ইলন মাস্কের জীবনী: একজন আর্দশ সফল উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক


ইলন মাস্কের জীবনী শুরু করার আগে আসুন তাঁর সম্পর্কে এক নজরে কিছু জানি:

প্রযুক্তি ও ব্যবসার খোঁজ খবর রাখনে অথচ ইলন মাস্কের নামের সাথে পরচিত নন – এমন মানুষ বোধহয় একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। দুই হাজার কোটি ডলারের বেশি সম্পদের মালিক বলিয়িনয়োর ব্যবসায়ী, যাকে নউি ইর্য়ক টাইমস  “ধাতব স্যুটবহিীন আয়রনম্যান ” বলে ঘোষণা করছে সেই ইলন মাস্ক এর কথাই বলা হচ্ছ। আজ আমরা জানবো এই বিলিয়নেয়ার জিনিয়াসের জীবনীর পরতে পরতে থাকা সাফল্য, ব্যর্থতা ও স্বপ্নের কাহিনী।


বর্তমান বিশ্বের অনেক তরুণ উদ্যোক্তাই স্বপ্ন দেখে ইলন মাস্ক হয়ে ওঠার। তাঁকে আদর্শ মেনে অনেকেই উন্নতির পথে এগিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখছে। আর তিনিও এমন একজন মানুষ যিনি স্বপ দেখতে, স্বপ্নকে বাস্তবে পরিনত করতে, ও দেখাতে ও দারুন ভালবাসেন। তিনি এমন একজন মানুষ যিনি অনলাইনে লেনদেনকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসার সূত্রপাত করের্ছিলেন। আজকের বিশ্ববিখ্যাত পে-পাল, স্পেস এক্স, টেসলা তাঁরই অবদান। চলুন আজ আমরা ঘুরে আসি এই অসাধারন সফল মানুষটির সাফল্যের পথ ধরে।

ইলন মাস্কের জীবনী:

দক্ষিন আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায় জন্ম নেয়া মার্কিন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী ইলন মাস্ক এর পুরো নাম ইলন ‘রীভ’ মাস্ক। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৮শে জুন। ১৯৯৯ সালে এক্স ডট কম নামে তাঁর প্রতিষ্ঠিত অনলাইন ভিত্তিক অর্থ লেনদেনের মাধ্যমটিই বর্তমানে সারাবিশ্বে তুমুল জনপ্রিয় পে-পাল। ২০০২ সালে তিনি স্পেস এক্স ও ২০০৩ সালে টেসলা মোটরস প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০২ সালে তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করেন। মাস্ক তাঁর জীবনের দ্বিতীয় দশকের শেষ দিকে কমপ্যাক্ট কম্পিউটার্সের একটি শাখার কাছে তাঁর প্রথম কোম্পানী “জিপ টু” বিক্রি করে প্রথমবারের মত মাল্টিমিলিয়নেয়ারের খাতায় নাম লেখান। ২০১২ সালের মে মাসে তিনি শিরোনামে উঠে আসেন যখন তাঁর কোম্পানী স্পেস এক্স প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে অর্থের বিনিময়ে ভ্রমনেচ্ছুক যাত্রী প্রেরণ করে। ২০১৬ সালে সোলার সিটি কিনে নেয়ার মধ্যদিয়ে তিনি তাঁর অর্জনের পাল্লা আরও ভারী করেন এবং ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম দিকে একজন উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করার মাধ্যমে ব্যবসায়িক জগতের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান পাকা করেন।

মোট সম্পদ:

ফোর্বস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হওয়া ডিসেম্বর ২০১৭ সালের হিসেব অনুযায়ী মাস্কের মোট সম্পদের পরিমান ২০.২ বিলিয়ন (২২০০ কোটি) মার্কিন ডলার। ২০০২ সালে পে পাল বিক্রি করার মধ্য দিয়ে তিনি প্রথমবারের মত বিলিয়ন ডলার আয় করেন। তাঁর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্স এর মোট সম্পদের পরিমান তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদের থেকেও বেশি।

