্ড সাইন্স প্রথমবারের মত মানবতায় অবদান রাখার জন্য বব হোপ মানবতা পুরস্কার চালু করল, তার প্রথমটি অপরাহ্’র হাতেই উঠেছিল।
রাজনীতি:
ডিসেম্বর ২০০৭ এ উইনফ্রে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বারাক ওবামার জন্য প্রথমবারের মত প্রচারনায় নামেন। প্রচারনার প্রাথমিক পর্যায়ে তখন পর্যন্ত একটি একটি নির্বাচনী প্রচারনা সভায় রেকর্ড পরিমান মানুষের সামনে অপরাহ্ ওবামার পক্ষে অবস্থান নিয়ে মঞ্চে ওঠেন। আইওয়া, নিউ হ্যাম্পশায়ার ও সাউথ ক্যারোলিনার মত রাজ্যগুলোতে বেশ কয়েকটি সভা ও র্যালীতে ওবামার পক্ষ হয়ে যোগ দেন অপরাহ্। ওবামাই প্রথম রাজনীতিবিদ যার হয়ে অপরাহ্ নির্বাচনী প্রচারনায় অংশ নেন।
সেই প্রচারাভিযানের সবথেকে বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল সাউথ ক্যারোলিনা ফুটবল স্টেডিয়ামে। প্রথমে ১৮০০০ দর্শক ধারনক্ষমতার একটি বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও র্যালীতে যোগ দেয়া ২৯০০০ সমর্থকের জন্য সভার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছিল আয়োজকদের। এই বিশাল জনসমাগমের পেছনে যে অপরাহ্’র উপস্থিতি অনেকটাই অবদান রেখেছিল তা বলাই বাহুল্য। সেই সমাবেশে অপরাহ্ জনতার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন -“ড. মার্টিন লুথার কিং এই স্বপ্নটি দেখেছিলেন। কিন্তু আমরা শুধুমাত্র স্বপ্ন দেখার দিন পার করে এসেছি। আমাদের হাতে সুযোগ এসেছে – এমন একজন মানুষকে যে শুধু জানেই না আমরা কারা, সে জানে আমাদের দিয়ে কি সম্ভব – ভোটের মাধ্যমে সাহায্য করে সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিনত করার।”
তাঁর টক শো এর শেষ সিজনে অপরাহ্ একটি পারিবারিক গোপন কথা প্রকাশ করে অনুষ্ঠানের রেটিংকে বিদ্যুৎগতিতে উপরে নিয়ে যান। দর্শকদের তিনি জানান তাঁর মা ১৯৬৩ সালে আরেকটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। সেই সময়ে বাবার সাথে বসবাসকারী অপরাহ্’র বয়স ছিল নয় বছর। অপরাহ্’র মা ছোট্ট প্যাট্রিসিয়াকে দত্তক হিসেবে দিয়ে দেন, কারন তিনি বিশ্বাস করতেন আরেকটি মেয়েকে পেলেপুষে বড় করার মত সহায়তা তিনি কারও কাছে পাবেন না। সাত বছর বয়স হওয়ার আগ পর্যন্ত প্যাট্রিসিয়া বেশ কয়েকজন পালক পিতামাতার ঘরে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন।
বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর প্যাট্রিসিয়া দত্তক সংস্থার মাধ্যমে তাঁর মায়ের সাথে পূনর্মিলিত হওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলেও তাঁর মা তাঁর সাথে কোনওবারই দেখা করতে রাজি হননি। কিছু খোঁজ খবর করার পর প্যাট্রিসিয়া অপরাহ্’র এক আত্মীয়ার সাথে যোগাযোগ করতে সমর্থ হন এবং ডি এন এ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমানিত হয় অপরাহ্ ও প্যাট্রিসিয়া রক্তসম্পর্কীয়। তাঁর একজন বোন আছে এই কথা জানার অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই অপরাহ্ সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি জনসম্মক্ষে এই কথা প্রচার করবেন।
