অনুপ্রেরণা কি অথবা মোটিভেশন কি ? – এই প্রশ্ন অনেক সময়েই আমাদের মনে জাগে। অনুপ্রেরণা বা মোটিভেশন নিয়ে একটা ধারণা তো সবারই আছে। কিন্তু নির্দিষ্ট ভাবে অনুপ্রেরণা বা মোটিভেশন কাকে বলে – এই ব্যাপারে অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই।
সেই ধারণাকে স্পষ্ট করতেই আজ আমরা জানব, অনুপ্রেরণা বা মোটিভেশন কি, এবং জীবনের যে কোনও বিষয়ে সফল হতে গেলে কেন এটা প্রয়োজন।
অনুপ্রেরণা কি / মোটিভেশন কি?
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির লিডারশিপ ও ডিজিটাল মার্কেটিং বিষয়ের অধ্যাপক মারি জোহানসেন অনুপ্রেরণার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “অনুপ্রেরণা হল সেই আকাঙ্খা বা শক্তি যা মানুষকে কোনওকিছু অর্জন করার জন্য কাজ করার ইচ্ছা বা উৎসাহ সৃষ্টি করে”
খুব সাধারণ একটা উদাহরণ দেয়া যাক, আমাদের ক্ষুধা লাগে বলে আমরা খাবার যোগাড় করি। খাবার যোগাড় করতে আমাদের কাজ করতে হয়। তার মানে, ক্ষুধা হল খাবার যোগাড় করার পেছনে একটি প্রধান অনুপ্রেরণা।
আবার ধরুন রেস্টুরেন্টের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বিরিয়ানীর ঘ্রাণ নাকে আসলে আমাদের তা খেতে ইচ্ছে হয়। অনেকেই বাসায় খাবার রেডি আছে জেনেও রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়েন, অথবা বাড়ি ফেরার পথ না ধরে বাজারের দিকে যান বিরিয়ানীর সরঞ্জাম কেনার জন্য।
বিরিয়ানীর ঘ্রাণ এখানে মোটিভেশন বা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
অর্থাৎ, কোনও কাজ করার পেছনের কারণই মূলত অনুপ্রেরণা।

যে ছাত্রটি খুব মন দিয়ে পড়াশুনা করছে, তার হয়তো ইচ্ছা সে ইঞ্জিনিয়ার হবে, অথবা বড় কর্মকর্তা হবে। আবার এমনও হতে পারে, সে খুব ভালো করে পড়ার বিষয়গুলো শিখতে চায়, যাতে করে সে সেগুলো জীবনে কাজে লাগাতে পারে।
মোটিভেশন বা অনুপ্রেরণা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যুদ্ধে মানুষ প্রাণ দিতেও দ্বিধা করে না, কারণ হতে পারে সে তার সন্তানের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও সুন্দর একটি দেশ বা পরিবেশ রেখে যেতে চায়। হয়তো যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে সে তার সন্তানের মুখ কল্পনা করে।
আবার হয়তো অন্য একজন যোদ্ধা যুদ্ধ করে প্রিয়জন হারানোর প্রতিশোধ নেবার জন্য। আরেকজন হয়তো করে যুদ্ধে জিতলে যে সম্পদ পাবে – তার জন্য। মানে লোভের জন্য।
একজন চাকরিজীবি সারাদিন অফিসে খাটাখাটনি করে মাস শেষে বেতন নিয়ে চলার জন্য। তার পাশেরজনই হয়তো কাজ করছে কাজটি আরও ভালো করে শিখে আরও ভালো অবস্থানে যাওয়ার জন্য। – এর সবই অনুপ্রেরণা।
অনুপ্রেরণা হল এমন একটি কারণ বা অবস্থা, যা মানুষকে নির্দিষ্ট কাজ করার জন্য উৎসাহিত করে অথবা নির্দিষ্ট কিছু করার ইচ্ছা জাগায়।
অনুপ্রেরণা বা মোটিভেশন এর ধরন:
প্রয়োজন, বিশ্বাস, আদর্শ, দেখা, শোনা,পড়া, ভালোবাসা, ঘৃণা, হিংসা, লোভ, রাগ, আনন্দ, দু:খ, স্বপ্ন – এসবই মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস।
বিশ্বাস, ভালোবাসা, আনন্দ, স্বপ্ন – ইত্যাদি মানুষকে ভালো কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে। তাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে।
