মেধাবী হওয়ার উপায়: নিজের মেধা চেনার ও সঠিক ভাবে কাজে লাগানোর কৌশল


মেধাবী হওয়ার উপায় বা মেধাবী ছাত্র হওয়ার বৈজ্ঞানিক কৌশল মানে কিন্তু বুদ্ধি বাড়ানোর উপায় নয়। পৃথিবীতে বহু বুদ্ধিমান ও প্রতিভাবান মানুষ আছেন, যাদের মেধাবী ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। আসলে নিজের মত করে সবারই মেধা আছে। কিন্তু সেই মেধাকে সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারলেই তাকে আমরা মেধাবী বলি। অনেক সময়ে সঠিক পরিবেশ ও পরিচর্যার অভাবে অনেক মেধাবীকেই মেধাহীনের অপবাদ সহ্য করতে হয়।

প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় একটি সমস্যা হল, সবার জন্য একটিই শিক্ষার মডেল। এক সাইজের জামা সবাইকে পরতে বাধ্য করা হয়। সেই জামা যার ফিট করে না, তাকেই মেধাহীন হিসেবে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সব মানুষ একভাবে শিখতে পারে না। কেউ পড়ে শিখতে পারলে, কেউ শুনে শেখে, কেউবা দেখে শেখে।

এখন যদি শুধু পড়ে বা শুনে শেখার ওপর ভিত্তি করে সবাইকে মাপা হয় – তবে সেটা কোনওভাবেই সুবিচার হবে না।  

সাধারণ ভাবে মেধা বলতে আমরা বুঝি কোনওকিছু শেখার ক্ষমতা ও সেই শিক্ষাকে সৃষ্টিশীলতা ও সার্থকতার সাথে কাজে লাগানোর ক্ষমতা।

মেধাবী

মেধাবী তাদেরই বলা হয়, যাদের মেধা বিকশিত হয়। অর্থা‌ৎ মেধাবী হওয়া মানে নিজের মেধাকে বিকশিত করা।

সবার মেধা একভাবে বিকশিত হয় না। মানুষের মেধা বিভিন্ন ভাবে বিকশিত হয়। সবার মাঝেই সবকিছু শেখার ও সবকিছু নিয়ে কাজ করার যোগ্যতা আছে – কিন্তু সবার শেখার ধরন ও আদর্শ কৌশল এক নয়।

বৈজ্ঞানিকদের মতে, শেখার ক্ষেত্রে মূলত মানুষের ৪টি ক্যাটাগরি আছে:

০১. দেখে শেখা

এই ধরনের মানুষেরা চোখের সামনে দেখা জিনিস বেশি মনে রাখতে পারে। চোখে দেখা কোনও ঘটনা, মানুষ বা দৃশ্য তারা খুব সুন্দর করে মনে রাখতে পারে। কোনও গল্প বা ঘটনা যদি ছবির সাহায্যে বোঝানো হয় – তাহলে এরা তা খুব ভালোকরে বুঝতে পারে। স্লাইড শো, চার্ট – ইত্যাদির মাধ্যমেও এরা যেমন ভালো করে বুঝতে পারে, তেমনি মনেও রাখতে পারে।

০২. শুনে শেখা

এই ধরনের মানুষ কানে শুনে খুব ভালো মনে রাখতে পারে, এবং শিখতে পারে। এরা বই পড়ার বদলে অডিও বুক, রেডিও প্রোগ্রাম, টেপ এর মাধ্যমে – অথবা অন্যের মুখে শুনে খুব ভালো মনে রাখতে পারে এবং বুঝতে পারে। এমন অনেক ছাত্র আছে, যারা বই পড়ে তেমন কিছু বুঝতে না পারলেও লেকচার শুনে খুব ভালো বুঝতে পারে – এরা আসলে এই দলে পড়ে।

