যে কোনও বাজে অভ্যাস দূর করার উপায় : মিনি হ্যাবিটস -( বুক রিভিউ )


বাজে অভ্যাস দূর করার চেষ্টা আমরা অনেকেই করি; সেই সাথে আমরা নিয়ম করেও চলতে চাই – কারণ সকলেই জানে, নিয়ম করে না চললে কিছুই ঠিকমত করা যায় না।

কিন্তু সবাই এটা জানলেও নানান কারণে পেরে ওঠেন না। হাতে কাজ রেখে প্রচুর সময় নষ্ট করেন, অথবা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন। অভ্যাস দূর করার চেষ্টা করেও পারেন না।

অনেকেরই গুরুত্বপূর্ণ এ্যাসাইনমেন্টের মাঝে থাকার সময়েও মনে হয় “যাই, দু’টো মিনিট একটু ফেসবুকটা চেক করে আসি” – কিন্তু সেই দুই মিনিট গিয়ে ঠেকে বিশ মিনিট এমনকি দুই ঘন্টাতেও, ফলাফল – আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট

আবার অনেকেই সকালে ওঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু একদিন বা দুই দিন ওঠার পর আবার সব আগের মত হয়ে যায়। এলার্ম দিয়েও কাজ হয়না। অনেক সময়েই আমরা কাল করব, পরশু করব বলে অনেক জরুরী কাজ ফেলে রাখি। এমন নয় যে আমরা আজকের কাজটি আজকে করতে চাই না, কিন্তু কি এক অদ্ভূত কারণে যেন করা হয় না।

সেই অদ্ভূত কারণটি আর কিছুই নয় – আমাদের অনেক দিনের অভ্যাস। আমরা বুঝতেও পারিনা কিছু ছোট ছোট অভ্যাস দূর করতে না পারায় আমাদের জীবন ও ক্যারিয়ারের কতটা ক্ষতি হচ্ছে।

বেস্ট সেলিং লেখক স্টিফেন গাইস তাঁর “Mini Habits” বইতে এই সমস্যার সমাধান দিয়েছেন । তিনি এমন কিছু অভ্যাসের কথা লিখেছেন, যা রপ্ত করতে প্রতিদিন ১০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট সময় লাগবে। এটা যে কোনও বাজে অভ্যাস দূর করার সেরা উপায় হতে পারে। তো চলুন শুরু করা যাক।

মোটিভেশন বনাম ইচ্ছাশক্তি:

বর্তমানে তরুণদের মাঝে একটি বদ অভ্যাস খুব বেশি দেখা যায়। তারা সকালে ঘুম থেকে উঠেই বালিশের পাশে রাখা স্মার্টফোনটি হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকে যায়। তারপর, কালকের স্ট্যাটাসে কয়টি লাইক পড়ল, কয়জন কমেন্ট করল, কয়টি মেসেজ আসল, কি কি আপডেট আসল – এসব আগ্রহের সাথে দেখে। – খুব মজা তাইনা? কিন্তু এই মজার মাঝেই আপনার বেরসিক বাবা, মা অথবা বুড়িয়ে যাওয়া বড় ভাই এসে আপনাকে বলেন “এই বন্ধ কর! কি একটা বাজে অভ্যাস বানিয়েছিস?” – আপনার মনে হয়, এরা আগের যুগের মানুষ, এসবের কি বুঝবে? কিন্তু ঘটনা হচ্ছে ‘মুরুব্বিরা কিন্তু ঠিকই বলেন।’

অভ্যাসই আমাদের জীবনের কেন্দ্র। আমরা আসলে জানিই না যে, আমরা অভ্যাস নিয়েই বেঁচে আছি। দিনের প্রতিটি বিষয়ের সাথে জড়িয়ে আছে অভ্যাস। এইযে আমরা প্রতিদিন সকালে উঠে দাঁত ব্রাশ করি – এটা কিন্তু একটা অভ্যাস।

এটা আপনি বড়দের দেখে ছোট বেলায় শুরু করেছিলেন এবং বছরের পর বছর ধরে এই কাজটি করার ফলে, এটা আপনার অভ্যাস হয়ে গেছে।