অন্যদিকে রাগ, ঘৃণা, হিংসা – এগুলোর ফলে মানুষ বেশিরভাগ সময়ে ধ্বংসাত্মক ও খারাপ কাজ করে। যা তাদের জীবনকে আরও বেশি খারাপ অবস্থার দিকে নিয়ে যায়।
আবার, কিছু অনুপ্রেরণার উৎস – যেমন, প্রয়োজন, দেখা, শোনা, পড়া – এগুলোর ফলে মানুষ ভালো কাজও করতে পারে আবার খারাপ কাজও করতে পারে।
একজন মানুষের যদি অনেক টাকার প্রয়োজন হয়, তবে সে সেই টাকা রোজগারের জন্য আরও বেশি পরিশ্রম করা শুরু করতে পারে। বিকল্প আয়ের চিন্তা করতে পারে। আবার হয়তো সে চুরি, ছিনতাই, ঘুষ এর আশ্রয়ও নিতে পারে।
জন্মগত অনুপ্রেরণা ও পরিবেশগত অনুপ্রেরণা:
মানুষের মাঝে জন্মগত ভাবেই কিছু অনুপ্রেরণা রয়েছে, যেগুলো মানুষকে বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে উৎসাহিত করে, আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাধ্য করে।
মোটিভেশন এর ‘নিড থিওরি’ এর প্রবর্তক বিশ্ববিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ডেভিড ম্যাক্কেল্যান্ড বলেছেন যে, কিছু মোটিভেশন আমাদের ডি এন এ তে কোড করা আছে।
লেখার শুরুতে ক্ষুধার কথা বলেছিলাম। এটা এমন একটি মোটিভেশন বা অনুপ্রেরণা যা প্রতিটি প্রাণীরই আছে। ক্ষুধা যদি না থাকতো তবে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই কোনও কাজ না করে জীবন পার করে দিত। ক্ষুধার মত সন্তানের প্রতি বা রক্তের সম্পর্কের মানুষের প্রতি ভালোবাসা আমাদের মাঝে জন্ম থেকেই আছে। পৃথিবীতে এমন বাবা-মা খুব কম পাওয়া যাবে যাঁরা তাঁদের সন্তানের জন্য বিনা দ্বিধায় নিজের প্রাণ দেবেন না।

আবার কিছু অনুপ্রেরণা আছে, যা পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রভাবে মানুষের মানসিকতার অংশ হয়ে যায়। ক্ষুধা জন্মগত অনুপ্রেরণা, কিন্তু বিশেষ খাবার খাওয়ার ইচ্ছা পরিবেশ থেকে শেখা অনুপ্রেরণা।
ডেভিড ম্যাক্কেল্যান্ড তাঁর ‘দি এ্যাচিভিং সোসাইটি (১৯৬১)’ বইয়ে লিখেছেন যে, অনুপ্রেরণার মাধ্যমে মানুষকে কিছু করা বা কিছু না করা শেখানো সম্ভব।
একজন মানুষকে মোটিভেশন দিয়ে তার মাঝে বড় কিছু করার ইচ্ছা জন্মানো সম্ভব, যাতে করে সে বড় কিছু অর্জন করার জন্য কাজ করে।
ভি.এইচ.ভ্রুম ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত বই “ওয়ার্ক এ্যান্ড মোটিভেশন” এ দেখিয়েছেন, বিশেষ পর্যায়ের পারফরমেন্সের জন্য বিশেষ ধরনের পুরস্কার বা মোটিভেশনের প্রয়োজন হয়।
একজন মানুষ বা কর্মী ততটুকুই কাজ করবে, যতটুকু করার জন্য তাকে অনুপ্রেরণা দেয়া হবে। সঠিক মোটিভেশনের মাধ্যমে অনেক মানুষকে দিয়েই অনেক কিছু করিয়ে নেয়া যায় – যা আগে তাকে দিয়ে কল্পনাও করা যায়নি। সঠিক পরিবেশ সৃষ্টি করলে সেটা মানুষের কাজের মান পরিবর্তন করার মোটিভেশন হিসেবে কাজ করে।
জন্মগত ভাবে একজন অলস মানুষকে যদি এমন একটি টাকার পরিমান দেখানো হয়, যা আয় করার কথা সে কল্পনাও করেনি (ধরুন, মাসে ১০ হাজার টাকায় আয় করা একজনকে ১ কোটি টাকা দেখানো হল) – এবং যদি বিশ্বাসযোগ্য বলা হয় টানা এক বছর দিনে ১০ ঘন্টার বদলে ৫ ঘন্টা ঘুমিয়ে বাকি সময় কাজ করলে এই টাকাটা তার হয়ে যাবে – তাহলে ৯০% এর বেশি ক্ষেত্রে সেই লোক ৪ ঘন্টা করে ঘুমানো শুরু করবে।
অনুপ্রেরণা বা মোটিভেশন প্রয়োজন কেন?
