ইগো: আপনার সবচেয়ে বড় শত্রু!!


“ইগো” শব্দটির সাথে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। শব্দটি মূলত ইংরেজী হলেও বাংলায় মোটামুটি প্রচলিত হয়ে গেছে। কেউ যদি জীবনের যে কোন কাজে কারও তুলনায় এগিয়ে যায়,  সেটা হতে পারে ক্লাসে প্রথম হওয়া; হতে পারে ব্যবসায় বা চাকরীতে তুলনামূলক বেশি সফলতা পাওয়া। এসব ব্যাপারে যদি কারও মনে বিন্দুমাত্র হিংসা জন্ম নেয় তাহলে সাধারন ভাবে ধরে নেয়া হয় তার “ইগো প্রবলেম আছে।”

তবে এই সমস্যাকে ইগো’র চেয়ে ঈর্ষা বা হিংসা বলা ভাল। ঈর্ষা ইগোর একটি অংশ হলেও ইগোর ব্যপ্তি আরও বড়।এটা আপনার সম্ভাবনাময় জীবন ও ক্যারিয়ারকে পুরোপুরি শেষ করে দিতে পারে। তাই ইগো কি, তা ভাল করে জানা, আর তা থেকে বের হয়ে আসাটা ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনের জন্য খুবই জরুরী।

তাই আজ চলুন বেস্ট সেলার লেখক রায়ান হলিডে’র বিখ্যাত বই “Ego is the Enemy” এর আলোকে জেনে নেয়া যাক কেন ইগো আপনার উন্নতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় শত্রু আর কিভাবেই বা এর থেকে বাঁচা যায়।

লেখকের কথা:

রায়ান হলিডে একাধারে একজন লেখক, মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ এবং সফল উদ্যোক্তা। তিনি Forbes, Huffington Post, The Guardian সহ অনেক বিখ্যাত পত্রিকার নিয়মিত কলামিস্ট। Ego is the Enemy ছাড়াও তাঁর আরও কয়েকটি বই “The obstacle is the way”, “Growth hacker marketing and trust me”, “I am lying” – বেশ কয়েকটি টপ চার্টে বেস্ট সেলিং।

ইগো আসলে কি?

ইগোর অনেকগুলো প্রচলিত সংজ্ঞা আছে, তবে রায়ান হলিডের মতে ইগো হচ্ছে “নিজের বড়ত্বের প্রতি একটি অস্বাভাবিক বিশ্বাস। যার সাথে মিশে থাকে অতি অহঙ্কার এবং আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর উচ্চাকাঙ্খা।”

লেখকের মতে, আমরা সবাই জানি ইগো একটি খারাপ জিনিস, এবং এটা আমাদের সবার মাঝেই কিছু না কিছু মাত্রায় আছে। আর সেজন্যই এটা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও আমাদের। ইগো কিভাবে আপনার জীবনকে খারাপ বা ভালো দিকে নিয়ে যেতে পারে, বইয়ে লেখক তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

নিজের প্রতি অস্বাভাবিক ও অবাস্তব উঁচু ধারনা একজন মানুষের সাফল্যের যাত্রাকে পুরোপুরি থামিয়ে দিতে পারে। ইগো আসলে মানুষের মাঝে বাস করা ছোট্ট শয়তানের মত যে একজন মানুষ আসলে যতটা বড়, তাকে তারচেয়েও অনেক বড় হিসেবে ভাবতে শেখায়।

আপনার মাঝে বড় হবার সম্ভাবনা আছে, এবং কাজ করলে আপনি আসলেই অনেক বড় হতে পারবেন – এটা আত্মবিশ্বাস। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী মানুষ এটাও জানে যে তার বর্তমান অবস্থা কি। সে যতটা বড় হতে চায়, ততটা বড় হতে হলে তাকে আরও কতটা কাজ করতে হবে সেটা সে খুব ভালকরে জানে।