হয়তো খেয়াল করেছেন, অনেকেই বার বার পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে অকারণে লক খুলে আবার বন্ধ করে দেন- এটাও আসলে একটা অভ্যাস। ছোটবেলা থেকে শুরু করে বড় হওয়া পর্যন্ত অনেক অভ্যাসই আমাদের জীবনে যোগ হতে থাকে।

কিন্তু ছোটবেলার চেয়ে বড় বেলায় অভ্যাস পরিবর্তন করা বেশি কঠিন।

আমরা অনেক সময়ে বিভিন্ন ভাবে মোটিভেটেড হয়ে অভ্যাস পরিবর্তন করা শুরু করি, কিন্তু অল্প সময় পরেই তা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। কেন এমন হয়, তা একটু পরেই ব্যাখ্যা করছি।

Image result for holiday - canvas wall art print

আসলে একটি ভালো অভ্যাস করা বা বাজে অভ্যাস দূর করার জন্য মোটিভেশন অথবা অনুপ্রেরণার চেয়েও ‘will power’ অর্থা‌ৎ ইচ্ছাশক্তির বেশি প্রয়োজন। ইচ্ছাশক্তি হলো নিজের মন না চাইলেও জোর করে কিছু করার শক্তি।  সবার এই শক্তি থাকে না, বা প্রথমেই আপনি খুব বেশি ইচ্ছাশক্তি খাটাতে পারবেন না।  একটু একটু করে এই শক্তিকে বাড়াতে হয়। বাজে অভ্যাস দূর করা বা ভালো অভ্যাস করার জন্য অল্প অল্প করে ইচ্ছাশক্তি বাড়ানো খুব জরুরী। পরের ধাপে আপনি এটাই শিখবেন।

একবারে করতে যাবেন না

যদি অভ্যাস বদল করার জন্য প্রথমেই বিশাল এক টার্গেট নেন, তাহলে আপনার ইচ্ছাশক্তিও কাজ করবে না। আপনি বডি বিল্ডিং করতে গিয়ে প্রথম দিনেই যদি ১০০ টি পুশ আপ (বুকডাউন) দেয়ার টার্গেট নেন, তাহলে সেটি করাটা কষ্টকর। অথবা মেডিটেশান অর্থা‌ৎ ধ্যান করতে গিয়ে প্রথম দিনেই যদি ৩০ মিনিট ধ্যান করার টার্গেট নেন তাহলে সেটি করতে পারার সম্ভাবনাও অনেক কম। প্রথম দিনেই যখন লক্ষ্য পূরণ করতে পারবেন না, তখন আপনার আত্মবিশ্বাস টলে যাবে – কন্টিনিউ করার আগ্রহও হারিয়ে ফেলবেন। তাহলে উপায়?

এইসব সমস্যার সেরা সমাধানটি হচ্ছে “ছোট অভ্যাস” (mini habits) – আপনি যে কোনও নতুন অভ্যাস সহজে করতে চাইলে, অথবা বাজে অভ্যাস দূর করতে চাইলে, প্রথমেই একটি মিনি হ্যাবিট অর্থা‌ৎ ছোট অভ্যাস শুরু করুন। নিজের ইচ্ছাশক্তিকে ছোট ছোট করে কাজে লাগান।

ধরুন, আপনার লক্ষ্য প্রতিদিন এক ঘন্টা দৌড়ানো, তাহলে শুরুটা করুন ৫ থেকে ১০ মিনিট দিয়ে। কারণ পাঁচ-দশ মিনিট দৌড়ানোর জন্য খুবই কম ইচ্ছাশক্তি লাগে। এটি আপনার কাছে তেমন কঠিন মনে হবে না। আবার ধরুন আপনার টার্গেট প্রতিদিন ১০০টি পুশ আপ দেয়া। তাহলে প্রথম দিন ৫টি দিয়ে শুরু করুন! মাত্র ১০ সেকেন্ড এর ব্যাপার।

আপনি যদি চান, প্রতিদিন আধা ঘন্টা করে মেডিটেশন করবেন – প্রথম দিন মাত্র ১ মিনিট করলেই চলবে। কয়েক দিন পর এটা একাই বেড়ে যাবে। কিন্তু আপনি দ্বিতীয় দিনেই ১ মিনিট থেকে ১ ঘন্টায় চলে যাবেন না। ধীরে ধীরে সময় ও পরিমান বাড়ান।

১ মিনিট থেকে ২ মিনিট, সেখান থেকে ৩ মিনিট – এভাবে বাড়াতে থাকুন। পুশ আপ ৫ থেকে এক লাফে ২০ করবেন না – পাঁচ থেকে ছয়, সাত, আট … এভাবে বাড়াতে থাকুন।

যদি ভোর ৫টায় উঠতে চান, তাহলে প্রথমেই অত ভোরে ওঠার চেষ্টা করবেন না। ভালো হয় ৭টা থেকে শুরু করলে। কয়েকদিন পর আরও ১৫ মিনিট আগে ওঠার চেষ্টা করুন। কয়দিন পরপর ১৫ মিনিট করে সময় কমিয়ে আনুন। আশা করা যায় এক-দেড় মাসের মধ্যেই ভোর ৫টায় ওঠার অভ্যাস হয়ে যাবে।

একবারে করতে গেলে অল্প দিনেই সেটি আপনার কাছে বোঝা মনে হবে। কাজেই একবারে করার চেষ্টার চেয়ে ধীরে ধীরে অভ্যাসটা স্থায়ী করে নেয়াই ভালো।

মিনি হ্যাবিটগুলো অনুশীলন করার মাধ্যমে এগুলো ধীরে ধীরে আপনার রেগুলার অভ্যাসে পরিনত হবে, তাই কাজগুলোও অনেক সহজে করতে পারবেন।

mini habits, বাজে অভ্যাস দূর করার উপায়

কিন্তু এটা কিভাবে হয়? এর কি কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে?

অভ্যাস আসলে নিউরাল পাথ

আমাদের অভ্যাসগুলো আসলে আমাদের মস্তিষ্কের নিউরোনগুলোর মধ্যে সংযোগ পথ বা নিউরাল পাথওয়ে। নিউরোনগুলোর মাঝে যোগাযোগের মাধ্যমেই আমাদের দেহ ও মনের কাজগুলো হয়।

প্রতিটি চিন্তা ও কাজের জন্য মস্তিষ্কে আলাদা আলাদা নিউরাল পাথওয়ে আছে। একটি কাজ বা চিন্তা আপনি যত বেশিবার করবেন পাথওয়েটি আরও চওড়া ও মসৃণ হতে থাকবে। আবার যদি আপনি সেই চিন্তা বা কাজটি নিয়মিত না করেন, তাহলে একটি রাস্তায় বহুদিন না চললে যেমন তা ঢেকে যায়, নিউরাল পাথগুলিও তেমন ছোট আর অমসৃণ হয়ে আসে।

যেসব কাজ করতে আমাদের কোনও প্রকার চিন্তাভাবনার প্রয়োজন হয় না, সেগুলো নিয়ন্ত্রণ হয় আমাদের ব্রেনের “basal ganglia” অংশ থেকে। যেমন আপনি যদি একজন এক্সপার্ট ড্রাইভার হন, তাহলে আপনাকে গিয়ার পাল্টানো বা ব্রেক চাপার জন্য কোনওরকম চিন্তাভাবনা করতে হয় না – কারণ এই কাজের তথ্যগুলো আপনার basal ganglia তে মজুদ আছে। এই ব্যাসাল গ্যানাগ্লিয়া আসলে আমাদের অবচেন মনের (subconscious mind) একটি অংশ। নিয়মিত গাড়ি চালানোর কারণে এই কাজের নিউরাল পাথওয়ে যথেষ্ঠ মসৃণ আছে। কিন্তু আপনি যদি দুই বছর গাড়ি চালানো বন্ধ রাখেন, তাহলে গাড়ি চালানো না ভুললেও আগের মত এতটা ভালোভাবে চালাতে পারবেন না।

মস্তিষ্কের অবচেতনের basal ganglia অংশটি এতটাই শক্তিশালী যে এর কাজ যদি আমাদের সচেতন মন করতে যায়, তবে সে দারুন ক্লান্ত হয়ে পড়বে।
আমাদের চেতন মন হলো আমাদের মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী অংশ যার নাম “prefrontal cortex”; এই অংশের কাজ করার ধরন basal ganglia এর চেয়ে আলাদা।

prefrontal cortex যখন কোনও সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সে অনেক বিষয় বিবেচনা করে। এই অংশের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে, কোনও বড় সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সে দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে – কারণ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অনেক শক্তি খরচ হয়।

ধরুন আপনি সিগারেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আপনার হাতের কাছে সিগারেটের দোকান থাকলেও আপনি অনেক্ষণ ধরে সেটি না খেয়ে থাকবেন। এর কারণ, আপনার সিদ্ধান্ত পালন করার প্রাথমিক নির্দেশ prefrontal cortex থেকে আসছে।
কিন্তু যখনই বিভিন্ন চিন্তা করতে করতে মস্তিষ্কের চেতন অংশ ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখনই basal ganglia আপনার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এবং যেহেতু বহুদিন ধরে করার ফলে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আপনার basal ganglia এর অংশ হয়ে গেছে, তাই আপনি আবার সেটা শুরু করবেন।

আমাদের অভ্যাসগুলো আসলে এভাবেই সৃষ্টি হয়। বার বার একটি কাজ করতে করতে সেই কাজের প্রক্রিয়াটি সচেতন মনের prefrontal cortex থেকে অবচেতনের basal ganglia এর অংশ হয়ে যায়, তাই অটোমেটিক ভাবেই কাজগুলো হতে থাকে। – এটাই আসলে অভ্যাস।

এখানে আপনার বোঝার বিষয়টি হচ্ছে একটি নতুন অভ্যাস অল্প অল্প করে অনুশীলন করতে করতে এক সময়ে সেটি করতে আপনার আর কোনও কষ্ট হবে না। তাই একবারে একটি অভ্যাস রপ্ত করার চেয়ে, সেটিকে আস্তে আস্তে আপনার অবচেতনের অংশ করে ফেলুন।

কাজের পরিমানের বদলে প্রক্রিয়াটিকে অভ্যাসে পরিনত করুন। প্রক্রিয়া নিউরাল পাথ এ মানিয়ে গেলে, সময় বা পরিমান কোনও ব্যাপার নয় – সেগুলো একা একাই বাড়বে। এক সময়ে দেখবেন এটিই আপনার জীবনের অংশ হয়ে গেছে।

আপনি চাইলেই বদ অভ্যাসগুলো একবারে বাদ দিতে পারবেন না, এতেকরে আপনার মস্তিষ্ক ও শরীরের ওপর চাপ পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের Duke University এর এক গবেষণায় দেখা যায় আমাদের ৪৫ শতাংশ কাজই অভ্যাসে করা হয়। আমরা জানিওনা যে, আমাদের কত ত্রুটি আসলে আমাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফসল। আমাদের সবারই উচি‌ৎ নিজের দিকে একবার তাকানো এবং কোন কোন অভ্যাস দূর করা দরকার – তা খুঁজে বের করা এবং Mini habits এর উপায় কাজে লাগিয়ে আমাদের জীবনকে নতুন করে সাজানো।


লড়াকুর লক্ষ্য আমাদের পাঠকদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসা। আমাদের এই মিশনকে আপনিও সাহায্য করতে পারেন আমাদের লেখাগুলোর ব্যাপারে আপনার মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানিয়ে এবং আমাদের বার্তাগুলো আপনার বন্ধু ও পরিচিতজনদের সাথে শেয়ার করে। সফল হোন, ভালো থাকুন। লড়াকু আপনার সাথে আছে।

পোস্টটি শেয়ার করুন !