সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া কি? – ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার মানসিক কারণ ও সমাধান


  • By
  • April 17th, 2019
  •    
  • পড়তে সময় লাগবে: 5 minutes
  • 11,115 views
সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া
5 mins read

সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া মানে সঠিক ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া এবং তাকে কাজে রূপান্তর করার পর কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া।

আমরা  যে বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেই না কেন, আমরা আশা করি সিদ্ধান্তটি যেন সঠিক হয় এবং যে উদ্দেশ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি – সেটা যেন পূরণ হয়।

সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারা যে কোনও ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়া ও সাফল্য পাওয়ার জন্য খুবই জরুরী। যারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, অন্যরা তাদের ওপর ভরসা করে, নেতৃত্ব তাদের হাতে তুলে দেয়।

কিছু মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে খুবই ভালো, আবার কিছু মানুষের বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই ভুল হয়। অনেক জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ মানুষও অনেক সময়ে ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। আসলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সঠিক প্রক্রিয়া বা প্রসেস অনুসরন করাটা জরুরী। এছাড়া কিছু মানসিক সীমাবদ্ধতাকেও জয় করতে হয়।

এই সঠিক প্রক্রিয়া রপ্ত করা এবং মানসিক বাধা বা সিমাবদ্ধতাকে জয় করতে না পারলে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া এড়ানোটা বেশিরভাগ সময়েই কঠিন হয়ে যায়।

এই লেখায় আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনাকে স্পষ্ট ধারণা দেয়ার সাথে সাথে, ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য দায়ী মানসিক সীমাবদ্ধতাগুলো কি, এবং কিভাবে এগুলো জয় করবেন – সেই বিষয়ে জানাবো।

চলুন তাহলে শুরু করা যাক:

সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া কি?

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসেচুসেটস্ এর গবেষকদের মতে, সাধারণ ভাবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া হল, একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে এবং তা বিশ্লেষণ করে সঠিক কাজটি বেছে নেয়া, বা সঠিক আইডিয়াটি বের করা।

সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া

সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য যদি কয়েকটি নির্দিষ্ট ধাপ পার করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যার মাঝে প্রয়োজনীয় তথ্য বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি, বিকল্প সমাধানও চিন্তা করার সুযোগ থাকে – তাহলে সিদ্ধান্ত সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

চলুন, সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার বিজ্ঞান সম্মত ধাপগুলো জেনে নেয়া যাক:

ধাপ ১:            যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চান, সেই বিষয়ে যত বেশি সম্ভব তথ্য জোগাড় করুন। কোনও কাজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হলে, সেই কাজ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা করুন। কোনও মানুষের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হলে সেই মানুষটির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে যত বেশি সম্ভব তথ্য যোগাড় করুন।

ধাপ ২:            যেসব তথ্য পেয়েছেন, সেগুলো চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করবেন না। তথ্যগুলো ভালোভাবে যাচাই করুন। এক জায়গা থেকে একটি তথ্য পেলে, অন্য জায়গা থেকে একই তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা করুন, এবং মিলিয়ে দেখুন যে – এগুলোর মধ্যে কোনও অসংগতি আছে কি না। একজন নতুন বিজনেস পার্টনার বা কর্মী নিয়োগের সময়ে তার সম্পর্কে বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য নেয়ার চেষ্টা করুন। এবং সেগুলো মিলিয়ে সঠিক তথ্যটি বের করার চেষ্টা করুন।

ধাপ ৩:            শুধু এক দিক থেকে চিন্তা না করে, বিষয়টি বিভিন্ন দিক থেকে চিন্তা করার চেষ্টা করুন। বুদ্ধিমান মানুষেরা যে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সেটি বিভিন্ন দিক থেকে চিন্তা করেন। এবং একটি সমস্যার আলাদা আলাদা সমাধান চিন্তা করে সেগুলো প্রয়োগ করলে কি হতে পারে, তা বোঝার চেষ্টা করেন।

