জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ ও স্থির করার উপায়: “সাকসেস প্রিন্সিপালস” – (বুক রিভিউ)


জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ বা স্থির করতে হলে জানতে হবে, কিভাবে জীবনের লক্ষ্য খুঁজতে হয়, আর কিভাবেই তা সবারচেয়ে ভালো ভাবে পূরণ করতে হয়?

– এই প্রশ্ন অনেকের মনেই জাগে।  আমরা প্রায়ই আমাদের আশপাশে বা টিভি-পত্রিকায় এমন কিছু মানুষ দেখি যাদের কাজ আর সাফল্যের পরিমান দেখলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না।

তাঁরাও তো আমাদের মতই মানুষ। দিনে তো তাঁরা ২৪ ঘন্টার বেশি পান না, কিন্তু কিভাবে তারা নিজেদের এমন পর্যায়ে নিয়ে যান? কিভাবে তাঁরা তাঁদের কাজ ও সময়কে ম্যানেজ করেন? এমন কিছু প্রশ্নের উত্তরই আমরা এখানে জড়ো করেছি “Success Principles” বইয়ের আলোকে।


পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ সাফল্য চায়। সাফল্য চায়না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। সেই চাওয়া হতে পারে অল্প সময়ের, বা সারা জীবনের জন্য। আমরা প্রতিটি মূহুর্তে সাফল্য কামনা করি।

একটি বোতলের ছিপি খোলার সময়েও আমাদের লক্ষ্য থাকে সেই কাজে সফল হওয়া। খাওয়া শুরু করার সময়ে লক্ষ্য থাকে সফল ভাবে খাওয়া শেষ করে ওঠার। একজন মানুষ তার জীবনকে তখনই একটি সফল জীবন হিসেবে ধরে নেয়, যখন তার জীবনের লক্ষ্য সম্পূর্ণ পূরণ হয়।

অনেকে আবার সারাজীবন ধরে জীবনের লক্ষ্যই খুঁজে বেড়ায়। এর কারন কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে লক্ষ্য খুঁজে পাওয়াটাও খুব একটা সহজ বিষয় নয়। তাই প্রথমে জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পাওয়া ও তাকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করতে পারা এক ধরনের সাফল্য।

ছোটখাট সাফল্য আমরা প্রায় প্রতিদিনই অর্জন করি। কিন্তু কিছু কিছু সাফল্য আছে যেগুলো অর্জন করতে হলে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়।

আবার সেই পথ খুঁজে খুঁজেই অনেকে তাদের জীবন পার করে দেয়। আবার খুঁজে পেলেও সেই পথ কিভাবে পাড়ি দিতে হবে, তা অনেকেই বোঝে না।

যারা জীবনের একটি নির্দিষ্ট ও অর্থপূর্ণ লক্ষ্য নির্ধারণ করতে চায়, এবং সেই লক্ষ্য অর্জন করে সফল মানুষ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায় – তাদের জন্য লেখক জ্যাক ক্যানফিল্ড এর বইগুলো অনেকটা ট্রেজার ম্যাপ এর মত।

বেস্ট সেলিং এই লেখক খুব সুন্দর করে, সহজ ভাষায় জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পাওয়া এবং সেই লক্ষ্যে কিভাবে ধাপে ধাপে পৌঁছতে হয় – সেসব তাঁর বইতে তুলে ধরেন।

তাঁর প্রথম বই প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই তিনি পৃথিবীর সাফল্যকামীদের মাঝে একজন অন্যতম রোল মডেলে পরিনত হয়েছেন। এর কারণ অসংখ্য মানুষ তাঁর বই থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ ও স্থির করার উপায় খুঁজে পেয়েছেন। হতাশার মাঝে দেখতে পেয়েছেন আশার আলো। আমরা আজ এমনই একটি বই নিয়ে আলোচনা করব।

লেখক সম্পর্কে

জীবনের লক্ষ্য স্থির করা

বই নিয়ে আলোচনা করার আগে লেখকের সম্পর্কে একটু ভাল করে জেনে নিলে লেখার বিষয়বস্তুগুলো বোঝাটা আপনার জন্য সহজ হবে।

একজন মানুষ যখন কোনও কাজের পরামর্শ দেয়, সবার আগে আমাদের মাথায় প্রশ্ন আসে যে কাজটি করে তিনি কি অর্জন করেছেন? এটা ভাবাই আসলে বুদ্ধিমানের কাজ।

