আমরা যখন রাস্তায় বের হই তখন অনেক রকমের মানুষ দেখি। কেউ গরিব, কেউ ধনী, কেউ মধ্যবিত্ত। আমরা সাধারনত পোশাক, পরিবহন, চেহারা, ফোন- এসব দিয়ে মানুষটির অর্থনৈতিক অবস্থা আন্দাজ করার চেষ্টা করি। কিন্তু আপনি কি জানেন অনেক সময়েই আমাদের এই আন্দাজ ভুল হয়?
আমরা রাস্তায় যতজন ধনী মানুষকে দেখতে পাই, এদের বেশিরভাগই আসলে সত্যিকার ধনী নয়। যে লোকটি ব্র্যান্ডের পোশাক গায়ে দিয়ে, দামী ঘড়ি আর সানগ্লাস পরে বন্ধুকে নিয়ে দামী রেস্টুরেন্টে ঢুকলো, তার বেতনের টাকা হয়তো তিন দিন আগেই শেষ হয়ে গেছে – এবং এখন সে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে চলছে। রাস্তায় যতগুলো গাড়ি দেখা যায়, তার অনেকগুলোর মালিকেরই আসলে গাড়ি কেনার পয়সা নেই। এগুলোর বেশিরভাগই লোনের টাকায় কেনা।
ইদানিং “লাইফস্টাইল মেইনটেন” কথাটা আমরা অনেক বেশি শুনছি। একটা ভালো লাইফস্টাইল মেইনটেন না করলে নাকি সমাজে চলা কষ্ট। সমাজে নিজেকে স্বচ্ছল প্রমান করতে গিয়ে অনেকেই আয়ের চেয়ে বেশি খরচ করে ফেলেন। দেখে মনে হয় যে তারা খুব ভালো আছেন। ভালো থাকছেন, খাচ্ছেন, খরচ করছেন – কিন্তু অন্যদিকে তাঁদের ভবিষ্যতের বারোটা বাজছে। যে টাকাটা তারা ভবিষ্যতের জন্য জমাতে বা কোথাও বিনিয়োগ করতে পারতেন, সেটাই তারা “লাইফস্টাইল মেইনটেন”, বা সোজা বাংলায় “বড়লোকি দেখাতে” গিয়ে নষ্ট করে ফেলছেন।
সময়ের আগে যদি আপনি লাইফস্টাইল মেইনটেন করতে যান – তবে আপনি কোনওদিন সত্যিকার বড়লোক হতে পারবেন না। আর সেই সাথে বড়লোকি দেখানোর আরও কিছু ভয়াবহ কুফল আছে, যা আপনার জীবনকে সমস্যায় পূর্ণ করবে। চলুন জেনে নিই নকল লাইফস্টাইল মেইনটেন বা বড়লোকি দেখানোর ১০টি মূল কুফল।
০১. আপনি সব সময়ে দু:শ্চিন্তায় থাকবেন
হাই লাইফস্টাইল মেইনটেন করার কারণে হয়তো আপনি অনেক কিছু উপভোগ করবেন। আপনার চলাফেরা, পোশাক – সবকিছুতেই একটা ঝকঝকে চকচকে ভাব থাকবে। কিন্তু আপনি সব সময়ে একটা দু:শ্চিন্তার মধ্যে থাকবেন। আপনার এই লাইফস্টাইল মেইনটেন করতে গিয়ে অনেক সময়েই আয়ের চেয়ে বেশি খরচ করতে হবে।
সেইসাথে টাকা না থাকলেও আপনাকে নির্দিষ্ট একটা খরচের লেভেল ধরে রাখতে হবে। এটা এক সময়ে দারুন টেনশনের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সব সময়েই আপনাকে টাকার চিন্তায় থাকতে হবে। কোথা থেকে টাকা আসবে, যদি সময়মত টাকা না থাকে তবে কি হবে? – এসব চিন্তা সব সময়েই মাথায় আসতে থাকবে।
আপনাকে হয়তো অনেক ভালো আছেন বলে মনে হবে – কিন্তু আপনি তো জানেন যে আপনার আসলে সত্যিকার কোনও আর্থিক নিরাপত্তা নেই। রাতের বেলা ঘুমাতে গেলেই দুনিয়ার সব দু:শ্চিন্তা মাথায় আসা শুরু হবে। আর দিনে দিনে এটা বাড়তেই থাকবে। কেন বাড়বে, সেটা পরের কয়েকটি পয়েন্ট পড়লেই বুঝে যাবেন।
০২. সব সময়ে অন্যের চোখে নিজেকে মাপবেন