২০১৩ এর নভেম্বরে অপরাহ্ দেশের প্রতি তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ আমেরিকার সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার “প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম” লাভ করেন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিজে তাঁর কাছে পুরস্কার হস্তান্তর করেন।
২০১৮ এর জানুয়ারীতে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান হিসেবে অপরাহ্ গোল্ডেন গ্লোবের আজীবন সম্মাননা পুরস্কার “Cecil B DeMille” এ ভূষিত হন। পুরস্কার গ্রহণের সময়ে তিনি তাঁর শক্তিশালী ভাষণে উল্লেখ করেন কয়েক দশক আগে সিডনি পলিটার এই একই মঞ্চ আলোকিত করে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এরপর তিনি তাঁর ভাষণে মুক্ত সংবাদমাধ্যম এবং “নিষ্ঠুর একদল পুরুষের অধীনে নিষ্পেষিত একটি সংস্কৃতির” মধ্যে বসবাস করে সত্য বলার সাহস দেখানোর গুরুত্বের ওপর আলোকপাত করেন।
ভাষণের শেষ দিকে তিনি বলেন: “আমি এই অনুষ্ঠানে চোখ রাখা প্রতিটি নারীকে বলতে চাই তারা যেন জেনে রাখে দীগন্তে এক নতুন দিনের আলো উঁকি দিচ্ছে। আর যখন সেই নতুন দিনের সূর্য পূর্ণভাবে উদিত হবে, তা হবে একদল অসাধারন নারীর কারনে, যাদের অনেকেই এই হলে উপস্থিত আছেন। আর হবে কিছু মহৎ পুরুষের কারনে যারা লড়াই করে যাচ্ছেন আমাদের সেই দিনের দিকে নিয়ে যেতে, যেদিন সবাই একই মর্যাদায় অবস্থান করবে।”
প্রণয়:
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের থেকেই অপরাহ্ স্টিডম্যান গ্রাহাম নামে একজন জনসংযোগ কর্মকর্তার সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছেন। ১৯৯২ সালে তাঁদের বাগদান সম্পন্ন হলেও তাঁরা এখনও পর্যন্ত বিয়ের মঞ্চে দাঁড়াননি। স্টিডম্যান ও অপরাহ্ শিকাগোতে একসাথে বসবাস করছেন। শিকাগো ছাড়াও বিনোদন জগতের অন্যতম সম্পদশালী ব্যক্তিত্ব অপরাহ্ মন্টেসিটো, ক্যালিফোর্নিয়া, রোলিং প্রেইরি, ইন্ডিয়ানা ও কলোরাডোতে বাড়ির মালিকানা ভোগ করছেন।
এত এত সাফল্যের পরও কিন্তু অপরাহ্’র কাজ থেমে নেই। প্রতিনিয়তই তিনি আরও উন্নতি করার উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। অপরাহ্’র থেকে অনেক কম সাফল্য অর্জন করেই অনেকে অবসরে চলে গেছেন। নিজের জীবনকে গুছিয়ে নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছেন, অথবা ভোগের স্রোতে গা ভাসিয়ে নিজের ক্যারিয়ারকে শেষ করে দিয়েছেন। কিন্তু অপরাহ্’র মত সর্বজয়ী কিংবদন্তী হয়ে উঠলে গেলে থেমে গেলে চলে না – কাজকে ভালবেসে এগিয়ে যেতে হয়। অপরাহ্’র কাহিনী থেকে আমাদের সবারই কিছু না কিছু শেখার আছে।
লেখাটি আপনার কেমন লাগলো তা আমাদের কমেন্ট করে জানান। কোনও পরামর্শ থাকলেও কমেন্ট করুন। আপনার প্রতিটি মতামতই আমাদের কাছে অমূল্য পাথেয়। যদি মনে হয় অপরাহ্র জীবন থেকে আপনি ও অন্যরা কিছু শিখতে পারবে – তবে শেয়ার করে অন্যদের দেখার সুযোগ করে দিন।