একজন ব্যর্থ বা সাধারন মানুষ যদি আপনাকে চোখ ধাধাঁনো সফলতা পাওয়ার পথ বলে দেয়, সেটা খুব একটা কাজের হবে না। কাজেই চলুন জেনে নেয়া যাক জ্যাক আসলে তাঁর নিজের জীবনে কি অর্জন করেছেন।

“Chicken soup for the soul” নিউ ইয়র্ক টাইমস এর হিসেব অনুযায়ী সর্বকালের অন্যতম সেরা বেস্ট সেলিং বুক সিরিজ, যার একজন সহলেখক হলেন জ্যাক ক্যানফিল্ড।

৪৭টি ভাষায় অনুবাদ হওয়া বইটির এখন পর্যন্ত মোট সাড়ে এগারো কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। এছাড়াও লেখকের বেস্ট সেলিং বইয়ের তালিকায় রয়েছে “The Aladin Factor”, “Dare to Win”, “The power of Focus”, এবং “The Key to living the law of attraction” এর মত বই।

বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলা “The Secret” ডকুফিল্মটিতে তাঁর রয়েছে চোখে পড়ার মত উপস্থিতি। তিনি আজ পর্যন্ত ১০০০ এর বেশি রেডিও ও টেলিভিশ শো-তে উপস্থিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে “দি অপরাহ উইনফ্রে শো”, “মন্টেল”, “ল্যারি কিং লাইভ” এর মত বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় প্রোগামগুলো।

তিনি “Canfield training group” এর প্রধান এবং “The transformational leadership council” এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি হার্ভার্ড এবং ম্যাসেচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের মত দু’টি বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন। তিনি সর্বস্বীকৃত ভাবে পৃথিবীর একজন সেরা মোটিভেশনাল স্পিকার। বর্তমানে তিনি স্ত্রীর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস করছেন।

এক নজরে The Success Principles

বইটি আসলে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ, এবং লক্ষ্য পূরণের মাধ্যমে  সাফল্য পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অনেক টিপস, ট্রিক্স, ও শিক্ষা মিলিয়ে একটি পরিপূর্ণ সাকসেস গাইড। এবং বইটিতে শুধুমাত্র আর্থিক সাফল্যের কথা বলা হয়নি।

ব্যক্তিগত, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক – এসব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের ৬৪টি নীতি বইটিতে আলোচনা করা হয়েছে। বইতে লেখক বর্তমান পৃথিবীর সেরা সেরা বেশকিছু সফল ব্যক্তির জীবনযাপন নিয়ে আলোচনা করেছেন। এবং তাঁদের সাফল্যের কৌশল কিভাবে আপনিও কাজে লাগাতে পারেন, তা বর্ণনা করেছেন।

এই লেখার প্রথম দিকে বলা হয়েছিল, সাফল্য অর্জনের জন্য সর্ব প্রথমে প্রয়োজন লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারা

এই ৬৪টি সূত্র বা প্রিন্সিপালের বেশকিছু প্রিন্সিপাল পাঠককে লক্ষ্য নির্ধারনের ব্যাপারে দারুন ভাবে সাহায্য করবে। নিজের দক্ষতা ও আগ্রহের জায়গাগুলোকে পর্যালোচনা করে নিজের লক্ষ্য স্থির করতে পারলে মানুষ সফল হওয়ার পথে অনেকটাই এগিয়ে যায়। আর এরপর ধাপে ধাপে সেই লক্ষ্য অর্জনের দিকে কিভাবে এগিয়ে যেতে হয়, লেখক সেই কথাও আলোচনা করেছেন তাঁর বেস্ট সেলিং বইটিতে।

লেখক তাঁর খুঁজে পাওয়া ৬৪টি সূত্রের মাঝে সমন্বয় করে লক্ষ্য নির্ধারন ও সফল ভাবে সেই লক্ষ্য অর্জন করার জন্য ৪টি ৪টি করে মোট ৮টি সূত্র প্রস্তুত করেছেন।

