সিলিকন ভ্যালি এর নাম মোটামুটি সবারই জানা। বিশেষ করে যাঁরা তথ্য প্রযুক্তি এবং ব্যবসা বানিজ্য বিষয়ে খোঁজ খবর রাখেন – তাঁরা এটার নাম অবশ্যই শুনেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার ৩০০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে সিলিকন ভ্যালির অবস্থান। ১৯৯৫ সালের পর থেকে বিশ্বের ইন্টারনেট ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এই এলাকাটি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় অনেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের শুরু হয়েছিল এখান থেকেই।
গুগল, ইয়াহু, এ্যাপল, এ্যাাডোবি, এইচপি, ইন্টেল, ইবে, ওরাকল, আসুস, ফেসবুক, সিমেন্স – কোম্পানীর নাম বলে শেষ করা যাবে না।
এসব বড় বড় নাম ছাড়াও আরও অনেক কোম্পানী আছে, যেগুলো আমাদের পর্যন্ত পৌঁছায় না – কিন্তু বাইরে তাদের যথেষ্ঠ সুনাম। প্রতি বছর নতুন নতুন মিলিওনেয়ার উদ্যোক্তা বের হচ্ছেন এই সিলিকন ভ্যালি থেকে। তাঁদের সবার আইডিয়া নতুন, কাজের ধরন আলাদা, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ধরনও আলাদা। কিন্তু কিছু বিষয়ে তাঁদের মধ্যে দারুন কিছু মিল রয়েছে। সবাই আলাদা কাজ করলেও, প্রায় সবাই প্রতিদিন কিছু কাজ প্রায় একইরকম ভাবে করেন।
বর্তমান বিশ্বে বিজনেস ট্রেইনিং ও সেলফ ডেভেলপমেন্ট জগতে যে কয়েকজন নতুন সেনসেশন অল্প সময়েই সফল হয়েছেন, জোয়েল ব্রাউন তাঁদের একজন। তিনি মূলত সফল উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করেন। তাঁদের কাজের ধরন, অভ্যাস, আইডিয়া – ইত্যাদি তাঁর ওয়েবসাইট ও চ্যানেল “এ্যাডিক্টেড টু সাকসেস” এর মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। এছাড়া প্রায়ই সফল উদ্যোক্তাদের সাথে একান্ত সময় কাটান। লেস ব্রাউন, গ্যারি ভেইনারচাক এর মত সফল উদ্যোক্তা ও বক্তারা তাঁর শো – এর নিয়মিত অতিথি। এর বাইরে তিনি নিজেও একজন সেলফ ডেভেলপমেন্ট কোচ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তিনি কোর্স করিয়ে থাকেন। জোয়েল সিলিকন ভ্যালি মিলিয়নেয়ারদের সাথে চলাফেরা করার অভিজ্ঞতা থেকে ৫টি বিষয় খুঁজে পেয়েছেন – যা প্রায় সব সিলিকন ভ্যালি সফল উদ্যোক্তাদের মাঝে দেখতে পাওয়া যায়।
তাঁরা যা-ই করেন না কেন, প্রতিদিন এই ৫টি কাজ করার চেষ্টা করেন। জোয়েল ব্রাউনের ব্লগ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর সেই ব্লগের মূল বিষয়বস্তু সংক্ষেপে তুলে ধরছি। যাতে আপনিও সেখান থেকে উপকৃত হতে পারেন।
সিলিকন ভ্যালি মিলিওনেয়াররা যে ৫টি কাজ প্রতিদিন করেন:
০১. তাঁরা লক্ষ্যগুলো পর্যালোচনা করেন
যে কোনও সাফল্যের জন্যই একটি লক্ষ্য ঠিক করা এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিকল্পনামাফিক কাজ করা জরুরী। সফল মানুষরা একটি বড় লক্ষ্য ঠিক করে তাকে ছোট ছোট লক্ষ্যে ভাগ করে নেন। প্রতিটি দিনের জন্য তাঁদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে।
সিলিকন ভ্যালির সফল উদ্যোক্তারা প্রতিদিন সকালে তাঁদের মূল লক্ষ্য এবং দিনের লক্ষ্য নিয়ে চিন্তা করেন। এতেকরে তাঁদের দিনের করনীয় কাজ সম্পর্কে একটা মানসিক লাইন আপ দাঁড়িয়ে যায়। তাছাড়া দিনের প্রথমে নিজের লক্ষ্য নিয়ে গভীর চিন্তা করলে দিনের শুরুতেই কাজ করার উৎসাহ জন্মায়।
অনেকেই গতকাল কি কি অর্জন করেছেন, তা নিয়ে প্রথমে ভাবেন। তারপর তাঁরা আজকের দিনে কি কি অর্জন করবেন – তার ওপর চোখ বুলান। এতে সারাদিনে কি করতে হবে – তা নিয়ে বার বার সিদ্ধান্ত নিতে হয় না। খুব সরল সুন্দর ভাবে তাঁরা তাঁদের দিনের কাজ সারতে পারেন।
সকাল বেলা বা আগের দিনের কাজের শেষে তাঁরা পরবর্তী দিনের করনীয় গুলো লিখে রাখেন। এর পাশাপাশি আগেই লিখে রাখা মূল লক্ষ্য আবার পড়ে দেখেন। এতে মূল লক্ষ্য ও দৈনিক লক্ষ্য সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা নিয়ে তাঁরা প্রতিদিন কাজ করতে পারেন।
তাঁরা যদি দেখেন কোনও কাজ তাঁদের মূল লক্ষ্য পূরণে অবদান রাখবে না – তখন তাঁরা সেই কাজ না করার চেষ্টা করেন।
সফল উদ্যোক্তা ও বিশ্বখ্যাত সেলফ ডেভেলপমেন্ট কোচ লেস ব্রাউন বলেন, “ভালোভাবে লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রতিদিন অন্তত ২ বার নিজের লক্ষের ওপর চোখ বুলানো উচিৎ”
০২. তাঁরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সবার আগে করেন
এটাকে বলা হয় “MIT” বা “Most Important Task” – সিলিকন ভ্যালির সফল উদ্যোক্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা কমন, তা হল তাঁরা কখনও কাজ ফেলে রাখেন না। যখন যে কাজটা করা সবচেয়ে জরুরী – তাঁরা সেই কাজটিই করেন। আজকের কাজ কখনও তাঁরা কালকের জন্য ফেলে রাখেন না। আপনি যে ক্ষেত্রেই সফল হতে চান না কেন – কোনওভাবেই ঢিলেমি করা যাবে না। অনেক প্রতিভাবান মানুষ শুধু ঢিলেমির কারণে সফল হতে পারেননি।
দিনের লক্ষ্যগুলো রিভিউ বা পর্যালোচনা করার পর, কোন কাজটি সবচেয়ে জরুরী তা বের করতে হবে। বের করার পর দিনের কাজ শুরুর প্রথমেই সেই কাজটি করে ফেলতে হবে। দিনের সবচেয়ে জরুরী কাজটা আগে করে ফেললে মন অনেক হাল্কা হয়ে যায়। এরপর দেখবেন পরের কাজগুলো করার জন্য দারুন গতি পাবেন। এক একটি কাজ শেষ করলে পরের কাজের জন্য আরও মোটিভেটেট হয়ে এগিয়ে যেতে পারবেন।
০৩. তাঁরা প্রতিদিন নতুন কিছু শেখেন
আপনি যদি প্রতিদিন নিজেকে আরও উন্নত করতে চান, তবে অবশ্যই প্রতিদিন নতুন কিছু শিখতে হবে। মিরাকেল মর্নিং বইয়ের লেখক হ্যাল ইলরড বলেন, জীবনে যে অবস্থায়ই থাকেন না কেন – সেই অবস্থা থেকে উন্নতি করতে গেলে প্রতিদিন নতুন কিছু শেখার বিকল্প নেই। সিলিকন ভ্যালির প্রতিটি সফল উদ্যোক্তা এটা মেনে চলেন।
লিজেন্ডারি সেলফ ডেভেলপমেন্ট কোচ ও মোটিভেটর আর্ল নাইটেঙ্গেল বলেন, “কেউ যদি প্রতিদিন ১ ঘন্টা তার আগ্রহের বিষয়ে বাড়তি পড়াশুনা করে, তবে ৫ বছরের কম সময়ে সে সেই বিষয়ে একজন জাতীয় বিশেষজ্ঞ হয়ে যাবে”
আপনি যখন কোনও বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবেন, অর্থাৎ সাধারন মানুষের চেয়ে বেশি জানবেন – তখন স্বাভাবিক ভাবেই অন্যদের চেয়ে আপনি কাজে অনেক এগিয়ে যাবেন।
আর শেখা কিন্তু শুধু বই পড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আপনি অডিও বুক শুনতে পারেন, ইন্টারনেটে ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখতে পারেন, আপনার চেয়ে অভিজ্ঞদের সাথে সময় কাটাতে পারেন, কোর্স করতে পারেন। শিখতে চাইলে উপায়ের অভাব নেই।
আপনি যত শিখবেন – ততই আপনার সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা বাড়বে। আর সেই ক্ষমতাকে প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়াতে হলে প্রতিদিনই আপনার কাজের বিষয়ে নতুন কিছু না কিছু শিখতে হবে। যেটা সিলিকন ভ্যালির প্রায় সব সফল মানুষের রুটিন এর অংশ।
০৪. তাঁরা স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন
নাটক সিনেমায় মেধাবীদের শারীরিক ভাবে দুর্বল করে দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা সেরকম নয়। একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আপনাকে প্রথম দিকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে। অনেক বেশি মাথা খাটাতে হবে। আর এর জন্য শরীর সুস্থ রাখার কোনও বিকল্প নেই।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠা, তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়া, এবং নিয়মিত কিছু শরীরচর্চা করাটা জরুরী। সেইসাথে খাবারের দিকেও নজর রাখতে হবে। অতিরিক্ত পরিমান ফাস্টফুড এবং চর্বি যুক্ত খাবার খাওয়ার বদলে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
আরেকটি ভুল অনেকেই করেন; কোনওরকম নড়াচড়া ছাড়াই ঘন্টার পর ঘন্টা টানা বসে বসে কাজ করেন। এটা শরীরের জন্য খুবই খারাপ। টানা আধা ঘন্টা কাজ করার পর আপনাকে অবশ্যই কয়েক মিনিটের জন্য একটু হাঁটাহাঁটি করতে হবে। উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হতে হলে শরীরকে পরিশ্রম করার যোগ্য রাখতে হবে। মনে রাখবেন, আপনি ৯টা-৫টা কাজ করছেন না। নতুন উদ্যোক্তার ছুটি বলে কিছু নেই। আপনাকে সব সময়ে হাই পারফর্মেন্স এর ফর্মে থাকতে হবে। কাজেই, শরীরের প্রতি বিশেষ নজর আপনাকে দিতেই হবে। যেমনটা আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বেশিরভাগ সফল উদ্যোক্তাই দিয়ে থাকেন।
“শরীরচর্চা আমাদের শরীরের লুকিয়ে থাকা এনার্জিকে জাগিয়ে তোলে”
– আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার
০৫. তাঁরা নিয়মিত টাকা পয়সার হিসাব করেন
যে কোনও ব্যবসারই সবচেয়ে জরুরী দিক হল টাকা পয়সার হিসাব ঠিক রাখা। শুধু সিলিকন ভ্যালি নয়, যে কোনও সফল উদ্যোক্তারই প্রতিদিনকার অভ্যাস হল দিনের শুরুতে এবং শেষে টাকাপয়সার হিসাব করা। প্রতিদিন কত টাকা আসছে, কত টাকা যাচ্ছে – এসব হিসাব একজন ব্যবসায়ীর মাথায় খুব ভালোভাবে থাকতে হবে। এটা না হলে খুব তাড়াতাড়িই ব্যবসার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।
একজন উদ্যোক্তা যে ডিপার্টমেন্টেই এক্সপার্ট হন না কেন – টাকা পয়সার হিসাব তাঁকে বুঝতে হবে, এবং প্রতিদিনই তার খোঁজ খবর নিতে হবে।
পরিশিষ্ট:
আমরা অনেক সময়েই শুনি সিলিকন ভ্যালির উদ্যোক্তারা অন্য উদ্যোক্তাদের চেয়ে বেশি কাজ করেন। তাঁরা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি প্রোডাক্টিভিটি দেখান। এটার একটি প্রধান কারণ, তাঁরা ওপরে বলা পদ্ধতিগুলো প্রতিদিন ফলো করার চেষ্টা করেন। যার ফলে তাঁদের কাজের গতি ও পারফেকশন অনেক বেশি থাকে। হাই পারফর্মাররা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি অর্জন করেন, কারণ তাঁরা কিছু কাজ অন্য ভাবে করেন। চাইলে আপনিও এমন হাই পারফর্মার হতে পারেন। আর সেই পথে এই লেখাটি আপনাকে সাহায্য করতে পারে।
লেখাটির বিষয়ে আপনার যে কোনও মতামত আমাদের কমেন্ট করে জানান। আপনার প্রতিটি মতামতই আমাদের কাছে মহামূল্যবান।
আর যদি মনে হয় লেখাটি অন্যদেরও উপকার করবে – তবে শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন।
আমরা আমাদের পাঠকদের কাছ থেকেও অনুপ্রেরণামূলক লেখা আশা করছি। এই ধরনের লেখা যদি আপনিও লিখতে পারেন তবে write@test.edaning.com – এ ইমেইল করতে পারেন। আপনার লেখা যত্ন সহকারে আপনার নাম সহ আমরা প্রকাশ করব।
নিয়মিত অনুপ্রেরণামূলক ও আত্ম উন্নয়ন মূলক লেখা পাওয়ার জন্য আমাদের সাথে থাকুন। সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার সাথে আছে।