যে কোনও সিদ্ধান্তের ফলাফল আগে থেকে ভালোভাবে বুঝতে পারা, সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আবশ্যক। প্রয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আগে সময় নিন, পরীক্ষা করুন – কিন্তু ফলাফলের ব্যাপারে আগে থেকে একটা স্পষ্ট ধারণা নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করুন।

ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার মানসিক কারণ ও সমাধান:

তবে ওপরে বলা উপায়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েও অনেকে ভুল সিদ্ধান্ত নেন। কারণ কিছু মানসিক বাধার কারণে তারা সঠিক ব্যাপারটি বুঝতে পারে না। চোখের সামনে অনেক কিছু থাকলেও তারা তা দেখতে পায় না। – এই কারণে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়।

ধরুন আপনি একটি নতুন পন্য নিয়ে রিসার্চ করছেন। পন্যটির মার্কেট ডিমান্ড ভালো বলে আপনার মনে হচ্ছে। আপনার সংগ্রহ করা তথ্যও সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

সবকিছু মিলিয়ে আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন আপনার পন্যটি মার্কেটে ভালো করবে, এবং আপনি সেটি বাজারে ছাড়লেন। সাথে বড় একটি মার্কেটিং ক্যাম্পেইনও করলেন।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল পন্যটি ব্যর্থ হল। আপনি যা আশা করেছিলেন, পন্যের বিক্রী তার ধারেকাছেও গেল না। এবং আপনি বিরাট লোকসানের মুখে পড়লেন।

খুব সম্ভবত আপনি যে ভুলটি করেছেন, তাকে বলে “confirmation bias” বা অতি নিশ্চিত হওয়া। আপনি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তথ্য বিচার না করে, আপনার চাওয়াকে প্রমাণ করার জন্য যেসব তথ্যের দিকে তাকানো দরকার শুধু সেগুলোর দিকেই তাকিয়েছেন।

ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে যে মানসিক বাধাগুলো কাজ করে এটি সেগুলোর অন্যতম।

এরকম আরও কিছু মানসিক বাধার কারণে সঠিক তথ্য বা পদ্ধতি অনুসরন করার পরও অনেকে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়।

১৯৮২ সালে প্রকাশিত “Judgment Under Uncertainty.” বইয়ে মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল কেইনিম্যান, পল স্লোভিচ, এবং আমোস টিভেরস্কি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মানসিক বাধা বা “psychological bias” এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন –

”এটা হল অযৌক্তিক ভাবে ও পক্ষপাতপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রবণতা। যেমন, আপনি হয়তো সব তথ্যের দিকে না তাকিয়ে যেসব তথ্য আপনার ধারণাকে সমর্থন করে – শুধু সেগুলো নিয়েই চিন্তা করেছেন – এবং এই কারণে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন”

সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া নষ্টকারী ৪টি মানসিক বাধা এবং এগুলোর সমাধান:

০১. ফলাফল সম্পর্কে অতি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা

সিদ্ধান্ত

অতি নিশ্চত হওয়ার ঘটনা তখনই ঘটে যখন কেউ শুধু তার ধারণাগুলোকে সাপোর্ট করে – এমন তথ্যেই মনোযোগ দেয়, এবং বাকিগুলো এড়িয়ে যায়। এর ফলে একপেশে সিদ্ধান্ত নেয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং বেশিরভাগ সময়েই সেগুলো ভুল হয়।

২০১৩ সালে ইয়েল ইউনিভার্সিটি, ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি, এবং কর্ণেল ইউনিভার্সিটির গবেষকদের মিলিত এক গবেষণাপত্রে রিপোর্ট করা হয় যে, এই মানসিক বাধার কারণে মানুষ পরিসংখ্যানের দিকেও একপেশে দৃষ্টিতে তাকায়। শুধু তারা যেটা দেখতে চাচ্ছে – সেটাতেই ফোকাস করে।