আসলে বড়লোকি দেখানোর প্রধান একটি উদ্দেশ্যই হলো অন্যের চোখে নিজেকে বড় করে দেখানো। আপনার হয়তো পকেটে খরচ করার মত টাকা আছে ২ হাজার, কিন্তু আপনি নিজের ‘স্ট্যাটাস মেইনটেন’ করার জন্য আরও ২ হাজার ধার করে বন্ধুর মেয়ের জন্মদিনের গিফট কিনবেন। অথচ ১০০০ টাকার গিফট দিলেই চলতো। যারা এই ধরনের কাজ করে, তারা আসলে সব সময়ে অন্যের চোখে নিজেকে মাপে।
অন্যরা তাকে নিয়ে কি বলল, কি ভাবলো, কতটা দামী মানুষ মনে করল – সেটার ওপর ভিত্তি করে তারা নিজেদের মূল্যায়ন করে। নিজের সামর্থ্য ও পছন্দ অনুযায়ী পোশাক না কিনে এরা অন্যের চোখে ভালো দেখানোর জন্য সাধ্যের বাইরে দামী ব্র্যান্ডের পোশাক পরে। দামী রেস্টুরেন্টে খেতে যায়। এভাবে চলতে চলতে একটা সময়ে গিয়ে এই ধরনের মানুষেরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজেকে অন্যের চোখে মাপতে শুরুকরে। তাদের নিজের কোনও স্ট্যান্ডার্ড থাকে না। এই প্রভাব গিয়ে তাদের পরিবার ও সন্তানদের ওপরও পড়ে। এই বিষয়টি ৭ নম্বর পয়েন্টে বিস্তারিত আলোচনা করব।
০৩. আপনি অন্যদের হিংসা করা শুরু করবেন
মানুষের মাঝে হিংসা সৃষ্টি করার জন্য বড়লোকি দেখানোর চেয়ে ভালো কোনও উপায় মনেহয় আর একটাও নেই। আপনি যখন দেখবেন আপনার বন্ধু বা প্রতিবেশী, এমনকি পরিবারের লোক আপনার চেয়ে ভালো জীবনযাপন করছে – আপনিও তখন তা পেতে চাইবেন। কেউ আপনার চেয়ে ভালো জীবনযাপন করুক – তা আপনার সহ্য হবে না।
বন্ধু বা প্রতিবেশীর যদি আইফোন থাকে, তবে আপনিও তা কিনতে চাইবেন। আর যদি কিনতে না পারেন, তবে মনে মনে অযথাই তার ওপর রাগ করবেন। অন্যের কাছে সেই মানুষটির বদনাম করবেন। একটা সময়ে এই হিংসুক স্বভাবের কারণে সবার সাথে আপনার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যেতে শুরু করবে।
আমরা আশপাশে তাকালেই এমন মানুষ দেখতে পাই, যে অন্যের ভালো দুই চোখে দেখতে পারে না। এর পেছনে আসলে থাকে নিজেকে সব সময়ে বড় করে জাহির করার মানসিকতা। যেহেতু এরা সত্যিকার ধনী নয়, তাই একটা পর্যায়ের পর আর নিজের লাইফস্টাইল উন্নত করতে পারে না – আর তখনই তারা অন্যদের হিংসা করা শুরু করে। অন্যের দুর্নাম করে, তাদের নামে বাজে কথা বলে মানসিক শান্তি পেতে চায় – কিন্তু সেই শান্তি আসলে পায় না। ধীরে ধীরে তারা আরও হতাশ হয়ে পড়ে। এবং তাদের হিংসার মাত্রাও বেড়ে যায়। নিজের আপন ভাই বা বোনকেও হিংসা করতে শুরু করে। আপনি হয়তো এমন মানুষও দেখেছেন যারা নিজের আপন ভাই বা বোনের ভালোও দেখতে পারে না। এটা আসলে নিজের সামর্থ্যের চেয়েও নিজেকে বড় করে দেখাতে চাওয়ার কুফল।
০৪. আপনি অনেক সুযোগ নিতে পারবেন না
আপনি যদি নিজের সামর্থ্যের চেয়ে বেশি প্রাচুর্য দেখাতে চান, তাহলে আপনাকে নিজের আয়ের সবটুকু তার পেছনে খরচ করতে হবে। তার ওপর আবার ধারও করা লাগতে পারে। ফলে আপনার হাতে কোনও টাকা জমবে না। অথবা জমলেও তা খুব অল্প পরিমান। এই অবস্থায় যদি কোনও ভালো বিনিয়োগের সুযোগ আসে – তাহলে আপনি সেই সুযোগ নিতে পারবেন না। দেখা গেল আপনার চেয়ে কম আয় করে, এমন মানুষ তার জমানো টাকা কাজে লাগিয়ে সুযোগটি নিয়ে ভালো একটি লাভ করে ফেলল। বর্তমানে অনেকেই অফিসের পন্য, স্টক লট ইত্যাদি কম দামে পেয়ে কিনে ফেলছেন এবং ভালো লাভ করছেন। কিন্তু আপনি যদি লাইফস্টাইল মেইনটেন করতে গিয়ে নিজের হাতে কোনও টাকা না রাখেন – তবে এইসব সুযোগ সব সময়েই হাতছাড়া হয়ে যাবে।
এছাড়া আপনার কোনও পরিচিত বন্ধু বা অন্য কেউ যদি কোনও ভালো কাজের বা চাকরির সুযোগ পান, তবে তারা আপনাকে তা দেয়ার কথা ভাববেন না। কারণ, আপনার লাইফস্টাইল দেখে মনে হয় আপনি অনেক ভালো আছেন – আপনার আরও ভালো কিছুর দরকার নেই। এভাবে নিজের অজান্তেই আপনি অনেক ভালো ভালো সুযোগের কথা জানতেও পারবেন না। কাজেই নিজের যতটুকু সামর্থ্য ততটুকু দেখানোই বুদ্ধিমানের কাজ। তাহলে এরচেয়ে ভালো কোনও সুযোগ আপনার শুভাকাঙ্খীদের হাতে থাকলে তারা আপনার কথা ভাববে।
০৫. অনেকে আপনার পেছনে লাগবে এবং আপনি তা সামলাতে পারবেন না
ছোট একটা ঘটনা বলা যাক: জাহিদ সাহেবের অফিসে ৩ বছর আগে কামাল নামে একটি ছেলে কাজ করতো। ৩ বছর আগে কামাল চাকরি ছেড়ে চলে যায়। জাহিদ সাহেবের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র আমদানীর ব্যবসা। জাহিদ সাহেব তার কথা মনেও আনেননি এতদিন। কিন্তু একদিন তার এক কর্মচারীর কাছে জানতে পারলেন যে কামাল ৩০ লাখ টাকা দিয়ে গাড়ি কিনেছে। অফিসের সবাই এই কথা জানে। জাহিদ সাহেব নিজে ১৮ লাখ টাকার গাড়িতে চড়েন, আর তার কোম্পানীতে মার্কেটিং এর কাজ করা কামালের গাড়ির দাম ৩০ লাখ – এই নিয়ে অফিসেও ফিসফাস শুরু হয়ে যায়। জাহিদ সাহেবের মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল। তিনি খোঁজ লাগালেন কামাল কিসের ব্যবসা করে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন কামাল ব্যাটারী আমদানী করে – জাহিদ সাহেবের মত সিনিয়র ব্যবসায়ীরা বড় বড় পন্য সাপ্লাই দেন, কিন্তু এসব পন্যেও যে এত লাভ – তা তার জানা ছিল না। তিনি বহুদিন ধরে মার্কেটে আছেন, সব ক্লায়েন্ট তার চেনা। তিনি সবার কাছে বললেন যে তিনি ব্যাটারী আমদানী করা শুরু করেছেন। এর ফলে কামাল তার মার্কেট হারিয়ে ফেলল। তার মাসিক ৫ লাখ টাকার আয় ৫০ হাজারের আশপাশে নেমে আসল। জাহিদ সাহেবের এটা না করলেও চলত। তার এমনিতেই কোটি কোটি টাকা। মাসে তার ইনকাম কামালের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। – কিন্তু তার সাবেক কর্মচারী তারচেয়ে বেশি দামের গাড়ি কিনে সবাইকে দেখিয়ে বেড়াচ্ছে – এটাই তার লেগেছিল।
কামাল একটি ফাঁকা মার্কেট ধরে কাজ করছিল – যেখানে সিনিয়ররা নজরই দেয়নি। কিন্তু যখনই সে সবাইকে দেখিয়ে দিল যে তার মার্কেটে কত লাভ করা যায় – তখনই তার ব্যবসা শেষ হয়ে গেল। কামাল যদি ১০ লাখ টাকারও গাড়ি কিনতো – তাহলেও তার এই অবস্থা হতো না। যতটুকু সে সামাল দিতে পারবে, তারচেয়ে বেশি বড়লোকি দেখাতে গিয়েই সে ক্ষতির মুখে পড়লো।
আসলে নিজের প্রাচুর্য দেখানোর আগে নিজের ক্ষমতার দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। আপনি যদি প্রাচুর্য দেখান, তবে তা সামাল দেয়ারও ক্ষমতা আপনার থাকতে হবে। এক কোটি টাকা পেয়ে যদি আপনি ৫০ লাখ টাকা দিয়ে গাড়ি কেনেন – তবে মানুষ ভাববে আপনার আসলে ১০ কোটি টাকা আছে। আর যখন জানতে পারবে আসলে আপনার অত ক্ষমতা নেই, তখন তারা আপনার যা আছে – তার ওপর নজর দেবে।