০৩. লেখা ও পড়ার মাধ্যমে শেখা

এই ধরনের মানুষ লিখিত জ্ঞানের অর্থ বুঝতে এবং সেগুলো মনে রাখতে খুব পারদর্শী। এরা পড়া এবং লেখার কাজ খুব আনন্দ নিয়ে করে। কারণ এই মাধ্যমে তারা যে কোনও বিষয় সবচেয়ে ভালো বুঝতে ও মনে রাখতে পারে।

০৪. হাতে কলমে শেখা

কিছু মানুষ শুনে, দেখে বা পড়ার চেয়ে হাতে কলমে কাজ করে সহজে শিখতে ও বুঝতে পারে। ইংরেজীতে এদের Kinaesthetic Learners বা Practical Learners বলা হয়। এদের মস্তিষ্কের গঠনই এমন যে, এরা হাতের স্পর্শ ও কাজ করার মাধ্যমে যে কোনও বিষয় খুব ভালো করে শিখতে ও মনে রাখতে পারে। রাতদিন এদের কানের কাছে বৈজ্ঞানিক থিওরির লেকচার দিন, অথবা বইয়ের মাঝে ডুবিয়ে রাখুন – এরা তেমন কিছু শিখতে পারবে না। কিন্তু ল্যাবে নিয়ে একবার প্র্যাকটিক্যালি বা হাতে কলমে দেখিয়ে দিন – এদের চেয়ে ভালো আর কেউ বুঝবে না।

মেধাবী হওয়ার উপায় ও কৌশল

এই যে ৪ ধরনের মানুষের কথা বলা হল, এরা কিন্তু সবাই সবকিছু শেখার ও মনে রাখার যোগ্যতা রাখে – কিন্তু এদের শেখার কার্যকর মাধ্যম আলাদা।

এখন যে ছাত্রটি বা লোকটি বই পড়ে বা লেকচার শুনে মনে রাখতে বা শিখতে পারে না, তাকে কি এক কথায় মেধাহীন বলে দেয়া ঠিক? হাতে কলমে দেখিয়ে দিলে সে হয়তো অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে।

কাজেই, যে কেউ নিজেকে মেধাবী প্রমাণিত করতে পারে – যদি সে নিজের মেধা বিকাশের সঠিক উপায় খুঁজে পায় এবং সেটাকে কাজে লাগায়। – এটাই আসলে সত্যিকার মেধাবী হওয়ার উপায়।

এখন কথা হল, আপনি কিভাবে আপনার নিজের বা আপনার সন্তান বা ছাত্রের সঠিক মেধা বিকাশের উপায় খুঁজে পাবেন, এবং তাকে কাজে লাগাবেন?

চলুন, এর ৩টি উপায় জেনে নেয়া যাক।

 

মেধাবী হওয়ার উপায়:

০১. প্রথমেই খুঁজে বের করুন, আপনি কোন দলের মেধাবী

মেধাবী

মেধাবী হতে হলে, মানে নিজের মেধার সেরা বিকাশ ঘটাতে হলে আপনাকে প্রথমেই বুঝতে হবে আপনি কোন ধরনের মেধাবী। মানে, আগে বলা ৪ ধরনের শিক্ষার্থীর মধ্যে আপনি কোনটি।

এটা খুঁজে বের করা খুব একটা কঠিন নয়।

আপনার আগ্রহের বিষয়ের ওপর যে কোনও একটি টপিক বেছে নিন। তারপর সেই টপিকের ওপর পড়াশোনা করুন, লেকচার শুনুন, ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখুন, এবং বিষয়গুলো হাতে কলমে প্রাকটিস করুন।

পড়ার বিষয়টি লেখার চেষ্টা করুন। এবং দেখুন কতটা বুঝেছেন এবং মনে রাখতে পেরেছেন। লেকচার শোনার পর নিরিবিলি চিন্তা করুন। মনে করার চেষ্টা করুন। ভিডিও টিউটোরিয়ালের বিষয়গুলোও পরে মনে করার ও কাজে লাগানোর চেষ্টা করুন। –

যদি দেখেন ভালোমত মনে করতে পারছেন না, তখন লেকচার শুনতে শুনতে, বা পড়তে পড়তে একই সময়ে সেই শিক্ষাগুলো কাজে লাগানোর চেষ্টা করুন।