এমনকি যদি দেখা যায় ১০০ জনের ওপর করা জরিপে ৬০ জন তাদের মতের বিপক্ষে মতামত দিয়েছে, তারা সেদিকে না তাকিয়ে ৪০ জনের মতামতের ওপর ফোকাস করে।

এর ফলে, বিশেষ করে ব্যবসার ক্ষেত্রে, ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

এড়ানোর কৌশল:

এই মানসিক বাধা দূর করতে আপনাকে একটি নতুন অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আপনি ছোট-বড় যে বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেন না কেন, সব সময়ে আপনার মতামতের বিপরীর মতামত বা তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করুন, এবং সেগুলো নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করুন। প্রয়োজন না হলেও, প্রতিটি ক্ষেত্রে এই চর্চা নিয়ে আসুন। এমনকি সকালের নাস্তায় কি খাবেন – এই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়েও এটি চর্চা করুন।

বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে চলার চেষ্টা করুন, এবং প্রতিটি বিষয়েই আলাদা আলাদা মতামত জানার চেষ্টা করুন। এবং শুধু জেনেই বসে থাকবেন না – এগুলো নিয়ে চিন্তা করুন। এবং আপনার নিজের মতামত এবং ভিন্ন মতামতের সত্যিকার যৌক্তিকতা নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করার চেষ্টা করুন।

নিজেকে সব সময়ে চ্যালেঞ্জ করুন। এবং একটি বিষয়ে আপনি যা জানেন, তার বাইরেও জানার চেষ্টা করুন, এবং এই নতুন জ্ঞান গুলোকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করুন।

যখন ভিন্ন মত, বা যুক্তিকে সহজে গ্রহণ করার মানসিকতা আপনার মাঝে চলে আসবে, তখন নিরপেক্ষ ভাবে তথ্যের দিকে তাকানো আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে।

০২. অতিরিক্ত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া

এই সমস্যাটি যাদের মধ্যে আছে তারা সাধারণত অস্থির ধরনের মানুষ। এই ধরনের মানুষ তথ্য সংগ্রহের জন্য যথেষ্ঠ সময় দিতে চায় না। তারা তথ্য সংগ্রহ করে ঠিকই, কিন্তু প্রাথমিক ভাবে যে তথ্য পায় তার ওপর নির্ভর করেই বেশি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে চায়।

এরা “first impression” এর ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। এটা বেশিরভাগ সময়েই ভুল সিদ্ধান্তে পরিনত হয়।

উদাহরণ হিসেবে একজন ব্যবসায়ীর কথা ধরা যাক। যিনি নতুন একজন এ্যাকাউন্টেন্ট খুঁজছেন। তাঁর এক বন্ধুর কাছে একজন এ্যাকাউন্টেন্ট এর ব্যাপারে শুনেই তাকে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে শুধু সিভির ওপর চোখ বুলালেন – ভালোমত পড়েও দেখলেন না। কোনওরকমে ইন্টারভিউ নিয়ে চাকরি দিয়ে দিলেন। অন্য কয়েকজন এর সাথে তুলনা করা, বা ফরমাল ইন্টারভিউ কল করার ব্যাপারটাও এড়িয়ে গেলেন।

এর ফলে হয়তো যে সেরা এ্যাকাউন্টেন্টকে তাঁর পাওয়ার কথা ছিল, তাকে তিনি পেলেন না। এভাবে দ্রুত সিদ্ধান্তে চলে আসার কারণে অনেকেই আর্থিক ও অন্যান্য ক্ষতির মুখে পড়েন।

এড়ানোর কৌশল:

চাপের মাঝে থাকলে অনেকেই অতিরিক্ত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন, আবার অনেকের স্বভাবই খুব বেশি ঘাঁটাঘাঁটি না করে দ্রুত কাজ করে ফেলা। এর কিছু ভালো দিক থাকলেও, অতিরিক্ত তাড়াহুড়া করলে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি।

আপনারও যদি এই সমস্যা থেকে থাকে, তবে প্রতিবার সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ে আগে তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত নিয়ে কি কি ক্ষতি হয়েছিল, সেগুলো নিয়ে একটু ভাবুন। এটা আপনাকে বিষয়টা উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে।

সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে চিন্তা করুন, আসলেই সিদ্ধান্তটি নেয়ার জন্য আপনার হাতে কতটা সময় আছে, তারপর সেই সময়ের পুরোটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করুন। আপনার হাতে যদি দুই দিন থাকে, তবে ২ ঘন্টায় সিদ্ধান্ত নেয়ার ঝোঁককে নিয়ন্ত্রণ করুন।

একটা বিষয় মনে রাখবেন, যদি কেউ আপনাকে অতিরিক্ত দ্রুত কোনও সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য চাপ দেয় – তবে বেশিরভাগ সময়েই এটা আপনাকে চিন্তা করতে না দেয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়। অপর পক্ষ আপনাকে অহেতুক বেশি তাগাদা দিলে বুঝবেন, হয়তোবা সে চায়না যে আপনি ব্যাপারটা ভালোমত ভেবে দেখেন। এর পেছনে তার এমন কোনও স্বার্থ আছে, যা আপনার জন্য ভালো হবে না।

তাই এই ধরনের চাপের মুখে পড়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। আর নিজের ভেতর থেকে এমন তাগাদা এলেও একটু সময় নিন। সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য হাতে যতটা সময় আছে, তার পুরোটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করুন। তাহলে দেখবেন, এমন অনেক কিছু চোখে পড়ছে – যা আগে পড়েনি। এর ফলে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে।

০৩. অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস

অহংকার

আত্মবিশ্বাস অবশ্যই একটি ভালো গুণ। এটা না থাকলে মানুষ আসলে কোনও কাজই ভালোমত করতে পারে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এটি। কিন্তু নিজের বুদ্ধি আর জ্ঞানের প্রতি অতিরিক্ত আস্থা থাকাটাও বিপজ্জনক।

বিল গেটস একবার বলেছিলেন, “সাফল্য ক্ষতিকর একজন শিক্ষক, সে বুদ্ধিমান মানুষকেও বিশ্বাস করায় যে সে ভুল করতে পারে না”

অনেক দিন ধরে সাফল্য আর প্রশংসা পেয়ে আসলে অনেক বুদ্ধিমান মানুষও এই ফাঁদে পড়ে যায়। এবং তখনই এরা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। এই জন্যেই নিজের চেষ্টায় সফল হওয়া অনেক বুদ্ধিমান ও ক্ষমতাবান উদ্যোক্তা/ শাসক/ জেনারেল শেষ দিকে এসে এমন ভুল করে বসেন – যা তাদের সবকিছু শেষ করে দেয়। এই ধরনের বহু মানুষ হাস্যকর হাস্যকর সব ভুল করে নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন।

অন্য কারও পরামর্শ তাঁদের আর কাজের মনে হয় না। তাঁদের মনে হয় তাঁরাই সবার চেয়ে ভালো বোঝেন। “আমি ভালো বুঝি/ আমার ভালো বোঝার ক্ষমতা আছে”, – এটা হল আত্মবিশ্বাস আর ”আমি সবার চেয়ে ভালো বুঝি/ আমার চেয়ে ভালো আর কেউ বোঝে না” – এটা হল অহংকার বা অতি আত্মবিশ্বাস। মানুষের মাঝে এই ধরনের চিন্তা একবার ঢুকে যাওয়া মানে, সেটাই তার পতনের শুরু।

অতি আত্মবিশ্বাস থেকে নেয়া ভুল সিদ্ধান্তগুলোই মানুষের পতন ডেকে আনে।

২০০০ সালে “জার্নাল অব বিজনেস ভেনচারিং” এ ওকল্যান্ড এবং জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকদের মিলিত একটি গবেষণা পত্রে দেখানো হয় যে, সাধারণ মানুষের চেয়ে উদ্যোক্তারা বেশি অতি আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ করেন। অনেকেই নিজের সত্যিকার জ্ঞান ও দক্ষতার মাপ বুঝতে এবং ঝুঁকি সামলানোর ক্ষমতা বুঝতে ভুল করেন – যা তাঁদের বিপদে ফেলে।

এই মানসিক বাধাটির কারণে অনেক সফল মানুষ শেষ দিকে গিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে যান, এবং নিজের সাফল্য ধরে রাখতে পারেন না।

এড়ানোর কৌশল:

এই কয়েকটি পয়েন্ট অনুসরণ করলে এই অভিশাপ থেকে বেঁচে থাকতে পারবেন

* নিজেকে সব সময়ে ছাত্র মনে করুন:

জ্যাক মা, ইলন মাস্ক, ওয়ারেন বাফেট – এমন বড় বড় উদ্যোক্তাদের বা সফল মানুষদের জীবনী ঘাঁটলে দেখা যায়, তাঁরা সব সময়েই নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করেন। কখনওই নিজেকে ভাবতে দেবেন না যে, আপনি সব জানেন। একজন মানুষের পক্ষে তা কখনওই সম্ভব নয়। প্রতিদিন নতুন কিছু শেখার জন্য বই পড়ুন, বা অন্য কিছু করুন। এটা করলে প্রতিদিনই আবিষ্কার করবেন যে, আপনি কিছু একটা জানতেন না। এই বোধ আপনাকে অহংকারী হওয়া থেকে বাঁচাবে – এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ে নিজেকে সর্বজ্ঞানী মনে হবে না।

* যে কোনও বিষয়ে অন্যের মতামত নিন:

আপনি একটি জিনিস যতই ভালো বোঝেন না কেন, সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অন্যদের মতামত জানার চেষ্টা করুন। সেই মতামতকে নিজের মতামতের সাথে তুলনা করুন, এবং বোঝার চেষ্টা করুন, আপনার মতামত বা আইডিয়া আসলেই ভালো কি না। এক্ষেত্রে একপেশে চিন্তা না করে, তথ্য ও বাস্তবতার ভিত্তিতে বিচার করুন। অন্যেরটা ভালো হলে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করুন। ইগো কে প্রশ্রয় দেবেন না। নিজের ভুল ধরার ও স্বীকার করার মানসিকতা রাখুন – তাহলে আর এই ফাঁদে পড়বেন না।

০৪. সবকিছু ছাঁচে ফেলে বিচার করা

কিছু মানুষ তার নিজের একটি নির্দিষ্ট ধ্যান ধারণা থেকে সবকিছু বিচার করে। ধরুন, একজন মহিলা সিইও বিরাট নারীবাদী। তাঁর মনেহয় পৃথিবীর সব পুরুষই অযোগ্য। একজন পুরুষ যোগ্যতর হলেও তিনি হয়তো তাকে কাজে নিয়োগ দেবেন না, বা যোগ্য বেতন-প্রমোশন দেবেন না। এর ফলে একজন ভালো কর্মী সুযোগ পেলেই তাঁকে ছেড়ে যাবে। আবার অনেকে মেয়েদের অযোগ্য মনে করেন। শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে হয়তো কাউকে নিয়োগ দিলেন না – এর ফলে তিনিও ভালো একজন কর্মী থেকে বঞ্চিত হবেন।

শুধু ছেলে-মেয়ে নয়, বিভিন্ন ধরনের মানুষের প্রতি বিভিন্ন জনের ‘এলার্জি’ থাকে। কেউ কেউতো এলাকা, রাশি -এইসব বিচার করে মানুষের সাথে সম্পর্ক মেইনটেন করে। – এই ধরনের মানসিকতা বেশিরভাগ সময়েই ভুল সিদ্ধান্তের জন্ম দেয়।

আবার কিছু মানুষ, আগের ঘটনার ভিত্তিতে নতুন সিদ্ধান্ত নেন। যেমন ধরুন ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বাজারে জিন্স এবং পলো টি-শার্ট এর চাহিদা ভালো ছিল – শুধুমাত্র এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কেউ একজন ২০১৯ সালে যদি তার সব পুঁজি বিনিয়োগ করে –তাহলে হয়তো তার পুঁজি হারানোরও সম্ভাবনা থাকে। এই ধরনের ট্রেন্ডের মাঝে সূক্ষ্ণ প্যাটার্ণ থাকে, যেগুলো শুধু এই ধরনের ছোট ধারণার ওপর নির্ভর করে বোঝা সম্ভব নয়।

মার্কেটের ট্রেন্ড বদলাতে একটা রাত লাগে। তবে তার আভাস পাওয়া সম্ভব যদি কেউ সত্যিকার অর্থে চোখ কান খোলা রাখে এবং সঠিক ভাবে তথ্য নিয়ে গবেষণা করে।

এড়ানোর কৌশল:

এই সমস্যা এড়ানোর কৌশল একটাই, কোনওকিছুকে ছাঁচে ফেলে বিচার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বাদ দিতে হবে। প্রতিটি পরিস্থিতি ও মানুষ আলাদা। চেহারা বা পোশাক দেখে যেমন কোনও মানুষের সত্যিকার যোগ্যতা মাপা যায় না, আগে কত বছর ধরে মানুষ কি পরিমানে কিনেছে – সেটা বিচার করেও পন্যের বাজার-সম্ভাবনা যাচাই করা যায় না।

চেহারা, লিঙ্গ, বাড়ি কোথায় – ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে মানুষের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার বদলে তার কাজ ও ব্যবহার দেখে সিদ্ধান্ত নিন। আর শুধু ডাটার অংক দেখে সিদ্ধান্ত নেয়ার বদলে সত্যিকার এ্যানালাইসিস করে সিদ্ধান্ত নিন। প্রয়োজনে এক্সপার্টদের সাহায্য নিন। – তাহলে এই ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

পরিশিষ্ট:

সত্যিকথা বলতে নিজের ভেতরে এই ধরনের মানসিক বাধাগুলো আসলেই আছে কিনা, তা বোঝাটা আসলেই একটু কঠিন। মূলত এগুলো মানুষের অবচেতন মনে কাজ করে। অনেক সময়ে অন্যরাও বুঝতে পারে না যে, কেন একজন মানুষ ভালো একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ফলো করার পরও ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। – এর মূল কারণ হল ওপরে বর্ণনা করা এই সূক্ষ্ণ মানসিক বাধাগুলো। এগুলো দূর করতে পারলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহীতা হওয়ার পথে আপনি অনেকটাই এগিয়ে যাবেন বলে আশা করা যায়।

২০১১ সালে প্রকাশিত হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ এর একটি আর্টিকেলের আলোচনা, এবং কিছু সাইকোলজিক্যাল জার্নালের রিপোর্টের বক্তব্যগুলো এক করে আমরা সহজ ভাষায় এই টপিকটি আপনার জন্য কাভার করার চেষ্টা করেছি।

সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বুঝতে এবং নিজের সীমাবদ্ধতার দিকে সত্যিকার নজর দিতে যদি এই লেখাটি আপনার একটুও উপকারে আসে তাহলেই আমাদের প্রচেষ্টা সফল হবে।

লেখাটির বিষয়ে আপনার যে কোনও মতামত আমাদের কমেন্ট করে জানান। আপনার প্রতিটি মতামতই আমাদের কাছে মহামূল্যবান। 

আর যদি মনে হয় লেখাটি অন্যদেরও উপকার করবে – তবে শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন। 

আমরা আমাদের পাঠকদের কাছ থেকেও অনুপ্রেরণামূলক লেখা আশা করছি।  এই ধরনের লেখা যদি আপনিও লিখতে পারেন তবে write@test.edaning.com – এ ইমেইল করতে পারেন।  আপনার লেখা যত্ন সহকারে আপনার নাম সহ আমরা প্রকাশ করব। 

নিয়মিত অনুপ্রেরণামূলক ও আত্ম উন্নয়ন মূলক লেখা পাওয়ার জন্য আমাদের সাথে থাকুন।  সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার সাথে আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *