সৃষ্টিশীলতা কি? – অনেকেই মনে করেন, এটি একটি জটিল প্রশ্ন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে এটা তেমন জটিল কিছু নয়। আমরা অনেকেই ভাবি সৃষ্টিশীল মানুষ হতে হলে লেখালেখি, ছবি আঁকা, গান গাওয়া – ইত্যাদি শৈল্পিক গুণ থাকতে হয়। ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও সেরকম নয়। সৃষ্টিশীলতা হল যে কোনও ক্ষেত্রেই নতুন চিন্তা করার ক্ষমতা, নতুন আইডিয়া ভাবতে পারার ক্ষমতা। নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সমস্যার সমাধান বের করা। – এটা ঠিক, সৃষ্টিশীল মানুষেরা একটু অন্য ভাবে চিন্তা করেন – কিন্তু সেটা বেশিরভাগ সময়েই ভালো ফলাফল বয়ে আনে।
সৃষ্টিশীলতা কি?
আপনার মাঝে যদি সৃষ্টিশীলতা থাকে, তবে আপনি বিভিন্ন সমস্যার এমন সমাধান ভাবতে পারবেন – যা আগে কেউ ভাবতে পারেনি। ইংরেজীতে যাকে “out of the box” চিন্তা বলে – সেটি আসলে এই সৃষ্টিশীলতা বা creativity এর একটি প্রকাশ।
এইসব কথা শুনে, অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন। অনেকের মনে হয় তাদের মাঝে কোনও সৃষ্টিশীলতা নেই। বন্ধু বা আত্মীয়, বা পরিচিতদের মাঝে কিছু মানুষকে তাদের ‘সৃষ্টিশীল কাজের’ জন্য বাহবা পেতে দেখে আড়ালে এই ভেবে দু:খ করেন – “আমার মাঝে কেন এমন কোনও গুণ নেই?”
আসলে, সৃষ্টিশীল হতে হলে যে শৈল্পিক গুণই থাকতে হবে – এমন কোনও কথা নেই। প্রতিটি মানুষের মাঝেই সৃষ্টিশীলতা আছে। এক এক জনের সৃষ্টিশীলতা এক এক রকম। তবে পরিস্থিতি, শিক্ষা ব্যবস্থার এক মুখী ধরণ, পরিবারের চাপ – ইত্যাদি কারণে অনেকের সৃষ্টিশীল চিন্তার গুণটি নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু চর্চার মাধ্যমে এটা উদ্ধারও করা যায়।
সৃষ্টিশীলতার সংজ্ঞা:
ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ওয়েব সাইটে সৃস্টিশীলতা বিষয়ে রবার্ট ই. ফ্র্যাঙ্কলিন এর যে সংজ্ঞা দেয়া আছে তা অনুযায়ী, সৃষ্টিশীলতা হল সমস্যা সমাধান, যোগাযোগ, বিনোদন – ইত্যাদির জন্য নতুন ধরনের আইডিয়া চেনা ও সৃষ্টি করার ক্ষমতা। সৃষ্টিশীলতার বিষয়ে রবার্ট এর এই সংজ্ঞাটিকেই সবচেয়ে পারফেক্ট বলে ধরা হয়।
এছাড়া সৃষ্টিশীলতা বিষয়ক বিখ্যাত বই “Creativity – Flow and the Psychology of Discovery and Invention” বই সৃষ্টিশীল মানুষের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে:
“একজন মানুষ যখন কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কোনও আইডিয়া বা প্যাটার্ণ বের করে – এবং সেটা সেই বিষয়ের নতুন একটি অংশ হয়ে যায় – তখন সেই মানুষটিকে ক্রিয়েটিভ বা সৃষ্টিশীল বলা যায়”
অর্থাৎ, একজন মানুষ যখন তার কাজের ক্ষেত্রে নতুন কিছু উদ্ভাবন করে, অথবা কোনও বিষয়ের নতুন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা ভেবে বের করতে পারে – তাকে আমরা সৃষ্টিশীল মানুষ বলতে পারি। এখানে একটি ব্যাপার লক্ষ্য করুন – একদম শুণ্য থেকে কিছু সৃষ্টি করা মানে সৃষ্টিশীলতা নয়। এটা মানুষের পক্ষে সম্ভবও নয়। ইতোমধ্যেই আছে – এমন সব তথ্য, জ্ঞান ও উপাদানকে কাজে লাগিয়ে নতুন কোনও আইডিয়া, সমাধান বা বস্তু বানানোই আসলে সৃষ্টিশীলতা। পরিবেশ থেকে কিছু নিয়ে সেটাকে নতুন ভাবে তুলে ধরা ও ব্যবহার করাই সৃষ্টিশীলতা। – এই কাজটি যারা ভালো পারেন তারাই প্রকৃত সৃষ্টিশীল মানুষ।
আজ যে পেট্রোল দিয়ে যানবাহন বা যন্ত্রপাতি চলছে – তা লক্ষ লক্ষ বছর ধরেই পৃথিবীতে ছিল। এই বস্তুর নতুন একটি ব্যবহার বের করার জন্য কেউ একজন, বা একাধিক মানুষ চিন্তা করেছিল, এবং চিন্তা করতে করতে সমাধানে পৌঁছেছিল। আবার অন্য ভাবেও ব্যাপারটি দেখা যায়, ঘোড়ার গাড়িকে কিভাবে ঘোড়া ছাড়া চালানো যায় – তার উপায় ভাবতে ভাবতেই ইঞ্জিনের ধারণা মানুষের মাথায় এসেছিল। – দু’টোই সৃষ্টিশীল চিন্তা।
আজকের বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল লেখকদের একজন জর্জ আর আর মার্টিন। তাঁর রচিত “সং অব আইস এ্যান্ড ফায়ার” বুক সিরিজের গল্প থেকেই আজকের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি শো “গেম অব থ্রোনস” সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই জানেন না, তাঁর গল্পের অনেক উল্যেখযোগ্য ঘটনাই সত্যিকার ইতিহাস থেকে নেয়া হয়েছে। তিনি শুধু ঘটনাগুলো একটু পরিবর্তন করে তাঁর উপন্যাসগুলোতে দিয়ে দিয়েছেন।
হেলিকপ্টারের ধারণা প্রথম আসে ফড়িং থেকে। প্লেনের ধারণা আসে পাখি থেকে। ট্যাঙ্ক এর ধারণা এসেছিল গুবরে পোকা থেকে। – এরকম প্রায় সব কালজয়ী আবিষ্কার আর সৃষ্টি কর্মের মূল অনুপ্রেরণা ছিল বাস্তব জীবন আর প্রকৃতি।
আপেল তো অনেকের মাথায়ই পড়েছে, কিন্তু বিজ্ঞানী নিউটন এটার কারণ খুঁজের বের করার চেষ্টা করেছেন, এবং একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পেরেছেন – কারণ তিনি সৃষ্টিশীল ভাবে ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তা করেছেন।
সব ধরনের সৃষ্টিশীলতাই আসলে এমন – আলাদা আলাদা বিষয় ও বস্তুর দিকে একটু অন্য ভাবে তাকিয়ে নতুন কিছু খুঁজে বের করা।
মজার ব্যাপার হল, একজন মানুষ ভালো গান গাইলেই কিন্তু তাকে সৃষ্টিশীল বলা যাবে না। হয়তো তার গলা ভালো, সেইসাথে অনুশীলন করে সে গানের প্রতিভাকে ধারালো করেছে – কিন্তু সে যদি নিজের মত করে সুর ভাবতে না পারে, শেখানো বুলির বাইরে নিজের মত করে কিছু দিতে না পারে – তাকে সৃষ্টিশীল বলা যাবে না।
আবার একজন চিত্রশিল্পীও যদি শুধু দেখে দেখেই বিভিন্ন দৃশ্য ও ফিগার হুবহু আঁকে এবং নিজের ভেতর থেকে নতুন কিছু দিতে না পারে – সেই চিত্রশিল্পীকেও সৃষ্টিশীল বললে ভুল হবে। সৃষ্টিশীল মানুষদের কাজের মাঝে সব সময়েই একটা ইউনিক ছোঁয়া থাকে।
আশা করি সৃষ্টিশীলতার মূল ব্যপারটি আপনাকে বোঝাতে পেরেছি।
সাফল্য ও সৃষ্টিশীলতা
স্টিভ জবস, জ্যাক মা, বিল গেটস, জেফ বেজোস, রতন টাটা, জেকে রাউলিং, টমাস আলভা এডিসন – বা এই ধরণের প্রতিটি সফল মানুষের সাফল্যের মূলেই ছিল সৃষ্টিশীল চিন্তা।
তাঁরা কোনও না কোনও সমস্যার এমন সমাধান করেছিলেন – যেভাবে অন্য কেউ করতে পারেনি। কারণ তাঁরা অন্যদের চেয়ে আলাদা ভাবে চিন্তা করেছিলেন। ফোনে বাটন থাকলে তার স্ক্রীণ অনেক ছোট হত, এই সমস্যার সমাধানে স্টিভ জবস পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর সেই চিন্তাকে অনেকেই হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। যার মধ্যে অনেক বড় বড় টেক কোম্পানীর সিইওরাও ছিলেন।
শুধু এসব বিশ্ব বিখ্যাত সফল মানুষই নন, সব ক্ষেত্রের সেরা সফল মানুষের দিকে তাকালেই এই ব্যাপারটা দেখা যায়। তাঁরা অন্যদের চেয়ে আলাদা চিন্তা করেন, এবং যে সমস্যার সমাধান কেউ দেখছে না – তাঁরা সেই সমস্যার সমাধান করেন।
যে কোনও প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তার সবচেয়ে সেরা পারফর্মারদের কাজের ধরণ দেখুন, দেখবেন তাঁরা সবকিছু একটু অন্যভাবে দেখেন। সবাই যে সমাধান দিচ্ছে, তাঁরা সেগুলোর সাথে একটু অন্যরকম সমাধানও চিন্তা করেন। অথবা কোনও সমস্যার কারণ যখন অন্যরা ধরতে পারছে না – এই হাই পারফর্মার লোকগুলো যে কোনও সমস্যার সম্ভাব্য কারণ ভেবে ফেলেন। – এর কারণ, তাঁরা সৃষ্টিশীল পদ্ধতিতে চিন্তা করেন। আর এই সৃষ্টিশীলতাই তাঁদের সফল হওয়ার পেছনে অনেক বড় ভূমিকা রাখে।
বিশ্ব বিখ্যাত সেলফ ডেভেলপমেন্ট ম্যাগাজিন “লাইফহ্যাক” এর সিইও লিওন-হো এর মতে, একজন মানুষ যখন তার সৃষ্টিশীলতাকে ব্যবহার করা শিখে যায়, তখন অল্প কষ্টেই সে অনেক বেশি অর্জন করতে পারে।
শুধুমাত্র সৃষ্টিশীলতার কারণেই অনেকে ছোট পদে ঢুকে একটি কোম্পানীর প্রধান একটি পদে চলে যায়। রতন টাটার ঘটনা যার জীবন্ত উদাহরণ। সৃষ্টিশীলতার কারণেই একটি ছোট্ট আইডিয়া থেকে বিলিয়ন ডলার ব্যবসা দাঁড়িয়ে যায়। এর কারণেই একজন লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, বা এমনকি রাজনীতিবিদ ইতিহাসে অমর হন।
সৃষ্টিশীলতা কি অর্জন করা সম্ভব?
আসলে, এই প্রশ্নটাই করা উচিৎ নয়। প্রতিটি মানুষের মাঝেই সৃষ্টিশীলতা বা ক্রিয়েটিভিটি আছে। শুধু নিজের এই ক্ষমতাটি ঠিক কোন ক্ষেত্রে – তা খুঁজে বের করে এটার যত্ন নেয়া প্রয়োজন। সৃষ্টিশীল চিন্তাধারা সবার মাঝেই আছে, আমরা যাদের ‘সৃষ্টিশীল’ মানুষ বলি – তাঁরা শুধু এই চিন্তাধারাটির সদ্ব্যবহার করেন।
এই লেখার আগের সেকশন গুলোর বক্তব্য যদি ভালোমত পড়েন, তবে এতক্ষণে বুঝে গেছেন – সৃষ্টিশীলতা আসলে একটি দক্ষতা। এবং চর্চার মাধ্যমে যে কোনও দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব। এজন্য জিনিয়াস হয়ে জন্মানোর দরকার নেই।
সৃষ্টিশীলতার মূল ব্যাপারটি হল যে কোনও বিষয়কে এমন একটি দৃষ্টিতে দেখতে পারা – যা অন্য সবার চেয়ে আলাদা। এই একটি দক্ষতাই আপনাকে যে কোনও বিষয় বা ঘটনাকে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার করতে, এবং একটি সমস্যার বিভিন্ন রকম সমাধান বের করতে সাহায্য করবে।
বেস্ট সেলিং ‘হাউ টু থিংক লাইক দ্য ভিঞ্চি’ বইয়ের লেখক মাইকেল জে. গ্যাল্ব – যিনি তাঁর সারাটা জীবনই সর্বকালের সেরা সৃষ্টিশীল একজন মানুষ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে নিয়ে গবেষণা করেছেন – তাঁর মতে, ভিঞ্চির জিনিয়াস হওয়ার পেছনে যতটা না তাঁর জন্মগত প্রতিভার ভূমিকা ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল নির্দিষ্ট কিছু অভ্যাস চর্চা করার ভূমিকা।
চলুন, আমরাও এমন ৫টি অভ্যাসের কথা জেনে নিই, যা চর্চা করলে আপনার সৃষ্টিশীলতাও বহু গুণে বেড়ে যাবে:
০১. একটি বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের মতামত ও থিওরি জানার চেষ্টা করুন
আগেই বলেছি, সৃষ্টিশীলতার মূল বিষয়টিই হল একটি বিষয়ের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জেনে, ও বিভিন্ন দিক থেকে চিন্তা করে নতুন একটি দিক বা আইডিয়া খুঁজে পাওয়া।
এর জন্য আপনাকে বিষয়টি নিয়ে গভীর চিন্তা করতে হবে, এবং যত পারা যায় সেই বিষয় সম্পর্কে জানতে হবে। একটি বিষয় নিয়ে বিভিন্ন লেখকের বই পড়তে হবে। একটি মতবাদ নিয়ে বিভিন্ন লোকের মতামত জানতে হবে। এগুলো করলে যে কোনও বিষয়কেই বিভিন্ন দিক থেকে দেখার মত উপাদান আপনি পেয়ে যাবেন। এবং ধীরে ধীরে সেই বিষয়ে আপনার নিজের ইউনিক চিন্তা করার ক্ষমতাও বেড়ে যাবে।
০২. যে কোনও বিষয়কে বিভিন্ন দিক থেকে ভাবার চেষ্টা করুন (ক্রিয়েটিভ প্রসেস)
ধরুন আপনি একটি সমস্যায় পড়েছেন। চট করে সেই সমস্যার একটি সমাধান আপনার মাথায় চলে এল। কিন্তু সেই একটি সমাধান নিয়েই পড়ে থাকবেন না। আরও বিভিন্ন সমাধান ভাবার চেষ্টা করুন।
যদি অন্য মানুষের কাছে, বা বই থেকে কোনও সমাধান পান – তার পরও সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নিজের মত এক বা একাধিক সমাধান ভাবার চেষ্টা করুন।
এছাড়া কোনও সমস্যার প্রচলিত সমাধান, বা কোনও জিনিসের প্রচলিত ব্যবহার এর পাশাপাশি আরও কি নতুন উপায়ে এসব সমাধান করা যায়, বা নতুন কি কাজে একটি জিনিস ব্যবহার করা যায় – এগুলো চিন্তা করুন। এমন নয় যে আপনাকে ভালো কিছু বের করতেই হবে। শুধু চিন্তা করার ক্রিয়েটিভ প্রসেসটি চর্চা করতে থাকুন।
সবচেয়ে ভালো হয় নতুন নতুন ভাবনা ও আইডিয়াগুলো নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা করুন। এতে সৃষ্টিশীলতা আরও বাড়ে। – এই ধরনের চিন্তা ও পরীক্ষা নীরিক্ষা ক্রিয়েটিভ প্রসেস বা সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ার খুব জরুরী একটি অংশ।
এই ‘ক্রিয়েটিভ প্রসেস’ চর্চা করলে আপনার সৃষ্টিশীল চিন্তা করার ক্ষমতা ও অভ্যাস দু’টোই বেড়ে যাবে।
০৩. বিভিন্ন ঘটনা কেন ঘটছে – তা নিয়ে ‘গভীর’ চিন্তা করুন
বেশিরভাগ সময়েই আমরা কি ঘটছে, এবং ঘটার ফলে কি হচ্ছে – এগুলো নিয়ে চিন্তা করি। সৃষ্টিশীল চিন্তার একটি বড় দিক হল, ‘কি’ এর বদলে ‘কেন’ তে বেশি ফোকাস করা।
আপনি যদি কোনও নতুন কোনও আইডিয়া ভাবতে চান, তবে সেই বিষয়ের মূলে যেতে হবে। সেটি কিভাবে কাজ করে, এবং কেন এভাবে কাজ করে – তা জানতে হবে। তাহলেই আপনি নতুন ধরনের আইডিয়া সহজে ভাবতে পারবেন।
নিউটনের আপেলের গল্পে ফিরে যাই। অন্য লোকেরা যখন আপেল পড়তে দেখে ভেবেছে: ‘কি পড়েছে? – আপেল পড়েছে’, ‘আপেল দিয়ে কি হয়? – আপেল খেতে হয়’, ‘না খেলে কি হবে? – পঁচে যাবে’ । সাধারণ মানুষের চিন্তাধারা যখন এই ধরণের, নিউটন তখন ভেবেছেন আপেলটা কেন মাটিতে পড়লো? কেন তা আকাশে গেল না? – এবং এই চিন্তা থেকেই তিনি কালজয়ী মধ্যাকর্ষণ তত্ব আবিষ্কার করেন।
এই পয়েন্টের শিরোনামে ‘গভীর’ কথাটি বিশেষ করে চিহ্নিত করা আছে। কারণ এর বিশেষ গুরুত্ব আছে। শুধু ‘কেন’ ভিত্তিক ভাবনাই যথেষ্ঠ নয়। আপনাকে ‘কেন’ এর গভীরে যেতে হবে।
আপেল কেন গাছ থেকে মাটিতে পড়েছে – এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হল, আপেল পেকে গিয়ে বোঁটা থেকে খসে গেছে এবং আর সব ফলের মতই মাটিতে পড়েছে।
কিন্তু নিউটন এই সহজ উত্তরে সন্তুষ্ট থাকেননি। তিনি আরও গভীর ভাবে চিন্তা করেছেন – একদম গোড়ার কারণটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন।
আপনিও যদি আপনার সৃষ্টিশীলতা বাড়াতে চান – তবে আপনিও আপনার আগ্রহের বিষয়ের একদম গোড়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা করুন – তাহলেই নতুন কিছু উপহার দিতে পারবেন।
০৪. আবেগ ও যুক্তি – দু’টোকেই মূল্য দিন
থিংক লাইক দ্য ভিঞ্চি বইটি থেকে জানা যায়, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি প্রতিটি বিষয়ের শৈল্পিক বা আবেগীয় এবং যৌক্তিক বা লজিক্যাল – দুটো দিককেই প্রাধাণ্য দিতেন।
আপনি যদি কোনও বিষয়ের দু’টো দিক নিয়েই চিন্তা করেন – তবে অনেক কিছু আপনার চোখে ধরা দেবে – যা সাধারণ একপেশে চিন্তার মাধ্যমে সম্ভব নয়।
আমাদের মস্তিষ্কের দু’টো অংশ আছে। ডান ও বাম বলয়। বাম বলয় যৌক্তিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে, আর ডান বলয় সাধারণত আবেগীয় বিষয় নিয়ে কাজ করে। সৃষ্টিশীল কাজ ও চিন্তার জন্য অবশ্যই আপনার অনুভব করার ক্ষমতা ও বুদ্ধি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা – দু’টোকে একসাথে কাজে লাগাতে হবে।
এই দুই বলয়ের মাঝের অংশটির নাম “মিডিয়াল প্রিফন্টাল কটেক্স” – মানুষ যখন কোনও নতুন উদ্ভাবন বা সৃষ্টিশীল কাজ করে – তখন এই অংশটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর একে সক্রিয় করার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, যে কোনও বিষয়কে আবেগীয় এবং যৌক্তিক – দুই দিক থেকেই বিচার করা। মস্তিষ্কের দুই বলয় যখন একটি বিষয় নিয়ে কাজ করবে – তখন তার প্রভাবে তাদের মাঝে অংশটিও সক্রিয় হবে। যার ফলে আপনি সমস্যার সৃষ্টিশীল সমাধান এবং নতুন আইডিয়া বেশি করে ভাবতে পারবেন।
০৫. ভুল করার ভয় করবেন না
সৃষ্টিশীল হওয়ার একটি প্রধান শর্তই হল, ভুল করার ভয় করা যাবে না। সৃষ্টিশীল মানুষরা প্রচুর ভুল করেন – কিন্তু তাঁরা ভুল করার পরও চেষ্টা করে যান। বার বার ভুল করতে করতে একটি ভালো কিছু তাঁরা করতে পারেন।
একজন শিল্পীর মাস্টারপিসটির ফাইনাল কপি বের হওয়ার আগে শত শত, এমনকি হাজার হাজার ছবি নষ্ট হয়। নিজের ওপর রেগে শিল্পী দীর্ঘদিন ধরে আঁকা ছবি পুড়িয়ে ফেলেন। যে কোনও বড় লেখকের মূল পান্ডুলিপি ঘাঁটলে, সেখানে লেখার চেয়ে কাটাছেড়া বেশি দেখা যায়। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা হাবিজাবি লেখার পর হয়তো একটা কবিতা বা একটা গল্প মনের মত হয়। একজন সফল উদ্যোক্তার ১০টি উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর হয়তো একটি বা দু’টি উদ্যোগ সফল হয়। টমাস আলভা এডিসন বৈদ্যুতিক বাতির সফল পরীক্ষা চালাতে গিয়ে ১০০০০ বার ব্যর্থ হয়েছিলেন।
আপনার আইডিয়া শুনে মানুষ হাসাহাসি করুক, বা বাহবা দিক – এসব কেয়ার করবেন না। নিজের আইডিয়া অকপটে বলুন, এগুলো নিয়ে কাজ করুন।
সফল ভাবে সৃষ্টিশীল চিন্তা করতে হলে সবার আগে ভুল করার সাহস করুন। তাহলেই সত্যিকার সৃষ্টিশীল হতে পারবেন।
০৬. কল্পনা শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করুন
পৃথিবীর যত সৃষ্টিশীল মানুষ আছেন, তাঁদের সবার মাঝে সবচেয়ে বড় মিলটি হল, তাঁদের কল্পনা শক্তি অসাধারণ।
যে কোনও চিন্তা করে, সেই চিন্তার বাস্তব প্রভাব তাঁরা স্পষ্ট কল্পনা করতে পারেন। একটি সমস্যার বিভিন্ন বিকল্প সমাধানের প্রভাব স্পষ্ট ভাবে তাঁরা কল্পনা করতে পারেন। দু’টি বা তার বেশি বিষয় মিলিয়ে একটি বিষয় দাঁড় করালে – তা কেমন হবে – তাও তাঁরা খুব পরিস্কার ভাবে কল্পনা করতে পারেন।
একজন বিজ্ঞানী যেমন গবেষণার কাজে হাত দেয়ার আগে তাঁর আইডিয়াটির প্রয়োগ কল্পনা করে নেন; একজন লেখক তাঁর গল্পের প্রথম দৃশ্যের ঘটনা কিভাবে শেষ দৃশ্যকে প্রভাবিত করবে – সেটাও খুব স্পষ্ট করে কল্পনার চোখে দেখতে পান; একজন সৃষ্টিশীল যোদ্ধা তাঁর আক্রমণের প্রভাব কল্পনা করেন; একজন সৃষ্টিশীল ব্যবসায়ী তাঁর নতুন মার্কেটিং কৌশলের প্রভাব ভালো করে কল্পনা করতে পারেন।
আপনি যদি কল্পনা করতে অভ্যস্ত না হন -তবে নিরাশ হবেন না।
কল্পনাশক্তি একটি দক্ষতা – যা চর্চার মাধ্যমে রপ্ত করা যায়। আমরা নিজের অজান্তে অচেতন ভাবে সারাদিনে অনেক কিছু কল্পনা করি। কিন্তু সৃষ্টিশীল মানুষরা সচেতন ভাবে এই কাজটি করেন। কল্পনা শক্তির চর্চার জন্য খুব সহজ একটি উপায় আছে। তা হল, নিজের জীবনের বিশেষ ঘটনা গুলো চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করা।
চোখ বন্ধ করে মনে করতে পারেন, আপনি শেষ কবে নিজের এলাকার বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলেন? সেখানে যাওয়ার পথে রাস্তা কেমন ছিল? – গাড়িতে গিয়েছিলেন না রিকশায় গিয়েছিলেন? – গাড়িতে গেলে গাড়ির রং কেমন ছিল? – রাস্তার পাশে কি প্রকৃতি ছিল, না শহর ছিল? – আপনার সাথে কি কেউ ছিল? – তার পরনে সেদিন কি ছিল? – আপনার পরনে কি ছিল? – রওনা হওয়ার আগে কি খেয়েছিলেন?
অথবা, চোখ বন্ধ করে আপনি শেষ যে বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন – তার কথা ভাবুন। – সেটা কি বাড়ি ছিল, না কমিউনিটি সেন্টার? – কেমন সাজানো হয়েছিল? – আলোকসজ্জা ছিল? – আপনার পরনে কি পোশাক ছিল? – খাবার কেমন ছিল? – দেশী না বিদেশী খাবার ছিল? – খাবারের গন্ধ কেমন ছিল? – স্বাদ কেমন ছিল? – রং কেমন ছিল?
– এই ধরনের স্মৃতিগুলো বা আপনার যা মন চায় – সেইসব ছবি প্রতিদিন ১০ মিনিট সময় নিয়ে ভাবুন। এই ভাবনাগুলো সহজ হয়ে আসলে তারপর নিজের কল্পনায় দৃশ্য সৃষ্টি করার চর্চা করুন। হয়তো আপনি একটি ফুলের বাগান করতে চান। বাগানে কি কি ফুল থাকবে, কয় রঙের গোলাপ থাকবে, কি কি ফলের গাছ থাকবে, ফুল ফুটলে বাগানটি কেমন লাগবে – এই দৃশ্যগুলো কল্পনা করার চেষ্টা করুন।
প্রাকটিসগুলো সাধারণ মনে হলেও দেখবেন একটা সময়ে এর ফলেই আপনার কল্পনা শক্তি অনেক উন্নতি করেছে। আসলে মানুষের কল্পনা শক্তি এমনিতেই ভালো। শুধু সচেতন ভাবে কল্পনা করার অভ্যাসটি করতে হবে। তাহলেই একে কাজে লাগিয়ে আপনি সৃষ্টিশীল চিন্তা করতে পারবেন।
পরিশিষ্ট:
সৃষ্টিশীলতা খুব জটিল ও কঠিন কিছু নয়। বিষয়টি ঠিকমত বুঝতে পারলে এবং কিছু অতি সাধারণ বিষয় চর্চা করলে এমনিতেই সৃষ্টিশীলতা বাড়বে। সেই কাজটি যাতে আপনার জন্য সহজ হয় – তাই এই লেখা।
লেখাটির বিষয়ে আপনার যে কোনও মতামত আমাদের কমেন্ট করে জানান। আপনার যে কোনও মতামতই আমাদের কাছে অমূল্য।
আর যদি মনে হয় এই লেখাটি পড়ে অন্যরা উপকৃত হবেন – তাহলে শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন।
এই ধরনের আরও লেখার জন্য নিয়মিত আমাদের সাথে থাকুন। সাফল্যের পথে সব সময়ে লড়াকু আপনার সাথে আছে