কমফোর্ট জোন কি?
কমফোর্ট জোন কি – এই প্রশ্নটির উত্তরে যে কথাটি প্রথমে মাথায় আসে – ব্যাপারটা অনেকটা সেরকমই। বাস্তবের কমফোর্ট জোন বা ‘আরামের অঞ্চল’ বলতে আমরা বুঝি এমন একটি জায়গা যেখানে সব রকমের সুযোগ সুবিধা ও নিরাপত্তা রয়েছে। খাবার ও আরামের সব ব্যবস্থা সেখানে আছে। – খুব ভালো ব্যাপার, তাই না? – কিন্তু সত্যি কথা বলতে, বুদ্ধিমান ও কিছু করতে চাওয়া মানুষের জন্য এটা জেলখানার মত।
আপনাকে যদি কেউ সব রকমের আরাম আয়েশ ও নিরাপত্তা দিয়ে একটি ঘরে বছরের পর বছর আটকে রাখতে চায় – আপনি কি রাজি হবেন? – নিশ্চই না!
কিন্তু অল্প কিছু মানুষ ছাড়া প্রায় সবাই মানসিক ভাবে এরকম একটি নিরাপত্তা বলয়ে নিজেদের আটকে রাখে। এই মানসিক কমফোর্ট জোন থেকে না বের হওয়ার জন্য মানুষ তার সম্ভাবনার অনেকটাই কাজে লাগাতে পারে না।
আমরা প্রায়ই বিভিন্ন গুণীজনের বিখ্যাত উক্তি থেকে জানতে পারি যে, কমফোর্ট জোন থেকে বের হলে একজন মানুষের জীবন অনেক বেশি সাফল্যময় হতে পারে। অনেক সময়ে আমরা এটা থেকে বের হতেও চাই – কিন্তু এটা খুব কঠিন কাজ বলে মনে হয়। শেষ পর্যন্ত জীবনের একঘেয়ে রুটিনের মাঝেই আমরা বন্দী হয়ে থাকি।
মাত্র কয়েকটি বছর দিনে ৮ ঘন্টার বদলে ১২ ঘন্টা কাজ করলে ক্যারিয়ার অনেক ওপরে চলে যাবে – এটা জানার পরও মানুষ তা করে না – কারণ ৮ ঘন্টা কাজ করতে করতে তার একটা কমফোর্ট জোন তৈরী হয়ে গেছে। বাড়তি ৪ ঘন্টা নিজের জন্য কাজ করলে কতটা কষ্ট হবে বা কতটা বিনোদন মিস হবে – এই চিন্তা করে অনেকেই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগকে কাজে লাগায় না।
কমফোর্ট জোন এর ধারণাটি প্রথম আসে ১৯০৮ সালে হওয়া একটি সাইকোলজিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট থেকে। সেই গবেষণা পত্রে বক্তব্য অনুযায়ী, কমফোর্ট জোন হল সেই পরিবেশগত ও আচরণগত অবস্থান যেখানে মানুষের কাজ কর্ম একটি নির্দিষ্ট নিরাপদ এবং চাপহীন রুটিন ও ছকের মাঝে আটকে যায়। এটি মানুষকে একটি মানসিক নিরাপত্তার অনুভূতি দেয়। এর মাঝে আটকে পড়া মানুষ নিয়মিত ভাবে সুখী থাকে, তাদের উদ্বেগ কম থাকে, এবং চাপ অনেক কম অনুভব করে।
শেষের অংশটি শুনতে ভালো লাগলেও এর অনেক খারাপ প্রভাব আছে। কমফোর্ট জোনে আটকে যাওয়া একজন মানুষ একদম ছোট কোনও ঝুঁকিও নিতে চায় না। এই কারণে তাদের উন্নতি একটি জায়গায় আটকে যায়।
ধরুন, একজন ছাত্র পড়াশুনা খুব কম করে। তার ফলাফল মোটেও ভালো না। প্রথম দিকে খারাপ লাগলেও এখন আর রেজাল্ট খারাপ হলে তার খারাপ লাগে না। কষ্ট করে নিয়মিত পড়াশুনা করার চেয়ে সে টিভি দেখে আর অন্য খারাপ ছাত্রদের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। – এই অভ্যস্ততাই কমফোর্ট জোন। এখন যদি তাকে ভালো রেজাল্ট করতে হয় – তাহলে তাকে টিভিতে ভালো প্রোগ্রাম চলার সময়ে পড়াশুনা করতে হবে, আগের বন্ধুদের বাদ দিয়ে ভালো পড়াশুনা করা ছাত্রদের সাথে চলতে হবে। এগুলো করতে গেলে তাকে তার কমফোর্ট জোন থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আগের বন্ধুদের থেকে সে দূরে সরে যাবে, তার প্রিয় টিভি প্রোগ্রাম গুলো মিস হবে – এইসব ছোট ছোট জিনিস হারানোর ভয়ে সে তার রুটিনই পরিবর্তন করলো না। এখন আপনিই বলুন – এটা কি তার জন্য ভালো কিছু হয়েছে?
