আমরা বেশিরভাগই ডেস্কে, অর্থাৎ চেয়ার টেবিলে বসে কাজ করে থাকি। আর চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করা মানুষদের মধ্যেই ওজন বৃদ্ধি, হৃদরোগ, শরীর ম্যাজম্যাজ করা, অল্প কাজ করেই ক্লান্ত বোধ করা, কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা – ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়।
অনেকেই কর্মজীবনের শুরুতে একটানা অনেক্ষণ বসে থেকে কাজ করেন। কিন্তু পরে আর সেইভাবে কাজ করতে পারেন না। কারণ কিছুদিন টানা এভাবে কাজ করলে শরীর ও মনে প্রভাব পড়ে।
প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে কি গভীর মনোযোগ দিয়ে একটানা কাজ করা খারাপ? ব্যাপারটা আসলে মোটেও সেরকম নয়। কিন্তু এর জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে।
কিন্তু যদি অল্প কিছু বিষয় মেনে চলেন, তাহলে কিন্তু খুব সহজেই টেবিল চেয়ারের কাজ বা ডেস্ক জবও উপভোগ করতে পারবেন – পাশাপাশি বসে কাজ করার ফলে যেসব শারীরিক অসুবিধা হয় – সেগুলো থেকেও বাঁচতে পারবেন।
এই লেখায় মূলত দু’টি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। এক, কিভাবে বসতে হবে; দুই, কতক্ষণ একটানা কাজ করা ভালো। চলুন তাহলে, জেনে নেয়া যাক।
বসার আদর্শ পদ্ধতি:
চেয়ার-টেবিল বা ডেস্কে বসে কাজ করলে শরীর ধরে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। শরীর ধরে যাওয়ার ফলে, গা ম্যাজম্যাজ করে আর দ্রুতই ক্লান্তি লাগতে শুরু করে। সেইসাথে দ্রুত ওজন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
তবে ঠিকভাবে বসলে এত ক্লান্ত লাগবে না। খুব বেশি রিল্যাক্সড এবং খুব বেশি টাইট হয়ে বসা – কোনওটাই ভালো নয়। কম্পিউটারে বা কাগজ কলমে কাজ করার সময়ে খুব বেশি পেছনে হেলান দিয়ে বা সামনের দিকে ঝুঁকে বসবেন না। দুই ভাবেই আপনার পিঠে ও মেরুদন্ডে চাপ পড়ে। এতে পিঠ ও বাহু আড়ষ্ট হয়ে যায়, ফলে অস্বস্তি ও ঝিমানো ভাব চলে আসে। সেই সাথে ব্যাক পেইন হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সবচেয়ে ভালো হয় যদি পিঠ সোজা করে বসে কাজ করতে পারেন। প্রয়োজনে মাঝারি সাইজের একটি কুশনে পিঠ ঠেকিয়ে বসে কাজ করুন। এতে এমনিতেই আপনার পিঠ সোজা হয়ে থাকবে, কিন্তু কোমরে চাপ পড়বে না। পিঠ এবং কাঁধ আড়ষ্টও হবে না। ব্যাক পেইনের ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতিটি খুব কার্যকর। মূলত ব্যাক পেইন বা মেরুদন্ডের ব্যাথার মূল কারণই হল, বেশি ঝুঁকে কাজ করা।
আপনি যদি কম্পিউটারে কাজ করেন, তবে খেয়াল রাখুন যেন কম্পিউটারের কিবোর্ড ও মাউস কনুইয়ের সমান্তরালে থাকে। কাঁধ যেন স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু বা নিচু অবস্থায় রাখতে না হয়। এতে করে কিছুক্ষণ কাজ করার পরই কাঁধ আড়ষ্ট হবে না। কাঁধ আড়স্ট হয়ে গেলে কাঁধে ও ঘাড়ে ব্যাথা, ম্যাজম্যাজ করা, হাত অবশ হওয়া – এসব হতে পারে। এতে কাজে অসুবিধার সাথে শরীর দ্রুত ক্লান্ত হয়। চাঙ্গা থেকে অনেক্ষণ কম্পিউটারে কাজ করতে চাইলে অবশ্যই এটা করুন।
এই কথা কাগজ কলমে কাজ করার বেলায়ও সত্যি। ঘাড় গুঁজে বা মেরুদন্ড বাঁকা করে কাজ করলেও একই ধরনের অসুবিধা হয়। কাজেই কাগজ কলমের কাজের সময়েও সোজা হয়ে বসুন।
এই কথা শুধু কাজের জন্য নয় – পড়াশুনার সময়েও এইভাবে বসলে অনেক বেশি ভালোভাবে পড়াশুনা করা যায়।
কতটা সময় ধরে কাজ করবেন?
অনেক্ষণ এক নাগাড়ে বসে থাকলে পিঠ ধরে যায়। হাত-পায়ের জয়েন্টগুলো আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। এমনকি যদি সঠিক ভাবে বসেও কাজ করেন – তবুও অনেক্ষণ একটানা বসে থাকবেন না। সবচেয়ে ভালো উপায় হল, প্রতি ২৫ মিনিট পরপর ৫ মিনিট একটু হাঁটাহাঁটি করা ও শরীর বাঁকিয়ে হাল্কা ব্যায়াম করা।
শরীরকে চাঙ্গা রাখার জন্য রক্তচলাচল গতিশীল রাখা খুব জরুরী। টানা বসে থাকলে রক্তচলাচল ধীর হয়ে পড়ে।ফলে শরীরে ক্লান্তি আসে, মনে হয় এনার্জি নেই।
কাজের গতি ঠিক রেখে শরীরের এনার্জি বৃদ্ধি করতে “পমোডরো টেকনিক” বেশ কাজে আসতে পারে। এই টেকনিকে প্রতিটি ওয়ার্ক সেশনকে ৪টি ২৫ মিনিটের সাব সেশনে ভাগ করা হয়। সব মিলিয়ে, ৪x২৫, মোট ১০০ মিনিটের সেশন। প্রথম ৩টি সাব সেশনে প্রতি ২৫ মিনিট পর পর ৫ মিনিটের একটি ব্রেক নিতে হয়। এই ব্রেকের সময়ে আপনি অবশ্যই চেয়ার ছেড়ে উঠবেন এবং একটু হাঁটাহাঁটি করবেন। ৪ নম্বর সাব সেশন, অর্থাৎ শেষ ২৫ মিনিটের সেশন শেষ করে ১৫-২০ মিনিটের একটি বড় ব্রেক নিন। তারপর আবার ১০০ মিনিটের আরেকটি সেশন শুরু করুন।
এই পদ্ধতিতে কাজ করলে, কাজে যেমন ফোকাস থাকবে, তেমনি এনার্জিও থাকবে। এখানে মনে রাখতে হবে, প্রতি সেশনের পুরো ২৫ মিনিটই যেন আপনার মনযোগ যেন শুধু হাতের কাজটির ওপরেই থাকে। ফোকাস শিফট হলে মস্তিষ্ক দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কেন এক সময়ে শুধু একটি কাজ করা আপনার জন্য ভালো, সেই বিষয়ে আমাদের আরও একটি পূর্ণাঙ্গ লেখা রয়েছে। চাইলে সেটি পড়ে নিতে পারেন।
পমোডরো টেকনিক ছাড়াও ৫ মিনিটের শর্ট মেডিটেশনও বেশ কাজে দেয়। টানা কাজ করার পর আপনি যদি ৫ মিনিটের জন্য চোখ বন্ধ করে থাকেন – তবে মস্তিষ্ক অনেকটা চাপমুক্ত হয়ে যায়। এই ৫ মিনিট চেষ্টা করবেন কোনওরকম চিন্তা না করার। শুধু চোখের সামনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। চাইলে অবশ্য সুন্দর কিছু দৃশ্য কল্পনা করার চেষ্টা করতে পারেন। এতে মন ফুরফুরে হবে।
পমোডরো টেকনিক ব্যবহার করলে যে কোনও একটি রেস্টিং সেশনেও এই মেডিটেশন করতে পারেন। অর্থাৎ প্রতিটি ১০০ মিনিট ওয়ার্কিং সেশনে ৫ মিনিট মেডিটেশন। এই দু’টি পদ্ধতি মেনে কাজ করলেই আশা করা যায় আপনি অনেক ভালো ভাবে আপনার ডেস্ক জব করতে পারবেন।
শেষ কথা:
তরুন বয়সে, বা ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে নিজের ইচ্ছামত কাজ করা তেমন প্রভাব না ফেললেও বয়স ৩৫ এর আশেপাশে গেলে এগুলো প্রভাব ফেলতে শুরু করে। কিন্তু প্রথম থেকেই যদি এই নিয়মগুলো মেনে কাজ করতে পারেন – তবে দীর্ঘদিন আপনি আপনার সেরা লেভেলে থেকে কাজ করে যেতে পারবেন। ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে আপনার কাজের মান আরও অনেক ভালো হবে – এবং আপনি কাজ বা পড়াশুনায় অনেক বেশি সাফল্য পাবেন।
আসলে আমরা বুঝতেও পারি না যে, কিছু সাধারন নিয়ম মেনে চললে আমাদের জীবনে কত বড় ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। আপনার প্রতি অনুরোধ থাকবে অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও এই পদ্ধতিগুলো চর্চা করে দেখার। নিজের পরিবর্তন আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন।
আপনার ক্যারিয়ারকে আরেকটু ভালোর দিকে নেয়ার ক্ষেত্রে এই লেখাটি যদি আপনাকে একটু হলেও সাহায্য করতে পারে – তবেই আমাদের প্রচেষ্টা সফল বলে ধরে নেব।
লেখাটির ব্যাপারে আপনার যে কোনও মতামত আমাদের কমেন্ট করে জানান। আপনার প্রতিটি মতামতই আমাদের কাছে অমূল্য।
আপনার নিজের যদি এমন কোনও ফর্মূলা জানা থাকে, তবে আপনিও লড়াকুর জন্য লিখতে পারেন। মোটিভেশনাল ও সেলফ ডেভেলপমেন্ট ক্যাটাগরির যে কোনও ভালো লেখা আমরা আপনার নাম সহ লড়াকুতে প্রকাশ করব। আপনার লেখা ইমেইল করুন এই এ্যাড্রেসে: Write@test.edaning.com.
আর সব শেষে, যদি মনে হয় এই লেখাটি পড়ে অন্যরাও উপকৃত হবেন, তবে শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন।
এই ধরনের আরও লেখার জন্য নিয়মিত আমাদের সাথে থাকুন। সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার সাথে আছে।