এক নজরে লেখাটির বিষয়ে:
আমাদের অনেকেরই ধারনা যে মস্তিষ্কের ক্ষমতা আর স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য বিশেষ কিছু কাজ নিয়মিত করা এবং বিশেষ খাদ্যাভ্যাস জরুরী। হ্যাঁ – কিছু কিছু ক্ষেত্রে কথাটি সত্য। কিন্তু আপনি যদি আপনার দৈনন্দিন কাজগুলোর ধরন ও সময় একটু এদিক ওদিক করে নিতে পারেন- তাহলেও কিন্তু দারুন ভাবে আপনার মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব। এই লেখায় আমরা তেমন কিছু কাজের কথা জানবো।
আজকাল ইন্টারনেট ঘাঁটলেই স্মৃতিশক্তি আর মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়ানোর অনেক উপায় পাওয়া যায়। কিন্তু এর বেশিরভাগ চর্চা করার জন্য একটু বাড়তি সময় আর চেষ্টার প্রয়োজন পড়ে। আর এই কারনে ইচ্ছা থাকা সত্বেও অনেকের এই কাজটি করা হয়ে ওঠে না। কারন, বর্তমান সময়ে আসলে একটু বাড়তি সময় পাওয়াটা যথেষ্ঠ কঠিন। কিন্তু আপনি চাইলে আপনার দৈনন্দিন কাজগুলো একটু অন্যভাবে করে, বা কাজের মাঝের অবসর সময়টিতে সোশ্যাল মিডিয়া বা ইউটিউবে সময় নষ্ট না করে অল্প একটু গঠনমূলক চর্চা আপনার মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা আর স্মৃতিশক্তির আশ্চর্যরকমের উন্নতি করতে পারে। এই চর্চাগুলো কিছুদিন করলেই আপনি আপনার মনের পরিবর্তন দেখে নিজেই আশ্চর্য হয়ে যেতে পারেন।
চলুন জেনে নেয়া যাক এমনই ৯টি অতি সাধারন কাজ।
০১. এ্যাকটিভ হাতের বদলে অন্য হাত দিয়ে দাঁত ব্রাশ করুন (সকাল ৬টা)
কিছু কাজ আমরা নিয়মিত একই ভাবে করে থাকি। আমাদের প্রতিটি অভ্যাস আসলে আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলোর মাঝে এক একটি সংযোগ পথ। আমরা যখনই নতুন কোনও অভ্যাস করি, তখন আমাদের মস্তিষ্কে নতুন নতুন সংযোগ পথ সৃষ্টি হয় – যার ফলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বেড়ে যায়।
এই কাজটি আপনি প্রতিদিন সকালে খুব সহজেই করতে পারেন। আর সেটি করার জন্য আপনার বাড়তি কিছুর প্রয়োজন নেই। আপনি যদি ডান হাতি হন, তবে বাঁ হাত দিয়ে ব্রাশ করুন, আর বাঁ হাত দিয়ে ব্রাশ করার অভ্যাস থাকলে, ডান হাত দিয়ে করুন। এতে আপনার মস্তিষ্কে নতুন সংযোগ পথ এর সৃষ্টি হবে, যার ফলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বেড়ে যাবে।
০২. যোগ ব্যায়ামের ‘বুকডন’ “downward dog” অনুশীলন করুন (সকাল ৭/৮টা)
আমাদের অনেকেরই সকাল বেলা হাল্কা হাঁটাহাঁটি বা শরীরচর্চার অভ্যাস রয়েছে। এই অভ্যাসের মাঝে যদি একটি অতি সহজ যোগ ব্যায়ামের আসন অনুশীলন করতে পারেন, তবে তা আপনার শরীরের পাশাপাশি আপনার মস্তিষ্ককে সতেজ করবে এবং আপনার স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করবে।