সবগুলো নীতির মূলকথা আসলে এই ৮টি সূত্রের মাঝে মিলেমিশে আছে। আমরা এই বুক রিভিউতে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ বা স্থির করার এই আটটি প্রধান সূত্র নিয়ে আলোচনা করব। প্রথম ৪টি, অর্থা‌ৎ প্রথম ভাগে থাকছে লক্ষ্য খুঁজে পাওয়া ও জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করার  সূত্র, আর দ্বিতীয় ভাগের ৪টি তে থাকছে লক্ষ্য অর্জন করার সূত্র।

প্রথম ভাগ: কিভাবে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়

জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ ও পূরণ করা

সাফল্য অর্জনের মূল ভিত্তি হলো আপনি আসলে কোন কাজে সফল হতে চান, তা খুঁজে বের করা, এবং সেটিকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করা। প্রথম ভাগে আমরা ৪টি সূত্রের মাধ্যমে সেই ব্যাপারটিই শিখব।

সূত্র ০১: নিজের ১০০ ভাগ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিন

এই সূত্র বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক বলেন, আমরা যতক্ষণ না আমাদের নিজের দায়িত্ব পুরোপুরি নিজের কাঁধে নিতে না পারছি, ততক্ষণ আমরা স্বনির্ভর হতে পারব না।

হয়তো আমরা পরিবেশ বদলানোর ক্ষমতা সব সময়ে রাখি না। আমাদের বাতাসের গতি বা আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই রয়েছে।

লেখক বলেন, বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করে যে তারা একটি অসাধারন জীবন পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু তার সাথে এ-ও বিশ্বাস করে যে তার সেই অসাধারন জীবনটি অন্য কেউ এসে তার হাতে তুলে দেবে।

একটি ভাল চাকরি পাবে কারন সে ভালমত পড়াশুনা করেছে। ব্যবসায় ভাল করবে, কারন তার পুঁজি আছে, অথবা তার পন্য বা সেবা ভাল। কেউ একজন এসে তার জীবনকে ভালবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেবে, কারন সে এটার যোগ্য। বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করে জীবনে যা পাওয়ার, সময় আসলে তা এমনিতেই হাতে চলে আসবে।

কিন্তু লেখক বলেন মানুষের এই বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভুল।  আপনার জীবনের প্রতিটি মূহুর্তের প্রতি যদি কারও দায়িত্ব থাকে, সে মানুষটি আপনি নিজে। শুধুমাত্র আপনার কাজের ওপরেই নির্ভর করে আপনার জীবন কেমন হবে। সৃষ্টিকর্তা আপনাকে স্বাধীন ইচ্ছা (free will) দিয়েছেন – যাতে নিজের সিদ্ধান্ত আপনি নিজে নিতে পারেন। ভালো এবং খারাপের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে পারেন।

আর এই ব্যাপারটিকে মাথায় রেখেই লেখক বলেন, যদি আপনি সত্যিই সফল হতে চান, তবে আপনার জীবনের প্রতিটি মূহুর্তের দায়ভার আপনার নিজের কাঁধে নিতে হবে। মেনে নিতে হবে আপনার জীবনের সবকিছুর দায়িত্ব একমাত্র আপনার।

আপনার দৈনন্দিন জীবন, আপনার সম্পর্ক, ক্যারিয়ার, স্বাস্থ্য, ফিটনেস, পেশা, আবেগ-অনুভূতি – সবকিছুর জন্য একমাত্র আপনি দায়ী থাকবেন।আপনার জীবনের প্রতিটি উপাদান, প্রতিটি অভিজ্ঞতা, এবং আপনার সাথে ঘটা প্রতিটি ঘটনার জন্য একমাত্র দায়দায়িত্ব আপনার নিজের। – আপনাকে মেনে নিতে হবে – আজ আপনার সাথে যা ঘটছে, তা আপনার গতকালের কাজের ফল। এখানে আর কারও দোষ নেই।

লেখক বলেন, মানুষের একটি সহজাত অভ্যাস হলো, সবকিছুর জন্য, বিশেষ করে কোনও খারাপ ঘটনার জন্য বা ব্যর্থতার জন্য অন্যকে দোষারোপ করা। এই দোষারোপের থেকে পিতামাতা, ভাই, বোন, বন্ধু, সরকার, সমাজ, সিস্টেম, পরিবেশ এমনকি চাঁদ, সূর্য, বাতাসও বাদ যায়না। সৃষ্টিকর্তাকে তো আমরা কথায় কথায় দোষ দিই। কিন্তু তিনি আমাদের স্বাধীন ভাবে ছেড়ে দিয়েছেন – যা অন্য কাউকে দেননি।