এমন অনেক প্রতিভাবান মানুষ আছেন, যাঁরা উদ্যোক্তা হতে চান, বা নিজে কিছু করতে চান। কিন্তু কমফোর্ট জোন থেকে বের হতে না পারার কারণে তাঁরা শুরুই করতে পারেন না।
মনোবিজ্ঞানী ও গবেষকরা বহু বছর ধরে এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। তাঁরা কমফোর্ট জোন কে সঠিক ভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করার পাশাপাশি, এটা থেকে বের হয়ে আসা কেন কঠিন – তা বোঝার চেষ্টা করেছেন। সেইসাথে, কমফোর্ট জোন থেকে বের হয়ে আসাকে সহজ করার নানান উপায় বের করার চেষ্টা করেছেন – এবং এখনও করছেন। তাঁদের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে একটু কষ্ট স্বীকার করে যদি নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বের হয়ে আসতে পারেন – তবে দেখবেন আপনার জীবনে এত বেশি ইতিবাচক বা পজিটিভ পরিবর্তন এসেছে – যা আপনি আগে ভাবতেও পারেননি।
সবারই কি কমফোর্ট জোন থেকে বের হয়ে আসা দরকার?
কমফোর্ট জোনের ভেতরে থাকার খারাপ প্রভাব থাকলেও, এটি সার্বিক ভাবে খারাপ কিছু নয়।
আপনার যদি একটি ভালো চাকরি বা ব্যবসা থাকে, আপনার জীবন যদি সুন্দর মত চলতে থাকে, আপনি যদি পরিবার ও বন্ধু-আত্মীয় নিয়ে সুখী হন – এবং এটাই যদি হয় আপনার কমফোর্ট জোন – তাহলে এখান থেকে বের হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।
আপনি এখন যা – তারচেয়ে বেশি কিছু হতে, বা আপনার যা আছে, তারচেয়ে বেশি যদি না চান – তাহলে এখানেই থাকুন।
কিন্তু যদি অনেক বড় কিছু করতে চান, নিজের ক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করে কিছু করে দেখাতে চান – এবং এখন যে অবস্থায় আছেন সেই অবস্থা থেকে বের হতে চান, কিন্তু প্রথম পদক্ষেপটিই নিতে পারছেন না – তাহলে খুব সম্ভবত আপনার কমফোর্ট জোন আপনাকে পেছন থেকে টেনে ধরে আছে।
যখনই মনে হবে আপনার বর্তমান অবস্থাটি আপনার জন্য আদর্শ নয়, এবং সেই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য কি করতে হবে – তাও আপনি জানেন – কিন্তু সেটা না করার জন্য নিজের মন থেকেই নানান অযৌক্তিক কারণ দাঁড় করাচ্ছেন, এবং পদক্ষেপ নেয়া থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন – তবে আপনার কমফোর্ট জোন থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করা উচিৎ।
অনেক সময়ে অনেক মানুষকে আমরা পছন্দ করি না, অথবা তাদের জন্য আমাদের ক্ষতি হচ্ছে – এবং আমরা বুঝতে পারি মানুষটিকে দূরে রাখা দরকার – তবুও আমরা তাকে কিছু বলতে পারি না বা এড়িয়ে চলতে পারি না। এটাও কমফোর্ট জোনে আটকে পড়ার একটি উদাহরণ। আপনি চাচ্ছেন না তার সামনা সামনি সত্যি কথা বলে নিজের মনের ওপর চাপ বাড়াতে। যেমন চলছে – তেমনটাতেই আপনি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু নিজের কথা না বললে তার দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব আপনার আরও বেশি ক্ষতি করবে। আপনি কাউকে বা কারও কোনও আচরণকে পছন্দ করছেন না; কিন্তু সেটা তাকে বলছেনও না – এমন পরিস্থিতি হলে আপনার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই কমফোর্ট জোনটি ভাঙা প্রয়োজন।
কমফোর্ট জোন থেকে বের হওয়া এত কঠিন কেন?
১৯০৮ সালের সেই সাইকোলজিক্যাল এক্সপেরিমেন্টের প্রধান দুই গবেষক, মনোবিজ্ঞানী ড. রবার্ট এম. ইয়ের্কস এবং জন ডি. ডসন। গবেষণাটি মূলত মানুষের পারফর্মেন্স নিয়ে হয়েছিল। মানুষের পারফর্মেন্স বাড়ানোর জন্য তাকে কিভাবে মানসিক ভাবে প্রভাবিত করা যায়, এবং কি কি প্রভাবের ফলে মানুষের কাজের পারফর্মেন্স বাড়ে বা কমে – সেটাই ছিল গবেষণার মূল বিষয়।এই গবেষণার ফলে বেশ কিছু নতুন জিনিস জানা যায়, যেগুলো পরর্বতীতে “Yerkes–Dodson law” নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে।
ইয়ের্কস ও ডসন বলেছেন, “মানুষের কমফোর্ট জোন তাকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার পারফর্ম করায়। স্বাভাবিক অবস্থায় সেই মাত্রা বাড়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। পারফর্মেন্স বাড়ানোর জন্য মানুষের অল্প মাত্রার উদ্বেগ প্রয়োজন হয়। খুব বেশি হলে তা আবার পারফর্মেন্সকে খারাপ করবে। স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য একটু বেশি উদ্বেগ সৃষ্টি করা গেলেই মানুষ সাধারণের চেয়ে বেশি কাজ করবে”
উদাহরণ হিসেবে দুইজন ছাত্র সাজু ও আসিফের কথা ধরা যাক। ইংরেজী পরীক্ষার দুই দিন আগে সাজু দেখল তার ২ চ্যাপ্টার পড়া হয়নি। এর আগে প্রায় মাসখানেক সময় পেলেও সে সেই চ্যাপ্টার নিয়ে বসেনি। মাঝে মাঝে মনে পড়লেও পরীক্ষার দুই দিন বাকি থাকতে তার যখন এটা মনে পড়ল – সে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তে বসল, এবং এক দিনের মধ্যেই চ্যাপ্টার দুটো শেষ করে ফেলল।
অন্যদিকে আসিফ পরীক্ষার দুই দিন বাকি থাকতে টের পেল, তার কিছুই পড়া হয়নি। বলতে গেলে পুরো সেমিস্টার সে বই খুলেও দেখেনি। সে-ও দারুন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তে বসল। কিন্তু এত বড় সিলেবাস দুই দিনে কিভাবে শেষ করবে – এই চিন্তাতেই তার মাথা খারাপ হয়ে যেতে লাগলো। কোনও পড়াই সে ঠিকমত বুঝতে পারছিল না। এবং শেষ পর্যন্ত দুই দিনে এই সিলেবাস কাভার হবেনা – ধরে নিয়ে সে পড়াই বন্ধ করে দিল।
এখানে Yerkes–Dodson law এর প্রভাব কাজ করেছে। সাজুর দুই চ্যাপ্টার বাকি থাকায় তার মাঝে কিছুটা উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছিল – এবং সেই কারণে সে দ্রুত পড়া শেষ করতে পেরেছিল। অন্যদিকে আসিফের পুরো বই বাকি থাকায় তার উদ্বেগের পরিমান ছিল অনেক বেশি। এই কারণে সে এতই ভয় পেয়ে গেল যে, পড়তেই পারলো না।
যাই হোক – বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে, কমফোর্ট জোন থেকে বের হওয়ার কথা ভাবতে গেলেই তারা অনেক বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এই অতিরিক্ত উদ্বিগ্নতাই তাদের নতুন কিছু চেষ্টা করতে বাধা দেয়।
নতুন কিছু চেষ্টা করতে গেলে বর্তমান অবস্থার কি হবে, অর্থাৎ “একূল ওকূল – দুই কূল” হারানোর ভয় অথবা নতুন পরিস্থিতি বা জায়গার অনিশ্চয়তা মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তোলে – এবং এই কারণেই মানুষ বেশিরভাগ সময়ে তার কমফোর্ট জোন ছেড়ে বের হতে পারে না।
ভবিষ্যতের আশায় কিছু করতে গিয়ে বর্তমানকে হারিয়ে ফেলার ভয়ই মূলত মানুষকে কমফোর্ট জোনের মাঝে আটকে রাখে।
কমফোর্ট জোন থেকে বের হলে কি লাভ?
কমফোর্ট জোন থেকে বের হওয়া মানে আপনার সামনে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে যাওয়া। আপনার অনেক দিনের লালিত স্বপ্ন পূরণের জন্য হয়তো প্রথম পদক্ষেপটি নিতে পারবেন।
যে কোনও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা, এবং সব অবস্থায় মাথা ঠান্ডা রাখার শক্তি আপনার মাঝে সৃষ্টি হবে। আপনার সৃষ্টিশীলতা বাড়বে, নতুন নতুন চিন্তা ও আইডিয়া ভাবার পাশাপাশি আপনি সেগুলোর বাস্তবায়ন করতে পারবেন। আপনার ভেতরে লুকানো গুণ গুলোকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওযার পাশাপাশি, নতুন নতুন বিষয় শেখার ও চেষ্টা করার উৎসাহ সৃষ্টি হবে। ফলে আপনি মানুষ হিসেবে দক্ষ ও উন্নত হয়ে উঠবেন।
সোজা কথায়, কমফোর্ট জোন থেকে বের হওয়ার অভ্যাস সৃষ্টি হলে, আপনার যোগ্যতা ও ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে আপনি এমন সাফল্য অর্জন করতে পারবেন – যা হয়তো সাধারণ অবস্থায় ভাবাও যায় না।
কমফোর্ট জোন থেকে বের হওয়ার ৪টি উপায়:
Yerkes–Dodson law অনুযায়ী, সাধারণের চেয়ে ভালো পারফর্ম করতে, বা কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে আসতে কিছুটা উদ্বেগের প্রয়োজন। উদ্বেগের মাত্রা বেশি হয়ে গেলে অবশ্য আরও খারাপ।
ভালো সংবাদ হল, মানুষের বেশিরভাগ উদ্বেগই মন গড়া। যা এখনও ঘটেনি – তা নিয়ে মানুষ বেশি উদ্বিগ্ন হয়। অতীতের খারাপ অভিজ্ঞতা, ভবিষ্যতের আশঙ্কা, বর্তমানের ভালো জিনিস হারিয়ে ফেলার ভয় – ইত্যাদি মানুষকে সামনে এগুতে বাধা দেয়।
যদি কিছু নির্দিষ্ট বিষয় চর্চা করেন – তবে নতুন কিছু আপনাকে খুব বেশি উদ্বিগ্ন করতে পারবে না, কিছুটা উদ্বেগ হয়তো থেকে যাবে – কিন্তু তা আপনাকে আরও ভালো পারফর্ম করার জন্য উৎসাহ দেবে – এবং সহজেই আপনি আপনার কমফোর্ট জোন থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন।
চলুন জেনে নিই এমন ৪টি বিষয় – যেগুলো চর্চা করলে আপনার জন্য কমফোর্ট জোন ভাঙা সহজ হয়ে যাবে।
০১. মেন্টাল মডেলিং বা মনছবি
আমাদের মস্তিষ্কের সবচেয়ে মজার একটি দিক হল, এটি কল্পনা ও বাস্তবের পার্থক্য ধরতে পারে না। সামনে কোনও দু:খের ঘটনা ঘটতে দেখলে আমাদের যেমন অনুভূতি হয়, দু:খের ঘটনা কল্পনা করলেও তেমনই লাগে। আবার আনন্দের বা মজার ঘটনার ক্ষেত্রেও তাই। আমরা যাদের ভালোবাসি, তাদের কাছে গেলে যেমন লাগে – তাদের কথা মনে পড়লেও তেমনই ভালোবাসা পূর্ণ আবেগ অনুভব হয়।
আরও একটি মজার ব্যাপার হল, একটি মিথ্যা তথ্য বা কল্পনা যদি বার বার মস্তিষ্কে আসতে থাকে – তবে এক সময়ে মস্তিষ্ক তাকে সত্যি বলে ভাবতে শুরু করে।
এটাই মেন্টাল মডেলিং পদ্ধতি কাজ করার সূত্র। মেন্টাল মডেলিং হল একটি নির্দিষ্ট বিষয় গভীর ভাবে কল্পনা করা। আপনার যদি কোনও কাজ করতে ভয় লাগে, তবে আপনি যদি সেই কাজটি ভালো ভাবে হচ্ছে – এই বিষয়টি বার বার কল্পনা করতে থাকেন – তবে এক সময়ে দেখবেন কাজটি করার কথা ভাবতে আর ভয় লাগছে না।
পাইলট এবং সেনা সদস্যদের এই ট্রেনিং দেয়া হয়। যাতে তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে বা কোনও দুর্ঘটনায় পড়লে মাথা ঠান্ডা রেখে বিপদ মোকাবেলা করতে পারেন।
২০০০ সালের ১ জুন এয়ার ফ্রান্স এর “ফ্লাইট ৪৪৭” ব্রাজিল থেকে প্যারিসে যাচ্ছিল। প্লেন ওড়ার কয়েক মিনিটের মাথায় প্রবল ঝড় উঠল, এবং আঘাত পেয়ে প্লেনের অটোপাইলট কাজ করা বন্ধ করে দিল। প্রবল ঝড়ের প্রভাবে প্লেনটি উল্টোপাল্টা ভাবে উড়ছিল, এবং পাইলটরা ঘাবড়ে গিয়ে প্লেন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কি করবে বুঝতে পারছিল না। এই ধরনের পরিস্থিতিতে পাইলটদের উচিৎ ছিল প্লেনের মাথাটি নিচের দিকে চালিত করে স্পিড বাড়িয়ে দেয়া। পাইলরা সেই বিষয়ে ট্রেনিং পাওয়া সত্ত্বেও পরিস্থিতির চাপে ভীত ও দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে সিদ্ধান্তহীন হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত প্লেনটি এক পর্যায়ে থেমে গিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে পতিত হয়। সেই দুর্ঘটনায় পাইলটসহ সব যাত্রীরই মৃত্যু হয়েছিল।
এবার আর একটি দুর্ঘটনার কথা বলা যাক, যাত্রী বোঝাই ক্যানটাস এয়ারওয়েজ এর ফ্লাইট৩২ সিঙ্গাপুর থেকে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছিল। প্লেন ওড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে প্লেনের একটি ইঞ্জিনে আগুন ধরে যাওয়ার ফলে ইঞ্জিনটি বিস্ফোরিত হয়। সাথে সাথে পাইলট অটোফ্লাই অপশন বন্ধ করে নিজের হাতে প্লেনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। একটু পরই প্লেনে ডেঞ্জার এলার্ম বেজে উঠল। যাত্রীরা ভয়ে এমন চেঁচামেচি শুরু করল যে তাদের কোনওভাবেই শান্ত করা যাচ্ছিল না। আবার প্লেনের নিয়ন্ত্রণও একটু পর পরই হারিয়ে যাচ্ছিল। এতসব ঝামেলার মাঝেও পাইলট মাথা ঠান্ডা রেখে তাঁর কাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। সাহস ধরে রেখে তিনি প্লেনটিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ল্যান্ড করালেন; আর সেই সাথে বেঁচে গেল বেশকিছু মানুষের জীবন।
এইযে দু’টি ঘটনা বলা হল, দুটিতেই প্লেন দুর্ঘটনার মুখে পড়েছিল। প্রথম দুর্ঘটনার থেকে দ্বিতীয়টি বেশি বিপজ্জনক ছিল। প্রথম প্লেনটির পাইলট সাহস না হারালে দ্বিতীয় প্লেনের পাইলটের থেকে সহজে তাঁর প্লেনটি রক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে না পারার কারনেই নিজেদের সাথে বহু যাত্রীকে চরম বিপদে ফেলেছিলেন। ফ্লাইট ৪৪৭, অর্থাৎ প্রথম বিমানটির পাইলটের যা হয়েছিল তাকে ইংরেজীতে বলে “cognitive tunneling” – এই অবস্থা তখন হয়, যখন একজন মানুষ রিল্যাক্সড অবস্থা থেকে হঠাৎ করেই কোনও একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। বিপদটা যখন একটি চমকের মত করে সামনে হাজির হয়, তখন অনেক মানুষের মাথাই ঠিকমত কাজ করে না। কোনওভাবেই তাঁরা কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না। আর এই সিদ্ধান্তহীনতার ফলেই ঘটে যায় চরম কোনও দুর্ঘটনা।
অন্যদিকে ক্যানটাস, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিমান এর পাইলট তুলনামূলক বেশি বিপজ্জনক অবস্থায় থাকার পরও মাথা ঠান্ডা রাখতে পেরেছিলেন কারন তিনি একটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। এই পদ্ধতিকে ইংরেজীতে বলে “Mental Modeling” – অর্থাৎ মনস্তত্বকে সাজিয়ে নেয়া। এটি একধরনের সাজানো কল্পনা বলা যায়। এই পদ্ধতিতে একজন মানুষ কোনও কাজ শুরুর আগে নিজের মনে কল্পনা করে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি ছক সাজিয়ে নেন। এই ছকের মাঝে কোনও অপ্রত্যাশিত বিপদ আসলে কি করবেন – সেই ব্যাপারটিও ভেবে নেয়া থাকে। এতেকরে কাজের প্রতিটি পদক্ষেপের ব্যাপারে যিনি কাজ করছেন, তাঁর একটি মানসিক প্রস্তুতি থাকে। যদি সত্যিকারেই কোনও অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে যায়, তখন আর সেটি পুরোপুরি চমক থাকে না – কারন হুবহু একই ঘটনা না হলেও – কোনও একটি বাধা বা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতে পারে, তা আগে থেকেই জানা থাকে।
যাঁরা সর্বোচ্চ প্রোডাক্টিভিটির সাথে কাজ করে থাকেন, তাঁরা কোনও একটি কাজ শুরুর আগে সেই কাজের প্রতিটি ধাপের একটি করে মনস্তাত্বিক ছবি (Mental image) সৃষ্টি করে নেন। এতেকরে কাজের চাপ অনেকটা কম অনুভূত হয়। দিনের শুরুতে যদি আপনি আপনার সারাদিনের কাজের ছকটি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে এভাবে কল্পনা করেন তাহলে সারাদিন সেটি একটি ম্যাপ এর মত কাজ করবে। শুধু সেই ম্যাপ ধরে ধরে এগুলেই চলবে। এর মাঝে যদি কোনও প্রকারের বাধা আসে, তবে সেই অবস্থায় মাথা ঠান্ডা রেখে সমস্যা সমাধানের বিষয়টিও মাথায় গেঁথে নিতে হবে। এতে করে সারাদিনে সব পরিস্থিতিতেই আপনি ঠান্ডা মাথায় গুছিয়ে কাজ করতে পারবেন।