যোগ ব্যাযামের একটি বিশেষ আসন, downward dog – কুকুর বা বিড়ালের আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গি থেকে এর উৎপত্তি। ব্যাপারটি শুনতে একটু খারাপ লাগলেও, এর উপকারিতা দারুন। প্রথম প্রথম হয়তো এটি করতে একটু কষ্ট হবে, কিন্তু ধীরে ধীরে ব্যায়ামটি রপ্ত হয়ে গেলে আর কষ্ট হবে না। এই ব্যায়ামটি আপনার মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলকে সাবলীল করার পাশাপাশি আপনার ফোকাসকে দারুন ভাবে বাড়িয়ে দেবে।
০৩. ঘড়ি হাত বদল করুন (সকাল ১০টা)
ইদানিং মোবাইল ফোনের কল্যানে ঘড়ি পরার চল প্রায় উঠেই গেছে। কিন্তু আপনি যদি এই অভ্যাসটি আবার করেন, তাহলে তা আপনার জন্য দু’টি কাজ করবে। এক, সময় দেখার জন্য বারবার পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করতে হবে না; দুই আপনার মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়বে।
আমরা সাধারনত বাঁ হাতে ঘড়ি পরি, আবার কেউ কেউ ডান হাতেও পরে থাকেন। এটা এমন একটি অভ্যাস, যা সময় দেখার প্রয়োজন হলে নিজের অজান্তেই আপনার নিয়মিত ঘড়ি পরা হাতটিকে চোখের সামনে নিয়ে আসে।
এখন যদি আপনি দিনের মধ্যে কয়েকবার ঘড়িটিকে হাত বদলে পরেন, তাহলে সকালে বাঁ হাত দিয়ে ব্রাশ করার মতই উপকার পাবেন। মস্তিষ্কে সৃষ্টি হবে নতুন সংযোগ পথ। কিন্তু ব্রাশ যেমন একবার করেন, এটা কিন্তু একাধিক বার করতে পারবেন। এক হাতে কয়েক ঘন্টা রাখুন, সেই হাতে একটু অভ্যস্ত হয়ে গেলে হাত বদলে ফেলুন। সকাল দশটা থেকে এটি শুরু করতে পারেন। এতে করে আপনার মস্তিষ্ককে আপনার ধারনার থেকে বেশি খাটতে হবে। বারবার হাত বদলের কারনে মস্তিষ্কে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সংযোগের সৃষ্টি হবে – যা আপনার মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে থাকবে।
০৪. মিনিট দশেক একটি পাজ্ল গেম খেলুন (দুপুর ১২টা)
লজিক ধারালা করার জন্য পাজ্ল গেম দারুন একটি উপায়। কাজের মাঝে বা পড়াশুনার ফাঁকে আমরা সোশ্যাল মিডিয়া চেক করেই থাকি, অথবা দশ-পনেরো মিনিট একটু বিশ্রাম নিয়ে থাকি। এই সময়টাতে আপনার ফোনে একটি পাজ্ল গেম ডাউনলোড করে কিছুক্ষণ খেলতে পারেন।
এতে যেমন কাজের মাঝে আপনার মস্তিষ্কের গতি বৃদ্ধি পাবে, সেই সাথে আপনার বোঝার ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাও বেড়ে যাবে। এটি কিছুদিন প্রাকটিস করলেই আপনার চিন্তার দ্রুততা দেখে আপনি নিজেই অবাক হয়ে যাবেন।
০৫. কফি পান করুন (দুপুর ২.৩০)
আমাদের দেশে দুপুরের খাবারের বিরতি সাধারনত দুপুর ২টার দিকে হয়ে থাকে। দুপুরের খাবারের পর অনেকেরই চা-সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে। এই অভ্যাসের কিছুটা পরিবর্তন এনে, দুপুরের খাবারের কিছু পরে যদি আপনি এক কাপ কফি খেতে পারেন, তাহলে তা আপনার মস্তিষ্কের জন্য অনেক ভাল হবে।
এই সময়ের আগে আমরা সারাদিনের কাজে ও পড়াশুনায় অনেক নতুন বিষয় ও তথ্য মাথায় নিয়ে থাকি। এক গবেষণায় দেখা গেছে যাঁরা নতুন কিছু জানার পর ২০০ মিলিগ্রামের মত ক্যাফেইন সেবন করেন, তাঁরা সেইসব বিষয় অন্যের চেয়ে দ্রুত মনে করতে পারেন। তবে অতিরিক্ত ক্যাফেইন শরীর ও মস্তিষ্কের জন্য খারাপ হতে পারে। তাই অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ থেকে বিরত থাকাই ভাল।
০৬. নতুন একটি ভাষা শেখায় সময় দিন (বিকাল ৪/৫টা)
অফিস বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটির পর ফেরার পথে বা সেখানে বসেই পনেরো বিশ মিনিট আপনার মোবাইলে বা একটি বই থেকে একটি নতুন ভাষা চর্চা করতে পারেন। নতুন ভাষা বলতে যে আপনাকে ফ্রেঞ্চ বা জার্মান বা এই ধরনের কোনও ভাষা শিখতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। আপনি চাইলে আপনার ইংরেজীকেও ঝালিয়ে নিতে পারেন। ভাষা শেখার বহু ফ্রি এ্যাপ আপনি গুগল প্লেতে সার্চ করলেই পাবেন। এছাড়া এমন অনেক ভাল ভাল বইও বাজারে পাওয়া যায়।
ভাবছেন এতে করে আপনার কি লাভ হবে? – আপনার মস্তিষ্কে নতুন নতুন শব্দভান্ডার ও ভাষাশৈলী যোগ হওয়ার ফলে প্রতিদিন নতুন কিছু শিখতে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। প্রতিদিন যদি আপনি একটি শব্দও শেখার চেষ্টা করেন – তাতেও এই কাজ হবে। এই অনুশীলন চালু রাখলে বয়সের সাথে সাথে আপনার মস্তিষ্ক দুর্বল হওয়ার বদলে, আপনার মনে রাখার ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, পরিকল্পনার দক্ষতা সহ মস্তিষ্কের অন্য সব ক্ষমতাই বাড়তে থাকবে।
০৭. মাছ, সামুদ্রিক মাছ, শাকসব্জী সমৃদ্ধ রাতের খাবার খান (সন্ধ্যা ৭টা)
যদিও আমরা সাধারনত নয়টা বা দশটার দিকে রাতের খাবার খাই, এই সময়টা একটু এগিয়ে এনে আপনি আপনার মস্তিষ্কের চরম উপকার করতে পারেন। রাতে আমাদের শারীরিক নড়াচড়া ও পরিশ্রম কম হয় বলে খাবার হজম হতেও সময় বেশি নেয়। আর ঘুমানোর আগে যদি আপনার খাবার হজম না হয়, সেক্ষেত্রে আপনার ঘুমও গভীর হবে না। এতে আপনার মস্তিষ্ক পূর্ণ বিশ্রাম পাবে না এবং পরদিন সে শতভাগ পারফর্মেন্স দিতেও পারবে না। তাই সন্ধ্যার পরপরই রাতের খাবার খেয়ে নেয়াটা আপনার মস্তিষ্কের জন্য ভাল হবে।
আরও একটি বিষয়। আমরা অনেকেই শুনেছি যে রাতের বেলা ভারী খাবার খেলে হজমে সমস্যা, চর্বি বেড়ে যাওয়া – ইত্যাদি হতে পারে। এবং তা হয়েও থাকে। কিন্তু এর বাইরেও আপনি যদি আপনার মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়াতে চান, তবে রাতের খাবারের তালিকা থেকে মাংস ও চর্বি জাতীয় খাবার বাদ দিয়ে মাছ ও শাকসব্জী রাখুন। মাছ – বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছের আয়োডিন মস্তিষ্কের জন্য খুবই ভাল। বিশেষজ্ঞরা বলে, সপ্তাহে অন্তত দুইদিন সামুদ্রিক মাছ দিয়ে রাতের খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন।
০৮. পড়াশুনা বা কোর্স করুন (রাত ৮টা)
রাতের খাবারের পর আমরা বেশিরভাগ সময়ই একটু টিভি দেখি, কম্পিউটারে গেম খেলি, সিনেমা দেখি – বা এই ধরনের অন্য কোনও কাজ করে থাকি। আপনি যদি এই সময়টা আপনার মস্তিষ্কের ক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর কাজে লাগাতে চান, তবে বই পড়ুন অথবা কোনও অনলাইন কোর্স করুন। চাইলে একটু গীটার শেখা, বা সৃষ্টিশীল কোনও কাজও করতে পারেন। চাইলে আপনার আগ্রহের কোনও বিষয়ের ওপর লেকচারও শুনতে পারেন। এতে করে দিনের শেষেও আপনার মস্তিষ্কে কিছু নতুন তথ্য ঢুকবে। প্রতিদিন না হোক – সপ্তাহে অন্তত তিন-চার দিন আপনি এটা করতে পারেন।
গবেষণায় দেখা গেছে যারা পরিনত বয়সে বা কর্ম জীবনে নতুন কিছু শেখে তাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা অন্যদের তুলনায় বেশ কিছুটা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ছোটবড় মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও অনেকটা কমে যায়।
০৯. তাড়াতাড়ি বিছানায় যান (রাত ১০টা)
এটা শুনে হয়তো অনেকের কাছেই অসম্ভব একটি বিষয় মনে হবে। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন রাত দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত আপনি তেমন জরুরী কিছু করেন কি-না?
মস্তিষ্ককে পূর্ণ মাত্রায় কাজ করতে হলে গভীর ঘুমের কোনও বিকল্প নেই। সকালে ওঠাটা যেমন জরুরী, তেমনি রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোটাও জরুরী। প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দিনে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা গভীর ঘুমের প্রয়োজন। আপনি যদি রাত ১০টায় বিছানায় যান, তবে খুব বেশি হলে আপনার ঘুমাতে ১১টা বাজবে, এবং এর ফলে আপনি অন্তত ৭ ঘন্টার ঘুমের পর সকাল ৬টার মধ্যে জাগতে পারবেন।
ঘুম ঠিকমত না হলে আপনার আগের দিনের স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কে ঠিকভাবে জায়গা করে নিতে পারে না। সেইসাথে নতুন স্মৃতিগুলোও ঠিকভাবে মনে থাকে না। তাই ঘুমানোর সময়টা দুই-এক ঘন্টা এগিয়ে আনাটা আপনার মস্তিষ্ক ও স্মৃতিশক্তির জন্য খুবই উপকারী হবে।
পরিশিষ্ট:
এই পদ্ধতিগুলোর সবগুলো হয়তো আপনি কাজে লাগাতে পারবেন না। তবে এর প্রতিটিই পরিক্ষিত। আপনার সুবিধামত আপনি যে কোনও একটি বা একটির বেশি পদ্ধতি বেছে নিতে পারেন। আশা করি টিপসগুলো আপনার কাজে লাগবে, এবং বর্তমান অবস্থা থেকে আপনার মস্তিষ্ক ও স্মৃতিশক্তি আরও ভাল পর্যায়ে উন্নীত হবে।
লেখাটি কেমন লাগলো, তা আমাদের কমেন্ট করে জানান। এর বাইরে যদি কোনও পদ্ধতির কথা আপনার জানা থাকে, সেটিও আমাদের জানান। আপনার প্রতিটি মতামতই আমাদের কাছে মূল্যবান। আর যদি মনে হয় লেখাটি সত্যিই অন্যদের কাজে লাগবে, তবে শেয়ার করার মাধ্যমে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন। আমাদের সাথে থাকুন, সাফল্যের পথে প্রতিটি পদক্ষেপে লড়াকু আপনার সাথে আছে।