আপনি হয়তো অনেক সুন্দর করে কথা বলেন। অনেক ব্যাপারে অনেক কিছু জানেন। এবং আপনি আশা করেন, মানুষ আপনার কথা শুনবে এবং আপনার কথার মূল্য দেবে। কিন্তু আসলে তেমনটা হয় না – এবং আপনিও বুঝতে পারেন না যে মানুষ কেন আপনার কথা শুনছে না। অনেকে মনে করেন যে অনেক কিছু জানলেই মনেহয় ভালো কমিউনিকেটর হওয়া যায়। ব্যাপারটা আসলে সেরকম নয়। আপনি যত জ্ঞানিই হন, আর যত সুন্দর করেই কথা বলেন – কমিউনিকেটর হিসেবে সফল হতে গেলে আপনাকে সবার আগে অন্যের কথা শোনা শিখতে হবে।
আপনি হয়তো ভাবছেন, এটা তো আপনি পারেনই। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, সঠিক ভাবে মানুষের কথা শোনা একটা আর্ট। আর খুব কম মানুষই দক্ষতার সাথে এটা পারফর্ম করতে পারে। এই আর্ট যখন আপনি খুব ভালোভাবে রপ্ত করতে পারবেন, তখন এমনিতেই মানুষ আপনার কথা শুনবে। সঠিক ভাবে অন্যের কথা শুনতে পারার ক্ষমতা থাকলে আপনার খুব বেশি জ্ঞানেরও দরকার হবে না, খুব সুন্দর করে কথাও বলতে শেখা লাগবে না।
একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক: মনে করুন আপনি বেশ কিছুদিন ধরে চোখের সমস্যায় ভুগছেন। আগের মত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না। তো উপায় না দেখে আপনি গেলেন এক চোখের ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার আপনার সমস্যার কথা কোনওরকমে শুনে নিজের চোখের চশমাটি খুলে আপনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন: “এই চশমাটা আমি বহুদিন ধরে ব্যবহার করছি, সবকিছু একদম ক্লিয়ার দেখা যায়। আপনিও এটাই পরুন।“
কিন্তু সেই চশমা আপনি চোখে দিয়ে কিছুই দেখতে পেলেন না। সেটা ডাক্তারকে বলার পর তিনি তারপরও সেই চশমার গুনাগুণ সম্পর্কে অনেক কথা বলে আপনাকে সেটাই নেয়ার জন্য জোর করতে লাগলেন। এরপরও কি আপনি ওই ডাক্তারের কাছে যাবেন?
গল্পটি অবশ্যই অবাস্তব। কোনও ভালো ডাক্তারই আপনাকে ভাল মত পরীক্ষা না করে নিজের চশমা দিয়ে দেবে না। সে নিজের সমস্যার সাথে তুলনা না করে, আপনার সমস্যাটি ভালোমত বোঝার চেষ্টা করবে।
গল্পটি আপনাকে বলার কারন, আমরা সবসময়েই সেই গল্পের ডাক্তারের মত কাজ করি। কিভাবে? – আমরা যখন কারও সাথে কথা বলি, তখন তাদের সমস্যা বা যুক্তিকে ভালমত না বুঝেই আমরা আমাদের মতামত আর পরামর্শ দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
আবার আরেকজনের বক্তব্য ভালমত না বুঝেই আমরা তর্ক শুরু করে দিই। এর কারণ, আমরা বেশিরভাগ সময়েই নিজের দিক থেকে চিন্তা করি, অন্যের মানসিকতা বা যুক্তি বুঝতে চাই না। আর এর কারনে কিন্তু মানুষও আমাদের থেকে দূরে চলে যায়। আমরা প্রায়ই বলি, কেউ আমাদের বোঝেনা – কিন্তু আমরা নিজেরাও বেশিরভাগ সময়ে সামনের মানুষটির অনুভূতি বুঝতে চাই না।
অন্যের কথা বা কাজ বিচার করার সময়ে মানুষ বেশিরভাগ সময়েই ভাবে “সে এটা কি বলল/করল?” ; খুব কম মানুষই আছে যে চিন্তা করে “সে এটা কেন বলল/করল?”। মজার ব্যাপার হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে খ্যাতিমান ডিটেকটিভ, ডাক্তার, এমনকি ব্যবসায়ী বা ম্যানেজাররা এই চিন্তার মানুষ। তারা কারও আচরণ বা কথা বিচার করার আগে মানুষটির চিন্তা ও অনুভূতিকে গভীর ভাবে বুঝতে চেষ্টা করেন। আর এই গুনটিই তাঁদের অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে। সাধারণ থেকে অসাধারণ বানিয়ে দেয়।