কিন্তু আমরা সত্যিকার সমস্যাটাই সব সময়ে এড়িয়ে যাই, আমরা বুঝতে ব্যর্থ হই যে আসল সমস্যা বাইরে নয়, ভেতরে। আমরা কখনও নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি না, আমাদের নিজেদের কোথায় কমতি আছে, কোথায় ভুল আছে।

computer, content, control

লেখক বলেন, যদি আমাদের পুরো দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে হয়, তবে প্রথমেই অভিযোগ করা ও অন্যকে দোষারোপ করা ছাড়তে হবে।

আরও একটি ব্যাপার, আমরা যখন অভিযোগ করি, বেশিরভাগ সময়ে এমন একজন মানুষের কাছে করি, যে কিনা অভিযোগের বিষয়ে কিছু করতে পারবে না।

যেমন, অফিসের ব্যাপারে অভিযোগ করি স্ত্রীর কাছে। অফিসে গেলে স্ত্রীর ব্যাপারে। এর কারন কি? এর কারন এটা কম ঝুঁকিপূর্ণ। কারও মুখের ওপর অভিযোগ করতে বেশ ভাল সাহসের দরকার হয়।

যদি কোনও কারনে কারও ওপর আপনার অভিমান হয়, তবে তা নিয়ে অন্যের কাছে বলার চেয়ে মানুষটির সাথে সরাসরি কথা বলাই ভাল।

অন্যদিকে, কোনও ঘটনা বা পরিস্থিতি আপনাকে খারাপ অবস্থায় ফেললে, তা নিয়ে মানুষের কাছে অভিযোগ করলে তেমন কোনও সমাধান আসবে না। লেখক বলেন, আমাদের সমস্যা নিয়ে অভিযোগ করার বদলে সমাধানের দিকে নজর দেয়া উচি‌ৎ। সমস্যা সমাধানে আমরা নিজেরা কি কি করতে পারি – তা ভেবে বের করা উচি‌ৎ।

এভাবে নিজের সমস্যার সমাধান নিজে বের করার মানসিকতা তৈরী করতে পারলে আপনার নিজের লক্ষ্য নিজে ঠিক করাটাও অনেক সহজ হয়ে যাবে। জীবনের লক্ষ্য ঠিক করতে অন্যের দিকে তাকানোর প্রয়োজন পড়বে না।

সূত্র ০২: আপনার জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ব্যাপারে পরিস্কার ধারনা রাখুন

এখানে লেখক আপনাকে নিজের যোগ্যতা ও চরিত্রের দিকে নজর দিতে বলছেন। আপনাকে বুঝতে হবে জীবনের প্রতিটি বিষয়েরই কোনও না কোনও উদ্দেশ্য আছে। জীবনের কোনওকিছুই উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘটে না।

accurate, action, adult

লেখক বলেন পৃথিবীর জন্য নির্দিষ্ট কিছু করার জন্যই প্রতিটি মানুষের জন্ম হয়। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করার পথে আমাদের প্রথম কাজ এই কথাটি মেনে নেয়া।

প্রতিটি মানুষের কিছু অনন্য বা ইউনিক যোগ্যতা ও প্রতিভা থাকে। গভীর পর্যবেক্ষণ ও চিন্তার মাধ্যমে সফল মানুষেরা সেইসব প্রতিভা ও যোগ্যতাকে খুব ভাল ভাবে বোঝার চেষ্টা করেন।

কোন জিনিসটা করতে একজন মানুষ সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, এটা সঠিক ভাবে বুঝতে পারা তাঁর জীবনের লক্ষ্য স্থির করার জন্য খুবই জরুরী। যাঁরাই জীবনে অনেক বেশি সফল হয়েছেন, তাঁরা আসলে নিজেদের জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে খুবই পরিস্কার ধারনা করতে পেরেছেন।

নিজের যোগ্যতা ও প্রতিভার ব্যাপারে পরিস্কার ধারণা থাকলে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা অনেক সহজ হয়ে যায়।

সূত্র ০৩: আপনি জীবন থেকে কি চান, সে বিষয়ে খুব ভালভাবে সিদ্ধান্ত নিন

আগের সূত্রটি মানলে আপনি জেনে যাবেন যে আপনার পৃথিবীতে আসার উদ্দেশ্য কি, এবং কোন কাজটা আপনি সবচেয়ে ভালো ভাবে করতে পারবেন। এবং আপনি তা করতে সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন।

