এশিয়ার যে কয়জন ব্যবসায়ী আন্তর্জাতিক ভাবে বিখ্যাত ও শ্রদ্ধেয় – রতন টাটা তাঁদের অন্যতম। বিশ্বব্যাপী টাটা গ্রুপের যে ব্যবসায়িক আধিপত্য – তাঁর অনেকখানি জুড়েই রয়েছে এই মানুষটির নেতৃত্ব ও ব্যবসায়িক দূরদর্শিতা। ব্যবসায়িক জগতের এই লিজেন্ড সারা বিশ্বের উদ্যোক্তাদের কাছে একজন আইডল।
এর আগে আমরা রতন টাটার জীবনী প্রকাশ করেছিলাম – যেখানে তিনি কিভাবে প্রায় অসহায় ভাবে জীবন শুরু করে এত বড় পর্যায়ে এসেছিলেন – তার বর্ণনা রয়েছে। সেই লেখাটি পড়ার পর আমাদের কাছে অনুরোধ আসে যেন আমরা ব্যবসা ও নেতৃত্ব বিষয়ে রতন টাটার কাছ থেকে নেয়ার মত শিক্ষাগুলো নিয়ে একটি লেখা প্রকাশ করি। সেই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতেই এই আয়োজন।
রতন টাটার জীবন ও ব্যবসায়িক দর্শন থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে। আমরা সেখান থেকে ১০টি শিক্ষা দিয়ে আজকের লেখাটি সাজিয়েছি। চলুন সেগুলো জেনে নেয়া যাক:
০১. লক্ষ্য বড় হতে হবে
বড় কিছু অর্জন করতে হলে আগে বড় স্বপ্ন দেখতে হবে। আর সেই স্বপ্নকে বাস্তব করার লক্ষ্য ঠিক করতে হবে।
রতন টাটা যখন টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হন তখন সেটি ছিল ভারতের মত তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের সাধারণ একটি কোম্পানী। ভারতের বাইরে বলতে গেলে তাদের তেমন কোনও কার্যক্রমই ছিল না।
রতন টাটা যখন কোম্পানীকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন – তখন অনেকেই তাকে পাগল ভেবেছিল। কোম্পানীর অনেক সিনিয়র এক্সিকিউটিভ তো সরাসরি তাঁর বিরোধীতা করেছিল। কিন্তু তিনি লক্ষ্য থেকে নড়েননি। ধীরে ধীরে তিনি দেশের বাইরে ব্যবসা বাড়াতে শুরু করেন, এবং এক পর্যায়ে টেটলি, জাগুয়ার এ্যান্ড ল্যান্ড রোভার, এবং তাজ বোস্টনের মত কোম্পানীকে টাটা গ্রুপের অধীনে নিয়ে আসেন।তাঁর নেতৃত্বেই টাটা গ্রুপ আজ বিশ্বের ১০০টি দেশে ব্যবসা পরিচালনা করছে। টাটা গ্রুপের আয়ের ৬৫% আজ আসে দেশের বাইরে পরিচালিত ব্যবসা থেকে।
০২. বিনয়ী হতে হবে, এবং সবাইকে সমান নজরে দেখতে হবে
রতন টাটা যেমন তাঁর ব্যবসায়িক স্কিলের জন্য বিখ্যাত ও শ্রদ্ধেয় – তেমনি তাঁর বিনয়ের জন্যও তিনি যথেষ্ঠ বিখ্যাত।টাটা গ্রুপে তাঁর শুরুটা হয়েছিল প্রায় শ্রমিকের মত ছোট পদ দিয়ে। অনেকেই বড় পজিশনে এসে অতীত ভুলে যান – কিন্তু রতন টাটা সব সময়েই তাঁর সেই অবস্থা স্মরণ করেন। কোম্পানীতে তিনি যতদিন ছিলেন – প্রতিটি নিন্ম পদের কর্মীর নাম তিনি জানতেন। সবাইকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতেন।
২০০৮ সালে তাঁর মালিকানাধীন হোটেল তাজ এ সন্ত্রাসী হামলায় তাঁর যে ৮০ জন কর্মচারী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল – তিনি প্রত্যেকের বাড়ি গিয়ে দেখা করেছিলেন।
তিনি যেমন সত্যিকার নেতার মত সাধারণ কর্মীদের কাতারে নেমে যেতে পারেন, তেমনি কর্মীরাও তাঁর জন্য প্রাণ দিতে পারে। তাঁর সাফল্যের পেছনে তাঁর এই সত্যিকার নেতাসুলভ গুণটির অবদান অনেক।
০৩. সততা নিশ্চিত করতে হবে
টাটা যে আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্র্যান্ড গুলোর একটি – এর পেছনে রয়েছে রতন টাটার সততাকে কোম্পানী কালচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে ফেলার উদ্যোগ।
রতন টাটা কর্মী ও ক্রেতাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি কখনও ভাঙেননি। সেইসাথে পাবলিক সেফটি ও সেরা কাস্টোমার সার্ভিস সব সময়েই রতন টাটার প্রধান একটি নীতি ছিল। সারা পৃথিবীর মানুষ যে আজ নিশ্চিন্তে টাটা গ্রুপের পন্য কেনে – তার পেছনে রতন টাটার সৃষ্টি করে যাওয়া ভরসার অবদান অনেকখানি।
০৪. ঝুঁকি নেয়ার সাহস থাকতে হবে
১ নম্বর পয়েন্টে বলেছিলাম, রতন টাটা কোম্পানীকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইলে অনেকেই তাঁর বিরোধীতা করেছিল। এই বিরোধীতার পেছনে ছিল ঝুঁকি নেয়ার ভয়। যারা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গিয়েছিল – তাদের নাম কেউ জানে না। কিন্তু যে লোকটি ঝুঁকি নেয়ার সাহস করেছিলেন – তিনি আজ লিজেন্ড।
শুধু রতন টাটা নন, পৃথিবীর সব বড় বিজনেস লিডারই এক একজন বড় রিস্ক টেকার। ঝুঁকি আসলে সফল ব্যবসার মূল খুঁটি। এজন বিজনেস লিডারের অবশ্যই বড় ঝুঁকি নেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। সেইসাথে, অন্যদের বিরোধীতা উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। এটাও এক ধরনের ঝুঁকি নেয়া। ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে আপনি সাময়িক ভাবে জনপ্রিয়তা হারাতে পারেন। কিন্তু সাহস করে ঝুঁকি নিয়ে সফল হলে, তারাই আবার আপনাকে বাহবা দেবে।
তাঁর মতে, কোনও সিদ্ধান্তই ভুল সিদ্ধান্ত নয়। সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তাকে সঠিক সিদ্ধান্তে পরিনত করতে হয়। – তাঁর মত এই মনোভাব নিয়ে চললে আপনি যে কোনও ঝুঁকি মোকাবিলা করার সাহস পাবেন।
০৫. অন্যদের অনুপ্রেরণা দিতে হবে
যে কোনও নেতারই অন্যদের অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা থাকা আবশ্যক। আপনি যদি রতন টাটার মত বিজনেস লিডার হতে চান – তবে আপনাকেও অন্যদের মোটিভেট করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
আপনার যদি একটা ভিশন থাকে, তবে তা এমন ভাবে উপস্থাপন করুন যেন সবাই সেই ভিশনকে নিজের বলে মনে করে। রতন টাটা যখন কোম্পানী বড় করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন – অনেকে পিছিয়ে গেলেও অনেক তরুণ কর্মী ও এক্সিকিউটিভ তাঁর এই কাজে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। তিনি সবার মাঝে এই আইডিয়াটি ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন যে – টাটা গ্রুপকে বড় করতে পারলে সবাই বড় একটা কিছুর সাথে থাকার সুযোগ পাবে। একজন মানুষ একা খুব বেশি কিছু করতে পারে না। তাই যদি বড় স্বপ্ন দেখেন, তবে সেই স্বপ্ন অন্যদের মনে জাগিয়ে তোলার মত দক্ষতাও আপনাকে অর্জন করতে হবে। অন্যদের যখন আপনার কাজে শামিল করবেন – তখন আপনার লাভের চেয়ে তাদের লাভটা বড় করে দেখান। তাহলেই মানুষ আপনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস এ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপল বুক রিভিউটি পড়তে পারেন।
০৬. নতুন আইডিয়া ও তারুণ্যকে মূল্য দিন
টাটা গ্রুপের প্রধান হয়ে রতন টাটা প্রথমে যে কাজগুলো করেছিলেন, তার অন্যতম হল, তরুণ কর্মীদের কথা শোনা, এবং তাদের আইডিয়াকে কাজে লাগানো।
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার মূল্য সব সময়েই আছে, কিন্তু তরুণদের কাছ থেকে এমন আইডিয়া আসতে পারে – যা এমনকি পৃথিবীর চেহারাও পাল্টে দিতে পারে। সত্যিকার বিজনেস লিডাররা তাই তরুণদের মূল্যায়ন করেন, এবং সব সময়ে নতুন আইডিয়ার খোঁজে থাকেন।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষকদের পেছনে টাটা গ্রুপের শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। যাতে তারা নতুন প্রযুক্তি ও পন্য উপহার দিতে পারে। এই বিনিয়োগের শুরুটা হয়েছিল রতন টাটার হাত ধরেই। টাটা গ্রুপের বাইরেও তিনি নিজের পকেট থেকে অনেক তরুণ ব্যবসায়ীর আইডিয়াতে বিনিয়োগ করেছেন। ভারতের অন্যতম ই-কমার্স ওয়েবসাইট স্ন্যাপডিল এ তিনি নিজের পকেট থেকে বিনিয়োগ করেছিলেন। এছাড়া অনলাইনে ভারতীয় চা এর বিক্রেতা ‘টিবক্স’, ক্যাশ ব্যাক ওয়েবসাইট ‘ক্যাশকারো ডট কম’ – এও তিনি বিনিয়োগ করেছেন।
রতন টাটা দেখিয়ে দিয়েছেন, নতুন আইডিয়া ও তরুণ প্রতিভার সঠিক ব্যবহার করতে পারা টপ ক্লাস ব্যবসায়ী হওয়ার অন্যতম শর্ত।
০৭. প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে
অনেক বিজনেস লিডারই প্রয়োজনের সময়ে কঠোর হতে না পারায় সফল হতে পারেন না। সিইওদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতাগুলোর একটি হল জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়। এই ভয়ের কারণে অনেকেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, অথবা সহকর্মীদের কাছে জবাবদিহিতা চাইতে পারেন না।
রতন টাটার বিনয় বিখ্যাত হলেও তিনি কোম্পানীর ভালোর জন্য যথেষ্ঠ কঠোর হতে পারেন। তিনি যখন কোম্পানীর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন, তখন টাটা এ্যান্ড সন্স এর অনেক সিনিয়র এস্কিকিউটিভ তাঁকে মেনে নিতে পারেননি। কারখানা লেভেল থেকে উঠে আসা এই তরুণকে চেয়ারম্যান পদে মানতে কয়েক দশক ধরে কোম্পানী চালানো লোকগুলোর বেশ বাধছিল। তাছাড়া রতনের পূর্বসূরী জে আর ডি টাটা তাদের অতিরিক্ত স্বাধনীতা দেয়ার ফলে তারা নিজেদের খেয়াল খুশিমত কোম্পানী চালাতেন। এমনকি গ্রুপের অধীন একক কোম্পানীগুলো তাদের কাজের ও আয় ব্যয়ের সঠিক রিপোর্টও হেড অফিসে পাঠাতো না।
রতন টাটা এই সমস্যার সমাধানে প্রথমেই কোম্পানীতে কাজ করার বয়সসীমা ঠিক করে দিলেন। এর ফলে সেইসব সিনিয়র এস্কিকিউটিভের বেশিরভাগই আর কোম্পানীর কার্যক্রম থেকে বাদ পড়লেন। সেইসব লোকের জায়গায় রতন টাটা সত্যিকার প্রতিভাবান তরুণদের বসালেন, যারা পরবর্তীতে টাটা গ্রুপকে আজকের পর্যায়ে আনতে তাঁকে সাহায্য করেছিল।
এছাড়া তিনি গ্রুপের একক কোম্পানীগুলোকে নিয়মিত রিপোর্ট করতে এবং তাদের লাভের একটা অংশ কোম্পানীর ব্র্যান্ডিং এর পেছনে ব্যয় করতে বাধ্য করেন।
রতন টাটা যদি সেই সময়ে এতটা কঠোর না হতেন, তবে হয়তো টাটা গ্রুপ আজকের পর্যায়ে আসতো না।
০৮. সমালোচনাকে স্বাগত জানানোর শক্তি থাকতে হবে
রতন টাটার উক্তি ও বানী গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত একটি উক্তি হল, “লোকেরা যদি তোমার দিকে পাথর ছুঁড়ে মারে, তবে সেগুলো দিয়ে তুমি একটা প্রাসাদ তৈরী করো”।
নিজের দোষ ও কমতি অনেক সময়েই আমাদের চোখে পড়ে না। অথবা ইগো আমাদের পরাজিত করে। সমালোচনায় আঘাত না পেয়ে সেগুলো নিয়ে চিন্তা করলে আমাদের নিজেদের অনেক দোষ আমরা ধরতে পারব – যেগুলো শুধরে আরও উন্নত মানুষ হওয়া সম্ভব।
তাছাড়া, অনেকেই অন্যের সমালোচনার কারণে হতাশ হয়ে যান, বা নিজের কাজ নষ্ট করে ফেলেন – রতন টাটার এই মনোভাব নিজের ভেতরে ধরে রাখলে – কোনও সমালোচনাই আপনাকে দুর্বল করতে পারবে না।
০৯. বিভিন্ন দিকে ব্যবসা ছড়িয়ে দিতে হবে
শুধু মাত্র একটি শিল্প বা ব্যবসার ওপর নির্ভর করলে ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। কোনওভাবে সেই ব্যবসাটি কাজ না করলে আপনি শেষ। রতন টাটার নীতি হল, “সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখা যাবে না”। লবণ ব্যবসা থেকে শুরু করে স্টিল মিল, গাড়ি, আইটি, মোবাইল, খাদ্য – ইত্যাদি নানান রকমের ব্যবসা তিনি টাটা গ্রুপের ব্যানারে দাঁড় করিয়েছেন। অনেকেই জানেন না, টাটা গুপের ‘মধ্যবিত্তের গাড়ি’ টাটা-ন্যানো প্রজেক্টটি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল। কোটি কোটি টাকার লোকসানও গুনতে হয়েছিল এই কারণে। কিন্তু এতে টাটা গ্রুপের গায়ে কোনও আঘাত লাগেনি। কারণ রতন টাটার দূরদর্শিতার কারণে টাটা গ্রুপ কখওই একটি মাত্র পন্যের বা ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল ছিল না।
পরিশিষ্ট:
টাকা হয়তো অনেক ব্যবসায়ীই আয় করেন। কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী নিজেদের অসাধারণ কাজ ও প্রতিভার কারণে লিজেন্ড ও আইকনে পরিনত হন। হয়ে ওঠেন অন্যদের অনুপ্রেরণা ও জ্ঞানের উৎস। জ্যাক মা, স্টিভ জবস এর কথা আমরা জানি। রতন টাটাও সেইসব লিজেন্ডদের একজন – যার কাছ থেকে নতুন উদ্যোক্তারা নিতে পারেন সফল হওয়ার অনুপ্রেরণা ও জ্ঞান।
সেই জ্ঞান আর অনুপ্রেরণা আপনার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যই আমাদের এই প্রচেষ্টা। রতন টাটার শিক্ষাগুলো কতটা কার্যকর হতে পারে – সেই বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কমেন্ট করে জানান।
যদি মনে হয় এই লেখাটি অন্য উদ্যোক্তা ও তরুণদের কাজে লাগবে – তবে শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন।
এই ধরনের আরও লেখা নিয়মিত পাওয়ার জন্য সব সবময়ে আমাদের সাথে থাকুন। সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার সাথে আছে