যার মাঝে ইগো আছে, সে সত্যিকার বড় হওয়ার আগেই নিজেকে বড় ভাবতে শুরু করে। তার এই ভাবনা তাকে সত্যিকার বড় হওয়ার পথে এগুতে বাধা দেয়। কারনটা খুব স্বাভাবিক, আপনি যদি আগেই ভেবে বসে থাকেন আপনি ইতোমধ্যেই অনেক বড় কিছু করে ফেলেছেন, তবে আর সত্যিকার বড় কিছু করার জন্য কষ্ট করার দরকার মনে করবেন না।

ইগো আমাদের সাথে এই খেলাটাই খেলে। ইগো সম্পন্ন মানুষ তার মিথ্যা অহঙ্কার নিয়ে বসে থাকে, আর অন্যরা তাকে টপকে সত্যিকারের বড় হয়ে ওঠে।

আবার অনেক মানুষ কিছুটা সফলতা পেয়েই নিজেকে অনেক বড় ভাবতে শুরু করে। তারা মনে করে তাদের আর প্রমান করার কিছু নেই। এই কারনে তারা সামনে চলা আর পরিশ্রম করা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তারা বুঝতেও পারে না যে এই ভুল ধারনাটি না থাকলে তারা আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত। অথবা বুঝলেও সেই সর্বনাশা ইগোর কারনে স্বীকার করতে চায় না।

একজন মানুষের মধ্যে যে প্রবল ইগো সমস্যা আছে তার একটি প্রধান লক্ষণ তারা ভুল করেও ভুল স্বীকার করতে চায় না। অনেক সময়ে ভুল বুঝতে পারলেও তারা তা স্বীকার করে না। সেই অস্বীকার যেমন অন্যদের কাছে করে, তেমনি তাদের নিজেদের কাছেও করে। আর ভুল স্বীকার না করলে সেই ভুল শোধরানোও অসম্ভব। একজন ইগো সম্পন্ন মানুষের যদি ইংরেজী গ্রামারে সমস্যা থাকে, এবং আপনি যদি তাকে সেটা ধরিয়ে দিতে যান, তাহলে সে আপনারই ওপর রাগ করবে। পরীক্ষায় নম্বর কম পেলে সেটা হবে শিক্ষকের দোষ, কিন্তু নিজে নিজের জ্ঞান বাড়ানোর কোনও চেষ্টা সে করবে না।

ইগো সম্পন্ন মানুষদের আরও একটি ব্যাপার, তারা নিজেরা যতটুকু জানে, তার তুলনায় বেশি জ্ঞানী বলে নিজেদের জাহির করতে চায়। সোজা বাংলায় এরা সব সময়ে “দুই লাইন বেশি বোঝে”। আপনি যদি মনে করেন তারা শুধু অন্যদেরকে বিশ্বাস করাতে চায় যে তারা বেশি জানে, তাহলে ভুল করবেন। এরা আসলে নিজেরাও বিশ্বাস করে যে তারা যে কোনও বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী। কোনও একটি বিষয়ে অল্প একটু ঘাঁটাঘাঁটি করেই তারা ধরে নেয় তারা আসলে অনেক কিছু জেনে ফেলেছে। আর এই বিশ্বাস তাদের যে কোনও ব্যাপারেই খুব বেশি জানার আগেই জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

একজন ইগো সম্পন্ন মানুষকে আপনি কখনও যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারবেন না। মানে, তারা কখনও তর্কে হার মানবে না। তারা যদি বোঝেও যে তাদের তুলনায় তাদের সামনের মানুষটির কথা বেশি যুক্তিসঙ্গত ও প্রমানিত, তারপরও তারা মানবে না।

একজন ইগোর দ্বারা অসুস্থ মানুষ ব্যর্থ হলেও সেই ব্যর্থতা থেকে না শিখে সব সময়ে পরিস্থিতি বা অন্য মানুষের ওপরে দোষ চাপাতে ভালবাসে। তারা কখনও নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে না তাদের কোথায় গলদ আছে। এর কারন তারা একটি ঘোরের মাঝে থাকে। তারা ভাবে, তাদের মধ্যে কোনও খুঁত নেই এবং সেই কারনে তারা কোনওভাবেই ভুল করতে পারে না।

এই লেখার প্রথম দিকে ঈর্ষা, পরনিন্দা, হিংসা ইত্যাদিকে ইগোর সাথে তুলনা করা হয়েছে। এগুলো আসলে ইগোর ফলাফল। একজন মানুষ যখন ইগোর শিকার হয় তখন সে অযথাই নিজেকে অন্যদের চেয়ে বড় ভাবতে শুরু করে। তারচেয়ে কেউ কোনও কিছুতে ভাল হলে সে কোনও না কোনও ভাবে তার ভুল ধরার চেষ্টা করে। যে কোনও ভাবে অন্য মানুষকে ছোট করার চেষ্টা করতে থাকে। আর এর ফলে সাধারন মানুষ তো তাকে পছন্দ করেই না, কাছের মানুষগুলোও দূরে চলে যায়। ইগো আসলে একটি মানসিক প্যারালাইসিস, যা আপনাকে শোয়া অবস্থায় বিশ্বাস করায় আপনি এখন উড়ছেন।

ইগো: আপনার সবথেকে বড় শত্রু…..

“Ego is the enemy” বেস্ট সেলিং বইটিতে লেখক পুরাতন ও বর্তমান সময়ের বেশ কয়েকজন বিখ্যাত  ব্যক্তির ওপর ইগো কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে – তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেই আলোচনার পাশাপাশি তিনি ইগোকে পাশ কাটিয়ে কিভাবে জীবনে সত্যিকার সফলতার দেখা পাওয়া যায় – সেই উপায়ও বলে দিয়েছেন। আমরা অবশ্য এই রিভিউতে অতটা বিস্তারিত ভাবে সেইসব ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা করব না। এখানে বইয়ের আলোকে আমরা আপনাকে ইগোর ব্যাপারে একটি স্পষ্ট ধারনা দেয়ার চেষ্টা করব, পাশাপাশি এর থেকে বের হয়ে আসার উপায়গুলো আপনাকে বিস্তারিত বলব।

বইটি ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই তিনটি ভাগে লেখক জীবনের প্রধান তিনটি পর্যায়ের কথা বলেছেন, যেগুলোকে ইগো সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করতে পারে। এই জায়গাগুলোতে ইগো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি, এবং এটা আপনাকে আপনার সাফল্যের পথ থেকে ছিটকে দিতে পারে।

জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি পর্যায় নিন্মরূপ:

  • লক্ষ্য ও আকাঙ্খা: জীবনের এই ভাগে মানুষ তার জীবনের লক্ষ্য নির্ধারন করে, এবং তা পূরণ করার আশায় বুক বাঁধে।
  • প্রাথমিক সাফল্য: জীবনের এই ভাগে মানুষ তার লক্ষ্য পূরণ করতে শুরু করে, এবং অন্যদের কাছ থেকে প্রশংসা পেতে শুরু করে।
  • ব্যর্থতা: এই ক্ষেত্রে মানুষের সার্বিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে এবং তার ওপরে আসা ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা তাকে সামলাতে হয়।

বইয়ে লেখক এই তিনটি পর্যায়কে দারুন ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।  ব্যাখ্যার পাশাপাশি তিনি পাঠকদের শিখিয়েছেন কিভাবে সঠিক ভাবে নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। সেইসাথে শিখিয়েছেন কিভাবে নিজের ও অন্যদের সাথে সম্পর্ককে পরিচালনা করতে হবে। ব্যর্থতার মুখে পড়লে কিভাবে ঠান্ডা মাথায়, মেজাজ ও ব্যক্তিত্ব না হারিয়ে সেই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা যায় – বইয়ে লেখক খুব সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

বইটিতে লেখক স্পষ্ট ভাবে আকাঙ্খা ও ইগোর মাঝে পার্থক্য করে দেখিয়েছেন।

তাঁর মতে যাদের মাঝে সত্যিকার লক্ষ্য ও আকাঙ্খার বদলে ইগো আছে, তারা আসলে কাজ করে না। কাজের চেয়ে তারা কথা বলেই বেশি সময় নষ্ট করে।

ইগো একজন মানুষকে বিশ্বাস করায় যে সে সব জানে। আকাঙ্খা একজন মানুষকে বিশ্বাস করায় যে শেখার কোনও শেষ নেই। একটু সাফল্য পেলেই মানুষ নিজেকে অনেক বড় কিছু ভাবতে শুরু করে যদি তার মাঝে ইগো বেশি পরিমানে থাকে। যতটা সাফল্য না সে অর্জন করেছে, তার শরীরী ভাষায় (body language) ও কথাবার্তায় তারচেয়ে বেশি অহঙ্কার দেখা যায়। আর এই দম্ভ বা অহঙ্কারই হয় তাদের পতনের কারন।

অন্যদিকে যারা নিজেদের ইগোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তারা সব সময়েই বিনয়ী হয়। তারা জানে যে তাদের শেখা ও উন্নতি করার এখনও অনেক সুযোগ রয়েছে। তারা অহঙ্কার না করে বরং বিনয়ের সাথে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

ব্যর্থ হলে একজন ইগো সম্পন্ন ব্যক্তি সব সময়ে অন্যকে দোষ দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করে। নিজের কোথায় ভুল বা কমতি ছিল – তা না দেখে নিজের কাছে ভাল থাকতে চায়। অন্যদিকে একজন সত্যিকার কাজের মানুষ লক্ষ্যপূরণের পথে তার ভুল গুলোকে সুন্দর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে সেগুলো থেকে শিক্ষা নেয়।

আগেই বলেছি, এইসব সমস্যা থেকে বের হওয়ার পথও লেখক তাঁর বইতে বলে দিয়েছেন। চলুন জেনে নেয়া যাক ইগো থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়গুলো।

০১. ক্যানভাস পদ্ধতি:

লেখকের মতে এই পদ্ধতিতে ইগোকে জয় করতে গেলে আপনাকে স্বল্পমেয়াদী সাফল্যে খুব বেশি খুশি হওয়া বাদ দিতে হবে। তার বদলে দীর্ঘ মেয়াদে নিজের উন্নতি করার অভ্যাস  করতে হবে। লেখক বলেন স্বল্প মেয়াদী সাফল্যের খুশি আসে আত্মতুষ্টি থেকে । আর এই আত্মতুষ্টি মানুষকে অনুপ্রাণিত করার বদলে অহেতুক গর্ব সৃষ্টি করে। নিজের লক্ষ্য অর্জনের ক্যানভাসটিকে সব সময়ে বড় করে দেখলে সামনে সব সময়ে একটির পর একটি নতুন লক্ষ্য আসতে থাকে। এতে করে সে নিজের বর্তমান জ্ঞান অথবা সাফল্যতেই খুব বেশি আত্মহারা হবে না। বরং সে নিজের উন্নতির আরও ক্ষেত্র দেখতে পাবে। মাঝে মাঝে লক্ষ্য পূরণের আনন্দের চেয়ে নতুন করে শিখতে পারার আনন্দকে গূরুত্ব দিলে ইগোর শিকার হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে আসে।

ধরুন আপনি ২৬ কিলোমিটার ম্যারাথনে অংশ নিতে চান। কিন্তু আপনি যদি ৫ কিলো দৌড়ানোর দক্ষতা অর্জন করেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিজেকে মহান দৌড়বিদ ভাবতে শুরু করেন – তাহলে কিন্তু আপনার ২৬ কিলো দৌড়ানোর দক্ষতা অর্জন করতে যে যা করতে হবে – তা আর করার ইচ্ছা থাকবে না। পুরো ক্যানভাসটিকে সব সময়ে মনের পর্দায় ভাসিয়ে রাখতে হবে। পাঁচ মাইলের দক্ষতা অর্জনের পরে আপনি যখন সামনে তাকিয়ে দেখবেন আরও ২১ মাইল বাকি, তখন আপনা আপনিই আরও ভাল করার তাড়া আসবে। এরপর সেই লক্ষ্য পূরণ হলে আপনার লক্ষ্য আরও বড় প্রতিযোগীতায় অংশ নেয়া। বড় মনের সফল মানুষেরা এই কারনেই সব সময়ে ‘নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে’ চান।

ক্যানভাস পদ্ধতি অনুসরন করে কাজ করতে হলে লেখক যে কোনও কাজের শুরুতে দুটি বিষয় মাথায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।

  • ১.১/ বিনীত থাকা: যে কোনও কাজ শুরু করার আগে ভেবে নিন আপনি নিজেকে যতটা ভাবছেন ততটা গুরুত্বপূর্ণ আপনি নন। আগে সফল হোন, তারপর নিজের গুরুত্ব নিয়ে চিন্তা করুন। লেখকের মতে, এই ভাবনা আপনাকে কাজের সময়ে বিনীত ও শান্ত থাকতে সাহায্য করবে। অনেক সময়েই দেখবেন গ্রেট গ্রেট খেলোয়াড় বিশ্বকাপ বা এই ধরনের কিছু জিতলে বলেন, যে তাদের আরও উন্নতি করার জায়গা আছে। সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড গড়া হলে অনেক সেরা খেলোয়াড় বলেন যে তারা রেকর্ডটিকে সামনে আরও উপরে নিয়ে যেতে চান। “নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে” চান। এর কারন তারা সব সময়ে সতর্ক থাকেন, তাদের অর্জন যেন তাদের ইগোর শিকার না বানায়। একটি বড় লক্ষ্য পূরণ হলে তাঁরা আরও বড় লক্ষ্যের দিকে চোখ দেন।
  • ১.২/ জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা মাথায় রাখা: কোনও কাজ শুরুর আগে সব সময়ে মাথায় রাখুন আপনি আসলে সেই কাজের বিষয়ে কতটা জানেন। একটি বিষয় মনে গেঁথে নিন, কোনও বিষয়েই জানার কোনও শেষ নেই, এবং আপনি এই কাজটির বিষয়েও সবকিছু জানেন না। কাজেই আপনার এই কাজ থেকেও নতুন অনেক কিছু শেখার আছে।শুধু নিজের সাফল্যে খুশি হওয়ার ক্ষেত্রের কথাই লেখক এই অধ্যায়ে বলেন নি। তিনি বলেন যে আমাদের শুধু একার সাফল্য নিয়েই ভাবলে চলবে না। ক্যানভাসটিকে আরও বড় করতে হলে, আমাদের অন্যদের নিয়েও ভাবতে হবে। একজন মানুষের সাফল্য বেশিরভাগ সময়েই অন্য আরও কিছু মানুষের সাফল্যের হাত ধরে আসে।ইগোকে পাশ কাটিয়ে সাফল্য পেতে গেলে আপনাকে এমন ভাবে কাজ করতে হবে যাতে করে অন্যদের জন্যও তাদের কাজ করাটা সহজ হয়ে যায়। নতুন কোথাও কাজ করতে গেলে প্রথমেই নিজের জ্ঞান ও মতামত জাহির করতে যাবেন না। আপনি ধরেই নিন যে যাদের সাথে আপনি কাজ করছেন, তারা আপনার চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখেন। এতে করে আপনি নতুন অনেক কিছু শিখতে পারবেন। অন্যদের জ্ঞানটি নিজে অর্জন করার পর সেই অনুযায়ী কাজ করতে করতে যখন তারা আপনার ওপর আস্থা পাবেন, তখনই তারা আপনার মতামতকে গুরুত্ব দেবেন। কাজেই প্রথমে অন্যদের কাছ থেকে শেখার মানসিকতা নিয়ে কাজ শুরু করুন। এর ফলে ইগো আপনাকে পরাজিত করতে পারবে না।ক্যানভাস পদ্ধতিটি রপ্ত করার জন্য লেখক প্রাচীন স্টইকদের মত করে চিন্তা করার পরামর্শ দিয়েছেন। স্টইকরা নিজেদেরকে “জীবনের ছাত্র” হিসেবে দেখত। তারা জীবনভর শিখে যাওয়াকে তাদের জীবনের ব্রত হিসেবে পালন করত। আর এই মানসিকতা তাদের সব সময়ে বিনয়ী ও নিরহঙ্কার থাকতে অনুপ্রেরণা যোগাত। সেইসাথে তারা যা জানতে চায়, সেই বিষয়ে সেরা মানুষদের কাছ থেকে শিখতে পারত।
    লেখক এই অধ্যায়ের শেষ করেছেন দার্শনিক এপিকটেটাস এর একটি উক্তি দিয়ে – “যদি মানুষ মনে করে যে সে কোনও কিছু জেনে ফেলেছে, তাহলে তার পক্ষে তা (সত্যিকার অর্থে) জানা অসম্ভব।