অন্যকে দিয়ে কাজ করানোর পাশাপাশি সঠিক মোটিভেশনের মাধ্যমে একজন মানুষ নিজের জীবনের মোড়ও ঘুরিয়ে ফেলতে পারে। সঠিক মোটিভেশন পেলে একজন পেছনের সারির ছাত্র হয়ে উঠতে পারে সেরা ফলাফল করা ছাত্র। একজন লো পারফর্মিং কর্মী হয়ে উঠতে পারে বছরের সেরা পারফর্মার বা কোম্পানীর ইতিহাসের সেরা পারফর্মার।
আসলে যে কোনও কাজের জন্যই মোটিভেশন প্রয়োজন। আর জীবনে বড় কিছু করার জন্য এর কোনও বিকল্প নেই।
আজ পর্যন্ত যারাই বড় কিছু করে দেখিয়েছেন, অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন, তার পেছনে অনুপ্রেরণার অনেক বড় একটি ভূমিকা ছিল।
আলিবাবা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা –একদম শূন্য অবস্থা থেকে, ব্যর্থতায় জর্জরিত অবস্থা থেকে আজ বিশ্বের অন্যতম সেরা ধনী ও বিখ্যাত মানুষ হতে পেরেছেন – এর পেছনে অন্যতম কারণ, সব ব্যর্থতার পরও তাঁর লক্ষ্য ছিল একদিন না একদিন তিনি বড় হবেন। এই লক্ষ্যই তাঁর অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
আজ জ্যাক মা নিজেই এক অনুপ্রেরণা। তাঁকে দেখে অনেকেই খারাপ অবস্থা কাটিয়ে উঠে বড় কিছু করার অনুপ্রেরণা পান। বহুবার ব্যর্থ হয়েও কাজ করে যান বড় হওয়ার লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে। যে লক্ষ্য তাদের কাজ করে যাওয়ার অনুপ্রেরণা নেয়।

এমন ডাক্তারের গল্প হয়তো আপনিও শুনেছেন, অথবা ব্যক্তিগত ভাবেই এমন ডাক্তারকে চেনেন – যিনি নিজের কোনও কাছের মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার কারণে ডাক্তার হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেন। এবং ডাক্তার হয়ে বহু মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেন।
সেই কাছের মানুষটির বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়াটা সেই ডাক্তারের জন্য একটি শক্তিশালী অনুপ্রেরণা বা মোটিভেশন ছিল। এতটাই শক্তিশালী যে বিপুল পরিমান টাকা রোজগারের সুযোগ না নিয়ে একজন মানুষ বিনা পয়সায় সেই কাজ করে যায়।
রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড বই হয়তো অনেকেই পড়েছেন। রবার্ট কিওসাকির এই সেলফ ডেভেলপমেন্ট মাস্টারপিসটিতে তিনি মাঝে মাঝে দুইজন মানুষের মাঝে তুলনা করেছেন। একজন তাঁর সন্তানকে বলেন, “তোমার জন্য আমাকে ধনী হতে হবে। তুমি আছ বলেই আমি ধনী হতে চাই”। আর অন্যজন, মানে পুওর ড্যাড বলেন, “তোমার জন্য আমি ধনী হতে পারলাম না”।
রিচ ড্যাড একজন বিলিওনেয়ার হিসেবে মারা যান, আর পুওর ড্যাড জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত টাকার চিন্তা করেছিলেন।
নিজের সন্তানকে অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখেছিলেন বলেই তিনি ধনী হতে পেরেছিলেন।
দুই জনের অবস্থা একটা সময়ে এক থাকলেও শুধুমাত্র অনুপ্রেরণা ও লক্ষ্যের জোরে একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে যান।
বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসনের জীবনী থেকে জানা যায়, তাঁর স্কুল জীবন ছিল মাত্র ১২ সপ্তাহের।