এরপর আপনাকে যা করতে হবে তা হল সিদ্ধান্ত গ্রহণ। আপনি আপনার জীবনের উদ্দেশ্য কিভাবে পূরণ করতে চান, এবং উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ার পর নিজেকে কোথায় দেখতে চান, কি অর্জন করতে চান, সেই সিদ্ধান্ত আপনাকে নিতে হবে।

কি পরিমান অর্থসম্পদের মালিক আপনি হতে চান, কতটা খ্যাতি চান, মানুষের জন্য কি করতে চান, পরিবারের জন্য কি করতে চান, কি নিয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চান – এই পর্যায়ে এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন।

সফল জীবন মানে আপনার কাছে কি – সেটা খুব ভালো করে জানার চেষ্টা করতে হবে।

box, celebration, gift

লেখকের মতে নিজের জীবনের উদ্দেশ্য ও নিজের প্রতিভা ও দক্ষতা জানার পরও মানুষ অনেক সময়েই সফল হয়না।

এর কারণ, এই ব্যাপারগুলোকে কাজে লাগিয়ে তারা ঠিক কি করতে চায় এবং কি পেতে চায়- সেই সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। তাই নিজের দক্ষতা, নিজের প্রতিভা জানার পর প্রতিটি মানুষের উচি‌ৎ নিজের সাফল্য আর আকাঙ্খাগুলোকে সুন্দর ভাবে সংজ্ঞায়িত করা।

সূত্র ০৪: মনে প্রাণে বিশ্বাস করা

এখানে লেখক বলেন যে মানুষ জীবনে যা চায়, তা না পাওয়ার পেছনে অন্যতম কারন হলো বিশ্বাসের অভাব। বলতে গেলে প্রতিটি মানুষই জীবনের কোনও না কোনও পর্যায়ে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু নিজের ওপর বিশ্বাস না থাকার কারণে বেশিরভাগ মানুষই সফল হতে পারে না।

beach, ocean, sand

লেখক এই ব্যাপারটি বোঝাতে গিয়ে “Think and Grow Rich” বইয়ের লেখক নেপোলিয়ন হিল এর একটি উক্তি দিয়েছেন – “মানুষের মন যা ভাবতে পারে ও বিশ্বাস করতে পারে, তা-ই সে অর্জন করতে পারে।“ – অর্থা‌ৎ ভাবনার সাথে বিশ্বাসটাও অতি জরুরী।

লেখক আরও বলেন মানুষের মন এতটাই শক্তিশালী যে সে যদি কোনওকিছু দৃঢ়ভাবে কামনা করে তাহলে তা অর্জন করতে পারে। কিন্তু সেই অর্জন করতে হলে মনকে ১০০ ভাগ বিশ্বাস করতে হবে যে সে তা পেতে পারে। এটাই লক্ষ্য স্থির করার শেষ ধাপ। আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে যে আপনি যা চান, তা আপনি অবশ্যই পাবেন।

এই বিশ্বাস নিজের মধ্যে নিয়ে আসতে পারলে – আপনি যে লক্ষ্য নির্ধারণ করবেন – সেটার দিকে পূর্ণ ভাবে এগিয়ে যেতে পারবেন।

দ্বিতীয় ভাগ: লক্ষ্য অর্জন করা

Red 3 Dart Pin on Black Green and Yellow Dartboard

স্বাধীনতা অর্জন করার থেকে যেমন রক্ষা করা কঠিন, লক্ষ স্থির করার পর তা অর্জন করা কিন্তু অতটা কঠিন না-ও হতে পারে। এটা নির্ভর করে আপনি সঠিক ভাবে আপনার লক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে পারছেন কিনা- তার ওপর।

লক্ষ নির্ধারণ করার পর কিভাবে সহজে সেই লক্ষ্য অর্জন করা যায় – তা লেখক বর্ণনা করেছেন তাঁর বইয়ের দ্বিতীয় ভাগে। এখানেও প্রথম ভাগের মতই চারটি মূল সূত্রের ওপর তিনি জোর দিয়েছেন। চলুন জেনে নেয়া যাক লক্ষ্য স্থির করার পর তা অর্জন করার ৪টি সূত্র।

