সফল উদ্যোক্তা হতে চাই – এই কথাটা অনেকের মনেই সারাদিন বাজে। তবে সফল উদ্যোক্তা হতে চাই বলা এবং সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য কাজ করা – দু’টো এক জিনিস নয়।
কথায় বলে – “বলা যত সহজ, করা তত কঠিন”। মুখ দিয়ে কথা বলতে তেমন কষ্ট হয় না, টাকাও খরচ হয়না। কিন্তু সেই কথাকে বাস্তবে পরিনত করতে যথেষ্ঠ কষ্ট করতে হয় – আবার পকেটের টাকাও খরচ করতে হয়।
বিখ্যাত সেলফ ডেভেলপমেন্ট বই রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড এর লেখক রবার্ট কিওসাকির মতে, আমাদের স্কুল গুলোতে কর্মচারী হতে শেখানো হয়। শেখানো হয় অন্যের বানানো নিয়ম ফলো করা। খুব কম স্কুল বা শিক্ষকই ছাত্রছাত্রীদের ভেতরকার আসল সৃষ্টিশীলতা এবং নেতৃত্বগুণ বের করে আনার চেষ্টা করেন।
শিক্ষা ব্যবস্থা ও সামাজিক কারণে বেশিরভাগ মানুষের মাথায় নির্দিষ্ট সময় কাজ করে নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিয়ে ‘নিরাপদ’ ও ‘সুখী’ জীবন এর ধারণা সেট হয়ে যায়।
তবে কিছু মানুষ আছে, যাদের কাছে জীবনের মানে শুধু নিরাপত্তা বা সুখ নয়। তারা নিজেদের মত করে কিছু করতে চায়। অন্যরা যা করছে বা বলছে – তা অন্ধের মত অনুসরন করার বদলে তারা নিজেরা স্বপ্ন দেখে এবং সেই স্বপ্ন পূরণ করতে চায়।
এই ধরনের মানুষের মধ্যে প্রধান হলেন উদ্যোক্তারা। বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে বন্দী না থেকে তাঁরা নিজে কিছু গড়তে চান। সাধারণ মানুষের অন্যের কর্মী না হয়ে নিজেই অন্য কর্মীদের কাজে লাগাতে চান। তাঁদের অনেকেই বার বার বলেন “সফল উদ্যোক্তা হতে চাই”।
কিন্তু এইসব মানুষদের মধ্যেও কিছু কিছু ব্যাপার ঢুকে যায়। তাঁরা নিজেরাও বোঝেন না যে, নিজের অজান্তেই কিছু প্রচলিত মানসিকতা কখন তাঁদের মাঝে ঢুকে গেছে। এবং এই মানসিকতাগুলো তাঁদের সাফল্যের পথে বাধা। আজ আমরা এমনই একটি মানসিকতা, ‘৯টা – ৫টা’ কাজ করা নিয়ে কথা বলব।
সফল উদ্যোক্তা হতে চাই বনাম ৯টা-৫টা মানসিকতা
বর্তমান বিশ্বে যে কয়জন সফল উদ্যোক্তা অন্যদের অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছেন, তাঁদের মধ্যে গ্রান্ট কার্ডন অন্যতম একজন। তাঁর লেখা বই ও তাঁর বক্তৃতা হাজার হাজার মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং সফল উদ্যোক্তা হওয়ার পথ দেখিয়েছে।
৬০ বছর বয়সী এই উদ্যোক্তা ও মোটিভেটরের মোট সম্পদের পরিমান বর্তমানে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলা টাকায় যা ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি!
উদ্যোক্তা ও কর্মী মানসিকতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে গ্রান্ট বলেন:
“আপনি কি জানেন, যারা এখন সাফল্যের চূড়ায় আছেন, কেন তাঁরা এখনও এত কষ্ট করেন? কেন নিয়মিত কাজ করে যান? – কারণ তাঁরা কোটা পূরণের জন্য কাজ করেন না, তাঁরা নিজের যোগ্যতার পুরোটা ব্যবহার করেন। নিজের ক্ষমতার পুরোটা কাজে লাগান। তাঁরা নিজেদের দক্ষতাকে সব সময়ে এক ধাপ বাড়াতে চান। নিজের কর্মক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করা তাঁরা নিজের দায়িত্ব মনে করেন।”
![সফল উদ্যোক্তা হতে](https://i0.wp.com/i.imgur.com/AGwkqTn.jpg?resize=640%2C423&ssl=1)
– একটু চিন্তা করলেই ব্যপারটা বুঝতে পারবেন। জ্যাক মা, বিল গেটস, ইলন মাস্ক, মার্ক জুকারবার্গ – বা এমন আরও অনেক বিলিওনেয়ারের কোনওকিছুরই অভাব নেই। তাঁরা হাত বাড়ালেই যে কোনও কিছু কিনতে পারবেন। তাঁদের টাকা তাঁদের পরের ১০ প্রজন্ম মিলেও শেষ করতে পারবে না। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ তাঁদের চেনে। তাঁদের খ্যাতি এমনকি বড় বড় ফিল্মস্টারদের চেয়েও অনেক বেশি। তাঁরা পৃথিবীর চেহারাই পাল্টে দিয়েছেন।
কিন্তু তবুও তাঁরা প্রতিদিন নিয়ম করে অফিস করেন। মিটিং করেন – নতুন নতুন আইডিয়া ও ব্যবসা নিয়ে কাজ করেন।
এর মূল কারণ, তাঁরা নিজের কাজের ক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে চান। তাঁরা দেখিয়ে দিতে চান তাঁরা কি পারেন। বেশিরভাগ মানুষের মত তাঁরা শুধু কিছু সময় কাজ করে কয়েকটি টাকা রোজগার করে বেঁচে থাকতে চান না।
যাদের মধ্যে নিজের ক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করে পৃথিবীকে দেখিয়ে দেয়ার বদলে ৯টা-৫টা কাজ করার, অথবা নির্দিষ্ট সময় কাজ করে টাকা ইনকাম করার মানসিকতা থাকবে, তারা জীবনেও সফল উদ্যোক্তা হতে পারবে না।
উদ্যোক্তা হতে চাইলে প্রথমেই এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যতক্ষণ কাজ করার ক্ষমতা আছে – প্রতিদিন ততক্ষণ কাজ করে যেতে হবে।
অন্যদের দেখে বা অন্য কোনও ভাবে যদি নিজের ভেতরে দিনে ঘড়ি ধরে একটি নির্দিষ্ট সময় কাজ করার পর ছুটি নেয়ার মানসিকতা আপনার মাঝে আছে কি না – সেটা খুঁজে বের করুন এবং সেই অনুযায়ী নিজেকে পরিবর্তন করুন।
![জ্যাক মা উদ্যোক্তা](https://i0.wp.com/test.edaning.com/wp-content/uploads/2018/10/Jack_Ma_Quote-01-e1541424248909.png?resize=640%2C394&ssl=1)
আলিবাবা ডট কম এর একদম শুরুর দিকে, জ্যাক মা এর একটি উক্তি এখনও খুব জনপ্রিয়। তিনি বলেছিলেন – “আমরা যদি এখানে ৮টা-৫টা কাজ করার চিন্তা করি – তবে এটা কোনও হাই টেক কোম্পানী নয়। যদি সেরকম মানসিকতা আমাদের মাঝে থাকে – তবে আমাদের অন্যকিছু করা উচিৎ”
উদ্যোক্তা হতে গেলে নিজেকে সময়ের ফ্রেমে আটকে ফেললে হবে না। ঘড়িতে কয়টা বাজে সেই হিসেবে কাজ বন্ধ করার বদলে কতটুকু কাজ হয়েছে – এবং যথেষ্ঠ কাজ হয়েছে কি-না – এই হিসেব করে দিনের কাজের ইতি টানতে হবে।
সফল উদ্যোক্তা হতে হলে দিনে কয় ঘন্টা কাজ করতে হবে:
কিছু সফল উদ্যোক্তা যেমন সবকিছু পাওয়ার পরও দিন রাত খাটাখাটনি করেন – আবার কিছু আছেন যারা আরাম আয়েশেও দিন কাটান। – কিন্তু এই দুই ধরনের উদ্যোক্তাই তাঁদের শুরুর সময়টাতে দারুন কষ্ট করেছেন।
সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য কত ঘন্টা কাজ করবেন?
উদ্যোক্তা ও নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলিং লেখক গ্রান্ট কার্ডন তাঁর মাল্টিমিলিয়ন ডলার ব্যবসা দাঁড় করানোর আগে ভয়ঙ্কর ভাবে ঋণগ্রস্থ ছিলেন। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করে তিনি সেই অবস্থা থেকে উঠে আসেন এবং বিশাল এক ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের পাশাপাশি নিজেকে একজন প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় মানুষে পরিনত করেন।
তাঁর মতে, একজন উদ্যোক্তাকে যদি সত্যিই অনেক বড় সাফল্য পেতে হয়, তবে তাকে সপ্তাহে অন্তত সপ্তাহে ৯৫ ঘন্টা কাজ করতে হবে। তিনি বলেন – “বেশিরভাগ মানুষ ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কাজ করে। কিন্তু আমি সপ্তাহে ৯৫ ঘন্টা কাজ করেছি। কেউ যদি সত্যিই নিজের চেষ্টায় মিলিওনেয়ার হতে চায় – তবে তাকে দিনে ৮ ঘন্টার বদলে অন্তত ১৪ ঘন্টা কাজ করতে হবে”
তিনি আরও বলেন – “আপনি যদি অন্য সব মানুষের চেয়ে বেশি সময় ধরে কাজ করেন – তবে আপনি নিশ্চই সৌভাগ্যের দেখা পাবেন। – এবং সেই সৌভাগ্য আসতে শুরু করার পরও অনেক দিন সেটা চালিয়ে যেতে হবে। তাহলেই তা স্থায়ী হবে।”
কার্ডনই একমাত্র মিলিওনেয়ার নন যিনি সপ্তাহে সাত দিন দিনে ১২ ঘন্টার বেশি কাজ করেছেন।
বর্তমান বিশ্বের আরও একজন জনপ্রিয় ও সফল মিলিওনেয়ার উদ্যোক্তা গ্যারি ভেইনারচাক বলেন, “যদি আপনি সত্যিই বড় উদ্যোক্তা হতে চান, তবে প্রথম বছর অন্তত দিনে ১৮ ঘন্টা খাটতে হবে।” – তিনি আরও বলেন – “ব্যবসা শুরুর প্রথম বছরে প্রতি ২৪ ঘন্টার ১৮ ঘন্টার প্রতিটি মিনিট আপনার ব্যবসার পেছনে খরচ করতে হবে – যদি আপনি সফল হতে চান। আমার মনেহয়, ব্যবসা শুরুর ১ থেকে ২ বছরের মধ্যে এত লোক ব্যর্থ হওয়ার প্রধান কারণই হল তারা বোঝেনা যে প্রথম এক-দুই বছরে কি পরিমান পরিশ্রম করতে হয়”
![সফল উদ্যোক্তা হতে চাই](https://scontent.fdac29-1.fna.fbcdn.net/v/t1.0-9/52326974_2160105304319447_5579895367773716480_n.png?_nc_cat=101&_nc_ht=scontent.fdac29-1.fna&oh=38a48913e3e969b1a7124d384188adcb&oe=5D0D542F)
আরেক মিলিওনেয়ার উদ্যোক্তা ডেইমন্ড জন বলেন, “সাফল্যের গোপন সূত্র শেষ পর্যন্ত একটাই: পরিশ্রম করুন। নিজের জান বের করে দিন। সবার আগে ঘুম থেকে উঠুন এবং সবার পরে ঘুমাতে যান – এবং নিজের জীবন বের করে দিন। এটাই যথেষ্ঠ।”
পরিশিষ্ট:
পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি – এই কথাটা যুগে যুগে বহু মানুষ প্রমাণ করেছেন। আর এই মানুষদের মাঝে সবচেয়ে বেশি আছেন সম্ভবত সফল উদ্যোক্তারা। আমরা এখানে কয়েকজন সফল উদ্যোক্তার দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরেছি – যাতে আপনি উদ্যোক্তা হতে চাই বলার পাশাপাশি পরিশ্রম করতেও অনুপ্রেরণা পান।
সঠিক পথে, নিজের জন্য পরিশ্রম করলে সাফল্য আসবেই। আর সেই পরিশ্রম করার পথে যদি এই লেখাটি আপনাকে একটুও অনুপ্রাণিত করে – তাহলেই আমাদের প্রচেষ্টা সফল।
লেখাটির বিষয়ে আপনার যে কোনও মতামত আমাদের কমেন্ট করে জানান। আপনার প্রতিটি মতামতই আমাদের কাছে মহামূল্যবান।
ভালো লাগলে এই পোস্টের নিচে রেটিং দিয়ে অনুপ্রাণিত করুন। যদি কোনও বিশেষ বিষয় নিয়ে অনুপ্রেরণামূলক বা শিক্ষনীয় লেখা চান – তবে সেটাও কমেন্ট করে জানান। চাইলে নিজেও লিখে পাঠাতে পারেন write@test.edaning.com – ইমেইল এ।
আর যদি মনে হয় এই লেখাটি অন্যদেরও সফল উদ্যোক্তা হতে পরিশ্রম করতে অনুপ্রাণিত করবে – তবে শেয়ার করে অন্যদের দেখার সুযোগ করে দিন।
প্রতিদিন অনুপ্রেরণামূলক লেখা ও টিপসের জন্য নিয়মিত আমাদের সাথে থাকুন। সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার সাথে আছে।