“গোছানো মানুষ” হওয়ার জন্য এই ৬টি জরুরী অভ্যাস চর্চা করুন


গোছানো মানুষ মানে গোছানো জীবন।  আর গোছানো জীবন মানেই সফল জীবন। নিজেকে যদি গোছাতে না পারেন, তবে কোনও কাজেই সফল হতে পারবেন না। পৃথিবীতে যত সফল মানুষ আছেন, তাঁদের সবার লাইফস্টাইলই অনেক গোছানো।  ছাত্র জীবন, পারিবারিক জীবন, ও পেশাগত জীবন – আপনি যেখানেই সাফল্য চান না কেন, আপনাকে গোছানো মানুষ হতে হবে।

সফল মানুষদের সবকিছুই একটি ছকে বাঁধা থাকে।  সবার ছক এক রকম নয়, তাঁরা নিজের সুবিধা অনুযায়ী নিজের মত করে জীবনকে গুছিয়ে নেন – এবং সেভাবেই কাজ করেন।  তাঁদের কাজ থেকে শুরু করে বিনোদন পর্যন্ত সুন্দর করে একটি ছকে বাঁধা থাকে।  আর এই ছকে বাঁধা জীবনই তাঁদের সফল করে।

কিন্তু কিভাবে তাঁরা এই গোছানো জীবন তৈরী করেন?

একটা ব্যাপার খুবই স্পষ্ট ভাবে চোখে পড়ে।  গোছানো মানুষদের চিন্তা ভাবনা খুব পরিস্কার থাকে।  তাঁরা কখন কোন কাজটি করছেন, এবং কেন করছেন – এসব খুব ভালো করে জানেন।  কোনও কাজই তাঁরা অহেতুক করেন না।  বিনোদন করার পেছনেও তাঁদের একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে।  তাঁরা তাঁদের উদ্দেশ্যের বাইরে অহেতুক কোনও কাজ করেন না, ফলে সময়কে অন্যদের চেয়ে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারেন।

গোছানো মানুষ হয়ে গোছানো জীবন গড়ার জন্য অনেকটা মানসিক শক্তির প্রয়োজন।  আর এই শক্তি একদিনে আসে না।  কিছু নির্দিষ্ট অভ্যাস চর্চা করার মাধ্যমে এই শক্তি গড়ে ওঠে।  আপনার জন্য সুখবর হলো, আপনিও চাইলে এই অভ্যাসগুলো চর্চা করে একজন গোছানো মানুষ হয়ে নিজের জীবনকে একটি গোছানো জীবন বানিয়ে সফল হতে পরবেন।

ব্যক্তিত্বমূলক ও উদ্দেশ্যমূলক অভ্যাস:

এই অভ্যাসগুলোকে ব্যক্তিত্বমূলক বা identity-based habits বলা হয়।  অন্য আরেক ধরনের অভ্যাস আছে, যাকে বলা হয় উদ্দেশ্যমূলক বা Goal-based habits – যেগুলো মূলত নির্দিষ্ট একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে গড়ে তোলা হয়।  যেমন ধরুন ভালো রেজাল্ট করার জন্য একটানা সারাদিন ধরে পড়ার অভ্যাস করা। শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেলে সারাদিন ধরে পড়ার এই অভ্যাসের আর তেমন একটা প্রয়োজন হবে না।

ব্যক্তিত্বমূলক অভ্যাসের সুবিধা হলো, এই অভ্যাসগুলো একবার রপ্ত হয়ে গেলে – জীবনের যে কোনও লক্ষ্য পূরণে আপনাকে সাহায্য করবে।  এই অভ্যাসগুলো সারা জীবনের জন্য  আপনাকে একজন গোছানো মানুষে পরিনত করবে।  গোছানো ও সফল জীবনের জন্য এই অভ্যাসগুলো চর্চা করা খুবই জরুরী।  চলুন তাহলে জেনে নিই গোছানো মানুষ হওয়ার জন্য যে ৬টি অভ্যাস চর্চা করা জরুরী।

গোছানো মানুষ হওয়া ও গোছানো জীবন এর জন্য জরুরী ৬টি অভ্যাস:

০১. প্রয়োজনীয় সবকিছু লিখে রাখার অভ্যাস করুন এবং সবকিছুর শিডিউল করুন

মানুষের মনে রাখার ক্ষমতা সীমিত।  এমনকি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মত জিনিয়াস প্রয়োজনীয় সবকিছু মনে রাখতে পারতেন না।  তিনি সব সময়ে কাছে একটা নোটবুক রাখতেন, এবং ভালো কোনও আইডিয়া বা জরুরী কিছু মাথায় আসলে সাথে সাথে লিখে রাখতেন।  সত্যি কথা বলতে পৃথিবীর প্রায় সব সফল মানুষেরই এই অভ্যাসটি ছিল।

নতুন আইডিয়া বা ভাবনা ছাড়াও, দিনের কাজগুলোকে গুছিয়ে লিখে রাখা উচি‌ৎ।  এতে করে কাজ গোছানো হয়।  কোনটার পর কোনটা করতে হবে, কোনটা বেশি জরুরী – ইত্যাদি ব্যাপার লিখে রাখলে অনেক ভালোভাবে কাজ করা যায়।

হাতের কাছে একটি নোটবুক সব সময়ে রাখুন।  একটি কাজের মধ্যে থাকার সময়ে যদি অন্য কিছু সম্পর্কে কোনও আইডিয়া আসে বা অন্য কাজের কথা মনে পড়ে যায় – তবে সাথে সাথে সেটা লিখে ফেলুন।  এতে করে সেই চিন্তার কারণে আর কাজে ব্যাঘাত ঘটবে না।  এবং আপনি পূর্ণ মনোযোগী হয়ে হাতের কাজটি করতে পারবেন।

এছাড়া, দিনের শুরুতে দিনের কাজগুলো শিডিউল করে ফেলুন।  যদি আগের রাতে করতে পারেন, তবে আরও ভালো হয়।  এভাবে সপ্তাহের ও মাসের কাজের একটা প্ল্যান রাখুন।  সপ্তাহ বা মাসিক কাজের লিস্টে কখন কোনটা করবেন – সেটা না লিখলেও লিস্ট করুন।  পরে প্রতিদিনের কাজের শিডিউলে সেগুলো প্রয়োজন মত যোগ করুন।

লিখে রাখার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, কোনও দরকারি জিনিস আপনি ভুলে যাবেন না।  এবং কোন কাজটি করা জরুরী, এবং কোনটি কম জরুরী – সেটা স্পষ্টভাবে আলাদা করতে পারবেন।  আপনার সব কাজই হবে গোছানো ও পরিপাটি।

০২. আর্থিক সচেতনতা

আর্থিক ভাবে সচেতন হওয়াটা গোছানো জীবন এর একটি প্রধান শর্ত।  রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড বইতে লেখক রবার্ট কিওসাকি বলেছেন, জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য আর্থিক সচেতনতার কোনও বিকল্প নেই।  টাকা কিভাবে আসছে, এবং কিভাবে খরচ হচ্ছে – এই হিসাব রাখা শুরু করলে দেখবেন, অনেক বাজে খরচ বাঁচাতে পারছেন।  এবং বেঁচে যাওয়া টাকা বিনিয়োগ করে আরও টাকা আয় করতে পারছেন।

আর্থিক চাপ মাথায় থাকলে কোনও কাজেই মন দেয়া যায় না। ফলে গুছিয়ে কাজ করা যায় না।  কাজেই টাকার চিন্তা যাতে মাথায় কম আসে, সেই কারণে সচেতনতার সাথে টাকার হিসেব রাখা জরুরী।

যদি ভাবেন কিভাবে এটা শুরু করা যায়, তবে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কোথায় কত টাকা খরচ করেছেন, সেটা দিনের শেষে লিখে রাখতে পারেন।  এভাবে শুরু করলে দেখবেন আপনি দিনে দিনে অর্থনৈতিক ভাবে আরও সচেতন হয়ে উঠছেন।  আপনার বাজে খরচ কমছে, এবং আপনার হাতে অনেক বাড়তি টাকা জমছে, যেগুলো আপনি লাভজনক কোনও কাজে লাগাতে পারবেন।  ইমার্জেন্সির সময়েও আপনার হাতে টাকা থাকবে।

এই কাজটি করলে টাকার হিসেব রাখার পাশাপাশি আরও একটা লাভ হবে।  দিনের শেষে প্রতিদিনের টাকার হিসেব মনে করতে গেলে কিছুদিনের মধ্যে আপনার স্মৃতিশক্তিরও অনেক উন্নতি হবে।  এবং আপনি যে কোনও জিনিসই চট করে মনে করতে পারবেন।

০৩. কাজের জায়গায় বাড়তি জিনিস রাখবেন না

আপনার কাজের জায়গায় বাড়তি জিনিস যত কম থাকবে, আপনি ততই মনোযোগের সাথে কাজ করতে পারবেন।

মনে করুন, আপনি আপনার ডেস্কে বসে একটা এ্যাসাইনমেন্ট করছেন।  সেই সময়ে আপনার চোখ গেল টেবিলের পাশে রাখা মাটির ব্যাংক এর দিকে।  তারপর আপনার মাথায় চিন্তা ঢুকলো, এই মাটির ব্যাংকের টাকা আপনি একটা চ্যারিটিতে দিতে চেয়েছিলেন।  এরপর মনে পড়বে গত ৫ দিন ধরে ব্যাংকে টাকা রাখা হয় না, কারণ খুচরা পয়সা পকেটে জমছে না।  কারণ গত ৫ দিনে আপনি কাঁচা বাজারে যাননি।  তারপর আপনার মনে পড়বে রান্নাঘরে মাত্র ৩টা পেঁয়াজ আছে, ডিপ ফ্রিজে রাখা মুরগীর বয়স ১৫ দিনের বেশি হয়ে গেছে, ওটা খেয়ে ফেলা দরকার।  তারপর মাথায় আসবে দেশের পোল্ট্রি শিল্পের সম্ভাবনা নিয়ে বিরাট কোনও আইডিয়া।  কিন্তু যেভাবে বার্ড ফ্লু হচ্ছে, তাতে কি পোল্ট্রি শিল্পকে বাঁচানো যাবে?

এতদূর পড়তে পড়তে নিশ্চই বিরক্ত হয়ে গেছেন? কিন্তু এমন চিন্তা করে সময় নষ্ট করাটা কিন্তু বিরক্তিকর নয়।  আপনার কাজের জায়গায় থাকা অদরকারী জিনিসগুলো এভাবে কত সময় খেয়ে ফেলে – সচেতন ভাবে হিসাব রাখতে গেলে অবাক হয়ে যাবেন।  অনেক সময়ে এই চিন্তার কারণেই আমরা সময়ের কাজ সময়ে শেষ করতে পারি না।  যার জন্য দায়ী হয় কাজের জায়গায় রাখা ছোট একটা মাটির ব্যাংক বা শো পিস।

কাজের সময়ে মোবাইল ফোন দূরে রাখুন।  দরকার হলে পাশের রুমে রেখে আসুন।  এভাবে যদি কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন, তবে দেখবেন অনেক বেশি দ্রুত আর মনোযোগের সাথে গুছিয়ে কাজ করতে পারছেন।

০৪. জায়গার জিনিস জায়গায় রাখুন

প্রতিটি জিনিসের জন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক করুন।  এবং সেগুলো নিয়ে কাজ করার পর আবার সেটা জায়গামত রেখে দিন।  জায়গার জিনিস জায়গায় রাখার অভ্যাস করলে, এই অভ্যাস আপনাকে খুব সহজেই গোছানো মানুষে পরিনত করবে।  এই অভ্যাস না থাকার কারণে, প্রয়োজনের সময়ে অনেক জিনিস খুঁজে পাওয়া যায় না।  এর ফলে ছোটখাট ঝামেলা থেকে শুরু করে অনেক বড় বড় বিপদও হতে পারে।  গোছানো মানুষের একটি প্রধান গুণই হলো, তারা জায়গার জিনিস জায়গায় রাখে।

এই অভ্যাস শুরু করার জন্য প্রতিদিন ১৫ মিনিট ব্যয় করতে পারেন।  দিনের কাজ শেষে প্রতিদিন ১৫ মিনিট ধরে আপনার কাজের ও বাড়ির জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখুন।  কোনও জিনিস তার জায়গা ছেড়ে অন্যকোথাও থাকলে, সেগুলো জায়গামত রাখুন।  ১৫ মিনিট হয়ে গেলে গোছানো বন্ধ করুন।  এভাবে কিছুদিন করার পর দেখবেন, ১৫ মিনিটের মধ্যে সব গোছানো না হলে আপনার নিজের মনের মধ্যেই খচখচ করবে।  তখনই বুঝবেন এটা আপনার অভ্যাসের অংশ হয়ে গেছে।  এরপর থেকে আপনার আর ঘড়ি ধরে করার দরকার হবে না।  এমনিতেই আপনি সবকিছু গুছিয়ে রাখবেন।

০৫. ঘরের ও বাইরের কাজ আলাদা করুন, এবং সময় বরাদ্দ করুন

আমাদের অনেক সময়েই এমন হয় যে, ঘরের কাজ করার সময়ে বাইরের কাজ মনে পড়ে, এবং বাইরের কাজ করার সময়ে ঘরের কাজের কথা মনে পড়ে।  আপনি যদি সপ্তাহের শুরুতে সেই সপ্তাহের মধ্যে করতে হবে – এমন সব বাইরের ও ঘরের কাজ ক্যাটাগরি অনুযায়ী ভাগ করে ফেলেন, এবং কোনটা কোনদিন করবেন – সেটা ঠিক করে ফেলেন – তাহলে আর এই সমস্যা হবে না।

এভাবে কাজ করলে আপনার পেশাগত, ও ব্যক্তিগত – সব কাজই সুন্দর ও গোছানো হবে।

০৬. অপ্রয়োজনীয় জিনিস ফেলে দিন

৩ নম্বর পয়েন্টে কাজের জায়গায় অপ্রয়োজনীয় জিনিস রাখার ক্ষতির কথা বলেছিলাম।  এই ব্যাপারটাও অনেকটা সেরকম।  এটাও চিন্তা বাধাগ্রস্থ করার পাশাপাশি মনে অস্বস্তির সৃষ্টি করে।  একটি ফুরিয়ে যাওয়া কলম, খাবারের প্যাকেট, অব্যহৃত পানির বোতল – এগুলো খুব সাধারণ জিনিস মনে হলেও, এগুলো সব সময়ে সামনে পড়লে সব সময়ে মাথায় অস্বস্তি কাজ করে।  আপনি যদি গোছানো জীবন যাপন করতে চান, তাহলে সব সময়ে এইসব ‘হাবিজাবি’ ফেলে দেবেন।

অনেকেরই এই অভ্যাসটা থাকে না।  এই অভ্যাস করার জন্য আপনি সপ্তাহের একটি দিন এক ঘন্টা অভিযান চালাতে পারেন।  এই ১ ঘন্টায় আপনি আপনার ঘর/কাজের জায়গায় সব অপ্রয়োজনীয় জিনিস এক করে ফেলে দেবেন।  এই অভ্যাসের ফলে আপনার মাঝে সব সময়ে শুধু প্রয়োজনীয় বিষয়কে গুরুত্ব দেয়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে।  গুছিয়ে কাজ করার জন্য যা অতি জরুরী।

শেষ কথা:

এই ৬টি অভ্যাস যদি আপনি টানা ১ মাসের বেশি চর্চা করতে পারেন, তবে এগুলো আপনার ব্যক্তিত্বের অংশে পরিনত হবে।  এবং আপনি সত্যি সত্যি একজন গোছানো মানুষ হয়ে উঠতে পারবেন।  গোছানো মানুষ হয়ে গোছানো জীবন যাপন করা আসলে খুব একটা কঠিন নয়।  অন্য সবকিছুর মত এটাও আসলে একটা চর্চার বিষয়।  প্রথম ৩০ দিনে যদি ব্যর্থ হন, তবে বিশ্বাস না হারিয়ে আবার শুরু করুন। চর্চা করতে করতেই আপনি গোছানো মানুষ হয়ে উঠবেন, এতে কোনও সন্দেহ নেই।

এগুলোর বাইরেও গোছানো জীবন যাপন করার আরও উপায় আছে।  কিন্তু এই অভ্যাসগুলো চর্চা করলে আপনি অনেক সহজে গোছানো মানুষ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবেন।  আপনি যদি একটি অভ্যাসও চর্চা করে রপ্ত করতে পারেন – তাহলেও অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে যাবেন।

লেখাটি কেমন লাগলো তা আমাদের কমেন্ট করে জানান।  আপনার প্রতিটি মতামতই আমাদের কাছে অমূল্য।  আর যদি মনে হয় লেখাটি পড়ে অন্যরাও উপকৃত হবেন – তাহলে শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন।

এই ধরনের আরও লেখার জন্য নিয়মিত আমাদের সাথে থাকুন। সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার সাথে আছে।

পোস্টটি শেয়ার করুন !

One thought on ““গোছানো মানুষ” হওয়ার জন্য এই ৬টি জরুরী অভ্যাস চর্চা করুন

  1. অত্যান্ত সুন্দর কিছু তথ্য সম্পর্কে অবগত হলাম। ধন্যবাদ আপনার এই প্রচেষ্টার জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *