দ্য পাওয়ার অব হ্যাবিট – বুক রিভিউ


দি পাওয়ার অব হ্যাবিট হল পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী লেখক চার্লস ডুহিগ এর বেস্ট সেলিং সেলফ ডেভেলপমেন্ট বই। বইটি টানা ১২০ সপ্তাহ নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার লিস্ট এ ছিল।

পাওয়ার অব হ্যাবিট বইটির শিক্ষা কাজে লাগিয়ে বহু মানুষ নেশার হাত থেকে বেঁচেছেন, নিজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার অভাবনীয় উন্নতি করেছেন, আলস্যকে হার মানিয়েছেন।

এক বাক্যে বইটির মূল কথা বলতে গেলে বলতে হয়, বইটি আপনাকে বুঝতে সাহায্য করবে, কেন আমাদের অভ্যাস গুলো আমাদের সব কাজের মূল, এবং কিভাবে একে পরিবর্তন করে ও কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের জীবনকে সফল ও সার্থক করতে পারি।

বইয়ের ভূমিকায় লেখক লিসা নামে এক মহিলার গল্প বলেছেন। তার জীবনে কিছুই ভালোমত চলছিল না। হাজার হাজার ডলারের ঋণ ছিল, কোনও কাজেই সে দুই মাসের বেশি টিঁকতে পারতো না, সেইসাথে তার ছিল ভয়াবহ রকমের সিগারেট আসক্তি। এর পাশাপাশি, খাওয়ার ওপর তার কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না, বাড়তি ওজনের কারণে তার ফিটনেট ছিল বাজে। চরম অলস ও অকর্মা লিসা মিশরে বেড়াতে গিয়ে ঘটনাক্রমে সিদ্ধান্ত নিল, সে তার জীবনকে বদলাবে। সে ঠিক করল, ১ বছর পর সে এই মরুভূমিতে এ্যাডভেঞ্চার করবে। এবং তার জন্য নিজেকে ফিট করে তুলবে। প্রথমেই সে সিগারেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় – এই একটি অভ্যাস বদলাতে গিয়ে তাকে আরও কিছু অভ্যাস বদলাতে হয়। শরীরকে শক্তিশালী ও ঝরঝরে রাখার জন্য ব্যায়াম করা, নিয়ম মেনে খাওয়াদাওয়া করা, সময়মত ঘুমাতে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠা – ইত্যাদি অভ্যাসও সে করতে শুরু করল।

এর ফলে তার শরীর তো ফিট হয়েই গেল, সেইসাথে তার চেহারাও আকর্ষণীয় হয়ে উঠল। রুটিন মেনে চলার অভ্যাস করার কারণে, সে যে কোনও কাজ সময়মত করতে লাগল, আলস্য কমে গেল। সবকিছুতেই পারফর্মেন্স ভালো হতে লাগল। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সে একটি ভালো চাকরি পেল, এবং মন দিয়ে কাজ করতে শুরু করল। তার সব আর্থিক ঝামেলা তো মিটলোই, ব্যাংকে বাড়তি টাকা জমার পাশাপাশি সে নিজের বাড়িও কিনে ফেলতে পারল।

হ্যাবিট

এ সবই আসলে সম্ভব হয়েছিল তার অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে। মানুষের অভ্যাস তার জীবন আর কাজকে পরিচালিত করে। অভ্যাসের শক্তিকে যদি কাজে লাগাতে পারেন, তবে জীবনে যে কোনও লক্ষ্য পূরণ করতে পারবেন। আর যদি অভ্যাসের দাস হয়ে যান – তবে জীবনকে নিজের মত করে চালাতে পারবেন না। আপনাকে বুঝতে হবে কোনটা আপনার জন্য ভালো। তারপর সেটাকে নিজের অভ্যাসের অংশ করে নিতে হবে। পাওয়ার অব হ্যাবিট বইয়ের লিসনগুলো আপনাকে এই ব্যাপারেই সাহায্য করবে।

দি পাওয়ার অব হ্যাবিট বইয়ের লিসনগুলো আপনাকে যেসব ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে, সেগুলোর অন্যতম কয়েকটি হল:

– যে কোনও ধরনের নেশা বা আসক্তি থেকে মুক্তি

– টাকা পয়সা খরচ নিয়ন্ত্রণ ও সেগুলো ভালোভাবে ম্যানেজ করার অভ্যাস

– সময়মত কাজ করতে পারা

– আলস্য থেকে মুক্তি পাওয়া

– অভ্যাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজের আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে নেয়া

– বাজে অভ্যাস বাদ দিয়ে, এবং ভালো অভ্যাস রপ্ত করে জীবনকে সুন্দর ও সফল করা

দ্য পাওয়ার অব হ্যাবিট এর ৩টি মূল উপকারিতা:

লেখকের মতে, বইটির লিসন গুলো একজন মানুষকে তিন ভাবে উপকার করতে পারে

১. অভ্যাস কিভাবে কাজ করে – তা আপনি জানতে পারবেন। এটি মূলত ৩টি ধাপে কাজ করে: ধারণা, রুটিন এবং রিওয়ার্ড বা পুরস্কার

২. তিনটি ধাপের একটি ধাপ – রুটিন কে কাজে লাগিয়ে কিভাবে অভ্যাস পরিবর্তন করা যায়

৩. নিজের ইচ্ছাশক্তিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে নিজেকে দিয়ে যা ইচ্ছা করিয়ে নিতে পারবেন।

চলুন তাহলে বইয়ের লিসন কাজে লাগিয়ে কিভাবে এই উপকারিতা গুলো পাওয়া যায়, তা দি পাওয়ার অব হ্যাবিট বুক রিভিউ থেকে সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক।

পাওয়ার অব হ্যাবিট লিসন সমূহ:

লিসন ১: অভ্যাস যে ৩টি ধাপে কাজ করে:

লেখক চার্লস ডুহিগ বলেন, আমরা সারাদিন যা করি, তার ৪০% মোটামুটি স্বয়ংক্রিয় ভাবে ঘটে। অর্থাৎ এগুলো করার জন্য আমাদের আলাদা ভাবে মাথা খাটাতে হয় না। সকালে উঠেই স্মার্টফোন হাতে নেয়ার মত বদ অভ্যাস থেকে শুরু করে, দাঁত মাজা বা গোসল করার মত ভালো কাজ গুলো আমরা ‘অটোমেটিক’ ভাবে করি।

দ্য পাওয়ার অব হ্যাবিট

অভ্যাস আসলে মস্তিষ্কের এনার্জি বাঁচানোর কৌশল। কিছু কিছু ব্যাপার সে নিজের মাঝে এমন ভাবে রেকর্ড করে নেয়, যাতে সেগুলো করার জন্য তার বাড়তি শক্তি খরচ করতে না হয়।

ব্যাপারটা আরেকটু ভালোমত বুঝতে চলুন, আরেক বেস্ট সেলিং বই মিনি হ্যাবিটস” এর লেখক স্টিফেন গাইস এর ব্যাখ্যাটা জেনে নেয়া যাক:

আমাদের অভ্যাসগুলো আসলে আমাদের মস্তিষ্কের নিউরাল পাথওয়ে, বা নিউরোনগুলোর মধ্যে সংযোগ পথ। আমাদের দেহ ও মনের কাজগুলো হয় নিউরোনগুলোর মাঝে যোগাযোগের মাধ্যমে।

প্রতিটি কাজ ও চিন্তার জন্য মস্তিষ্কে ভিন্ন ভিন্ন নিউরাল পাথওয়ে বা সংযোগ পথ আছে।  আপনি যত বেশিবার একটি কাজ বা চিন্তা করবেন পাথওয়েটি আরও চওড়া ও মসৃণ হবে। আবার যদি আপনি সেই চিন্তা বা কাজটি নিয়মিত না করেন, তাহলে একটি রাস্তায় বহুদিন না চললে যেমন তা আগাছায় ঢেকে যায়, নিউরাল সংযোগ পথ গুলোও তেমনি ছোট আর অমসৃণ হয়ে আসে।

যেসব কাজ করতে আমাদের কোনও প্রকার চিন্তাভাবনার প্রয়োজন হয় না, সেগুলো নিয়ন্ত্রণ হয় আমাদের ব্রেনের “basal ganglia” অংশ থেকে।  যেমন একজন এক্সপার্ট ড্রাইভারের ব্রেক চাপা বা  গিয়ার পাল্টানোর জন্য কোনওরকম চিন্তা করতে হয় না – প্রয়োজনের সময়ে অটোমিটিক ভাবেই সে সেটা করে ফেলে। কারণ এই কাজের তথ্যগুলো তার basal ganglia তে মজুদ আছে।

এই ব্যাসাল গ্যানাগ্লিয়া আসলে আমাদের অবচেন মনের (subconscious mind)  অংশ। নিয়মিত গাড়ি চালানোর কারণে এই কাজের নিউরাল পাথওয়ে যথেষ্ঠ মসৃণ আছে। কিন্তু ড্রাইভারটি যদি দুই বছর গাড়ি চালানো বন্ধ রাখেন, তাহলে তিনি এতটা সুন্দর ভাবে গাড়ি চালাতে পারবেন না।

মস্তিষ্কের অবচেতনের basal ganglia অংশটি এতটাই শক্তিশালী যে এর কাজ যদি আমাদের সচেতন মন করতে যায়, তবে সে দারুন ক্লান্ত হয়ে পড়বে।

আমাদের চেতন মন হলো আমাদের মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী অংশ যার নাম “prefrontal cortex”; এই অংশের কাজ করার ধরন basal ganglia এর চেয়ে আলাদা।

prefrontal cortex যখন কোনও সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সে অনেক বিষয় বিবেচনা করে। এই অংশের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে, কোনও বড় সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সে দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে – কারণ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অনেক শক্তি খরচ হয়।

ধরুন আপনি সিগারেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আপনার হাতের কাছে সিগারেটের দোকান থাকলেও আপনি অনেক্ষণ ধরে সেটি না খেয়ে থাকবেন। এর কারণ, আপনার সিদ্ধান্ত পালন করার প্রাথমিক নির্দেশ prefrontal cortex থেকে আসছে।
কিন্তু বিভিন্ন চিন্তা করতে করতে মস্তিষ্কের চেতন অংশ যখনই ক্লান্ত হয়ে যায়, তখনই basal ganglia নিয়ন্ত্রণ নেয়। এবং যেহেতু বহুদিন ধরে করার ফলে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আপনার basal ganglia এর অংশ হয়ে গেছে, তাই আপনি আবার সেটা শুরু করবেন।

নিয়মিত করা কাজগুলো ব্যাসাল গ্যানাগ্লিয়াতে রেখে দিয়ে মস্তিষ্ক আসলে প্রিফ্রন্টাল করটেক্স এর এনার্জি বাঁচায়। যা মানুষের সময় ও শক্তিকে অন্য কাজে লাগাতে সাহায্য করে।  কিন্তু এটা মানুষের ক্ষতিও করে, প্রতিদিন সকালে উঠেই ফেসবুক চেক করার অভ্যাস ক্ষতিকর, আবার প্রতিদিন সকালে উঠেই এক্সারসাইজ করা বা ধ্যান করা উপকারী।

খারাপ অভ্যাসগুলো মাথা থেকে দূর করে ভালো অভ্যাস গুলোর শক্তিকে কিভাবে ব্যবহার করবেন – পাওয়ার অব হ্যাবিট আপনাকে সেটাই শেখাবে।

চার্লস ডুহিগ নিজের মত করে অভ্যাসের মূল ব্যাপার গুলো খুঁজে বের করেছেন। তিনি অনেক গবেষণা ও পর্যালোচনা করে দেখেছেন যে, মানুষের অভ্যাস আসলে ৩টি ধাপের সমষ্টি।

দি পাওয়ার অব হ্যাবিট বই

প্রথমটি হল ধারণা বা ‘cue’ – এটি মানুষকে কোনও কাজ করার জন্য ভেতর থেকে অনুপ্রাণিত করে। যেমন সকালে উঠেই একজন মানুষের মনে হয় ৭টার সময়ে তাকে নাস্তার টেবিলে বসতে হবে।

ধারণার পর আসে রুটিন। ধারণা মাথায় আসার পর যেভাবে আপনি কাজটা করবেন – সেটাই রুটিন। যেমন সকাল ৭টায় নাস্তার টেবিলে বসেই হয়তো আপনি কিছু না ভেবেই চায়ের কাপটি টেনে নেবেন। চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দেয়ার সাথে সাথে দিনের খবরের কাগজটি টেনে নেবেন, বা ফোনের নেট অন করে পত্রিকার ওয়েবসাইটে ঢুকবেন। – এগুলো করার জন্য আপনাকে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হবে না। অটোমেটিক ভাবেই আপনার হাত চলতে থাকবে।

রুটিনের পর ৩ নম্বর ধাপে আসে রিওয়ার্ড বা পুরস্কার। চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার পর চাঙ্গা লাগা, খবরের কাগজের প্রথম পাতার খবর গুলোতে চোখ বুলানোর সময়কার উত্তেজনা – এগুলোই রিওয়ার্ড। অভ্যাস বশত কাজ গুলো করার ফলে যে ভালো অনুভূতিগুলো হয়, সেগুলোই আসলে রিওয়ার্ড বা পুরস্কার।

এই রিওয়ার্ড এর কারণেই মূলত মানুষ অভ্যাস ছাড়তে পারে না। এগুলো না পেলে খারাপ লাগে। যেমন ধরুন, সকালে উঠে নাস্তার টেবিলে গিয়ে দেখলেন চা নেই, অথবা আজ খবরের কাগজ দেয়নি, বা নেট কানেকশন বন্ধ – তাহলে রীতিমত মেজাজ খারাপ হয়ে যেতে পারে। আপনার মনে হবে জীবন থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কি যেন একটা হারিয়ে গেছে।

এই রিওয়ার্ড এর কারণেই মানুষ সিগারেট ছাড়তে পারে না, রাত জাগা এবং দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা ছাড়তে পারে না, অতিরিক্ত টিভি দেখা বা গেম খেলা ছাড়তে পারে না, সোশ্যাল মিডিয়ায় পড়ে থাকা ছাড়তে পারে না।

আর আগেই বলেছি, চার্লস ডুহিগ এর গবেষণা অনুযায়ী, অভ্যাস মূলত এই তিনটি ধাপে কাজ করে।

ডুহিগ আরও বলেন, এই ৩টির মধ্যে একটি আমরা চাইলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। যার মাধ্যমে আমরা যে কোনও বাজে অভ্যাস দূর করা অথবা নতুন ভালো অভ্যাস রপ্ত করতে পারি। পরের লিসনে এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

লিসন ২: রুটিন পরিবর্তনের মাধ্যমে অভ্যাস পরিবর্তন করা যায়

প্রাকৃতিক ভাবেই, মানুষ যে কাজটি নিয়মিত বার বার করে, সেটি তার ব্রেনের ব্যাসাল গ্যানাগ্লিয়া বা অভ্যাসের অংশ হয়ে যায়। একটা সময়ে গিয়ে সেটি এমনি এমনিই ঘটতে থাকে, এর জন্য মানুষকে এ্যাকটিভ হতে হয় না।

আগেই বলেছি, অভ্যাস মত সকাল বেলা চা বা খবরের কাগজের দিকে হাত বাড়াতে আপনাকে ভাবতে হবে না, আর যদি কোনও কারণে তা না পান, তবে মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে।

এটা যেমন একটা দুর্বলতা, তেমনি এটাকে কাজে লাগিয়ে আপনি অভ্যাস বদলেও ফেলতে পারবেন।

ডুহিগ এটাকে বলেছেন “গোল্ডেন রুল” – রুটিন পরিবর্তনের মাধ্যমে অভ্যাস বদলানো।

সকালে নাস্তার টেবিলে গিয়ে যদি আপনার প্রথমেই চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার অভ্যাস হয়। তবে এই রুটিন বদলে ফেলুন। কিভাবে? – চায়ের বদলে টেবিলে পানি রাখুন। চায়ের বদলে পানি খান। মনে রাখবেন, অভ্যাসকে মুছে ফেলা যায় না, সেই অভ্যাসের জায়গায় অন্য একটি অভ্যাস প্রতিস্থাপন করতে হয়।

আপনার যদি রাতে সোশ্যাল মিডিয়া ঘেঁটে বা সিনেমা দেখে ঘুমানোর অভ্যাস থাকে, সেই অভ্যাসকে বই পড়া দিয়ে প্রতিস্থাপন করুন। তাতে তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে, এবং স্ক্রিণ থেকে আসা অতি বেগুণী রশ্নি চোখ ও মাথার ওপর চাপ ফেলবে না।

সকালে উঠেই বালিশের পাশ থেকে মোবাইল হাতে নেয়ার রুটিনে অভ্যস্ত হলে বালিশের পাশে মোবাইল রাখা বাদ দিন। এবং ঘুম থেকে উঠেই বিছানা থেকে নেমে হাত মুখ ধুতে চলে যান। – এভাবে কিছুদিন করলেই এটা আপনার অভ্যাসে পরিনত হবে

আগের রুটিনের জায়গায় নতুন রুটিন তৈরী করুন। কিছুদিন অটোমেটিক ভাবে কাজ করার বদলে সচেতন ভাবে নতুন রুটিন ফলো করুন। এরপর দেখবেন সেটাই নতুন অভ্যাসে পরিনত হয়ে গিয়েছে।

লিসন ৩: ইচ্ছাশক্তিকে শক্তিশালী করুন

অভ্যাস পরিবর্তনের জন্য রুটিন বদলাতে হয়। আর নতুন রুটিন অভ্যাস হওয়ার আগ পর্যন্ত সচেতন ভাবে সেগুলো ফলো করতে হয়। এবং লেখকের মতে, সব সময়ে এটা সহজ হয় না। কিছু অভ্যাস করার জন্য অল্প ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ঠ। আবার কিছু অভ্যাসের জন্য অনেকটা ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন হয়।

তাই, ইচ্ছাশক্তিকে শক্তিশালী করাটা খুবই জরুরী। আর এটা করার জন্য লেখক ৩টি পদ্ধতির কথা বলেছেন। চলুন সেগুলো সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক।

 #১. এমন কিছু শুরু করুন যা সহজ কিন্তু তার জন্য শৃঙ্খলার প্রয়োজন

ইচ্ছাশক্তিকে শক্তিশালী করার জন্য নতুন কোনও ছোট অভ্যাস গড়ে তুলুন – যেটা করতে সহজ, কিন্তু নিয়মিত চালিয়ে যাওয়ার জন্য শৃঙ্খলার দরকার। যেমন ধরুন প্রতিদিন ঠিক একই সময়ে ঘুম থেকে ওঠা। এটা বলতে সহজ, করতে গেলেও এমন কোনও ঝুঁকি বা পরিশ্রম করতে হয় না – কিন্তু একটানা নিয়মিত করাটা বেশ কঠিন। – আর এখানেই ইচ্ছাশক্তির প্রাকটিস করা যায়।

টানা ৫ দিন হয়তো আপনি ঠিক সকাল ৬টায় উঠলেন, কারণ আপনি রাত ১১টায় ঘুমাতে পেরেছেন। কিন্তু একদিন যদি কোনও কারণে আবার রাত ২টায় ঘুমাতে যান, তবে পরদিন ৬টায় বিছানা ছাড়াটা কঠিন হয়ে যাবে।

কিন্তু আপনি যদি যা-ই ঘটুক না কেন, ৬টার সময়েই বিছানা ছাড়তে নিজেকে বাধ্য করেন, মানে জোর করে ওঠেন – তাহলে কিছুদিনের মধ্যেই আপনার ইচ্ছাশক্তি আলস্য ও আরামপ্রিয়তার ওপর বিজয়ী হবে।

যে কোনও বড় দক্ষতা শুরু হয় ছোট ছোট বিষয় প্রাকটিস করার মধ্যদিয়ে। যে এখন একবার না থেমে ১ মাইল দৌড়াতে পারে, তার শুরুটা হয়েছিল ১০ হাত দৌড়ানোর মধ্যদিয়ে। ইচ্ছাশক্তিও এমন। ছোট ছোট ব্যাপারে ইচ্ছাশক্তি খাটানোর অভ্যাস করলে, এই অভ্যাসই আপনাকে বড় বড় ব্যাপারে নিজের ফোকাস ও শক্তি ধরে রাখতে সাহায্য করবে।

 

#২. সবচেয়ে বাজে অবস্থাটা কল্পনা করে নিন

আগেই বলেছি, ভবিষ্যতে বড় অর্জন করতে গেলে বর্তমানে মন না চাইলেও অনেক কিছু করতে হয়। নিজের প্রিয় টিভি শো দেখা বাদ দিয়ে পড়াশুনা করতে হয়, বন্ধু বা কলিগরা আড্ডা দেয়ার সময়ে নিজেকে কাজের মাঝে ডুবিয়ে রাখতে হয়, বহু দিনের রাতে সিনেমা দেখার অভ্যাস বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যেতে হয় – ইত্যাদি। আর ভবিষ্যতের বড় অর্জনের জন্য বর্তমানে কষ্ট করতে অনেকটা ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন হয়।

এই ইচ্ছাশক্তি অর্জনের জন্য একটা ভালো প্রাকটিস করতে পারেন। কোনও কাজ করতে ইচ্ছা না হলে, সেটা করার এবং না করার সবচেয়ে বাজে ফলাফলটা ঠান্ডা মাথায় কল্পনা করার চেষ্টা করুন। যদি কাজের সময়ে সিনেমা দেখতে ইচ্ছা করে, তবে চিন্তা করুন, কাজ না করে সিনেমা দেখলে ঘন্টা দুয়েকের জন্য হয়তো মজা পাবেন, কিন্তু কাজটা না হলে কতটা ঝামেলা পোহাতে হবে।

হয়তো বসের বা কাস্টোমারের কাছে ছোট হতে হবে। কাজটা হয়তো সময়মত শেষ করতে পারবেন না – যার ফলে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি নিজের সম্মানও নষ্ট হবে। – এভাবে চিন্তা করলে দেখবেন মুড না থাকলেও কাজ করার ইচ্ছা হচ্ছে। এভাবে কাজ করতে করতে যে কোনও অবস্থাতে প্রয়োজনীয় কাজটি করার অভ্যাস গড়ে উঠবে। মুডের ওপর নির্ভর না করে আপনার কাজ আপনার সত্যিকার ইচ্ছাশক্তির ওপর নির্ভরশীল হবে।

 

#৩. যে কোনও কাজে একটি অনুপ্রেরণা খুঁজে নিন

ইচ্ছাশক্তিকে জাগিয়ে তোলার জন্য, এবং তাকে শক্তিশালী করার জন্য সঠিক অনুপ্রেরণা একটি দারুন ভূমিকা রাখে।

ধরুন আপনি দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস বদলাতে চান। সকাল বেলা এলার্ম দিয়ে রাখেন, ঘুমও ভাঙে, কিন্তু বিছানা থেকে আর ওঠা হয়না। আবারও ঘুমিয়ে পড়েন। আপনি যদি সকালে ঘুম থেকে উঠলে জীবনে কি কি ভালো পরিবর্তন হবে সেগুলো একটি কাগজে লিখে বিছানার পাশে রাখেন, এবং ঘুম থেকে উঠে তাতে চোখ বুলান – তাহলে বিছানা ছাড়ার জন্য আপনার মাঝে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হবে।

এরকম প্রতিটি নতুন অভ্যাস করার ফলে, বা পুরাতন অভ্যাস বদলানোর ফলে কি কি ভালো হতে পারে, তা যদি ভালোভাবে ভেবে দেখেন, এবং সেটা চর্চার সময়ে মনে করতে পারেন – তাহলে তা আপনার জন্য অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করবে। যার ফলে আপনার ইচ্ছাশক্তি কার্যকর হবে।

পরিশিষ্ট বোনাস টিপস:

পাওয়ার অব হ্যাবিট বইটি আসলে আমাদের অভ্যাসকে কাজে লাগিয়ে জীবনকে সফল করার গাইডলাইন। বইটির ব্যাপ্তি ৪০০ পৃষ্ঠা, অনেকেই হয়তো পুরো বইটি পড়ার সময় পাবেন না। কিন্তু তাঁরা হয়তো বইয়ের শিক্ষাগুলো কাজে লাগাতে পারবেন। সেই কারণেই এই বুক রিভিউটি করা। আমরা চেষ্টা করেছি বইয়ের লিসনগুলো সহজ ভাষায় ও সংক্ষেপে তুলে ধরতে।

তবে এর মাঝে আরও একটি টিপস বা পরামর্শের কথা না বললেই নয়। লেখক এটাকে বলেছেন, “keystone habit” – এমন একটি অভ্যাস যা পরিবর্তন করলে একজন মানুষের জীবন প্রায় সব দিক দিয়ে আরও ভালো হবে।

লেখার প্রথমে বলা লিসার গল্প নিশ্চই মনে আছে? যে সিগারেট ছাড়ার অভ্যাস করতে গিয়ে, নিজের ওজন কমানো, আলস্য দূর করা – ইত্যাদি আরও বেশ কিছু খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে পেরেছিল, এবং একজন পরাজিত মানুষ থেকে সফল মানুষ হয়ে গিয়েছিল।

আমাদের অনেকেরই এমন একটি অভ্যাস আছে, যার কারণে আমাদের জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও খারাপ প্রভাব পড়ে। সেটা হতে পারে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা, অথবা অতিরিক্ত ফাস্টফুড খাওয়া, ধূমপান করা, হিসাব ছাড়া খরচ করা, সবকিছুতে অতিরিক্ত আবেগী হয়ে পড়া – বা এমন অন্য কোনও অভ্যাস।

কোন অভ্যাসটি (যদি থাকে) আপনার জীবনের অন্যান্য দিকে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে – তা খুব ভালোভাবে ভেবে বের করুন। দরকার হলে কয়েকদিন সময় নিন। নিজের প্রতিটি কাজ ও আচরণের ওপর সচেতন নজর রাখুন। অভ্যাসটি খুঁজে পাওয়ার পর পাওয়ার অব হ্যাবিট বইয়ের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে অভ্যাসটিকে অন্য একটি ভালো অভ্যাস দিয়ে বদলানোর চেষ্টা করুন।

যদি সঠিক ভাবে করতে পারেন – তবে দেখবেন আপনার সবকিছুতেই দারুন সব ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে।

হতে পারে ভোর বেলা ঘুম থেকে ওঠার কারণে আপনি তাড়াহুড়া ছাড়া সময়মত অফিসে/ক্লাসে যেতে পারছেন, এবং কাজ অনেক গুছিয়ে করতে পারছেন – কারণ সকালে উঠেই তাড়াহুড়া না করার কারণে আপনার মাথা অনেক ঠান্ডা থাকছে। এছাড়া, চিন্তা বিক্ষিপ্ত থাকার কারণে যাদের সাথে ঠিকমত কথা বলতে পারতেন না, তাদের সাথে সুন্দর ভাবে কথা বলতে পারছেন। মানুষের সাথে আপনার সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। নিয়ম করে চলার কারণে আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে, শরীরে বেশি এনার্জি থাকছে। ফলে আপনি অনেক বেশি কাজ করার পাশাপাশি প্রফুল্ল থাকতে পারছেন।

শুধুমাত্র একটি অভ্যাস পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একজন মানুষের জীবন পুরোপুরি বদলে যেতে পারে। কাজেই, কোন অভ্যাসটি আগে পরিবর্তন করবেন সেটি খুঁজে বের করে দ্য পাওয়ার অব হ্যাবিট বইয়ের লিসনগুলো প্রাকটিস করুন। আপনার সাফল্যেই আমাদের সার্থকতা।

বুক রিভিউটির বিষয়ে আপনার যে কোনও মতামত আমাদের কমেন্ট করে জানান। আপনার প্রতিটি মতামতই আমাদের কাছে মহামূল্যবান। 

আর যদি মনে হয় লেখাটি অন্যদেরও উপকার করবে – তবে শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন। 

আমরা আমাদের পাঠকদের কাছ থেকেও অনুপ্রেরণামূলক লেখা আশা করছি।  এই ধরনের লেখা যদি আপনিও লিখতে পারেন তবে write@test.edaning.com – এ ইমেইল করতে পারেন।  আপনার লেখা যত্ন সহকারে আপনার নাম সহ আমরা প্রকাশ করব। 

নিয়মিত অনুপ্রেরণামূলক ও আত্ম উন্নয়ন মূলক লেখা পাওয়ার জন্য আমাদের সাথে থাকুন।  সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার সাথে আছে।

আরও বুক রিভিউ:

♠ সব দিক বিবেচনা করার দক্ষতা বাড়ান: সিক্স হ্যাট থিংকিং মেথড – বুক রিভিউ

♠ ৫ সেকেন্ড রুল – বুক রিভিউ: জীবন ও সময়ের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার সূত্র

♠ সকাল ৮টার আগে এই ৬টি কাজ করলে আপনার জীবনই বদলে যাবে: “দি মিরাকেল মর্নিং” বুক রিভিউ

♠ ডেল কার্নেগী এর “হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস এ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপল”–বুক রিভিউ

♠ সত্যিকার বড়লোক হওয়ার উপায়: থিংক এ্যান্ড গ্রো রিচ (বুক রিভিউ)

পোস্টটি শেয়ার করুন !