ধরুন আপনি ফেসবুকে হেডফোন বিক্রী করার উপায় শিখতে চান। এখন প্রথমে গুগলে সার্চ করুন, “how to sell headphones on facebook” – বেশ কিছু আর্টিকেল আপনার সামনে হাজির হবে। একে একে আর্টিকেল গুলো পড়ে ফেলুন। – তারপর মনে করার ও লেখার চেষ্টা করুন, কি কি শিখলেন।

এরপর ইউটিউবে একই টার্ম সার্চ করুন। তারপর ভালো ভালো কয়েকটি ভিডিও দেখুন। এবং চোখ বন্ধ করে শুনুন। তারপর মনে করার চেষ্টা করুন। – দেখুন কতটা শিখতে পেরেছেন।

এরপর চেষ্টা করুন, পড়া, শোনা, বা দেখার পাশাপাশি একই সময়ে সেই কাজগুলো করার।

পড়াশুনার ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন। বইয়ের পড়াগুলো পড়ে ও লিখে বোঝার চেস্টা করুন। নিজের পড়া রেকর্ড করে শুনুন। পড়ার বিষয়ের ওপর ভিডিও দেখুন। সম্ভব হলে সেগুলো ব্যবহারিক ভাবে করার চেষ্টা করুন।

এভাবে পরীক্ষা করতে থাকলে আপনি অবশ্যই আপনার মেধা বিকাশের বা মেধাবী হওয়ার সঠিক পদ্ধতি পেয়ে যাবেন।

০২. মনোযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করুন

মেধাবী হওয়ার কৌশল

আপনি যে পদ্ধতিতেই শেখার চেষ্টা করেন না কেন – আপনাকে মনোযোগী হতে হবে। যেটাই করবেন, সেটার জন্য নির্দিষ্ট সময় আলাদা করুন। এবং সেই সময়ের মধ্যে শুধু সেই কাজটিই করুন। অন্য কিছুতে মনোযোগ দেবেন না।

মনোযোগ বৃদ্ধির উপায় হিসেবে পমোডরো টেকনিক ব্যবহার করতে পারেন। ২৫ মিনিট টানা একটি বিষয় নিয়ে কাজ করে তারপর ৫ মিনিটের ব্রেক নিন। এভাবে ৪ বার করে ১০০ মিনিট কাজ করে ১৫-২০ মিনিটের ব্রেক নিন – তারপর আবার শুরু করুন। – মনোযোগ বাড়ানোর জন্য এটা খুবই ভালো একটি পদ্ধতি।

এছাড়া মেডিটেশন প্রাকটিস করতে পারেন। ছোট একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে সেটি নিভে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেদিকে তাকিয়ে থাকুন। প্রথম প্রথম দারুন কষ্ট হবে। কিন্তু একটা সময়ে এটা অভ্যাস হয়ে যাবে। এটা অভ্যাস হয়ে গেলে আপনি যে কোনও কিছুতে অনেক্ষণ ধরে পূর্ণ ফোকাস ধরে রাখতে পারবেন।

পড়া বা কাজ করার সময়ে ভুলেও ফেসবুক বা অন্য সোশ্যাল মিডিয়া চেক করবেন না। বর্তমানে মনোযোগ নষ্ট করার জন্য এগুলোর চেয়ে বড় কিছু আর নেই।

রিলেটেড পোস্ট: মস্তিষ্কের ক্ষমতা বৃদ্ধির উপায় হিসেবে শরীরচর্চা

০৩. মেধা বিকাশের মূল উপায়ের পাশাপাশি অন্যগুলোও ব্যবহার করুন

মেধাবী হওয়ার উপায়

মেধাবী হওয়ার উপায় হিসেবে নিজের মেধা বিকাশের মূল পদ্ধতি খুঁজে বের করা এবং মনোযোগ বাড়ানো যথেষ্ঠ কার্যকর হলেও, যখনই নতুন কিছু শিখবেন – সেটা ভালোভাবে রপ্ত করার জন্য বাকি কৌশলগুলোও কাজে লাগাবেন।

