ট্রান্সফারওয়াইজ : ৫০০ পাউন্ড এর লস থেকে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা গড়ে তোলার গল্প


কথাটি বলেছিলেন আলিবাবা ফাউন্ডার জ্যাক মা, “প্রতিটি সমস্যাই এক একটি সুযোগ”। জ্যাক মা হয়তো এই উক্তিটি প্রথমে করেছেন, কিন্তু বড় বড় সব সফল উদ্যোক্তা এই নীতিকে কাজে লাগিয়েই আসলে তাঁদের সাফল্য পেয়েছেন।

স্টিভ জবস এ্যাপল কম্পিউটারের মাধ্যমে কম্পিউটারকে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে গেছেন। পরে তিনিই আবার বাটন বিহীন ফোন এর মাধ্যমে পুরো পৃথিবীর চেহারা পাল্টে দিয়েছেন। শুরু করেছেন নতুন যুগ। ইলন মাস্ক তাঁর পে-পাল দিয়ে অর্থ লেনদেনের নতুন যুগ সৃষ্টি করেছেন। জেফ বেজোস আমাজন এর মাধ্যমে খুচরা কেনাবেচাকে একটি ক্লিকের ব্যাপারে পরিনত করেছেন। গুগল তো এক কথায় পুরো বিশ্বের তথ্য ভান্ডারকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে।

আজ অবশ্য এঁদের কাউকে নিয়ে কথা বলব না। কিন্তু এঁদের মত একই পথে হাঁটতে গিয়ে, মানে সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে বিলিয়ন ডলারের বিজনেস গড়ে তোলার একটি গল্প বলব। যেটি উদ্যোক্তাদের জন্য যেমন অনুপ্রেরণার উৎস হবে, তেমনি নতুন বিজনেস আইডিয়া কিভাবে কাজে লাগাবেন, অথবা কোনও সমস্যাকে কিভাবে ব্যবসায় পরিনত করবেন – তার একটি ধারণাও পাওয়া যাবে।

hello-bcs-041223-1 (1)

৪৬ তম বিসিএস পরিপূর্ণ প্রস্তুতি

বর্তমানে অংশগ্রহণ করেছেন 620 জন

জয়েন করুন

একটি ভুল ও একটি আইডিয়া:

লন্ডনবাসী এস্তোনিয়ান নাগরিক ক্রিস্তো কারমান বর্তমানে অর্থ লেনদেন ব্যবসা “ট্রান্সফারওয়াইজ” এর সিইও হিসেবে কাজ করছেন। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান বাজার মূল্য ১২০ কোটি মার্কিন ডলার বা ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

২০০৮ সালে ক্রিস্তোর বয়স যখন ২৮ বছর, তিনি তখন একজন ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট হিসেবে লন্ডনে কাজ করতেন। চাকরি নিয়ে ভালোই ছিলেন, বেতন-বোনাস মিলিয়ে দিন ভালোই চলছিল তাঁর। ২০০৮ সালে তিনি ক্রিসমাসের বোনাস হিসেবে বাড়তি ১০ হাজার পাউন্ড পেলেন। ১০ হাজার পাউন্ড মানে আসলেই অনেক টাকা।

ক্রিস্তো বরাবরই বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি এই বিরাট অংকের বোনাসের টাকা উড়িয়ে না দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন এই টাকা ব্যবহার করে আরও টাকা বানানোর। তিনি হিসেব করে দেখলেন লন্ডনের ব্যাংকের চেয়ে এস্তোনিয়ার ব্যাংকে সুদের হার বেশি। তাই তিনি টাকাটি ইউকের ব্যাংক থেকে তুলে এস্তোনিয়ায় তাঁর নিজের সেভিংস একাউন্টে পাঠিয়ে দিলেন। যার জন্য তাঁকে ইউকের ব্যাংকে মাত্র ১৫ পাউন্ড ফি দিতে হয়েছিল।

ক্রিস্তো ভেবেছিলেন, এই ১৫ পাউন্ডই খরচ হবে। কিন্তু এক সপ্তাহ পর দেখলেন তাঁর এস্তোনিয়ান ব্যাংক এ্যাকাউন্টে ৫০০ পাউন্ড আরও কম জমা পড়েছে! প্রথমটায় তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না। তারপর একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতেই আসল ঘটনা বেরিয়ে পড়লো। কতবড় বোকামী করেছেন টের পেয়ে নিজের মাথার চুল নিজেরই ছিঁড়তে মন চাইছিল।

আসলে তিনি পত্রিকায় মুদ্রার বিনিময় হার দেখে টাকা পাঠিয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন ইউকের ব্যাংক তাঁকে সেই বিনিময় হারেই টাকা দেবে।

কিন্তু ব্যাংকগুলো আসলে প্রকাশিত রেটের চেয়ে অন্তত ৫% কম মূল্য ধরে মুদ্রা বিনিময় করে। সব ব্যাংকই লাভের জন্য এটা করে। এবং নিজ থেকে জিজ্ঞাসা না করলে কোনও ব্যাংকই এটা গ্রাহকদের জানায় না।