শিক্ষা:

১৯৮৯ সালে সতের বছর বয়সে মাস্ক কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি এবং বাধ্যতামূলক সামরিক দায়িত্ব এড়ানোর জন্য দক্ষিন আফ্রিকা থেকে কানাডায় পাড়ি জমান।

১৯৯২ সালে কানাডা ত্যাগ করে আমেরিকায় পাড়ি জমান পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসা ও পদার্থ বিজ্ঞান অধ্যয়ন করার উদ্দেশ্যে। তিনি অর্থনীতিতে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করার পর পদার্থ বিজ্ঞানে আরেকটি ব্যাচেলর অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যায়ে থেকে যান।

পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে জ্বালানী পদার্থ বিদ্যায় পিএইচডি করার উদ্দেশ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেই সময়েই ইন্টারনেট বিপ্লবের সূচনা হয় এবং এই বিপ্লবের অংশ হওয়ার জন্য মাস্ক মাত্র দুইদিন পিএইচডি প্রোগ্রামে কাজ করার পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় বের হয়ে যান।

তারপর তিনি তাঁর প্রথম কোম্পানী “জিপ টু” প্রতিষ্ঠা করেন। জিপ টু আসলে ছিল একটি অনলাইন সিটি গাইড সফটঅয়্যার।

প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নিউ ইয়র্ক টাইমস ও শিকাগো ট্রিবিউনের মত দু’টি প্রকাশনার কাছে তারা তথ্য বিক্রি করা শুরু করেন। ১৯৯৯ সালে কমপ্যাক কম্পিউটার্স ৩০৭ মিলিয়ন ডলার নগদ ও ৩৪ মিলিয়ন ডলারের স্টকের বিনিময়ে জিপ টু কিনে নেয়।

ইলন মাস্ক ও পে-পাল:

১৯৯৯ সালে মাস্ক তাঁর ভাইয়ের সাথে মিলে অনলাইন আর্থিক লেনদেন সেবাদাতা সাইট এক্স ডট কম সহপ্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী বছর নতুন কিছু বিষয় যোগ হওয়ার মাধ্যমে এক্স ডট কম আজকের পে-পালে পরিনত হয়। ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে ১.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের স্টকের মাধ্যমে ইবে পে পালকে কিনে নেয়। বিক্রয়ের সময়ে মাস্ক পে পালের ১১ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিলেন। যার ফলে মাস্ক একজন মাল্টিমিলিয়নিয়ারে পরিনত হন।

ইলন মাস্ক এর জীবনী
[কাজের ফাঁকে তরুণ ইলন মাস্ক]

স্পেস এক্স প্রতিষ্ঠা:

২০০২ সালে মাস্ক বানিজ্যিক মহাকাশ ভ্রমণ সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে মহাকাশযান তৈরী করার জন্য স্পেস এক্স কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রকেটের সম্পর্কে এর আগে তেমন কিছু জানতেন না। কিন্তু অল্পকিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজেকে রীতিমত একজন রকেট বিজ্ঞানীতে পরিনত করেন। তিনি এটা কিভাবে সম্ভব করলেন জানতে চাইলে তাঁর উত্তর ছিল “আমি (এই বিষয়ে) অনেকগুলো বই পড়েছি।” ২০০৮ সালের ভেতরেই স্পেস এক্স একটি সুপ্রতিষ্ঠিত মহাকাশযান প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয় এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে মালামাল পৌঁছানোর চুক্তি স্বাক্ষর করে – যার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় নাসার নিজস্ব মহাকাশযানের বদলে স্পেস এক্স এর যানে মহাকাশচারী আনা নেয়ার বিষয়ও ছিল!

ফ্যালকন ৯ রকেট:

২০১২ সালের ২২শে মে মাস্ক এবং তাঁর কোম্পানী একটি নামহীন ক্যাপসুল সহ ফ্যালকন ৯ রকেট উড্ডয়ন করে। মহাকাশযানটিতে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে অবস্থানরত মহাকাশচারীদের জন্য ১০০০ পাউন্ড ওজনের রসদ ছিল। কোনও প্রাইভেট কোম্পানীর নির্মিত মহাকাশযানের আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে এটিই প্রথম যাত্রা। শোনা যায় এই উড্ডয়নের ব্যাপারে মাস্ক বলেছিলেন – “আমাদের এই অর্জনের জন্য আমি নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করছি। মনে হচ্ছে যেন আমরা সুপার বোউল জিতে নিয়েছি।”

২০১৩ সালের ডিসেম্বরে স্পেস এক্স আরও একটি মাইলফলক অতিক্রম করে ফ্যালকন ৯ এর মাধ্যমে একটি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠিয়ে। স্যাটেলাইটটি এতটা দূরত্বে পাঠানো হয় যাতে করে পৃথিবীর নিজের কক্ষপথ ও গতিকে অনুসরন করে চলতে পারে।

Falcon 9
[Falcon 9 রকেট]
২০১৫ সালের ফ্রেবুয়ারীতে স্পেস এক্স আরও একটি ফ্যালকন ৯ রকেট উড্ডয়ন করে যেটি মহাশূন্যের দূরতম স্থান পরিভ্রমণ করতে সক্ষম একটি স্যাটেলাইট (উঝঈঙঠজ) বহন করছিল। স্যাটালাইটটির উদ্দেশ্য ছিল সূর্যের উচ্চমাত্রার বিকীরণ যা পৃথিবীতে অবস্থিত মহাশক্তি কেন্দ্র ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে – তা  পর্যবেক্ষণ করা।

২০১৭ এর মার্চে স্পেস এক্স এর অর্জনের খাতায় আরও একটি যুগান্তকারী সাফল্য যোগ হয়। পূর্বে ব্যবহৃত রকেটের যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরী একটি ফ্যালকন ৯ রকেটের উড্ডয়ন পরীক্ষা সফল ভাবে স¤পন্ন হয় – যা মহাশূন্য যাত্রার জগতে একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত করে। এই সফল পরীক্ষার ফলে ভবিষ্যতে মহাশূন্য ভ্রমণ অনেক  কম খরচে সম্পন্ন হবে।

তবে ২০১৭ এর নভেম্বরে মাস্ক এবং তাঁর কোম্পানীকে বেশ বিপাকে পড়তে হয়েছিল। কোম্পানীর উদ্ভাবিত নতুন “ব্লক ৫ মারলিন” ইঞ্জিন এর পরীক্ষার সময়ে ইঞ্জিনটি বিস্ফোরিত হয়। স্পেস এক্স জানায় যে এতে কোনও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি এবং তাদের ফ্যালকন ৯ রকেটের পরবর্তী প্রজন্মের প্রকল্পগুলোতে এর কোনও বিরূপ প্রভাব পড়বে না।

টেসলার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক:

বিশ্ববিখ্যাত টেসলা মোটরস এর কথা প্রত্যেক গাড়ি প্রেমীরই জানা আছে। এই অত্যাধুনিক গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটির সহ উদ্যোক্তা, প্রধান নির্বাহী ও প্রধান পন্য পরিকল্পনাকারী হলেন ইলন মাস্ক। কোম্পানীটি শুধুমাত্র সাধারনের ক্রয়সীমায় সেরা গাড়িগুলোই বানায় না, এর সাথে সাধারন ব্যবহার্য ইলেক্ট্রনিক্স, ব্যাটারী এবং সোলার রুফও প্রস্তুত করে।

ইলন মাস্কের জীবনী

প্রতিটি পন্যের আইডিয়া সৃষ্টির থেকে শুরু করে ডিজাইন, প্রকৌশল ইত্যাদি সবই মাস্ক নিজে তত্বাবধান করেন। প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় টেসলা বিশ্বের সেরা একটি স্পোর্টস কার “রোডস্টার” বাজারে নিয়ে আসে। মাত্র ৩.৭ সেকেন্ডের মধ্যেই রোডস্টার ০ থেকে এর গতিবেগ ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটারে নিয়ে যেতে সক্ষম। এছাড়াও গাড়িটি কোনওরকম জ্বালানী তেল ব্যা গ্যাস ছাড়া শুধুমাত্র এর লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারীর ওপর নির্ভর করে ২৫০ মাইল পাড়ি দিতে পারে। ডেইমলারের সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন ও টয়োটার সাথে কারিগরী অংশীদারিত্ব নিয়ে ২০১০ সালের জুনে টেসলা প্রথমবারের মত পাবলিক লিমিডেট কোম্পানী হিসেবে স্টক মার্কেটে নামে অল্প সময়ের মধ্যেই যার মূল্য দাঁড়ায় ২২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।

কোম্পানীর প্রথম ইলেকট্রিক সিডান “Model – S” বাজারে দারুন সফলতা লাভ করে। একবার ব্যাটারি ফুল চার্জ হলে এটি ২৬৫ মাইল পাড়ি দিতে সক্ষম। মোটর ট্রেন্ড ম্যাগাজিন মডেল এস কে ২০১৩ সালের সেরা গাড়ির মর্যাদা প্রদান করে।

২০১৭ সালের এপ্রিলে ঘোষণা দেয় যে তারা জেনারেল মোটরস কে টপকে আমেরিকার সবথেকে লাভজনক গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছে। ব্যাপারটি অবশ্যম্ভাবী ভাবেই টেসলার প্রত্যাশা পূরণ করেছিল এবং পন্য প্রস্তুতে আরও গতির সঞ্চার করেছিল যার ফলে ঐ বছরই তারা তাদের “মডেল ৩ সিডান” বাজারে আনে।

২০১৭ এর নভেম্বরে মাস্ক কোম্পানীর ডিজাইন স্টুডিওতে তাদের নতুন দু’টি গাড়ি টেসলা সেমি এবং রোডস্টারের পর্দা উন্মোচন করে আবারও একবার হৈচৈ ফেলে দেন। টেসলা সেমি আসলে একটি সেমি ট্রাক, ২০১৯ সালে যেটির প্রস্তুতের কাজ শুরু হবার কথা রয়েছে – একবার ব্যাটারি ফুল চার্জ দিলে গাড়িটি ৫০০ মাইল পথ পাড়ি দিতে পারবে, এবং সেইসাথে কোম্পানীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে গাড়িটির ব্যাটারি ও মোটর ১ মিলিয়ন মাইল ভ্রমণ পর্যন্ত কোনও সমস্যা ছাড়াই চলবে। রোডস্টারকে ধরা হচ্ছে আজ পর্যন্ত তৈরী হওয়া সবথেকে দ্রুতগামি গাড়ি হিসেবে। মাত্র ১.৯ সেকেন্ড সময়ে এর গতিবেগ প্রতি ঘন্টায় ০ থেকে ৬০ কিলোমিটারে উঠবে! রোডস্টার ২০২০ সালে বাস্তবতার মুখ দেখবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন মাস্ক।

উন্মোচন অনুষ্ঠানে মাস্ক বলেন – “আমার এই প্রকল্পের একমাত্র উদ্দেশ্য হল খনিজ জ্বালানী চালিত গাড়িকে একটি বড় আঘাত দেয়া। (আমার গাড়ির পাশে) খনিজ জ্বালানীর স্পোর্টসকার চালালে মনে হবে আপনি ডিমের খোসায় তৈরী একটি স্টিম ইঞ্জিন  চালাচ্ছেন।”

সোলার সিটি :