০২. কাজ ও বিশ্বাস পদ্ধতি

লেখকের মতে এই পদ্ধতিতে ইগোকে জয় করতে গেলে প্রথমেই যা করতে হবে, তা হল কথা কম বলে কাজ শুরু করে দেয়া। ইগো সম্পন্ন মানুষরা নিজের বড়ত্বের ব্যাপারে কথা বলতে বেশি ভালবাসে। ভবিষ্যতে তারা কি করবে, না করবে, কত বড় বড় কাজ করবে – এইসব কথা বলে বেড়ায়, কিন্তু তেমন কোনও কাজ আসলে করে না। লেখকের মতে, এই বড় বড় কথা বলার অভ্যাস আসলে মানুষের ভেতর থেকে কাজ করার গতি নষ্ট করে ফেলে। নিজের পরিকল্পনার ব্যাপারে বড় বড় কথা বলতে বলতে নিজের মাঝে একটি অহেতুক আত্মতুষ্টি জন্ম নেয়। তাই কাজ করে সেই পর্যায়ে যাওয়ার আগ্রহ ততটা থাকে না। লেখকের মতে, এই বড় বড় কথা বলার বদলে মানুষ যদি সত্যিকার কাজে নামে, তাহলে কথা বলার শক্তিটি কাজ করার শক্তিতে পরিনত হয়।

কথা না বলে কাজ করার পাশাপাশি লেখক এই অধ্যায়ে অন্য যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন – তা হল বিশ্বাস। একটি সফল কাজ করতে গেলে নিজের প্রতি বিশ্বাস তো অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু যদি একজন মানুষ সব রকমের ইগোকে জয় করে সাফল্য পেতে চায় সেক্ষেত্রে তাকে অন্যদের ওপরও বিশ্বাস রাখতে হবে।

লেখকের পর্যবেক্ষণ হল ইগো অনেক সময়ে মানুষকে অন্য মানুষের যোগ্যতার ওপর ভরসা করতে বাধা দেয়। অনেক সময়েই ইগোর কারনে মানুষ ভাবে যে, কিছু কাজ পৃথিবীতে তার থেকে ভাল আর কেউ করতে পারে না। এই ভাবনার কারনে কিছু মানুষ সব কাজ একাই করতে চায় এবং এর ফলে কাজের ক্ষেত্রে অন্যদের সাথে তার কোনও ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। এছাড়াও অন্যদের সাথে নিয়ে না করার জন্য কাজটি আসলে যত ভাল হতে পারত – ততটা ভাল হয় না।

নিজের প্রতি অতিরিক্ত বিশ্বাসের কারনে মানুষ অন্যের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারে না। এমনকি অন্যদের দক্ষতা সম্পর্কে জানার পরও ইগো সম্পন্ন মানুষ তাদের ওপর ভরসা করতে পারে না – কারন তারা ভাবে সেই কাজ তারা নিজেরা করলেই সবথেকে ভাল হবে।

এই অধ্যায়ে লেখক পাঠকদের বোঝাতে চান যে বিশ্বাস আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। একথা ঠিক যে ঢালাও ভাবে সবার ওপর বিশ্বাস করতে নেই। কিন্তু একটা মানুষকে ভাল করে লক্ষ্য করলে এবং তার কাজ দেখলে তার সততা ও দক্ষতা সম্পর্কে বেশ ভাল ধারনা পাওয়া যায়। আপনি একজন অসুস্থ ইগো সম্পন্ন মানুষের সাথে দীর্ঘদিন একসাথে কাজ করার পরও সে আপনার ওপর কোনও দায়িত্ব দেয়ার ভরসা পাবে না। কিন্তু এই কারনে অনেক বড় বড় সম্ভাবনাময় প্রজেক্ট যতটা সাফল্য পাওয়ার উচি‌ৎ – ততটা পায় না।

লেখক বলেন, বিশ্বাস একটি কাজের গতিকে অনেক গুণে বাড়িয়ে দেয়। একটি ব্যবসায়ের সাফল্যের গতি সবথেকে বেশি থাকে যখন মালিক, কর্মচারী, অংশীদাররা একে অপরের ওপর ভরসা করে। একটি প্রজেক্টের কাজ যখন বেশ কয়েকজনের মাঝে ভাগ হয়ে যায় তাহলে একটি কাজের সময়েই বেশ কয়েকটি কাজ একসাথে হয়ে যায়। একটি প্রজেক্টে যদি চারটি ধাপের কাজ থাকে, এবং অফিসে লোকও হয় চারজন।  তাদের প্রত্যেকেরই কাজের বিষয়ে ভাল জ্ঞান ও দক্ষতা আছে। কিন্তু এদের মধ্যে একজন আছে যার ইগোর সমস্যা। সে অন্যদের কাজ করতে না দিয়ে নিজেই পুরো প্রজেক্টটি নামাবে বলে ঠিক করল। এতে করে প্রজেক্ট এর চারটি ধাপ করতে তাকে এক এক করে চার ঘন্টা কাজ করতে হল।

কিন্তু এই কাজটি যদি চারজনে মিলে করত, তাহলে দেখা যেত যে এক ঘন্টায়ই কাজটি শেষ করা যায়। কিন্তু তার বদলে কাজটি করতে তিন ঘন্টা বেশি সময় নষ্ট হল, কারন একজন মানুষ তার ইগোর কারনে অন্যদের হাতে কাজের কোনও অংশই ছাড়তে চাইছিল না।

লেখকের মতে আপনি যদি ইগোকে জয় করে অন্যদের ওপর বিশ্বাস রাখেন, তাহলে কাজের গতি তো বাড়বেই, সেই সাথে অন্যরাও আপনাকে বিশ্বাস ও সম্মান করবে।

০৩. সাফল্য ব্যর্থতা গ্রহণ পদ্ধতি

যে কোনও কাজে অপ্রত্যাশিত ফলাফল আসলে একটি রাস্তার বাঁকের মত। এই বাঁকে আপনি নিজেকে আরও একটু ভাল করে নেয়ার সুযোগ পাবেন।

এই অপ্রত্যাশিত ফলাফল ভাল খারাপ – দু’টোই হতে পারে। আর এই সময়ে ইগো তার বড় চালটা চালে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে ইগোর কারনে আপনি সঠিক পথ থেকে সরে যেতে পারেন। ইগো খারাপ ও ভাল – দুই সময়েই আপনাকে শেষ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।

আপনি যখন কোনও খারাপ বা ভুল কিছু করেন, আপনার ইগো আপনাকে সেই ভুল স্বীকার করে সেটা না শুধরে, সেই দায় অন্যের ওপর চাপাতে উ‌ৎসাহিত করে। এই পরিস্থিতিতে ইগোর শিকার হলে আপনি কখনওই সেই খারাপ অবস্থার জাল কেটে বের হতে পারবেন না।

আবার যখন আপনি ভাল কিছু করেন অথবা আশার থেকে বেশি সাফল্য পান, তখন আপনার ইগো সেই সাফল্যের জন্য অন্যদের প্রাপ্য কৃতিত্ব দিতে চায়না। ইগো আপনাকে বোঝায় যে কাজটির পুরো কৃতিত্ব আপনার একার। এই ধরনের ইগোর কারনে সাফল্য ও সম্মান ধরে রাখাটা খুব কঠিন হয়ে যায়।

লেখক এই দুই পরিস্থিতিতেই আপনাকে এমন আচরন করার পরামর্শ দেন যাতে করে ইগো আপনার মনের নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে। – কিভাবে?

আপনি যখনই আশার থেকে বেশি ভাল বা খারাপ পরিস্থিতিতে পড়বেন, আপনাকে ভাবতে হবে এটা আপনার নিজের উন্নতি করার জন্য সবচেয়ে ভাল সময়।

আপনি যদি চরম ভাবে ব্যর্থ হন, তবে আপনাকে ভেবে দেখতে হবে সেই ব্যর্থতার পেছনে আপনার নিজের কি কি ভুল ছিল, যেগুলো শুধরে আপনি সেই ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

আবার যদি আশার চেয়ে বেশি সাফল্য পেয়ে যান, তবে ভাবুন, যদি কাজটি সামনে আরও ভালভাবে করা যায় তবে আপনি আরও বেশি সাফল্য পাবেন। যারা আপনার কাজের সময়ে বিভিন্ন ভাবে সমর্থন দিয়েছেন,  সব সময়ে  তাদের কৃতজ্ঞতা জানান। তাদেরকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ দিন। আপনার এই সাফল্যের পেছনে কার কি অবদান আছে তা ভালকরে মনে করুন। প্রয়োজন হলে কাগজ-কলম নিয়ে বসে যান।

আপনার নিজের ভেতরে অহঙ্কার আর হতাশাকে কখনওই জায়গা দেবেন না। হতাশা একটি দুর্বলতা, যা থেকে অহঙ্কারের মত রোগ দেখা দেয়, আপনার নিজের ভুল গুলোকে মেনে নিতে বাধা দেয়। আর আপনি নিজেও জানেন অহঙ্কার মানুষের পতন ডেকে আনে।  সাফল্যে আত্মহারা হয়ে গেলেও সেই একই ঘটনা ঘটে। মনে রাখবেন, একা কেউ সফল হতে পারে না। আপনি যদি খুব ভাল একটি পন্য আবিষ্কার করেন এবং তা থেকে আপনার দারুন লাভ হতে থাকে – মনে রাখবেন, মানুষ যদি আপনার পন্য না কিনত, তাহলে আপনার লাভ হত না।

প্রতিটি নতুন আইডিয়া আসলে আলাদা আলাদা জ্ঞানের মিশ্রণ। আপনি হয়তো বুঝতেও পারেন না, আপনার ‘ইউনিক’ আইডিয়াটি হয়তো দশটি বই পড়ার পরে এসে গেছে। আপনার অবচেতনে দশটি বইয়ের জ্ঞানগুলো মিলেমিশে একটি নতুন জ্ঞানের জন্ম দিয়েছে।

কাজেই সব সময়ে বিনীত থাকুন।  ইগোকে কখনওই আপনার ওপর প্রভুত্ব করতে দেবেন না। আপনার যদি নিজেকে পৃথিবীর প্রভু মনে হয়, তবে মনে রাখবেন, আপনি পৃথিবীর প্রভু নন, ইগো আপনার প্রভু হয়ে বসায় আপনার মাথায় এই উদ্ভট ভাবনা এসেছে।

পরিশিষ্ট:

আশা করা যায় এই বুক রিভিউটি থেকে আপনি ইগো কি এবং কিভাবে এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, সেই ব্যাপারে একটি ভাল ধারনা পেয়েছেন। অনেকের মাঝে ইগো থাকলেও তারা নিজের এই অসুস্থতাটি ধরতে পারেনা, যার কারন তাদের সেই ইগো। আপনার যদি এমন মনে হয় যে আপনার মাঝেও এই ইগোর কিছুটা হলেও আছে, তবে এখনই সময় রায়ান হলিডে’র পরামর্শগুলো কাজে লাগানোর।

লেখকের সাথে আমাদেরও আশা বইটির জ্ঞান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইগোর ফাঁদ চিনে নিয়ে তা থেকে পাঠকেরা মুক্তি পাবেন। এক কথায়, শুধুমাত্র একটু দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করলেই জীবন অনেক সহজ হয়ে যায়, ইগো শুধু আপনার জীবনকে জটিল থেকে জটিলই করবে।

যদি আপনার মনে হয় যে আপনার কোনও কাছের মানুষ ইগোর সমস্যায় ভুগছেন এবং তিনি এই লেখাটি থেকে উপকৃত হবেন, তবে লেখাটি তাদের সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন। ইগো নামক শত্রুর হাত থেকে নিজে বাঁচুন, অন্যদেরও বাঁচতে সাহায্য করুন।

পোস্টটি শেয়ার করুন !

5 thoughts on “ইগো: আপনার সবচেয়ে বড় শত্রু!!

  1. এখান থেকে জীবনে অনেক কিছু শিখলাম,,ধন্যবাদ প্রিয় লেখকে…!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *