সেলস টেকনিক বা বিক্রয় কৌশল যে যত ভালো জানে, উদ্যোক্তা হিসেবে তার সফল হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। একজন নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের আইডিয়া, প্রোডাক্ট ও সার্ভিসকে ক্রেতা, ইনভেস্টর ও সাধারণ জনগনের কাছে গ্রহণ যোগ্য করে তুলে নিজের ব্র্যান্ড বা ব্যবসাকে সফল করাই মূলত একটি ভালো সেলস টেকনিক এর কাজ।
যদি কোনও উদ্যোক্তাকে সফল হতে হয়, তবে তার প্রথমে কিছুদিন সেলস পার্সন হিসেবে কাজ করা উচিৎ। একজন মানুষ যখন বিক্রয় কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করে – তখন সে বেশ কয়েকটি শিক্ষা পায় – যা সারা জীবন তার কাজে লাগে।
সেলস পার্সন বা বিক্রয় কর্মী হিসেবে কাজ করার ফলে একজন মানুষ না- শুনতে অভ্যস্ত হয়। সেইসাথে না-কে হ্যাঁ বানানোর কৌশল তাকে রপ্ত করতে হয়। নিজের ইগো বিসর্জন দেয়া শিখতে হয়। একজন বিক্রয় কর্মী খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারে, সফল হতে গেলে তাকে সব সময়ে শিখতে হবে। সে বুঝতে পারে তার দুর্বলতা কোথায়, এবং ঠিক কোন কোন জায়গায় তাকে উন্নতি করতে হবে। এইসব গুণ একজন নতুন উদ্যোক্তার সাফল্যের অন্যতম শর্ত।
সাবেক ডিভিশন ১ কলেজ ফুটবল প্লেয়ার, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, ডেভিস এর স্কলার-এ্যাথলেট ব্রায়ান ফোর্ড পড়াশুনা করা অবস্থাতেই ২ বছর মেডিকেল ডিভাইস সেলস কনসালটেন্ট হিসেবে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। পরবর্তীতে সিলিকন ভ্যালির কয়েকটি উদ্যোগে মার্কেটিং ও সেলস এ্যাডভাইজার ও ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন। এ্যামাজন এ্যালেক্সার টপ রেটেড “Self Improvement Daily” প্যাকেজ এর ফাউন্ডারও তিনি।
সিলিকন ভ্যালি ও মেডিকেল সেক্টরে একজন বিক্রয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে দারুন সাফল্যের সাথে কাজ করার পেছনে তিনি তাঁর সেলস টেকনিক কে কৃতিত্ব দেন। এই টেকনিক শেয়ার করতে গিয়ে তিনি খুব সাধারণ কিছু টিপস দিয়েছেন – যেগুলো যে কোনও নতুন উদ্যোক্তা সহজে বুঝতে ও কাজে লাগাতে পারবেন।
তিনি বলেন “এই শিক্ষাগুলো আমি ভুল করতে করতে অর্জন করেছি, এবং শেষ পর্যন্ত এগুলো আমাকে সঠিক পথে আসতে সাহায্য করেছে। আমি মোট ৫টি সিম্পল কিন্তু কার্যকর টেকনিক এর দেখা পেয়েছি যেগুলো আমাকে বাধা বিপত্তি পার হয়ে সত্যিকার কাজ করতে সাহায্য করেছে”
চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক ব্রায়ান ফোর্ড এর ৩টি শিক্ষা বা সেলস টেকনিক গুলো।
সেলস টেকনিক সমূহ:
০১. মেনে নিন, শিক্ষা থাকলেই পারফর্ম করা যায় না
বেশিরভাগ তরুণের মত ব্রায়ানও ভেবেছিলেন তিনি কাজে নেমেই পৃথিবী জয় করে ফেলবেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল কলেজ থেকে তিনি যা শিখেছেন – সেগুলো কাজে লাগিয়েই তিনি চূড়ান্ত সফল হবেন। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে পারলেন – একাডেমিক স্কিল আর বাস্তব কাজের মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে। একাডেমিক ভাবে অন্যের বলে দেয়া পথে ঠিকমত চললেই সাফল্য আসে – কিন্তু বাস্তব কাজের ক্ষেত্রে নিজেকে অনেক বেশি সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং সমস্যার সমাধান বের করতে হয়।
গতানুগতিক শিক্ষা আপনাকে বিভিন্ন ধরনের চিন্তা ও জ্ঞানের সাথে পরিচিত করায় – যেটা অবশ্যই বাস্তব জীবনে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে – কিন্তু শুধুমাত্র একাডেমিক যোগ্যতার শক্তিতে যদি কেউ কর্মক্ষেত্রে বড় হতে চায় – তবে খুব শিঘ্রই বোঝা যায়, সেটা যথেষ্ঠ নয়। ছাত্র অবস্থায় সবকিছু একটা ছকে বাঁধা থাকে, সেই ছক মেনে পরীক্ষা দিলেই মার্ক আসে – কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে – বিশেষ করে সেলস এবং মার্কেটিং এ কোনওকিছুই আগে থেকে বলে দেয়া যায় না।
একজন সেলস পার্সন বা বিক্রয় কর্মীর সাফল্য প্রাথমিক ভাবে মাপা হয় তার বিক্রয়ের পরিমান দিয়ে – যেটা খুবই অনিশ্চয়তাপূর্ণ একটি ব্যাপার। আপনি হয়তো মার্কেটিং এর ক্লাসে সব সময়ে ভালো করে এসেছেন, কিন্তু সত্যি সত্যি যখন ক্রেতা বা ক্লায়েন্ট এর কাছে কিছু বিক্রি করতে যাবেন – তখন সেটা বইয়ের থিউরিতে না পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। একজন মানুষ কিছু কিনবে কি কিনবে না – সেটা অনেকটাই তার মুডের ওপর নির্ভর করে। মানুষ কি মুডে আছে, এবং কোন মুডে থাকলে কি বলতে হবে – এগুলো বুঝতে অভিজ্ঞতার দরকার হয়।
একাডেমিক শিক্ষার সাথে যখন প্রাকটিক্যাল অবস্থা মেলে না, তখন অনেক তরুণ বিক্রেতাই নার্ভাস হয়ে যান – কিংবা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। প্রথম কয়েকবার ব্যর্থ হওয়ার পরই তারা ধরে নেন, তাদের দিয়ে সেলস হবে না – তাদের অন্যকিছু করা উচিৎ।
তবে ব্রায়ান ফোর্ড বলেন – এই অবস্থায় আত্মবিশ্বান না হারিয়ে সমস্যাটা ধরার চেষ্টা করতে হবে। আসলে একাডেমিক পড়াশুনা শেষ হওয়ার পরই মানুষের সত্যিকার শিক্ষা শুরু হয়। যেখানে নিজেরটা নিজের করে নিতে হয়, অন্যের দায়িত্ব নিতে হয়। – এসব ক্ষেত্রে পথমেই সত্যিটা মেনে নিতে হবে। একাডেমিক পারফরমেন্স এবং বাস্তব জীবনে পারফরমেন্সে পার্থক্য থাকবেই।
এক্ষেত্রে ব্রায়ান যে সেলস টেকনিকটি ব্যবহার করতেন, সেটি হল ‘রোল–প্লেয়িং’। সোজা বাংলায় অভিনয় করা। একাডেমিক ভাবে আপনি যতই ভালো করেন না কেন – আপনাকে ধরে নিতে হবে আপনি কিছুই জানেন না, কিন্তু চেষ্টা করলে পারবেন, এবং প্রতিটি বাস্তব পরিস্থিতি থেকেই কিছু না কিছু শিখবেন।
প্রয়োজনে কমিশনের ভিত্তিতে যেসব কোম্পানীতে চাইলেই বিক্রয় কর্মী পদে ঢোকা যায় – সেইসব প্রতিষ্ঠানে ঢুকে তাদের পন্য বিক্রি করার চেষ্টা করতে হবে। – ধীরে ধীরে আপনি নিজেই নিজের ভুলগুলো ধরতে পারবেন এবং মানুষের সাথে পন্য ও সেবা নিয়ে কথা বলা এবং তাদের মুড বুঝে তাদের ‘পটানোর’ বিষয়টা বুঝতে থাকবেন।
যে কোনও মুডের মানুষের কাছেই আপনি পন্য বিক্রি করতে পারবেন – আপনাকে শুধু তার মুড বুঝে সেই অনুযায়ী কথা বলতে হবে। আপনার জানা থিওরির সাথে না মিললেও ঘাবড়াবেন না। অন্য ভাবে চেষ্টা করুন। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের আচরণ বদলান। এভাবে একের পর এক চেষ্টাই আপনাকে অভিজ্ঞ একজন সেলস পার্সন করে তুলবে।
০২. কাস্টোমারের দিক থেকে চিন্তা করা শিখুন
সেলস টেকনিক রপ্ত করার সবচেয়ে মৌলিক একটি বিষয় হল কাস্টোমারের লেভেলে নিজেকে নিয়ে যেতে পারা।
একটা উদাহরণ দেয়া যাক, তরুণ বিক্রয় কর্মী বা উদ্যোক্তারা অনেক সময়েই কাস্টোমার বা সম্ভাব্য ইনভেস্টরের সামনে টেকনোলজিক্যাল প্রেজেন্টেশন দিতে পছন্দ করেন। ট্যাব, ল্যাপটপ, অথবা প্রজেক্টরে জটিল জটিল গ্রাফ, চার্ট, পন্য বা সেবার ডেমো বা ইফোগ্রাফিক দেখিয়ে কাস্টোমার বা সম্ভাব্য ইনভেস্টরকে ইমপ্রেস করতে চান।
কিন্তু তাঁরা অনেক সময়েই চিন্তা করেন না – যার সামনে প্রেজেন্টেশন দিচ্ছেন – তিনি টেকনোলজি কতটা বোঝেন? তিনি হয়তো টেকনোলজি আর গ্রাফের বহর দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন, কিন্তু আপনার কথা পুরোপুরি বুঝতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে। হয়তো একারণেই আপনার পন্য বিক্রী হবে না, অথবা ইনভেস্টমেন্ট পাবেন না।
তরুণ উদ্যোক্তারা অনেক সময়েই এই ভুলটা করেন। তাঁদের যদি কেউ পরামর্শ দেয় যে, এসব টেকনোলজি অনেকে বোঝে না, কাজেই পদ্ধতি বদলানো দরকার; তখন অনেকেরই জবাব হয় – “আমি কেন বদলাবো? টেকনোলজির যুগে তাদেরই বদলানো উচিৎ”
– সেটা হয়তো উচিৎ কিন্তু, ব্যবসা করতে গেলে এই ধরনের আবেগ বা ইগো দূরে রাখতে হবে। না হলে দিন শেষে আপনি নিজেই ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।
এসব ক্ষেত্রে আপনি যে সেলস টেকনিক কাজে লাগাতে পারেন – ব্রায়ানের ভাষায় সেটা “Be old-fashioned”
তিনি বলেন, “যদি কাস্টোমারকে দেখে মনে হয় সে টেকনোলজির ব্যাপারে ততটা পারদর্শী নয়, আমি তখন কাগজ-কলমে চলে যাই। তার সামনে কাগজ কলমে লিখে বিষয়গুলো বোঝাই। এটা অনেক বেশি কার্যকর।”
আবার মার্কেট অনুযায়ী কিছু কাস্টোমার হয়তো জিন্স টি-শার্ট পরা তরুণ সেলস পার্সন বা উদ্যোক্তাদের পছন্দ করে। কেউ আবার স্যুট পরা ট্রাডিশনাল লুক পছন্দ করে। যে যেটাই পছন্দ করুক – আপনি সেই রূপ নিয়ে তার সামনে যান। আপনার আইডিয়া বা পন্য বিক্রির সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে।
এছাড়া, একজন ক্রেতা বা ইনভেস্টর ঠিক কি চাইছেন – এটা বুঝে সেই দিকে কথা ঘুরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করুন। আপনি কি চাইছেন – সেটা আপাতত গুরুত্বহীন। ক্রেতার বা ইনভেস্টরের চাওয়াটি কিভাবে আপনার পন্য বা আইডিয়া দিয়ে পূরণ করা যাবে – তা নিয়ে কথা বলুন।
ব্রায়ান বলেন – “একজন স্মার্ট সেলস পার্সন ক্রেতার ইমোশনকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেন”
মার্কেটিং এক্সপার্ট রয় বার্টেল এর একটি উক্তি তিনি এক্ষেত্রে মনে রাখতে বলেন: “বেশিরভাগ মানুষ মনে করে বিক্রী করা মানে কথা বলা। কিন্তু সেরা সেলস পার্সনরা জানে অন্যের কথা শোনা হল এই কাজের সবচেয়ে জরুরী অংশ”
অন্যের দৃষ্টিভঙ্গী বুঝে তাকে আপনার পথে চালিত করার কৌশল সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে “হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস এ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপল বুক রিভিউ” পড়তে পারেন।
০৩. নতুন ট্রেন্ড ও টেকনোলজি সম্পর্কে ধারণা রাখুন
আপনাকে যেমন পুরনো দিনের ট্রেন্ড সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে – তেমনি নতুন টেকনোলজি ও ট্রেন্ড সম্পর্কেও আপডেট থাকতে হবে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সেলস টেকনিক হল মানুষের সাথে কথা বলার ও তাদের বোঝানোর ক্ষমতা। মানুষের সামনে কথা বলার সাহস ও ক্ষমতা থাকলেই শুধু হবে না, তাদের সাথে আলাপ জমাতে হবে। নতুন উদ্যোক্তা বা সেলস পার্সন হিসেবে কমিউনিটিতে সবার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে গেলে আপনাকে যে কোনও বিষয়ে আলোচনা করতে পারতে হবে – এবং নতুন টেকনোলজি ও ট্রেন্ড বর্তমানে আলাপ করার সবচেয়ে ভালো বিষয়। মানুষ বর্তমানে কি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা করছে, এবং বাজারে কি নতুন টেকনোলজি আসছে – এইসব বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর রাখুন।
এছাড়া, বর্তমানে সেলস বা মার্কেটিং এর জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বা ইন্টারনেট সবচেয়ে বড় মাধ্যম। আর এই মাধ্যমে ভালো করতে হলে নতুন টেকনোলজি ও ট্রেন্ড সম্পর্কে অবশ্যই ভালো ধারণা ও দক্ষতা থাকতে হবে।
পরিশিষ্ট:
ব্রায়ান ফোর্ড এর সেলস টেকনিক গুলোর মূল কথা হল, সব সময়ে নতুন জিনিস শিখতে হবে, এবং কাস্টোমারের মনোভাব বুঝে, সেই অনুযায়ী তার সাথে কথা বলতে হবে।
আসলে যে কোনও সফল কমিউনিকেশনের সবচেয়ে প্রধান বিষয় এগুলোই। নিজের বুদ্ধি আর ব্যক্তিত্বকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি এই সেলস টেকনিক গুলো অনুসরন করলে, নতুন উদ্যোক্তা বা সেলস পার্সন হিসেবে সাফল্যের পথে অনেকটাই এগিয়ে যাবেন।
পন্য বা সেবা বিক্রী অথবা ইনভেস্টরের সাথে ডিল করার বিষয়ে ব্রায়ানের পরামর্শগুলো যদি আপনাকে একটুও সাহায্য করে – তাহলেই আমাদের প্রচেষ্টা সফল।
লেখাটির বিষয়ে আপনার যে কোনও মতামত আমাদের কমেন্ট করে জানান। আপনার সব মতামতই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
লেখাটি ভালো লাগলে এই পোস্টের নিচে রেটিং দিয়ে অনুপ্রাণিত করুন। যদি কোনও বিশেষ বিষয় নিয়ে অনুপ্রেরণামূলক বা শিক্ষনীয় লেখা চান – তবে সেটাও কমেন্ট করে জানান। চাইলে নিজেও লিখে পাঠাতে পারেন write@test.edaning.com – ইমেইল এ।
আর যদি মনে হয় এই লেখাটি পড়ে অন্যরাও উপকৃত হবেন – তবে শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন।
প্রতিদিন অনুপ্রেরণামূলক লেখা ও টিপসের জন্য নিয়মিত আমাদের সাথে থাকুন। সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার সাথে আছে।