অন্যের সম্পদের ওপর মানুষের চোখ পড়বেই। আর আপনি যদি অল্প সম্পদ অর্জন করেই তা দেখাতে শুরু করেন, তবে তার ওপর হামলা হলে সামাল দেয়ার ক্ষমতা আপনার থাকবে না। আপনার পকেটে যদি ১ কোটি টাকা থাকে, এবং ৫০ লাখ টাকার গাড়ি চড়েন, তবে তার ওপর কারো নজর পড়লে আপনি ব্যাংকে থাকা বাকি ৫০ লাখ দিয়ে তা সামাল দিতে পারবেন না। কিন্তু আপনার যদি ১০ কোটি থাকে, এবং তখন ৫০ লাখের গাড়িতে চড়েন – তাহলে সাড়ে ৯ কোটি দিয়ে অনেক কিছু সামাল দিতে পারবেন। আপনাকে কেউ ঘাঁটাতেও সাহস পাবেন না। কারণ ১০ কোটির মালিক হওয়ার পথে এমনিতেই আপনার ভিত অনেক শক্ত হয়ে যাবে।
কাজেই সম্পদ দেখানোর আগে ভেবে নিন, আপনি তার ওপর হামলা হলে সামাল দিতে পারবেন কি-না। যতটুকু সামাল দিতে পারবেন, ততটুকুই দেখান।
০৬. জরুরী প্রয়োজনে টাকা থাকবে না
মানুষের বিপদ আর জরুরী প্রয়োজনের কথা বলা যায় না। যে কোনও সময়ে একটা এ্যাক্সিডেন্ট, অসুখ বা অন্য ইমার্জেন্সী এসে যেতেই পারে। আর এই জন্য কিছু টাকা আলাদা করে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু আপনি যদি সাধ্যের বাইরে খরুচে লাইফস্টাইল মেইনটেন করেন – তবে এই টাকা আলাদা করা আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না। বরং সব সময়েই আপনার কিছু না কিছু দেনা থাকবে। সেই দেনা হতে পারে মানুষের কাছে, অথবা ক্রেডিট কার্ডের কাছে। এবং সত্যিকার বিপদের সময়ে আপনার হাতে টাকা থাকবে না।
০৭. পারিবারিক অশান্তি তৈরী হবে এবং অনেকের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হবে
আপনি যখন সাধ্যের বাইরে বড়লোকি দেখাবেন, তখন আপনার একার তা দেখালে হবে না। পরিবারকেও সেভাবে অন্যের সামনে তুলে ধরতে হবে। আপনার সন্তান ও অন্যদেরও সাধ্যের বাইরে দামী লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত করে ফেলতে হবে। এবং একবার যদি তাদের এই অভ্যাস হয়ে যায়, তবে তারা যখন যেটা চাইবে – তখন সেটাই দিতে হবে। আপনার কোনও যুক্তিই তারা শুনবে না। এবং এতে করে তাদের সাথে আপনার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে – কারণ এসব ব্যাপারে সারাক্ষণই ঝগড়া ও কথা কাটাকাটি লেগে থাকবে। তারা আরও বেশি করে চাইতে থাকবে। আপনার সঠিক সাধ্য যদি আপনার পরিবারের লোকজন বুঝতে না পারে, তবে তারা আপনার কাছ থেকে অনেক বেশি আশা করবে। এবং যদি কোনও কারণে আপনি তাদের তা দিতে না পারেন – তখনই ঝামেলা বাধবে। তারা কিছুতেই তা মানতে চাইবে না।
এর পাশাপাশি, সাধ্যের বাইরের লাইফস্টাইলের ফলে আপনার মাঝে যে হিংসা জন্ম নেবে, তা শুধু টাকা পয়সা বা লাইফস্টাইলে থেমে থাকবে না। প্রতিবেশি বা বন্ধুর সন্তান যে স্কুলে পড়ে, সাধ্যের বাইরে হলেও নিজের সন্তানকে সেই স্কুলে পড়াতে চাইবেন। অন্যের সন্তান যা পায়, নিজের সাধ্যের বাইরে সন্তানকে সেসব জিনিস দিতে চাইবেন। এছাড়া অন্যের ছেলেমেয়ে যা অর্জন করেছে নিজের সন্তানকে দিয়েও তা অর্জন করাতে চাইবেন।