সূত্র ০১: নিজের চারপাশে সফল ও ইতিবাচক মানুষদের একটি বলয় সৃষ্টি করুন

লেখক এখানে বলেন যে পাঁচজন মানুষের সাথে সবচেয়ে বেশি সময় কাটান, আপনি আসলে তাদের সমষ্টি। তিনি বলেন আমরা যে মানুষদের সাথে সবচেয়ে বেশি সময় পার করি, আমরা চাই বা না চাই, ধীরে ধীরে তাদের কিছু কিছু স্বভাব আমাদের ওপর প্রভাব ফেলে।

এই কারনেই তাঁর পরামর্শ হলো, যত কষ্টই হোক, অসাধারন, ইতিবাচক ও সফল মানুষদের সাথে আপনাকে সময় কাটাতে হবে।

art, ball-shaped, circle

যাঁরা ইতোমধ্যেই জীবনের লক্ষ্য সঠিকভাবে নির্ধারণ করেছেন, বা তা অর্জন করে ফেলেছেন – সেইসব মানুষের সাথে বেশি সময় কাটানোর পরামর্শ দেন জ্যাক।

এতেকরে আপনার মাঝেও সাফল্য অর্জনের ক্ষুধা জাগবে। তাছাড়া এমন মানুষের কাছ থেকে আপনি অনেক কিছু শিখতেও পারবেন।

বিশেষ করে আপনার স্থির করা লক্ষ্যের সাথে মিলে যায় – এমন মানুষদের সাথে থাকার চেষ্টা করুন। হয়তো বন্ধু হিসেবে, অথবা ছাত্র হিসেবে, অথবা একজন কর্মচারী হিসেবেও তাঁদের সাথে থাকতে চেষ্টা করুন। একটা সময়ে তাঁদের গুনগুলো আপনার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সূত্র ০২: অতীতের সবকিছুকে ভাল চোখে দেখুন

এখানে লেখক বলতে চেয়েছেন, অতীত নিয়ে আমাদের মনে কোনও আফসোস থাকা উচি‌ৎ নয়। অতীতের ঘটনাপ্রবাহই আমাদের বর্তমানে এনে দাঁড় করিয়েছে। আপনি যদি এই মূহুর্তে সুন্দর কোনও ভবিষ্যদের ছবি দেখতে পান – তবে তা আপনার অতীতের কারনেই।

past present future

আপনি যদি ভবিষ্য‌ৎকে জয় করার স্বপ্ন দেখেন, তবে তা হয়তো আপনার অতীদের ব্যর্থতার কারনেই।

তাই ভেবে নিন অতীতে আপনার সাথে যা-ই ঘটেছে তা আসলে একটি সুন্দর বর্তমান ও ভবিষ্যতের পথ খুলে দেয়ার জন্য ঘটেছে। অতীতের সবকিছুকে আশির্বাদ ধরে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া শুরু করুন। অতীত নিয়ে আফসোস করলে আর সামনের দিকে পা বাড়ানো হবে না। লক্ষ্য অর্জনের পথে এটা তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

সূত্র ০৩: যা-ই ঘটুক না কেন, লক্ষ্যের থেকে ফোকাস সরাবেন না

লেখক বলেন কোনও খারাপ পরিস্থিতিতে পড়লে হতাশ হওয়াটাই সবচেয়ে সবচেয়ে সহজ কাজ। কিন্তু অসাধারন মানুষেরা যে কোনও পরিস্থিতিতে পজিটিভ থাকতে ও অনুপ্রেরণা ধরে রাখতে পারেন বলেই তাঁরা অসাধারন সব সাফল্য অর্জন করতে পারেন।

লেখক স্বীকার করেন যে মনের ভেতর বাজতে থাকা নেতিবাচক ‘রেকর্ড’ বন্ধ করার কোনও সুইচ নেই। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই এসবে কান না দিয়ে নিজেদের মনযোগ ইতিবাচক বিষয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে।

লেখক বলেন সফল মানুষেরা তাঁদের জীবনে যত খারাপ পরিস্থিতিতেই পড়েন না কেন, কখনওই তার জন্য হতাশ হন না।

তাঁরা কখনওই অতীতের ব্যর্থতার গ্লানিতে ভোগেন না, বরং সেখান থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যান তাঁদের বড় লক্ষটি পূরণ করার জন্য।

