কোনও বিষয়ে উপদেশ দেয়া তারই সাজে, যে সেই বিষয়ে সফল। জ্যাক মার মত মানুষ যদি উদ্যোক্তাদের উপদেশ দেন, তবে সেটায় কান দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। হ্যাঁ – ঠিক ধরেছেন। আলিবাবা ডট কম (Alibaba.com) এর প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা-এর কথাই বলা হচ্ছে।
জ্যাক মা এর জীবনী পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে যেন একটি সিনেমার গল্প। মাত্র ২০ হাজার ডলার নিয়ে তিনি তাঁর ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এই ২০ হাজার ডলারও তাঁর নিজের নয়। তাঁর এক বন্ধু ও স্ত্রীর সাহায্যে তিনি এই পুঁজি জোগাড় করেছিলেন। তিনি ফোর্বস ম্যাগাজিনের কাভারে স্থান পাওয়া প্রথম চীনা উদ্যোক্তা। তিনি বর্তমানে চীনের সবথেকে ধনী ব্যক্তি এবং পুরো পৃথিবীর মধ্যে ১৮তম ধনী ব্যক্তি। তাঁর মোট সম্পদের পরিমান প্রায় ৩ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। আজ আমরা জানব জ্যাক মা-এর সাফল্যের সূত্র, তাঁর নিজের দেয়া ও তাঁর জীবনী থেকে নেয়া ১০টি উপদেশ এর মাধ্যমে।
আজ আপনাদের সাথে এই বিজনেস জিনিয়াসের সাফল্যের ১০ সূত্র শেয়ার করব। এবং এই সূত্রগুলো তাঁর নিজের মুখেই বলা।
০১. ব্যর্থতাকে গ্রহণ করে এগিয়ে যাওয়া শিখতে হবে
“আমি যখন ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশুনা করে বের হলাম, তারপর তিন বছরের মত কাজের খোঁজ করেছিলাম, এবং প্রতিবারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলাম, সব মিলিয়ে ৩০ বার!
আমি পুলিশের চাকরীর চেষ্টা করলে আমাকে বলা হল, তুমি এর উপযুক্ত নও। কেএফসি যখন চীনে এল, ২৪ জন সেখানে কাজের জন্য এ্যাপ্লাই করেছিল। ২৩ জনের চাকরী হলো, আমি বাদ পড়লাম। পুলিশের কথা বলছিলাম, আমরা পাঁচজন এ্যাপ্লাই করেছিলাম। চারজনের চাকরী হয়েছিল – আমি বাদ পড়েছিলাম। – আমি হার্ভাড ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য ১০ বার দরখাস্ত করেছিলাম – এবং দশবারই ব্যর্থ হয়েছিলাম। এরপর আমি নিজেকে নিজে বলেছিলাম কোনও একদিন হয়তো আমি সেখানে শিক্ষকতা করব”।
একটি কনফারেন্সে নিজের মুখে এইসব কথা বলেছেনে বিশ্বের ১৮তম ধনী ব্যক্তিটি।
পাঠক, ভেবে দেখুন তো আপনি হলে এইক্ষেত্রে কি করতেন? মাত্র একটা-দু’টো চাকরী থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কতজন সব ছেড়েছুড়ে মুষড়ে পড়ে থাকে? একটি ব্যবসায় লস করে কতজন আত্মহত্যা করে? জ্যাক মা যদি এতবার ব্যার্থ হওয়ার পর একবারও ভাবতেন যে তাঁকে দিয়ে কিছু হবে না – তাহলে আজ তিনি কোথায় থাকতেন? প্রতিটি ব্যর্থতা এক একটি শিক্ষা – আপনার কোথায় কোথায় দোষত্রুটি আছে, কোন জায়গাতে উন্নতি করতে হবে, আপনার সত্যিকার সাফল্য কোন কাজে আসবে, কোন ক্ষেত্রে আপনার দক্ষতা সবচেয়ে বেশি – এসব জানতে হলে আপনাকে অবশ্যই নিজের ব্যর্থতাগুলোকে ইতিবাচক ভাবে গ্রহণ করতে হবে। পর্যালোচনা করতে হবে নিজের কমতি আর সম্ভাবনাগুলোকে। তারপর এগিয়ে যেতে হবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে।
০২. স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে
“Asia Game Changer” নামের একটি ইভেন্টে যোগ দিয়ে জ্যাক মা একবার বলেছিলেন: “আলিবাবার সফলতার পেছনে একটি গোপন রহস্য আছে। আলিবাবার গুহায় ঢুকতে যেমন “চিচিং ফাক” বলতে হতো, তেমনি আমরাও আমাদের আলিবাবার জন্য এমন একটি মন্ত্র খুঁজে পেয়েছিলাম। মন্ত্রটি ছিল ‘স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখো, কারন এটি একদিন সত্যিতে পরিনত হতে পারে’। “
পাঠক, এই উপদেশ হয়তো এর আগে আপনি হাজার বার শুনেছেন। শুনতে শুনতে কথাটি অতি সাধারনের পর্যায়ে নেমে এসেছে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, এই সাধারন কথাটি বাস্তব জীবনে পালন করতে গেলে দেখা যায়, ব্যাপারটি আসলে কতটা কঠিন। একটি স্বপ্ন দেখে আমরা একটু বাধার সম্মুখীন হলেই সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়া সম্ভব নয় ধরে নিয়ে আমরা তা দেখাই ছেড়ে দিই। এভাবে কত লক্ষ লক্ষ সুন্দর স্বপ্নের মৃত্যু হয় প্রতিদিন – তার হিসেবও কেউ রাখে না। কিন্তু জ্যাক মা’র মত কিছু মানুষ আছেন যাঁরা নিজের মৃত্যুর মুখেও স্বপ্নকে মরতে দেন না। তাঁরা জানেন, স্বপ্ন দেখতে থাকলে একদিন তা বাস্তবে রূপ নেবে। সেই বিশ্বাসই তাঁদের আর সবার থেকে আলাদা করে দেয়।
০৩. সেবা ও সহযোগীতার সংস্কৃতি সৃষ্টি করুন
এক টিভি প্রোগ্রামের উপস্থাপক একবার জ্যাক মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার প্রতিষ্ঠানের মূল ফোকাস কি? জ্যাক মা’র উত্তরটি নিচে দেয়া হল:
“আমাদের মূল মনযোগ বা ফোকাস হলো, সংস্কৃতি। অনেকেই ভাবে আমাদের মূল মনযোগ প্রযুক্তি, কিন্তু সেটা ঠিক নয়। প্রযুক্তি একটি মাধ্যম (যা ব্যবহার করে কাজ করা যায়)। আমরা ১৮জন তরুন কর্মী নিয়ে শুরু করেছিলাম, যার সংখ্যা এখন ২০,০০০। আমাদের মূল মনযোগ এমন একটি সংস্কৃতি সৃষ্টি করা যেখানে এই বিশ হাজার কর্মীর প্রত্যেকেই একে অপরকে সাহায্য করার জন্য কাজ করে। পাশাপাশি সবার মাথায় যেন এটা থাকে কেউ এখানে শুধু টাকা রোজগারের জন্য কাজ করছে না। আমরা সবাই মানুষকে সাহায্য করার জন্য কাজ করছি”।
প্রতিটি বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই কাজ করে মানুষের জীবনকে আরও সহজ করার জন্য। আপনি যত পুঁজি নিয়েই নামেন না কেন, যত ভাল মার্কেটিং ক্যাম্পেইনই করেন না কেন, আপনার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মাঝে যদি সেবার মানসিকতা গড়ে তুলতে না পারেন, তবে তা কখনওই আমাজন, মাইক্রোসফট বা আলিবাবা হয়ে উঠতে পারবে না।
একটি প্রতিষ্ঠানের সেরা কাজটি বের করে আনার জন্য আপনার কর্মীদের মাঝে অবশ্যই পরস্পরকে সাহায্য করার মানসিকতা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। নাহলে ‘টিম ওয়ার্ক’ এর সুফল আপনি কখনওই পাবেন না। আর টিমের মধ্যকার এই সেবার মনোভাব শুধু টিমের মাঝে থাকলেই চলবে না। গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করাটা প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতিতে পরিনত করতে পারলেই শুধুমাত্র সুবিশাল সাফল্য আপনার হাতে ধরা দেবে।
৪. খোঁচা, অপমান, ইত্যাদি গায়ে মাখা যাবে না
যেই কনফারেন্সে জ্যাক তাঁর প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন, সেই একই কনফারেন্সে তিনি বলেছিলেন: “আমার আলি-পে (Alipay) এর আইডিয়া শুনে বেশিরভাগ মানুষই বলেছিল ‘এটা আজ পর্যন্ত তোমার মাথায় আসা সবচেয়ে ফালতু আইডিয়া’। – আমি বলেছিলাম, যদি মানুষ এটা ব্যবহার করে, তাহলে এটা ফালতু না দারুন – এই বিষয়ে আমার কোনও মাথা ব্যাথা নেই। আর এখন আশি কোটি মানুষ (সেই ফালতু) আলি-পে ব্যবহার করছে”।
আপনার কোন আইডিয়াটি কাজ করবে আর করবে না, তা আপনার থেকে ভাল আর কেউ জানে না। একটি নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে গেলে নানান জনে নানান কথা বলবে। আপনাকে খোঁচা দেবে, অপমান করবে। আপনি যদি একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখেন, তো দেখবেন, যেসব মানুষ নতুন কোনও আইডিয়া নিয়ে উপহাস করে – তারা আসলে নিজেদের জীবনে তেমন কিছু করতে পারেনি। আপনি কেন এমন সব মানুষের কথা গায়ে মাখবেন যারা কিনা আপনার সাফল্যের চিন্তার গভীরতাও ধরতে পারে না। যারা নিজেরা কখনওই বড়কিছু করার স্বপ্ন পর্যন্ত দেখে না। এমন মানুষদের কটু কথায় দমে না গিয়ে নিজের কাজটি করে যান, সব ক্ষেত্রে সফল না হলেও নতুন কিছু নিশ্চই শিখতে পারবেন।
০৫. সব সময়ে শেখার আর অনুপ্রাণিত হওয়ার চেষ্টা করুন
কোন কোন বিষয় থেকে তিনি শেখেন, এমন প্রশ্নের জবাবে আলিবাবা ফাউন্ডার বলেছিলেন: “আমি সিনেমা থেকে অনেক কিছু শেখেছি। আমি হুইটনি হিউসটনের ‘বডিগার্ড’ সিনেমা থেকে শিখেছি কিভাবে স্পিচ দিতে হয়। তিনি যখন তাঁর গান গুলো গাইছিলেন, আমি তার দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলাম ‘বাহ, এভাবেই ভাষণ দেয়া উচিৎ। কিভাবে স্পিচ বা ভাষণ দেয় – আমার তা জানা ছিল না। সিনেমা দেখার সময়ে আমার মনে হয়েছিল, কেউ যদি হৃদয় থেকে গান করে, যদি সে সত্যিকার ভাবে নিজেকে তুলে ধরে – তাহলেই এমনটা সম্ভব। এটা ভাষণ দেয়ার সময়েও কাজে লাগতে পারে। – আমি ‘গডফাদার’ সিনেমা থেকে শিখেছি। আমার সবচেয়ে পছন্দের সিনেমা ‘ফরেস্ট গাম্প” – এই সিনেমার থেকেও অনেককিছু শেখার আছে।, অনুপ্রাণিত হওয়ার আছে”।
সত্যিকথা বলতে আপনার যদি শেখার আর অনুপ্রেরণা নেয়ার মত মানসিকতা থাকে, তবে আপনি সবকিছুর মাঝেই শেখার মত, অনুপ্রাণিত হওয়ার মত কিছু না কিছু খুঁজে পাবেন। সিনেমা, বই, কোনও ঘটনা, অভিজ্ঞতা – এসব কিছুর মাঝেই আমাদের জন্য শিক্ষা আর অনুপ্রেরণা আছে। এগুলো যারা সঠিক ভাবে বুঝতে পারে ও তার থেকে নিতে পারে, তারাই সফল হয়।
০৬. নিজের লক্ষ্যে অটল থাকুন (না বলতে শিখুন)
আলিবাবা গ্রুপের ১৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে Bloomberg News এর একজন সাংবাদিক জ্যাক মা কে প্রশ্ন করেছিলেন “আলিবাবা অনেক ধরনের ব্যবসার সাথে জড়িত। আমার কৌতুহল হয়, কোনও ধরনের ব্যবসার আইডিয়াকে আপনি কখনও না বলেছেন?”
জ্যাকের উত্তর ছিল: “আমি অনেক আইডিয়াকেই প্রতিনিয়ত না বলছি। কারন একজন সিইও হিসেবে আমার অনেক সুযোগকেই না বলতে হবে। যদি আমি হ্যাঁ বলতে থাকি, তাহলে কমপক্ষে প্রতিদিন আমার সামনে ৫০০০ নতুন সুযোগ আসবে। আপনি হ্যাঁ বলুন আর না বলুন, সব ক্ষেত্রেই তা যেন আপনার মিশনকে ভিত্তি করে হয়। আপনার মূল লক্ষ্য অর্জনের পক্ষে যদি সেটি সহায়ক হয়, তবে হ্যাঁ বলুন, অন্যথায় না। যদি আপনার কাছে এসে বলে ‘আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে, যাতে করে আপনি প্রচুর টাকা বানাতে পারবেন’ – (যদি সেটা আমার মূল লক্ষের পক্ষে সহায়ক না হয়) তাতে আমার কোনও আগ্রহ থাকবে না”।
কথায় বলে দুই নৌকায় পা দিলে পানিতে পড়তে হয়। আপনি যদি একই সাথে একাধিক লক্ষ্যের পেছনে ছুটতে যান, সবগুলোতেই ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। জ্যাক মা’র ভাষ্যমতে, আপনি যখন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন, তখন আপনার সামনে অন্য যত বড় সুযোগই আসুক না কেন, আপনাকে না বলার মানসিক দৃঢ়তা দেখাতে হবে। লক্ষ্যের থেকে কোনওভাবেই সরা যাবে না। আপনি হয়তো কৌশল বদলাতে পারেন, কিন্তু লক্ষ্য নয়। একটি লক্ষ্য অর্জন করতে নানান ব্যর্থতা আপনার সামনে আসতে পারে, কিন্তু সেই ব্যর্থতার জন্য লক্ষ্য পরিবর্তন না করে কৌশল পরিবর্তন করুন। আপনার সামনে যত বড় সুযোগই আসুক না কেন, তা যদি আপনার লক্ষ্যের সাথে সম্পর্কিত না হয়, তাহলে তাকে না বলুন। লক্ষ্য ঠিক রেখে কাজ করে যান।
০৭. আপনার প্রতিষ্ঠানের ভাল একটি নাম দিন
১ ও ৪ নম্বর পয়েন্টের কথাগুলো যেই কনফারেন্সে বলেছিলেন, সেই একই কনফারেন্সে জ্যাক মা’কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি কেন তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম আলিবাবা দিয়েছিলেন?
জ্যাক মা’র উত্তর ছিল: “আমরা যখন শুরু করি, তখন আমার মনে ভাবনা এসেছিল, যেহেতু ইন্টারনেট একটি বৈশ্বিক বা আন্তর্জাতিক বিষয়, আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামটিও বৈশ্বিক হওয়া উচিৎ, সেই সাথে এমন হওয়া উচিৎ যা মানুষের মাঝে আগ্রহের সৃষ্টি করে। সেই সময়ে সেরা নামটি ছিল Yahoo – আমি বহুদিন ধরে চেষ্টা করছিলাম এমন একটি নাম খুঁজে বের করার। তারপর হঠাৎ করেই মনেহয় আলিবাবা একটি ভাল নাম হতে পারে। সৌভাগ্যবশত, আমার মাথায় যখন চিন্তাটি আসে, আমি তখন সানফ্রান্সিস্কোর একটি রেস্তোরায় লাঞ্চ করছিলাম। ওয়েট্রিস যখন আমাকে খাবার দিতে আসল, আমি তাকে প্রশ্ন করলাম সে আলিবাবাকে চেনে কিনা। সে বলল হ্যাঁ। আমি আবার বললাম, আলিবাবা কি? – সে বলল “চিচিং ফাক”! – দারুন! এরপর আমি রাস্তায় বের হয়ে বিশজনের মত মানুষকে আলিবাবা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তাদের সবাই আলিবাবা, চল্লিশ চোর, গুপ্তধনের গুহা – সবকিছুই জানে। আমি ভাবলাম, এটা খুবই ভাল একটা নাম হতে পারে। প্রায় সবাই একবারে বুঝতে ও মনে রাখতে পারবে, সেইসাথে এটা A দিয়ে শুরু হয়”।
আমরা অনেক ব্যবসাকেই দেখি খুব রাশভারী নাম দিতে গিয়ে এমন নাম দিয়ে ফেলে যা মানুষ বুঝতেও পারে না, মনেও রাখতে পারে না। একটি প্রতিষ্ঠান – বিশেষ করে যেটি সাধারন মানুষের কাছাকাছি থেকে কাজ করবে, এর নামটা সহজ ও মনেরাখার মত হওয়া উচিৎ। একটি ভাল নামের কারনে একটি প্রতিষ্ঠান অনেক বেশি পরিচিতি লাভ করতে পারে। জ্যাক মা শুধুমাত্র তাঁর নিজের পছন্দের ওপর ভরসা করেননি। নামটি মাথায় আসার সাথেসাথে তিনি ওয়েট্রিস সহ রাস্তার বেশকিছু মানুষকে দিয়ে ব্যাপারটা যাচাই করেছেন। নাম দেয়ার সময়ে জ্যাক মা’র মাথায় ছিল সেটা মানুষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে।
০৮. সব সময়ে ক্রেতা বা কাস্টোমারদের প্রাধান্য দিতে হবে
এক টিভি সাক্ষাৎকারে জ্যাক মা বলেছিলেন: “আমাদের কোম্পানীর নীতি হল ক্রেতারা এক নম্বরে, দুই নম্বরে কর্মীরা, তিন নম্বরে শেয়ার হোল্ডাররা। এটা বলতে পারেন আমার ‘ধর্ম’। ক্রেতারাই কিন্তু আমাদের টাকা দেয়। কর্মীরা কোম্পানীকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যখন আমরা আইপিও ছাড়লাম, বহু মানুষ এসে আমাকে বলেছিল, ‘জ্যাক আমাদের কিছু শেয়ার দাও, আমরা বহুদিন ধরে এর সাথে জড়িত আছি’। যখনই সমস্যা আসলো, সত্যি বলতে, তারা দৌড়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু আমার কর্মীরা আমার সাথে ছিল, আমার ক্রেতারা আমার সাথে ছিল।”
আপনি যখন একটি পন্য বা সেবা নিয়ে বাজারে নামবেন, আপনাকে মনে রাখতে হবে সেগুলো কারা কিনবে। কাদের কাছ থেকে আপনার লাভ আসবে। এইসব মানুষদের ঠিকমত দেখভাল না করতে পারলে আপনি কখনওই আপনার ব্যবসা ধরে রাখতে পারবেন না। কাজেই ক্রেতাদের যতটা সম্ভব সুযোগসুবিধা দেয়া উচিৎ। সেইসাথে তাঁদের সব রকমের অভিযোগ ও প্রত্যাশাকে গুরুত্বের সাথে দেখা উচিৎ।
০৯. অভিযোগ করার বদলে সুযোগ খুঁজে নিন
Asia Game Changer ইভেন্ট এ জ্যাক মা তরুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন:
“ব্যবসার সুযোগ কোথায় – এই নিয়ে অনেকেই অভিযোগ করেন। তাঁদের কথা হলো, ব্যবসার সুযোগ তাঁরা পান না। কিছু মানুষ অভিযোগ করতে থাকে, আর কিছু মানুষ নিজেদের ও অন্যদের পরিবর্তন করতে শুরু করে। সত্যি কথা বলতে যেখানেই অভিযোগ, সেখানেই সুযোগ। সমস্যা যেখানে, ব্যবসার সুযোগও সেখানে। আমি সব সময়েই এটা বিশ্বাস করেছি”।
সেরা পন্য কোনগুলো? – যেগুলো মানুষের সমস্যাগুলো সবথেকে ভালভাবে সমাধান করে। যারা মানুষের জন্য সেরা সমাধানটি দিতে পারে, মানুষ তাদের কাছেই যায়। কোনও কোনও সময়ে দেখা যায় যে একই পন্য ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানীর লেবেলে ভিন্ন ভিন্ন দামে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু মানুষ বেশি টাকা খরচ করে অনেক সময়েই বেশি দামের পন্যটি কেনে। এর কারন বেশি দামে হলেও পন্যটি সবথেকে ভালভাবে মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারছে। জ্যাক মা’র মতে একজন নতুন উদ্যোক্তাকে ছোট ছোট সমস্যা খুঁজে বের করে তার সমাধান করতে হবে। সে যখন সেরা সমাধানটি দিতে পারবে, তার কাছে মানুষ এমনিতেই আসবে। ছোট বড় সব সমস্যার মাঝেই আসলে ব্যবসার সুযোগ লুকিয়ে আছে। সত্যিকারের উদ্যোক্তারা সেই সমস্যা গুলো দেখতে পান, এবং দেখে সবার মত অভিযোগ অনুযোগ না করে, সেই সমস্যা সমাধানের উপায় বের করার চেষ্টা করেন। এবং তার ওপরেই নিজের ব্যবসার সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।
১০. কাজের প্রতি নিবেদিত থাকুন
এখন আপনি যা পড়তে যাচ্ছেন, তা হল ১৯৯৯ সালে আলিবাবার প্রতিষ্ঠালগ্নে তাঁর টিমের উদ্দেশ্যে দেয়া স্পিচ:
“আজ আমরা এখানে এক হয়েছি আমাদের আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে আমাদের কি করতে হবে, তা নিয়ে আলোচনা করতে। আলিবাবার ভবিষ্যৎ কি হতে যাচ্ছে? যখন থেকেই আমরা চীনা ভাষার ওয়েবপেজটি নিয়ে কাজ শুরু করেছি, আমি বলে এসেছি, দেশীয় ওয়েবসাইটগুলো কিন্তু আমাদের প্রতিযোগী নয়। আমাদের প্রতিযোগীতা আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটগুলোর সাথে। আমাদের প্রতিযোগীরা চীনে নেই; আছে আমেরিকার সিলিকন ভ্যালিতে। সেই কারনে আমাদের প্রথম কাজ হলো, আলিবাবাকে শুধুমাত্র চীনে সীমাবদ্ধ না রাখা। একে একটি আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
দ্বিতীয়ত, সিলিকন ভ্যালির কঠোর পরিশ্রমী সত্ত্বা আমাদের মাঝেও জাগিয়ে তুলতে হবে। আমরা যদি সকাল আটটায় অফিস শুরু করে বিকাল পাঁচটায় বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে যাই, তবে এটা কোনও হাইটেক কোম্পানী নয়। এভাবে চললে আলিবাবা কখনওই সাফল্যের মুখ দেখবে না। আমরা যদি সেই ৮টা-৫টার মনোভাব নিয়ে এখানে আসি, তাহলে আমাদের উচিৎ এখান থেকে বের হয়ে গিয়ে অন্যকিছু করা। আমেরিকানরা তাদের যন্ত্রপাতি আর প্রযুক্তিতে শক্তিশালী। কিন্তু তথ্য আর সফটঅয়্যারে চীনা মগজ তাদের মতই শক্তিশালী। আর এই কারনেই আমরা আমেরিকানদের সাথে প্রতিযোগীতা করার সাহস করতে পারছি। আমরা যদি একটি ভাল টিম হয়ে উঠতে পারি, আর আমরা কি করতে চাই তা ভালভাবে হৃদয়ে গাঁথা থাকে, আমাদের এক একজন ওদের দশজনকে হারিয়ে দিতে পারবে। আমরা সরকারী সংস্থা আর বড় বড় বিখ্যাত কোম্পানীগুলোকে পরাজিত করতে পারব, আমাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর উদ্ভাবক সত্ত্বা দিয়ে। তা না করতে পারলে আমাদের সাথে সাধারণের পার্থক্য কোথায়?
সবাই জানে ইন্টারনেট এমন একটি বেলুন যা ক্রমে বড় থেকে বড় হচ্ছে। কে জানে কখন এটি ফাটবে? ইয়াহুর স্টক পড়ে যাবে, এবং eBay এর স্টক বেড়ে যাবে। এবং হতে পারে ইবের স্টকের সাথে আলিবাবার স্টকও বেড়ে গেল। কাজেই ভয়ের কিছু নেই। ইন্টারনেটের স্বপ্নের বেলুন এত সহসা ফাটবে না। আগামী তিন থেকে পাঁচ বছর আমাদের ভয়াবহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এটাই আমাদের সফল হওয়ার একমাত্র পথ। এখন আমাদের গোল হচ্ছে ২০০২ এর ভেতর আলিবাবা আইপিও (শেয়ার) ছাড়বে”।
এই বিশাল স্পিচের মাঝে একটিই কথা উঠে এসেছে। আশা ও বিশ্বাস রাখতে হবে যে আপনার স্বপ্ন সফল হবে। এবং নিজের পুরোটা দিয়ে সেই স্বপ্নকে বাস্তব করার পেছনে কাজ করে যেতে হবে। কোনও বাধাকে ভয় পাওয়া যাবে না। মাত্র বিশ হাজার ডলার নিয়ে শুরু করা কোম্পানীর প্রথম দিককার মিটিংএ একজন মানুষ কতটা বিশ্বাস আর সাহস থাকলে একজন মানুষ সিলিকন ভ্যালী, সরকার, ও বড় বড় বিখ্যাত কোম্পানীর সাথে প্রতিযোগীতার কথা বলতে পারেন। কোম্পানী যত ছোটই হোক বিশ্বাস রাখতে হবে যে একদিন তা বিশ্বের সবথেকে বড় কোম্পানীর একটি হবে। জ্যাক মা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। স্বপ্ন যত বড়ই হোক বিশ্বাস আর কাজের প্রতি নিবেদন যে কোনও অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে।
পরিশিষ্ট:
জ্যাক মা এমন একটি অবস্থা থেকে আজকের অবস্থানে উঠে এসেছেন, যা কল্পনা করতে গেলেও আমাদের অনেকের মাথা খারাপ হয়ে যাবে। তাঁর একমাত্র অস্ত্র ছিল তাঁর মেধা আর সাহস। এই গুন আমাদের সবার মাঝেই আছে। শুধু প্রয়োজন একটু বিশ্বাস আর প্রচেষ্টা। কে জানে হয়তো আগামি দিনের জ্যাক মা আপনার মাঝেই সুপ্ত আছে। কাজেই নিজের স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যান, বিশ্বাস রাখুন। বিশ্বাস রাখুন নিজের ওপর, বিশ্বাস রাখুন নিজের মেধার ওপর, বিশ্বাস রাখুন সৃষ্টিকর্তার ওপর। কোনও স্বপ্নের পেছনে নিজের পুরোটা দিয়ে চেষ্টা করে গেলে তিনি কাউকে নিরাশ করেন না।
লেখাটি ভাল লাগলে লাইক ও শেয়ার করুন। আপনার যে কোনও মতামত আমাদের কমেন্টের মাধ্যমে জানান। সাফল্যের পথে প্রতিটি পদক্ষেপে লড়াকু আপনার সাথে আছে, আপনিও আমাদের সাথে থাকুন।