আজকাল দেখা যায় বাবা-মায়েরা সন্তানদের ভয়াবহ রকমের পড়াশুনার চাপের মধ্যে রাখার পাশাপাশি তাদের দিয়ে গান, ছবি আঁকা, নাচ – সবকিছুই করাতে চান। সন্তানের প্রতিভা কোথায় তারা তা দেখতে চান না। তাদের সব পারতে হবে। এর কারণ কিন্তু সন্তানের ভালো চাওয়া নয় – এর কারণ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা। অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছলতা দেখানোয় যখন তারা সমকক্ষ হতে না পারেন, তখন অন্যান্য দিক দিয়ে টেক্কা দিতে চান।
বন্ধু/প্রতিবেশী/ভাই-বোন এর সন্তানরা যা করছে – নিজের সন্তানকে দিয়েও তা করাতে হবে। এই অসুস্থ প্রতিযোগীতার ফলে ছেলেমেয়েদের মানসিকতার যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি তাদের নিজেদের মাঝেও সেই হিংসার স্বভাব দেখা দিচ্ছে। নিজেদের মধ্যেকার সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মের মাঝেও সুস্থ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারছে না।
আপনি হয়তো কিছু মানুষকে খেয়াল করেছেন, যারা সামনে খুব আন্তরিকতা দেখাচ্ছে – কিন্তু চোখের আড়াল হলেই দুর্নাম ও সমালোচনা শুরু করে দিচ্ছে। এটা আসলে এই হিংসারই ফল, যার শুরু হয় সমকক্ষ হতে না পারার হতাশা থেকে।
০৮. ধার-দেনা বেড়ে যাবে
আপনি যখন আপনার সামর্থের চেয়ে বেশি স্বচ্ছলতা দেখাতে যাবেন, তখন অবশ্যই আপনাকে আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করতে হবে। আর একারণে মাঝে মধ্যেই আপনাকে ধার-দেনা করতে হবে। আর ধার করার অভ্যাস একবার শুরু হলে এক সময়ে তা নেশায় পরিনত হয়। এটি এমন একটি নেশা, যা দিন দিন বাড়তেই থাকে। একটা সময়ে গিয়ে আয়ের চেয়ে ধারের পরিমান বেশি হয়ে যায়। বহু বাস্তব প্রমাণ আছে যে, একটি লেটেস্ট মডেলের ফোন কেনার জন্য মানুষ অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার করছে – যে ফোনটির আসলে তার কোনও প্রয়োজনই নেই। এভাবে ধার করতে করতে অর্থনৈতিক অবস্থা এমন হয়ে যায় যে একটা সময়ে পাওনাদারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়।
ক্রেডিট কার্ডও কিন্তু এমনই একটা ফাঁদ। ক্রেডিট কার্ড মানে একটা ঋণ – যা আপনাকে খরচ করার জন্য উৎসাহ দেয়। কিন্তু দিন শেষে সুদটা ঠিকই নিয়ে নেয়। পকেটে টাকা না থাকলেও অনেকে ক্রেডিট কার্ড দিয় এটা ওটা কিনে ফেলেন, কিন্তু বুঝতেও পারেন না যে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন।
কাজেই আপনার মাঝে যদি এসব অভ্যাস সামান্য হলেও থেকে থাকে, তবে এই মূহুর্তে এটা করা বাদ দিন। না হলে খুব তাড়াতাড়িই আপনাকে খুব বাজে অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে। ভুলেও ভাববেন না যে আপনি এর থেকে বাঁচতে পারবেন। আজ অথবা কাল এই ফাঁদে আপনাকে পড়তেই হবে। কাজেই এখনই সাবধান হয়ে যান।
০৯. আপনি শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বেন
এতক্ষণে নিশ্চই বুঝতে পেরেছেন যে সাধ্যের চেয়ে বেশি খরুচে লাইফস্টাইল মেইনটেন করতে গেলে নানান রকমের মানসিক অশান্তির সৃষ্টি হয়। আর এই অশান্তির প্রভাব পড়বে স্বাস্থের ওপর। হৃদরোগ, হাই ব্লাড প্রেশার, ডায়বেটিস, স্ট্রোক – এই সব রোগের উৎসই আসলে মানসিক অশান্তি আর দু:শ্চিন্তা। অর্থাৎ সাধ্যের বাইরে বড়লোকি দেখাতে গেলে যে আপনি এইসব রোগের শিকার হওয়ার পাশাপাশি শারীরিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়বেন – এটা প্রায় নিশ্চিত।
১০. আপনার ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে
স্কুল-কলেজে থাকতে নিশ্চই একটি কবিতা পড়েছেন, “ যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি, আশু গৃহে তার দখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি ” – অর্থাৎ দিনের বেলা যদি মজা করার জন্য মোমবাতি পুড়িয়ে ফেলেন, তবে রাতের অন্ধকারে সে আলো পাবে না।
আপনার যদি আজ মাসে ১ লাখ টাকা ইনকাম থাকে, এবং আপনি ‘লাইফস্টাইল মেইনটেন’ করতে গিয়ে কিছুই না জমিয়ে সব টাকাই শেষ করে ফেলেন, অথবা অপ্রয়োজনে খরচ করেন – তবে ভবিষ্যতে অনেক বড় বিপদে পড়বেন। কাজ করার ক্ষমতা মানুষের সব সময়ে এক রকমের থাকে না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পরিশ্রম করার ক্ষমতা কমে যাবেই – আর যখন আপনার কাজ করার ক্ষমতা চলে যাবে, তখন অবশ্যই আপনাকে জমানো টাকা অথবা বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করতে হবে।
আপনার ইনকাম করা টাকার একটা অংশ যদি আপনি না জমান, অথবা এমন কোথাও বিনিয়োগ না করেন যেখান থেকে এমনিতেই টাকা রোজগার হবে – তবে এক সময়ে গিয়ে আপনি খুব সাধারণ প্রয়োজন মেটানোর জন্যও নিজের সন্তান বা অন্য কারও ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হবেন।
পরিশিষ্ট: এভাবে চললে আপনি কোনওদিন সত্যিকার ধনী হতে পারবেন না
রবার্ট কিওসাকি তাঁর বিখ্যাত ফাইন্যানশিয়াল এডুকেশন বই, রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড এ মানুষের ধনী হতে না পারার বেশ কিছু কারণ দেখিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রধান কারণটিই হলো হিসাব ছাড়া খরচ করা এবং ধনী হওয়ার আগেই ধনীর মত লাইফস্টাইল দেখানো। ওয়ারেন বাফেট বা জেফ বেজোস এর মত বিশ্বসেরা ধনীরা কিন্তু খুব সাধারণ ভাবে থাকেন। বাফেট ২০১৩ সাল পর্যন্ত নোকিয়ার একটি সাধারণ ফোন ব্যবহার করতেন। এই প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন “কোনওকিছু কাজ করা বন্ধ করার আগে তাকে ফেলে দেয়াটা বোকামী”। তিনি খুব সাধারণ একটি গাড়িতে চড়েন যার দাম ৫০ হাজার ডলারের কম।
বিল গেটসের আগে যিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধনী ছিলেন, ওয়ালমার্টের প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ওয়ালটন কে নিজের চোখে দেখে কেউ বিশ্বাসই করতে পারেনি এই লক্কড়ঝক্কড় ট্রাক চালানো, কম দামী টি-শার্ট আর ক্যপ পরা লোকটি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষ। সিনেমা এবং টিভির কল্যানে আমরা যদিও দেখি ধনীরা খুব জাঁকজমকে থাকেন – ব্যাপারটা আসলেই সেরকম নয়। তাঁরা প্রতিটা টাকার মূল্য বোঝেন। বিনা প্রয়োজনে একটা টাকাও খরচ করেন না।
তাঁরা টাকা দিয়ে টাকা বানাতে চান। যদি কোনও শখ পূরণের প্রয়োজন হয় তার জন্য আলাদা করে বাজেট করেন। এবং সেই খরচের টাকাটা কিভাবে আবার উঠিয়ে আনবেন – সেই পরিকল্পনা করে তবেই শখ মেটান। আপনি যদি নিজের চেষ্টায় সত্যিকার বড়লোক হতে চান, তবে আপনাকে একটা সময় পর্যন্ত বড়লোকি দেখানো থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রতিটি টাকা হিসেব করে খরচ করতে হবে। যতটা সম্ভব বিনিয়োগ করতে হবে।
স্বচ্ছলতা দেখানোর মানে ধনী হওয়া নয়, সত্যিকারের অর্থ আর সম্পদের মালিক মানে ধনী। আর পৃথিবীর খুব কম মানুষই আসলে এটা হতে পেরেছে। আপনি যদি সেই কম মানুষদের একজন হতে চান, তবে আপনাকে অবশ্যই সেই কম সংখ্যক মানুষের মত আচরণ করতে হবে।
প্রয়াত বিখ্যাত সেলফ ডেভেলপমেন্ট কোচ আর্ল নাইটএ্যাঙ্গেল বলেছেন, প্রতি ১০০ জনের মধ্যে মাত্র ৫ জন ৬৫ বছর বয়সে গিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর থাকে, কারণ এরা নিজেরা চিন্তা করে কাজ করে। অন্যরা যেভাবে চলছে, সেভাবে চলে না। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এদের একটা লক্ষ্য থাকে, এবং তা পূরণ করার একটা পরিকল্পনা থাকে। শুধুমাত্র সমাজের মানুষকে দেখানোর বদলে এই ৫% মানুষ সত্যি সত্যি বড়লোক হওয়ার চেষ্টা করে।
এই প্রসঙ্গে ওয়ারেন বাফেট এর অসাধারণ উক্তি: “খরচ করার পর যা থাকে, তা না জমিয়ে – জমানোর পরে যা থাকে তা খরচ করো”
খুব কম মানুষ এটা করতে পারে। আর যারা পারে, তারাই সত্যিকার ধনী হয়।
শেষ কথা:
আপনি যদি স্বচ্ছলতা দেখানোর চেষ্টা করা বন্ধ করে সত্যিকার ধনী হওয়ার চেষ্টা করেন, তবে আপনিও একদিন সত্যিকার ধনী হতে পারবেন। ধনী হওয়ার আসলে কোনও গোপন সূত্র নেই। খুব সাধারণ কিছু বিষয় মেনে চললেই এটা সম্ভব। কিন্তু এগুলো সাধারণ হলেও নিয়মিত ভাবে এগুলো মেনে চলা এবং অভ্যাস ধরে রাখা খুব সহজ নয়। ধীরে ধীরে এটা অভ্যাস করতে পারলেই বুঝবেন আপনি সত্যিকার ধনী হওয়ার পথে আছেন।
সত্যিকার ধনী হতে গেলে মিথ্যা বড়লোকি দেখানো কি, এবং এর ফলে কি কি ক্ষতি হয় – তা বোঝা খুব জরুরী। একবার বুঝতে পারলে এর থেকে বেঁচে থাকা সহজ হয়ে যায়। এবং এই বিষয়গুলো বুঝতে যাতে আপনার কিছুটা হলেও সুবিধা হয় – সেই কারণেই এই লেখা।
বড়লোকি দেখানোর কুফল ও এটা বাদ দেয়ার প্রয়োজনয়ীতা বিষয়ে যদি আপনি এই লেখা থেকে কিছুটা হলেও ধারণা পান – তাহলেই আমাদের পরিশ্রম সফল।
আমরা আপনাকে বোঝাতে কতটা সফল হয়েছি, তা আমাদের কমেন্ট করে জানান। আর যদি মনে হয় এই লেখা পড়ে অন্যরাও উপকৃত হবেন – তবে শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন।
এই ধরনের আরও গবেষণামূলক লেখার জন্য নিয়মিত আমাদের সাথে থাকুন। সাফল্যের পথে, সব সময়ে, লড়াকু আপনার সাথে আছে।