দ্বিতীয় প্লেনটির পাইলট প্রতিবার ফ্লাই করার আগে এই কাজটি করে নিতেন। প্রতিবারই তিনি তাঁর ফ্লাই এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি মেন্টাল মডেলিং করে তারপর প্লেনে উঠতেন। এর মাঝে যদি কোনও অপ্রত্যাশিত বিপদ আসে, তবে তিনি সেগুলোকে কিভাবে সামলাবেন – সেই ব্যাপারটিও তিনি আগে থেকেই ভেবে রাখতেন। আর এই মেন্টাল মডেলিং এর কারনেই তিনি চরম বিপদে পড়েও মাথা ঠান্ডা রাখতে পেরেছিলেন।
আপনি যেসব কাজ আপনার কমফোর্ট জোনের বাইরে বলে মনে করেন, সেই কাজগুলো ভালো ভাবে করছেন বলে কল্পনা করুন। যেসব সমস্যা আসতে পারে, সেগুলো কিভাবে সমাধান করছেন – তাও ভাবুন – এই কল্পনা যদি বার বার করেন, তবে সেই কাজ করা নিয়ে আপনার উদ্বেগ আস্তে আস্তে কেটে যাবে – এবং আপনি একটা সময়ে কমফোর্ট জোন থেকে বের হয়ে কাজটি শুরু করতে পারবেন।
০২. নিজের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়ান
কোনও কাজ করতে পারবো না – এটা মনে হওয়ার প্রধান কারণ হল সেই বিষয়ে আমাদের জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব। কোনও বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা কম থাকলে সেই বিষয় নিয়ে কিছু করতে ভয় লাগা বা আত্মবিশ্বাস না পাওয়া স্বাভাবিক।
আপনার সাঁতার কাটার ইচ্ছে হলে প্রথমেই আপনি নদীতে ঝাঁপ দেয়ার সাহস পাবেন না। এজন্য আপনাকে প্রথমে ট্রেনিং নিতে হবে। যে কোনও নতুন বিষয়ের প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিৎ ট্রেনিং ও পড়াশুনা।
আপনি হয়তো নতুন ব্যবসা করতে চান, কিন্তু শুরু করার সাহস পাচ্ছেন না। আগের জায়গার কমফোর্ট জোন ছেড়ে বের হতে পারছেন না – কারণ আপনি আশঙ্কা করছেন, ব্যবসায় লস হলে তো বর্তমানও যাবে, ভবিষ্যৎও যাবে।
এখন আপনি যদি সেই ব্যবসার বিষয়ে পড়াশুনা করেন ও ট্রেনিং নেন, সেইসাথে শিক্ষানবিশ হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন – তাহলেই দেখবেন ভয় অনেকটাই কেটে গেছে। আজকের যুগে যে কোনও বিষয়ের বই ও ট্রেনিং পাওয়া যায়। আপনি যেটাই করতে চান না কেন – ভালো করে খুঁজলে সেই বিষয়ে ট্রেনিং ও পড়াশুনার সরঞ্জাম অবশ্যই পেয়ে যাবেন।
০৩. নতুন জায়গায় একা একা বেড়াতে যান
কমফোর্ট জোন থেকে বের হওয়ার অভ্যাস করার জন্য এটি দারুন একটি প্রাকটিস। নতুন জায়গায় একা একা ঘুরতে গেলে আপনাকে বাধ্য হয়েই নতুন নতুন মানুষের সাথে কথা বলতে হবে, নিজের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে, খাওয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় সব প্রয়োজন মেটাতে হবে।
এতে করে আপনার একদম নতুন কিছুর সাথে ডিল করার অভ্যাস হতে থাকবে। কথায় বলে সমুদ্রে সাঁতার কাটতে হলে আগে ছোট ডোবায় সাঁতার শিখতে হয়। আপনি যখন নতুন কোনও জায়গায় একা বেড়াতে যাবেন – তখন সেটি হয়তো আপনার নতুন ব্যবসা শুরু করা, অথবা নতুন বিষয়ে পড়াশুনা শুরু করা, বা নতুন অভ্যাস গড়ে তোলার সাথে সরাসরি জড়িত নয় – কিন্তু এর ফলে আপনার মস্তিষ্ক নতুন বিষয়ের সাথে মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।
এই বিষয়টি কিছুদিন প্রাকটিস করলে দেখবেন যে কোনও নতুন বিষয় চেষ্টা করতে গেলেই আর আগের মত উদ্বেগ লাগছে না। এভাবে যে কোনও ব্যাপারেই কমফোর্ট জোন থেকে সহজে বের হয়ে আসতে পারবেন।
০৪. মাঝে মাঝে রুটিনে বদল আনুন
একজন মানুষ যদি নিয়মিত একটি রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন তার পক্ষে নতুন কিছু চেষ্টা করা একটু কঠিন হয়ে পড়ে। সুযোগ পেলে মাঝে মাঝে রুটিনে একটু পরিবর্তন আনুন।
প্রতিদিন যে রাস্তা দিয়ে অফিসে/কলেজে/বিশ্ববিদ্যালয়ে – বা অন্য কোথাও যান – সেই রাস্তাটি মাঝে মাঝে পরিবর্তন করুন। সবচেয়ে ভালো হয় একটু আগে আগে বেরিয়ে নিজের চেষ্টায় নতুন কোনও রাস্তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। পথ হারিয়ে ফেললে রিকশা বা অন্য যানবাহন তো আছেই।
এছাড়া রান্না করতে না জানলে রান্না করার চেষ্টা করা, বা এই ধরনের ছোটখাট না পারা কাজ নিজে করার চেষ্টা করা আপনার মস্তিষ্ককে বড় বিষয় চেষ্টা করার জন্য প্রস্তুত করে তুলবে।
পরিশিষ্ট:
ছোট ছোট নতুন বিষয় চেষ্টা করা ও ছোট ছোট ঝুঁকি নিতে থাকলে আপনার মস্তিষ্কের বড় ঝুঁকি নেয়া বা নিজের জীবনে বড় পরিবর্তন আনার জন্য অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। সেলফ ডেভেলপমেন্ট গুরু আর্ল নাইটেঙ্গেল বলেন “মানুষ তার মনের আচরণ বদলানোর মাধ্যমে যে কোনও অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে”। একটি সাধারণ মানসিক পরিবর্তন শুধু একজন মানুষের জীবন নয়, তার আশপাশের পরিবেশ এমনকি পৃথিবীকেও বদলে দিতে পারে। যুগে যুগে অনেকেই এটা প্রমাণ করেছেন।
কমফোর্ট জোন থেকে বের হতে না পারা একটি মানসিক অবস্থা ও অভ্যাস। এবং চেষ্টা করলে যে কেউ পজিটিভ চিন্তার মাধ্যমে এই অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারে। পজিটিভ চিন্তা কিভাবে করবেন – তা ভালো ভাবে জানতে আমাদের পজিটিভ চিন্তা করার উপায় লেখাটি পড়ুন। – তবে তার আগে এই লেখাটির বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কমেন্ট করে জানান।
আর যদি মনে হয় এই লেখাটি পড়ে অন্যরাও উপকৃত হবেন – তাহলে শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন।
এই ধরনের আরও আত্ম উন্নয়ন মূলক এবং সাফল্য বিষয়ক লেখা নিয়মিত পাওয়ার জন্য আমাদের সাথে থাকুন।
সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার সাথে আছে।