তবে ক্রিস্তো ব্যাংকে গিয়ে হৈচৈ না করে এটা নিজের ভুল বলে মেনে নিলেন। ব্যাংকের ওপর রাগ করার বদলে নিজের বোকামীর জন্য নিজের ওপরই বিরক্ত হলেন। কিন্তু সেইসাথে তিনি বাইরে টাকা পাঠানোর এমন একটি পদ্ধতি বের করার জন্য চিন্তা করতে লাগলেন, যে পদ্ধতিতে ব্যাংকে যাওয়ারই কোনও দরকার হবে না। এই চিন্তার থেকেই এক সময়ে তিনি ট্রান্সফারওয়াইজ এর আইডিয়া পান।

যেভাবে শুরু:

ট্রান্সফারওয়াইজ
[বাঁ থেকে- তাভেত হিনরিকাস ও ক্রিস্তো কারমান]
ক্রিস্তো তাঁর আরেক এস্তোনিয়ান বন্ধু, স্কাইপি ম্যাসেঞ্জারের কর্মকর্তা তাভেত হিনরিকাস এর সাথে প্রায়ই ব্যক্তিগত পর্যায়ে অর্থ লেনদেন করতেন।

এটা করতে তাঁদের কোনও সমস্যা হত না, কারণ, তাঁদের একজন (ক্রিস্তো) পাউন্ড দিয়ে তৎকালীন এস্তোনিয়ান মুদ্রা ‘করুন’ নিতেন, এবং তাভেত মাঝে মাঝে করুন এর বদলে পাউন্ড নিতেন। আর এটার জন্য তাঁরা লেনদেনের দিনে বিভিন্ন পত্রিকায় দেখানো বিনিময় হারের একটি গড় ধরে বিনিময় করতেন। এখানে ব্যাংকের কোনও কমিশন থাকতো না, ফলে তাঁদের কোনও লস হত না।

এই লেনদেন দুইজন থেকে আস্তে আস্তে আরও বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী তাঁদের এস্তোনিয়ান বন্ধু-পরিচিতদের মাঝে একটি লেনদেনের নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। এস্তোনিয়ায় থাকা ও এস্তোনিয়ার বাইরে থাকা বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে নিয়মিত মুদ্রা বিনিময় শুরু করেন।

এই নেটওয়ার্কটি দিনে দিনে বাড়তেই থাকে। সাথে বাড়তে থাকে লেনদেনের পরিমান। এবং তাতেভ ও ক্রিস্তো ভেবে দেখেন যে, এটাকে আরও বাড়িয়ে পুরোপুরি ব্যবসার রূপ দেয়া সম্ভব।

সেই উপলব্ধি থেকেই তাঁরা দুইজন মিলে ২০১১ সালে লন্ডনে ট্রান্সফারওয়াইজ এর প্রথম ওয়েবসাইট চালু করেন। এটি মূলত একটি আর্থিক প্রযুক্তি (fintech) সেবাদাতা ওয়েবসাইট। এটি ব্যবহার করে যে কেউ এক দেশের মুদ্রাকে অন্য দেশের মুদ্রায় পরিবর্তন করে নির্দিষ্ট মানুষের কাছে পাঠাতে পারেন।

আর এটার জন্য ওয়েবসাইটটি বিভিন্ন প্লাটফর্মে পাওয়া দিনের মুদ্রা বিনিময় হারের গড় অনুযায়ী বিনিয়ময় করে। এবং যে কোনও মুদ্রার জন্য ফি কাটা হয় মাত্র ০.৫%, যা ব্যাংকের হারের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ কম।

পরিবর্তন ও সাফল্যের শুরু:

[ট্রান্সফারওয়াইজ ওয়েবসাইট]
প্রথম দিকে ওয়েবসাইটটির কার্যক্রম নিজেদের সার্কেলের মধ্যেই বেশি ছিল। এরপর একজন দুইজন করে গ্রাহক বাড়তে থাকে। প্রথমটায় ওয়েবসাইটটির নাম মানুষের মুখে মুখে ছড়ায়, এবং প্রাথমিক গ্রাহকরা সেখান থেকেই আসেন।

পরে একটা সময়ে একটি টেকনোলজি ভিত্তিক জনপ্রিয় ওয়েবসাইট তাদের সার্ভিস নিয়ে একটি দারুন ইতিবাচক রিভিউ প্রকাশ করে। মূলত তারপর থেকেই ট্রান্সফারওয়াইজ এর গ্রাহক উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে শরু করে।

যে কোনও ফাইনানসিয়াল সার্ভিস চালাতেই বেশকিছু আইনগত জটিলতা থাকে। এই জটিলতা এড়াতে বৃটেনের সর্বোচ্চ আর্থিক কতৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি ও লাইসেন্স নিয়ে তারপরই ব্যবসা শুরু করেন। এরপরই ধীরে ধীরে তাঁরা সাফল্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন।

বিনিয়োগ:

ওয়েবসাইটের প্রাথমিক সাফল্য ও গ্রাহকের হার বাড়ার পরও ভালো কোনও ইনভেস্টর বা বিনিয়োগকারীকে ধরতে পারছিলেন না দুই ফাউন্ডার। প্রথমদিকে নিজেদের জমানো টাকা বিনিয়োগ করেই ক্রিস্তো ও তাভেত তাঁদের সার্ভিসটি চালাতেন।

২০১২ সালে বিনিয়োগকারী আকর্ষণ করার যথেষ্ঠ চেষ্টা চালিয়েও তাঁরা ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা তবুও চেষ্টা করে গেছেন। ১৫ জন ইউরোপিয়ান বিনিয়োগকারীর সাথে কথা বলে কাউকেই রাজি করাতে পারেননি তাঁরা। পরে একটা সময়ে গিয়ে তাঁরা বুঝতে পারেন, ইউরোপিয়ানরা আমেরিকানদের চেয়ে ঝুঁকি নিতে বেশি ভয় পায়।

পরে তাঁরা আমেরিকান বিনিয়োগ ধরার চেষ্টা করেন, এবং নিউ ইয়র্কের আইএ ভেঞ্চারস নামের একটি সংস্থা থেকে তাঁরা তাঁদের প্রথম বিনিয়োগটি পান। এরপর আর ট্রান্সফারওয়াইজকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ভার্জিন গ্রুপের মালিক রিচার্ড ব্র্যানসন, পে পাল এর সহ প্রতিষ্ঠাতা ম্যাক্স লেভচিন এর মত বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ সহ ৩০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ পেয়েছে কোম্পানীটি।

বর্তমানে ট্রান্সফারওয়াইজ:

ট্রান্সফারওয়াইজ লোগো

বর্তমানে ট্রান্সফার ওয়াইজ ওয়েবসাইট ও এ্যাপ মিলিয়ে গ্রাহক সংখ্যা ৪০ লক্ষ। আর এখানে তারা মোট ৫০টি দেশের ৪৯টি মুদ্রা বিনিময় করার সুযোগ পান। প্রতি মাসে ৩৯০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি লেনদেন হয়ে থাকে ওয়েবসাইটটিতে।

কোম্পানীটির বার্ষিক লাভের পরিমান প্রায় ৮০ লক্ষ মার্কিন ডলার – এবং এখানে বর্তমানে ১৪০০ নিয়মিত কর্মী রয়েছেন।

ফিন্যানশিয়াল টেকনোলজি বিশেষজ্ঞ ক্রিস স্কিনারের মতে, ট্রান্সফারওয়াইজের এই দ্রুত বেড়ে ওঠার প্রধান কারণ এটি খুব সহজ ও সস্তা, এবং ব্যাংকের মত এটির কোনও লুকায়িত খরচ (hidden cost) নেই।

পরিশিষ্ট:

মানুষের সমস্যার সমাধান করেই যে সত্যিকার বড় উদ্যোক্তা হওয়া যায়, তা হাতে কলমে প্রমাণ করেছেন দুই এস্তোনিয়ান বন্ধু ক্রিস্তো ও তাভেত।

ক্রিস্তোর জবানীতে, “শুরু করার সময়ে বলতে গেলে কিছুই জানতাম না; আমরা ভাবছিলাম- দুই এস্তোনিয়ানের বানানো একটি ওয়েবসাইটের ওপর কে ভরসা করবে? আমাদের মত সমস্যা কি আরও মানুষের আছে? – পরে দেখা গেল, বিশ্বের অনেক মানুষেরই এই সমস্যা ছিল, এবং তারা আমাদের ওপর ভরসাও করেছেন”

আসলে আপনি কোথা থেকে এসেছেন, কি করেছেন – এগুলো কোনও ব্যাপার নয়। যদি কোনও সমস্যা দেখেন, তাহলে তা সমাধানের চেষ্টা করুন। নতুন আইডিয়া পেলে তা নিয়ে এগিয়ে যান। সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করলে সাফল্য আসবেই – দুই অখ্যাত এস্তোনিয়ান অভিবাসী আরও একবার সেটাই প্রমাণ করলেন।

লেখাটির বিষয়ে আপনার যে কোনও মতামত আমাদের কমেন্ট করে জানান। আপনার প্রতিটি মতামতই আমাদের কাছে মহামূল্যবান। 

আর যদি মনে হয় লেখাটি অন্যদেরও উপকার করবে – তবে শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন। 

আমরা আমাদের পাঠকদের কাছ থেকেও অনুপ্রেরণামূলক লেখা আশা করছি।  এই ধরনের লেখা যদি আপনিও লিখতে পারেন তবে write@test.edaning.com – এ ইমেইল করতে পারেন।  আপনার লেখা যত্ন সহকারে আপনার নাম সহ আমরা প্রকাশ করব। 

নিয়মিত অনুপ্রেরণামূলক ও আত্ম উন্নয়ন মূলক লেখা পাওয়ার জন্য আমাদের সাথে থাকুন।  সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার সাথে আছে।

পোস্টটি শেয়ার করুন !