তিনি পড়াশুনায় এতই খারাপ ও অমনোযোগী ছিলেন যে তাঁকে স্কুল থেকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সাথে দেয়া হয় খামে ভরা একটি চিঠি। চিঠির ভাষ্য ছিল, “আপনার ছেলে একদমই মেধাহীন। এমন মেধাহীন আর অমনোযোগী ছেলের আমাদের স্কুলে পড়ার যোগ্যতা নেই”। চিঠি পড়ে টমাসের মায়ের চোখে পানি এসে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি সামলে নিয়ে ছেলেকে পড়ে শোনান, “আপনার ছেলে অতিরিক্ত মেধাবী। এত বেশি মেধাবী ছেলেকে পড়ানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। তাকে বাড়িতে পড়াশুনা করালেই ভালো হবে”
[টমাস আলভা এডিসন]
এটা শোনার পর টমাস সামনে যা পান, তাই পড়া শুরু করেন। মায়ের এই ছোট্ট মিথ্যা তাঁর মাঝে এমন অনুপ্রেরণা এনে দেয় যে, তাঁর মনে হত, তিনি বুঝবেন না বা পারবেন না – পৃথিবীতে এমন কঠিন কোনও বিষয় নেই। এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন সর্বকালের সেরা একজন মেধাবী বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক।
এরপর অনেক বছর কেটে যায়, টমাস ততদিনে ধনী আর বিখ্যাত বিজ্ঞানী হয়ে গেছেন। মায়ের মৃত্যুর পর পুরাতন সেই চিঠিটি তিনি খুঁজে পান। তারপর কাঁদতে কাঁদতে নিজের ডায়েরীতে লেখেন, “টমাস আলভা এডিসন, এক মেধাহীন শিশু; একজন অসাধারণ মায়ের অনুপ্রেরণায় যিনি যুগের সেরা মেধাবী হয়ে ওঠেন”
অনুপ্রেরণা এতটাই শক্তিশালী।
অনুপ্রেরণা ভীতু মানুষকে সাহসী করে তোলে। একজন আত্মবিশ্বাসহীন মানুষকে বিশ্ব জয়ের আত্মবিশ্বাস এনে দেয়।
সঠিক অনুপ্রেরণা ব্যবহার করে অন্যকে দিয়ে যেমন আপনি ভালো কাজ করাতে পারবেন। তেমনি নিজেও নিজেকে বহুগুণে ছাড়িয়ে যেতে পারবেন।
পরিশিষ্ট:
অনুপ্রেরণা কি বা মোটিভেশন কি – এটি আসলে একটি জটিল মনস্তাত্বিক প্রশ্ন। এবং বেশিরভাগ জায়গাতেই জটিল বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত দিয়ে ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
আমরা চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব সহজ ভাষায় অনুপ্রেরণা বা মোটিভেশন কি – তা আপনার সামনে তুলে ধরতে।
আমরা কতটা সফল ভাবে বিষয়টি আপনার সামনে তুলে ধরতে পেরেছি – তা আমাদের কমেন্ট করে জানান। আপনার কোনও মতামত বা তথ্য থাকলেও কমেন্টে লিখুন – তাতে এই লেখাটি আরও সমৃদ্ধ হবে।
আর আপনি যদি এই ধরনের লেখা লিখতে পারেন, বা মোটিভেশন অথবা আত্ম উন্নয়ন বিষয়ে কিছু জানা থাকে – তবে আপনিও প্রবন্ধ আকারে লিখে write@test.edaning.com – এ মেইল করতে পারেন। আমরা যত্ম সহকারে আপনার নাম সহ লেখাটি প্রকাশ করব।
যদি মনে হয় এই লেখাটি পড়ে অন্যরাও উপকৃত হবেন – তবে শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন।
এই ধরনের আরও লেখার জন্য নিয়মিত আমাদের সাইট ভিজিট করুন এবং আমাদের ফেসবুক গ্রুপ ও পেজে এ্যাকটিভ থাকুন।
সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার সাথে আছে।
KMS Pico borderlands crack
Photoshop Crackeado Gratis
Snaptube App Video editing solution
crackedo
gratis
Ativador Windows 8, 8.1
kinemaster app download for pc