ধরুন আপনি পড়ে খুব ভালো মনে রাখতে পারেন – তবুও সেই বিষয়ে শোনা, দেখা ও প্রাকটিস করার কৌশল কাজে লাগাবেন। এতে সেটি আরও ভালোভাবে রপ্ত হবে।

যখনই নতুন কিছু জানবেন – তখনই সেটি যথা সম্ভব প্রাকটিস করার চেষ্টা করুন। সেটা নিয়ে ভিডিও খুঁজে বের করুন, আলাদা আলাদা মানুষ সেটা নিয়ে কি মতামত দিয়েছেন – তা জানার চেষ্টা করুন। বিভিন্ন সোর্স থেকে তথ্য জানার চেষ্টা করুন। আজকের ইন্টারনেটের যুগে যে কোনও বিষয়েই বিভিন্ন ধরনের তথ্য জানা অন্য যে কোনও সময়ের চেয়ে সহজ। আপনার ডিভাইসটিকে শুধু সোশ্যাল মিডিয়া বা গেম খেলার ডিভাইস না বানিয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে সহায়ক বন্ধুতে পরিনত করুন।

আপনার মেধা বিকাশের পদ্ধতি যেটাই হোক না কেন, একটি নোটবুক/ডায়েরী নিজের কাছে সব সময়ে রাখুন। নিজের আগ্রহ বা কাজের বিষয়ে নতুন কোনও ফ্যাক্ট বা আইডিয়া জানতে পারলেই তা লিখে রাখুন এবং মাঝে মাঝে তাতে চোখ বুলান। এতে পরীক্ষা বা অন্য কোনও প্রয়োজনের সময়ে সেগুলো চট করে মনে পড়ে যাবে।

এভাবে চললে যে কোনও বিষয়ে আপনার জ্ঞান ও দক্ষতা অনেক বেড়ে যাবে। আপনার মেধার বিকাশ এতটা হবে যে, অন্যরা তো বটেই – আপনি নিজেও অবাক হয়ে যাবেন।  

পরিশিষ্ট:

আগেই বলেছি, আবারও বলি, প্রতিটি মানুষই মেধাবী হয়ে জন্মায়। কিন্তু প্রতিটি মানুষের শেখা ও মেধার বিকাশের ধরন আলাদা। আপনার শেখার সঠিক পদ্ধতি ও মেধা বিকাশের ধরন বের করে, পূর্ণ মনোযোগে শিখতে থাকলে – আপনিও মেধাবী হিসেবে বিকশিত হবেন।

মেধার বিষয়টি ভালো ভাবে বুঝতে এবং তাকে কাজে লাগাতে এই লেখাটি যদি আপনাকে একটুও সাহায্য করে – তাহলেই আমাদের প্রচেষ্টা সফল হবে।

লেখাটির বিষয়ে আপনার যে কোনও মতামত আমাদের কমেন্ট করে জানান। আপনার প্রতিটি মতামতই আমাদের কাছে মহামূল্যবান।

ভালো লাগলে এই পোস্টের নিচে রেটিং দিয়ে অনুপ্রাণিত করুন। যদি কোনও বিশেষ বিষয় নিয়ে অনুপ্রেরণামূলক বা শিক্ষনীয় লেখা চান – তবে সেটাও কমেন্ট করে জানান। চাইলে নিজেও লিখে পাঠাতে পারেন write@test.edaning.com – ইমেইল এ।

আর যদি মনে হয় এই লেখাটি অন্যদেরও নিজের মেধার বিকাশে অনুপ্রাণিত করবে – তবে শেয়ার করে অন্যদের দেখার সুযোগ করে দিন।

প্রতিদিন অনুপ্রেরণামূলক লেখা ও টিপসের জন্য নিয়মিত আমাদের সাথে থাকুন। সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার সাথে আছে।

পোস্টটি শেয়ার করুন !