আরও বেশি মানুষের হাতে বহুব্যবহারযোগ্য জ্বালানী ও শক্তি তুলে দেয়ার এবং এই শক্তির ব্যবহারকে আরও বেশি প্রচলিত করার চেষ্টার অংশ হিসেবে ২০১৬ এর অগাস্ট মাসে মাস্ক তাঁর ইলেক্ট্রিক গাড়ি প্র¯তুতকারী প্রতিষ্ঠান ও সৌরশক্তি উৎপাদনকারী কয়েকটি কোম্পানীর মাঝে ২.৬ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি করেন। তাঁর টেসলা মোটর কোম্পানী সেই বছর ঘোষণা দেয় যে তারা সোলার সিটি করপোরেশনের সমস্ত স্টক কিনে নিয়েছে। ২০০৬ সালে তিনিই তাঁর কয়েকজন আত্মীয়কে সোলার সিটি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন। বর্তমানে দুই প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগ শেয়ারই তাঁর। এই চুক্তির ব্যাপারে টেসলার ওয়েবসাইটে নিচের লেখাটি প্রকাশিত হয়:

“সৌরশক্তি এবং এর ব্যবহারকারী সবথেকে ভাল কাজ করে যখন তারা একই জায়গায় থাকে। টেসলা (ব্যবহারকারী) এবং সোলার সিটি  (সৌরশক্তি উৎপাদনকারী) একসাথে এমন সব সুনির্মিত, বানিজ্যিক পন্য প্রস্তুত করতে পারবে যা শক্তি প্রস্তুত, সংরক্ষণ ও ব্যবহারের ধারনাই বদলে দেবে।”

বর্তমানে সবথেকে বেশি ইলেক্ট্রনিক পন্যের পেটেন্ট এর মালিকানার রেকর্ডও টেসলার দখলে।

ইলন মাস্কের পারিবারিক জীবন:

ছেলেবেলা

মাস্কের বাবা ছিলেন দক্ষিন আফ্রিকান ও মা ছিলেন কানাডিয়ান। তিনি তাঁর বাল্যকাল তাঁর দুই ভাইবোন কিমবেল ও টসকার সাথে কাটান। ইলনের বয়স যখন ১০, তখন তাঁর বাবা-মায়ের মাঝে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই অন্তর্মূখী ইলন এই সময়টাতে মন খারাপ ভাব কাটাতে কম্পিউটারের জগতে হারিয়ে যেতেন। প্রোগামিং এর প্রাথমিক বিদ্যা তিনি নিজে নিজেই অর্জন করেন এবং মাত্র বারো বছর বয়সেই তিনি তাঁর নিজের তৈরী গেম “ব্লাশার” বিক্রির মাধ্যমে সফটঅয়্যার বিক্রেতা হিসেবে প্রথম পা বাড়ান।

ইলন মাস্কের জীবনী
[ভাই ও বোনের সাথে ইলন মাস্ক]

স্ত্রী

ইলন মাস্ক এখন পর্যন্ত মোট দুইবার বিয়ে করেছেন। ২০০০ সালে তিনি কানাডিয়ান লেখিকা জাস্টিন উইলসনকে বিয়ে করেন যার স্থায়িত্ব ২০১০ সালে অতি তিক্ত একটি বিচ্ছেদের মধ্যদিয়ে শেষ হয়।

ইলন মাস্ক
[প্রথম স্ত্রী জাস্টিন উইলসনের সাথে]
পরবর্তীতে সেই বছরই তাঁর পরিচয় হয় বৃটিশ অভিনেত্রী টালূলাহ রেইলির সাথে। ২০১০ সালেই তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ২০১২তে একবার আলাদা হয়ে ২০১৩ সালে আরেকবার বিয়ে করেন তাঁরা এবং ২০১৬ সালে শেষবারের মত বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে মাস্ক ও রেইলির মাঝে।

২০১৭ থেকে মাস্ক হলিউড অভিনেত্রী এ্যামবার হার্ড এর সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছেন।

সন্তান

এলন মাস্ক মোট ছয়টি ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। ছয়জনই তাঁর সাবেক স্ত্রী জাস্টিন উইলসনের গর্ভে জন্ম নেয়। তাঁর প্রথম সন্তান মাত্র দশ সপ্তাহ বয়সে হঠাৎ করেই এসআইডিএস (নবজাতকদের হঠাৎ করে মৃত্যু ঘটার একটি বিরল রোগ) এ আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। পরবর্তীতে এই দম্পতির দুই বার দুইটি ও তিনটি করে জমজ ছেলে জন্ম নেয়।

অন্যান্য গবেষণা ও উদ্ভাবন:

স্পেস এক্স ও টেসলার বাইরেও ইলন মাস্ক সব সময়েই তাঁর উদ্ভাবনী কল্পনাগুলোকে বাস্তবে পরিনত করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকেন। তার মধ্যে কয়েকটির কথা চলুন জেনে নেয়া যাক।

হাইপার লূপ

২০১৩ এর আগস্টে ইলন মাস্ক যাতায়াতের একটি নতুন পদ্ধতির কথা প্রকাশ করেন যার নাম তিনি দেন “হাইপার লূপ”। এটি এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে বড় বড় শহরগুলোতে যাতায়াত করা খুবই কম সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। বহুব্যবহারযোগ্য শক্তিতে চালিত এবং আবহাওয়ার প্রভাবমুক্ত এই প্রকৃয়ায় যাত্রীরা ক্যাপসুলের মধ্যে অবস্থান করে একটি লো প্রেশার টিউবের নেটওয়ার্কের ভেতর দিয়ে ঘন্টায় ৭০০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ভ্রমণ করতে পারবেন। মস্কের মতে এই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন ও ব্যবহারোপযোগী হতে সাত থেকে দশ বছর সময় লাগবে।

hyper loop
[হাইপার লূপ এর একটি কল্পিত মডেল]
যদিও তাঁর দাবী অনুযায়ী হাইপারলূপ ট্রেন এবং প্লেনের থেকে কম ঝুঁকিপূর্ণ হবে, কিন্তু এর ৬ বিলিয়ন ডলারের আনুমানিক খরচ ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের জন্য পরিকল্পিত রেল সিস্টেমের খরচের দশ ভাগের এক ভাগ! আর এই কারনেই অনেকে তাঁর এই পরিকল্পনার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তবে মাস্ক এসবে দমে যাওয়ার পাত্র নন, তা তিনি আগেও বহুবার প্রমান করেছেন – এবং এবারও উৎসাহের সাথেই তাঁর নতুন এই প্রকল্পের কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি এই হাইপার লূপ প্রজেক্টের জন্য একটি ডিজাইন প্রতিযোগীতার ঘোষণা দেন এবং সেই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালের জানুয়ারী মাসে  তাঁর স্পেস এক্স গবেষণা কেন্দ্রে।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়ে মাস্কের আগ্রহের কথা অনেকেরই জানা। তিনি এ আইতে নিবেদিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ওপেন এ আই এর চেয়ারম্যান। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানীটি মানবতার কল্যানে ডিজিটাল বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নের জন্য গবেষণার কাজে নিবেদিত। ২০১৭ সালে খবর প্রকাশিত হয় মাস্ক “নিউরালিঙ্ক” নামের একটি উদ্যোগকে সহায়তা করছেন যারা কিনা এমন চিপ বানানোর জন্য গবেষণা করছে যা কিনা মানুষের মস্তিষ্কে স্থাপন করে সফটঅয়্যারের সাথে তার সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হবে।

খননকারী কোম্পানী

আরেকটি যুগান্তকারী চিন্তা! ২০১৭ সালের জানুয়ারীতে মাস্ক হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি টানেল খনন এবং নির্মানের মাধ্যমে ট্রাফিক সমস্যার সমাধান করবেন। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তিনি “দি বোরিং কোম্পানী” নামে একটি খননকারী প্রতিষ্ঠান শুরু করেন যার প্রথম কাজ ছিল লস এ্যাঞ্জেলসে অবস্থিত স্পেস এক্স এর আওতাভূক্ত জমিতে খননকার্য চালানো। অক্টোবরের শেষের দিকে মাস্ক তাঁর ইন্সটাগ্রাম পেজে তাঁর এই কোম্পানীর কাজের অগ্রগতির ছবি পোস্ট করেন। তিনি বলেন এই পাঁচশত ফুট টানেলটি ক্যালিফোর্নিয়ার ইন্টারস্টেট ৪০৫ বাইপাস সড়কের সমান আয়তনের এবং চার মাসের মধ্যে সেটি পাঁচশত ফুট থেকে দুই মাইলের একটি টানেলে পরিনত হবে।

প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা:

২০১৬ সালে সফলতার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ঘোষণা দিলেন যে তিনি বিশাল অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরিকল্পনা করছেন – মাস্ক নতুন প্রেসিডেন্ট ও তাঁর উপদেষ্টামন্ডলীর সাথে নিজের চিন্তার বেশ মিল খুঁজে পেলেন। সেবছরের ডিসেম্বরেই তিনি ট্রাম্পের কৌশল ও নীতি বিষয়ক সভায় ডাক পেলেন এবং তার পরের জানুয়ারিতেই তিনি ট্রাম্পের “কর্মসৃষ্টির উদ্যোগ” এর সাথে জড়িত হন।

প্রেসিডেন্টের কিছু কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপ যেমন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর থেকে অভিবাসী প্রবেশ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব, মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে দেয়াল তুলে দেয়া – ইত্যাদির কারনে ট্রাম্প প্রশাসন সমালোচিত হলেও তিনি ট্রাম্প প্রশাসনে তাঁর নিজের জড়িত হওয়ার ব্যাপারে ২০১৭ সালের প্রথম ভাগে টুইটারে লেখেন – “আমার উদ্দেশ্য হল সৌরশক্তি ব্যবহারে পৃথিবীর যাত্রাকে গতিশীল করা এবং এবং মানব সভ্যতাকে একটি বহুগ্রহ ভিত্তিক সভ্যতায় রূপান্তরে সাহায্য করা। যার ফলে আমরা লক্ষ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারব এবং সবার জন্য আরও আশাব্যাঞ্জক একটি ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।” – তবে সেই বছরের ১ জুন ট্রাম্প প্যারিসে অনুষ্ঠিত পরিবেশ বিষয়ক সম্মেলন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহার করার পর মাস্ক তাঁর উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়ান।

ইলন মাস্কের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান:

মানবজাতির কল্যানে বিরাট সম্ভাবনাময় মহাকাশ অন্বেষণ এবং মানবজাতির স্থায়িত্ব দীর্ঘায়িত করাই মাস্কের কাজের প্রধান অনুপ্রেরণা। এবং এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে তিনি মাস্ক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন যা মহাকাশে নতুন সম্ভাবনার খোঁজ এবং বহুব্যবহারযোগ্য পরিবেশবান্ধব শক্তির উৎস খুঁজে বের করার কাজে নিবেদিত।

শেষ কথা:

ইলন মাস্ক তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করেছেন মানুষের জীবনকে আরও সহজ করা এবং পৃথিবী ও পৃথিবীর বাইরের জগতকে মানুষের জন্য বসবাসের আরও উপযোগী করে গড়ে তোলার প্রয়াসে। ধীরে ধীরে তিনি তাঁর স্বপ্নের আরও কাছে এগিয়ে যাচ্ছেন। হয়তো তাঁর হাত ধরেই আমরা একদিন মানবজাতির ভিন গ্রহে বসবাসের বহু বছরের লালিত স্বপ্নকে বাস্তব হতে দেখব। এই প্রখর প্রতিভাবান ও অসাধারন সফল মানুষটির জীবন থেকে আমরা সবথেকে বড় যে শিক্ষাটি নিতে পারি তা হল স্বপ্ন যত বড়ই হোক, বিশ্বাসের সাথে কাজ করে গেলে সাফল্য আসবেই।

লেখাটি ভাল লেগে থাকলে লাইক ও কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের উ‌ৎসাহিত করুন।  আপনার যদি মনে হয় ইলন মাস্ক এর জীবন থেকে তরুণ উদ্যোক্তারা কিছু শিখতে পারবে, তবে আপনার কাছে অনুরোধ  থাকবে শেয়ার করার মাধ্যমে লেখাটি ছড়িয়ে দেয়ার। সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে সবার সাথে আছে।

পোস্টটি শেয়ার করুন !