আপনি যখন অন্যকে কিছু বোঝাতে যাবেন, তখন তার ভাষায় আপনাকে কথা বলতে হবে। একটু বুঝিয়ে বলি, ধরুন আপনি ফিজিক্সে এক্সপার্ট, এখন আপনার কথায় সেই বিষয় চলেই আসবে। কিন্তু আপনি যখন এমন কাউকে কিছু বোঝাতে যাবেন যে ফিজিক্স এর কিছুই জানে না – তখন তার সাথে তার ভাষায় কথা বলতে হবে। আপনার নিজের ভাষায় কথা বললে সে আপনার কথা বুঝবে না, এবং অল্প সময় পরেই সে আপনার কথা শোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। কাজেই প্রথমে তার কথা শুনে আপনাকে বুঝতে হবে যে, সে কোন ধরনের শ্রোতা এবং কিভাবে কথা বললে সে বুঝবে।
আপনি যখন কারও কথা শুনবেন, তখন শুধু উত্তর দেয়ার জন্য শুনবেন না। গভীর ভাবে তার কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করুন। এবং সামনের মানুষটি যেন বোঝে আপনি সত্যিই তার অনুভূতি আর কথাগুলো বুঝতে পারছেন। আপনি যখন অন্যের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে তার কথা বুঝতে চেষ্টা করবেন, তখন এমনিতেই তার আসল অবস্থা সম্পর্কে আপনার মনে প্রশ্ন জাগবে। কোনও কিছু না বুঝলে আপনি তাকে প্রশ্ন করে ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে চাইবেন। মানুষ আসলে এটাই চায়। কারও ব্যাপারে যখন অন্যরা আগ্রহ দেখায় এবং কেয়ার করে – তখন সেই কেয়ার করা মানুষগুলোকে সে পছন্দ করতে শুরু করে। ডেল কার্নেগী তাঁর “হাউটু উইন ফ্রেন্ডস এ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপল” বইয়ে লিখেছেন, কারও সাথে কথা বলার সময়ে অবশ্যই ৭৫% সময় আপনাকে শুনতে হবে, এবং মাত্র ২৫% সময় নিজে বলতে হবে।
আপনার মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে যে, আপনি কেন মাত্র ২৫% কথা বলবেন? – এর কারণ, আপনি যদি ২৫% কথা বলার অভ্যাস করতে পারেন, তবে আপনি এই একটি অভ্যাসের কারণেই একজন অতি দক্ষ কমিউনিকেটর হয়ে উঠবেন। অন্যরা যখন দেখবে আপনি গুরুত্ব দিয়ে তাদের ৭৫% কথা শুনছেন, তবে তারাও আপনার ২৫% কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনবে। অন্যরা যদি আপনার কথার গুরুত্ব না দেয় তবে ১০০% সময় কথা বলেও কোনও লাভ নেই।
আবার তর্কে না জড়িয়ে যদি আপনি কারও কথাগুলো ভাল মত বুঝে তার যুক্তিতেই কথা বলেন তবে একটা পর্যায়ে সে আপনার মতামত মেনে নেবে। আর মেনে না নিলেও সে আপনার প্রতি একটা ভালো ধারণা পোষণ করবে। মনে রাখবেন কখনওই কথা দিয়ে কাউকে আক্রমণ করবেন না। অন্যের প্রতিটি কথার পেছনের অর্থ বুঝতে চেষ্টা করুন, প্রয়োজনে প্রশ্ন করুন। আপনি যখন সত্যিই অন্যকে বুঝতে শুরু করবেন, তখন অন্যরাও আপনাকে বুঝতে শুরু করবে। এই বোঝাপড়াটাই আসলে মানুষের মাঝে ভালো সম্পর্ক ও কমিউনিকেশন তৈরী করে।
কিভাবে মানুষের সাথে ভালো যোগাযোগ তৈরী করা যায়, তা আরও বিস্তারিত জানতে “হাউটু উইন ফ্রেন্ড্রস এ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপল” এর পুরো বুক রিভিউটি পড়ুন।
তবে তার আগে এই লেখাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো তা আমাদের কমেন্ট করে জানান। আপনার প্রতিটি মতামতই তামাদের কাছে মূল্যবান।
যদি মনে হয় এই লেখাটি পড়ে অন্যরা উপকৃত হবেন – তবে শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন।
এই ধরনের আরও লেখার জন্য নিয়মিত আমাদের সাথে থাকুন। সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার সাথে আছে।