তাঁরা কখনওই নিজের মন কে তাঁদের লক্ষ্য থেকে সরতে দেন না। যেই লক্ষ্য তাঁরা একবার স্থির করে ফেলেন, সেই লক্ষ্য অর্জনের আগ পর্যন্ত কোনও পরিস্থিতিই তাঁদের মনযোগ নষ্ট করতে পারে না। লেখক বলেন, লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রতিটি মানুষ যদি এই মনোভাব নিজের মাঝে সৃষ্টি করতে পারত, তবে সবাই সফল হতে পারত।

মনে যদি কখনও কোনও হতাশা বা নিরাশা জাগে – চোখ বন্ধ করে নিজের সুন্দর ভবিষ্য‌ৎ কল্পনা করুন – ভাবুন লক্ষ্যটি পূরণ হলে আপনার কেমন লাগবে। তাহলেই দেখবেন আর হতাশ লাগছে না। মন খারাপ হলে, কাজ থামানোর বদলে – বেশি করে কাজ করুন। ধীরে ধীরে এটা আপনার অভ্যাসে পরিনত হবে – এবং এভাবেই একদিন মনের হতাশা আর নেতিবাচক চিন্তা আপনাকে কাজ থেকে দূরে রাখতে পারবে না।

আপনি মন খারাপ করে সময় নষ্ট না করে, প্রতিটি মূহুর্ত লক্ষ্য পূরণের কাজে লাগাতে পারবেন।

সূত্র ০৪: সবকিছু গুছিয়ে নিন, এলোমেলো সবকিছুকে একটি ছকে নিয়ে আসুন

লেখক এখানে বলেন, একটি অগোছালো ডেস্ক একটি অগোছালো মনের পরিচয় দেয়। মানসিকতাকে গোছানোর সাথে সাথে কাজগুলোও গুছিয়ে ফেলা উচি‌ৎ। কোনটার পর কোনটা করবেন, তার একটি ছক সাজিয়ে নেয়াটা সঠিক ভাবে কাজ করার জন্য খুবই জরুরী।

জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করার উপায়

০১ – সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ০২- পরিকল্পনা, ০৩- কাজ শুরু, ০৪- কাজ চালিয়ে যাওয়া, ০৫ – হাতের কাজ শেষ করা, ০৬- পুরো প্রজেক্টটি এভাবে শেষ করা।

এটাকে লেখক বলেন “cycle of completion” – একটি কাজের প্রতিটি ধাপ এই সাইকেল মেনে করলে দিনশেষে যে কোনও বড় কাজে আপনি সফল হতে পারবেন যা আপনাকে আপনার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে খুব সহজে।

গোছানো জীবনের জন্য গোছানো মানুষ হওয়ার কোনও বিকল্প নেই।

পরিশিষ্ট

মানুষের জীবন আসলে একটি দীর্ঘ যাত্রার মত। সেই যাত্রায় একটি লক্ষ্য না থাকলে যাত্রাটি হয়ে পড়ে অর্থহীন। আবার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সেই লক্ষ্য পূরণের সঠিক পথ খুঁজে সে পথে চলতে না পারলেও জীবন অর্থহীন হয়ে পড়ে।

কাজেই জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পাওয়া আর সেই লক্ষ্যের দিকে সঠিক ভাবে এগিয়ে যাওয়া – দুটোই সমান জরুরী। সেই ক্ষেত্রে পেতে “Success Principles” বইটি খুবই কার্যকর। আমরা আশা করব বইটির জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আপনিও আপনার জীবনের সঠিক লক্ষ্য খুঁজে পেয়ে সেই লক্ষ্য পূরণে পূর্ণ সফল হবেন।

বুক রিভিউটি কেমন লাগলো – তা আমাদের কমেন্ট করে জানান। আপনার প্রতিটি মতামতই আমাদের কাছে অমূল্য। আর যদি মনে হয়,

আপনার যদি মনেহয় লেখাটি আপনাকে  আপনার কোনও বন্ধুকে একটু হলেও সাহায্য করবে – তাহলে শেয়ারের মাধ্যমে লেখাটি সবার কাছে পৌঁছে দিন।

এই ধরনের আরও বুক রিভিউ এবং অনুপ্রেরণামূলক লেখার জন্য নিয়মিত আমাদের সাথে থাকুন। সাফল্যের পথে প্রতিটি পদক্ষেপে লড়াকু আপনাদের সাথে আছে।

পোস্টটি শেয়ার করুন !