বন্ধু বানানোর উপায়: মাত্র ৯০ সেকেন্ডেই যে কাউকে বন্ধু বানিয়ে ফেলুন! – (বুক রিভিউ)


মানুষের সামনে কথা বলার সাহস সবার থাকে না। বিশেষ করে  প্রথম দেখায় অনেকেই ভালো করে কথা বলতে পারেন না।  এটাও ঠিক যে, একজন মানুষকে ভালো বন্ধু বানানোর জন্য অনেকটা সময়ের প্রয়োজন। তবে সেটার শুরুও হয় কিন্তু প্রথম দেখায়। আবার কিছু সময় আসে যখন অল্প সময়ের মাঝেই একজন মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়া দরকার হয়। সেটা ব্যবসায়িক কারণেই হোক, বা জড়তা কাটানো, বা নিছক একটি মানুষকে ভালোলাগার কারণে। আজ আপনাকে শেখাবো  স্বল্পতম সময়ে একজন মানুষের সাথে আলাপ জুড়ে দিয়ে তাকে বন্ধু বানানোর উপায়।


বলুন তো একজন মানুষ আপনার কেমন বন্ধু হবে তা তার সাথে কতক্ষণ থাকার পর নির্ধারিত হয়? মাত্র দেড় মিনিট, অর্থা‌ৎ ৯০ সেকেন্ড!

হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়েছেন। একটি ফুটবল ম্যাচের ১০০০ ভাগের একভাগ সময় আপনি হাতে পান, প্রথম পরিচয়ে কারও সাথে ভালো অথবা খারাপ সম্পর্ক তৈরী করার। – কিন্তু সময়টা নেহাত কম নয়, যদি আপনি সঠিক ভাবে এর ব্যবহার করতে পারেন। সত্যি কথা বলতে, একজন মানুষকে প্রথম দেখায় বন্ধু বানানোর জন্য আপনার ৯০সেকেন্ড এর বেশি দরকারও নেই।

এখন থেকে আপনি যা পড়বেন, তা যদি ঠিকমত কাজে লাগাতে পারেন তাহলে এই দক্ষতা আপনার ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে চাকরীর ইন্টারভিউ, ব্যবসায়িক ডিল, পন্য বা সেবা বিক্রয় – সবখানেই সমান ভাবে কাজে লাগবে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু না হলেও, বন্ধু নিশ্চই বানাতে পারবেন।

তো চলুন শুরু করা যাক: আপনি হয়তো ভাবছেন, এত কিছু থাকতে ৯০ সেকেন্ড কেন? – আসলে বেশকিছু গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমান সময়ে হাজারো তথ্য, সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি প্রোগাম, মুভি, যোগাযোগ – ইত্যাদির কারণে মানুষের মনযোগ এক জায়গায় খুব কম সময় থাকে।

আপনি যদি পাঁচ মিনিট সময় নিয়ে ধীরে ধীরে একজন মানুষের সাথে প্রাথমিক কথাবার্তা সারতে চান, তাহলে এই সময়ের মধ্যে দেখা যাবে আপনার সামনের মানুষটির ফোনটি বেজে উঠেছে অথবা কোনও একটি নোটিফিকেশন এসেছে – অথবা অন্যকিছু। আপনার দিকে তার মনযোগ পুরোপুরি ঘোরার আগেই তিনি অন্যদিকে মনযোগী হয়ে পড়বেন। তাই সময়ের হিসেবে দেড় মিনিট খুব অল্প হলেও এটাই বন্ধু বানানোর জন্য সবচেয়ে ভালো।

এতো গেল মানুষে মানুষে কথা বলার ব্যাপার, আপনি কি জানেন একটি ম্যাগাজিনের আর্টিকেল বা এ্যাড এর কাছে আপনার মনযোগ আকর্ষণ করার জন্য কতটা সময় থাকে? – মাত্র দুই সেকেন্ড! দুই সেকেন্ড এর মধ্যে যদি কোনও লেখা বা ছবি আপনার মনযোগ আকর্ষণ করতে না পারে – তাহলে ধরে নিতে হবে, সেটি আপনার মনযোগ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে।

একজন রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে আপনি হয়তো দুই সেকেন্ড এর বেশি সময় পাবেন, কিন্তু সেটাও খুব বেশি নয়। কথা শুরু করার জন্য আপনার হাতে পাঁচ সেকেন্ডের মত সময় থাকবে।

অনেকেই ভাবে “আমি কেন আগ বাড়িয়ে মানুষের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করব? যদি কারও দরকার হয় তাহলে নিজে এসে আমার সাথে কথা বলুক”। – এটা খুব স্বাভাবিক একটা মনোভাব, কিন্তু এটা আপনার ক্যারিয়ার অথবা ব্যক্তিগত জীবনের জন্য মোটেই ভালোকিছু নয়। একজন মানুষকে সফল হতে গেলে ভালো সম্পর্কের একটি নেটওয়ার্ক তৈরী করাটা খুবই জরুরী। আর আপনি যদি কিছু হওয়ার আগেই নিজেকে কিছু একটা ভাবতে শুরু করেন, তাহলে ক্ষতিটা আপনারই হবে। মনে রাখবেন প্রয়োজনটা যদি আপনার হয় তবে আপনাকেই আগে পা বাড়াতে হবে। – আর এই ‘হাল্কা অহঙ্কারী’ মনোভাবটা কিন্তু আপনার ভেতরের জড়তা ঢাকার একটি খোলসমাত্র।

বেশিরভাগ মানুষই নতুন কারও সাথে কথা বলতে গেলে নার্ভাস হয়ে কথা খুঁজে পান না। অবশেষে যতক্ষণে কথা খুঁজে পান ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। একজন মানুষ পাঁচ সেকেন্ড আপনাকে লক্ষ্য করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে আপনার সাথে কথা বলতে চায় কি চায় না। বন্ধু হওয়া তো দূরের কথা। কাজেই এটা খুবই জরুরী যে আপনি এই প্রথম কয়েক মিনিটেই সামনের মানুষটির কাছে একটি সুন্দর ভাবমূর্তি বানিয়ে তার মনযোগ আপনার দিকে নিয়ে নিন।

তাহলে বন্ধু হওয়ার জন্য একজন নতুন মানুষের সাথে আপনি কিভাবে কথা বলবেন? – আর কি নিয়েই বা কথা বলবেন?

আপনার বোঝার সুবিধার্থে এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে চলুন আমরা তিন ভাগে ভাগ করে ফেলি: ১/ সাক্ষা‌ৎ, ২/ গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি, ৩/ মৌখিক যোগাযোগ।

১ এবং ৩ আসলে এই ৯০ সেকেন্ড সময়ের বাইরে। ২ নম্বর ধাপটি হচ্ছে আপনার ৯০ সেকেন্ড, যখন আপনি আপনার সামনের মানুষটির সাথে একটি আবেগী (emotional) সম্পর্কের ভিত তৈরী করবেন। তবে এই ধাপটির সম্পর্কে আলোচনা করার পাশাপাশি বাকি দু’টি ধাপও জানা জরুরী।

এই ৩টি ধাপ সম্পর্কে জানলে এবং এর কৌশলগুলো অনুশীলন করলে আপনি অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরীতে দক্ষ হয়ে উঠবেন।

চলুন বন্ধু বানানোর এই তিনটি ধাপ সম্পর্কেই আমরা একে একে জেনে নিই:

০১/ সাক্ষা‌ৎ:

কোনও মানুষের সামনে প্রথমবার হাজির হওয়ার তিন থেকে চার সেকেন্ডের মধ্যেই যদি আপনি তার সামনে একটি ভালো ইমপ্রেশন তৈরী করতে পারেন, তবে আপনাকে সে বিশ্বাসযোগ্য ও নিরাপদ মনে করা শুরু করবে। আর তা ২ নম্বর ধাপে পৌঁছনোর জন্য খুবই জরুরী।

এখন আমরা আপনাকে পাঁচটি ছোট ছোট কিন্তু কার্যকরী টিপস দেব। এই টিপসগুলো অনুসরন করে আপনি পাঁচ সেকেন্ড এর মধ্যেই নতুন মানুষটির সামনে নিজের একটি ভালো ভাবমূর্তি দাঁড় করাতে পারবেন।

১.১/ নিজেকে মুক্ত রাখুন:

এখানে মুক্ত মানে বোঝানো হচ্ছে আপনার ভাবভঙ্গী যেন এমন হয়, যাতে করে আপনার সামনের মানুষটি বুঝতে পারে আপনি একজন মুক্ত মনের মানুষ। এখানে শারীরিক ভঙ্গী বা body language খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

একটু ব্যাখ্যা করা যাক: আপনি যদি বুকে আড়াআড়ি হাত বেঁধে দাঁড়ান বা খুব গুটিসুটি হয়ে বসেন, অথবা পা দু’টো প্রায় মিশিয়ে অথবা ক্রস করে দাঁড়ান তাহলে আপনার সামনের মানুষটি আপনার সাথে কথা বলতে খুব বেশি সহজ হতে পারবে না। Image result for hands crossed on chest

অন্যদিকে আপনি যদি হাত দুটো’কে সহজ ভঙ্গীতে রাখেন এবং বসা ও দাঁড়ানো – দুই সময়েই দুই পায়ের মাঝে বেশ কিছুটা জায়গা রাখেন – তাহলে আপনার সামনের মানুষটি সহজ বোধ করবে।

১.২/ চোখে চোখে তাকান:

এই ব্যাপারটি হয়তো আপনি আগেই শুনেছেন, বা পড়েছেন। প্রায় সব communication skill টিপসের এটি একটি খুবই কমন অংশ। কিন্তু এর যথেষ্ঠ কারণ আছে। একজন মানুষের সাথে কথা বলার সময়ে চোখে চোখে তাকানো বা eye contact এর গুরুত্ব কমবেশি সবারই জানা আছে।
তাই এই ব্যাপারে খুব বেশি কথা না বলে, শুধু এটুকু বলি, কথা বলার সময়ে অপরজনের চোখে চোখ রাখলে তার চোখে আপনি একজন আত্মবিশ্বাসী ও আকর্ষণীয় মানুষ হয়ে উঠবেন।Image result for people looking at each other

অন্যদিকে যদি একেবারেই সামনের জনের চোখে না তাকান, অথবা খুবই কম তাকান, তাহলে তার মনে হতে পারে আপনি নার্ভাস বা অনাগ্রহী। এমনকি আপনাকে মিথ্যেবাদীও ভেবে বসতে পারে।

তবে খুব বেশি সময় ধরে টানা চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে সেটি আবার একটু উদ্ভট দেখায়। কাজেই মাঝে মাঝে চোখ সরিয়েও নিতে হবে। সামনের মানুষটির মনভাব ও চরিত্র বুঝে eye contact করা উচি‌ৎ।

১.৩/ মুখে হাসি রাখুন:

Eye contact করার সাথে সাথে আপনার আরও যেই কাজটি করতে হবে, তা হল সামনের মানুষটির উদ্দেশ্যে একটি সুন্দর অথচ মুচকি হাসি দেয়া। – হয়তো অনেকবারই শুনেছেন, হাসি সংক্রামক। তাই আপনার দেয়া হাসি তার মুখেও ফুটে ওঠার সম্ভাবনা অনেকখানি।

এই হাসির কারণে সামনের লোকটি আপনার বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব সম্পর্কে একটি মেসেজ পাবে। – মনে রাখবেন মুখের সাথে সাথে যেন চোখও হাসে। হাসিটি যেন আন্তরিক মনে হয়। নাহলে উদ্ভট মনে হবে।

১.৪/ শুভেচ্ছা :

হাসির পর আপনাকে যা করতে হবে তা হচ্ছে একটি সুন্দর ও আন্তরিক সুরে সামনের মানুষটিকে শুভেচ্ছা জানানো। এই শুভেচ্ছা সালাম হতে পারে, হাই বা হ্যালো হতে পারে। শুধু মনে রাখবেন আপনার বন্ধু সুলভ আন্তরিকতা যেন এর মাঝে খুব সুন্দর ভাবে প্রকাশ পায়।

যত সুন্দর ভাবে সামনের মানুষটিকে শুভেচ্ছা জানাবেন, আশা করা যায়, সে-ও ততই সুন্দর ভাবে আপনাকেও শুভেচ্ছা জানাবে।

১.৫/ সামনে ঝুঁকুন:

না, আপনাকে জাপানিজদের মত একেবারে ঝুঁকে মাটির কাছাকাছি চলে যেতে বলা হচ্ছেনা। বন্ধু বানানোর জন্য এত ঝোঁকার প্রয়োজন নেই।

আপনি যখনই একজন নতুন মানুষের সাথে প্রথমবারের মত পরিচিত হবেন তখন তার দিকে হাল্কা ঝুঁকুন – একদম অল্প করে। এতে সামনের মানুষটির অবচেতন মনে একটি বার্তা যাবে যে আপনি তার প্রতি আন্তরিক ও বন্ধু ভাবাপন্ন।

তবে যদি বিপরীত লিঙ্গের কারও সাথে এরকম করেন তবে সেখানে একটি চিন্তার বিষয় আছে। মেয়েরা বিশেষ করে কোনও পুরুষের এই ধরনের আচরণকে আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি ভাব জমানোর চেষ্টা মনে করে থাকে। কাজেই সেক্ষেত্রে ঝোঁকার মাত্রা আরও কমিয়ে দিন।

আপনি হয়তো ভাবছেন মাত্র তিন থেকে পাঁচ সেকেন্ড এর মধ্যে এতকিছু কিভাবে হবে? – এই মূহুর্তেই ব্যাপারটি নিজে করে দেখতে পারেন।

০২/ গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি:

একজন নতুন মানুষের সাথে অল্প সময়ে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি করার তিনটি ধাপের সবচেয়ে জরুরী ধাপ এটি। ইংরেজীকে এই ধাপটিকে বলাহয় “Rapport” – এই গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি করতে আপনার হাতে রয়েছে ৯০টি মূল্যবান সেকেন্ড।

এই সময়টির সঠিক ব্যবহার করতে পারলে ৯১ সেকেন্ডে গিয়ে দেখতে পাবেন মানুষটির সাথে আপনার বেশ গভীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে।

মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণীর আগে একটি আবেগী প্রাণী। আমরা বেশিরভাগ কাজ যতটা না বুদ্ধি দিয়ে করি, তারচেয়ে বেশি আবেগ থেকে করি। এমনকি বুদ্ধি খাটিয়ে করা কাজগুলোর সাথেও কিছুটা হলেও আবেগ জড়িয়ে থাকে। কিন্তু এমন অনেক কাজ আমরা করি যার সাথে বুদ্ধি জড়িয়ে থাকা দূরে থাক, ছোঁয়াও থাকে না। কাজেই বুঝতেই পারছেন মানুষের আবেগ কতটা গূরুত্বপূর্ণ।

কাজেই যদি সামনের মানুষটির সাথে আবেগের একটি সংযোগ গড়ে নিতে পারেন তাহলেই বুঝবেন বন্ধু বানানোর কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে।

আর আবেগের সংযোগ গড়ে তোলার জন্য সবার আগে যেটা করতে হবে তা হল, সামনের মানুষটি এই মূহুর্তে কি অনুভব করছে তা বুঝতে পারা এবং সেই অনুযায়ী তার সাথে আচরণ করা।

মানুষের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে আমরা ৩টি উপায় অবলম্বন করে তাদের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। চলুন একে একে উপায় গুলো জেনে নেয়া যাক:

২.১/ আচরণ:

আপনার সাথে এমন ঘটনা নিশ্চই ঘটেছে যে আপনি কাছের বন্ধু অথবা পরিবারের কারও সাথে বসে আছেন; তার দিকে তাকিয়েই মনে হল সে কোনও সমস্যায় আছে। যদিও তাকে সেই কথা জিজ্ঞেস করলে সে মৃদু হেসে উত্তর দিল “না – কিছু হয়নি”। তবুও আপনার মন খচখচ করতে লাগল এবং পরে জানতে পারলেন আসলেই কিছু হয়েছিল।

কিন্তু কিভাবে এটা বুঝতে পারেন? কোন জাদুর বলে আমরা আমাদের কাছের মানুষগুলোর মনের কথা আঁচ করতে পারি?

ব্যাপারটা আসলে কিছুই নয় – মানুষের আচরণ। একজন যখন আপনার সামনে রাগ হয়ে বসে থাকবে, সে যতই স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করুক না কেন – তার আচরণে কোনও না কোনও ভাবে তা প্রকাশ পাবেই।

আমাদের আচরন আমাদের মস্তিষ্কের ওপর সব সময়ে প্রভাব ফেলে, এবং এর ফলে শত লুকোনোর চেষ্টা করলেও তা কোনও না কোনও শারীরিক ভঙ্গিতে তা প্রকাশ পেয়ে যায়।

মনোভাব লুকোনোর বিষয়ে আপনি যদি একদম পেশাদার ট্রেনিং না নিয়ে থাকেন, তাহলে রাগী বা দু:খী অবস্থায় যতই স্বাভাবিক অথবা হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করেন – অঙ্গভঙ্গী, কথার টোন, মুখের ভাব – ইত্যাদি দেখে আপনার মনের অবস্থা মানুষ ঠিকই ধরে ফেলতে পারবে। আর এতে করে গভীর সম্পর্ক বানানোটা মুশকিল হয়ে যাবে।

এই কারণে নতুন কারও সাথে কথা বলার সময়ে সব সময়ে চেষ্টা করুন যেন আপনার মাঝে রাগ, অস্থিরতা, হতাশা, অহঙ্কার, দু:খ – এইসব নেতিবাচক আচরন প্রকাশ না পায়। সামনের মানুষটি যেন বুঝতে পারে আপনার মন ও মেজাজ বেশ ভালো ও ফুরফুরে আছে।

মন মেজাজ যদি খারাপ থাকে, তাহলে সুন্দর কোনও স্মৃতির কথা ভাবুন। অথবা আরও একটি কাজও করতে পারেন; এই মানুষটির সাথে একটি ভালো সম্পর্ক হলে তা থেকে আপনি কিভাবে লাভবান হবেন, সেই কথা মনে করতে থাকুন।

শুধু অভিনয় করার চেয়ে সত্যিকারেই ভালো অনুভব করতে চেষ্টা করুন। একটা কথা মনে রাখবেন, আমাদের মস্তিষ্ক বাস্তব ঘটনাতে যেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়, কল্পনাতেও সেই একই প্রতিক্রিয়া দেখায়। কাজেই ভালোকিছু কল্পনা করতে চেষ্টা করুন – দেখবেন মন এমনিতেই ভালো লাগছে।

এ তো গেল আপনার নিজের আচরনের কথা। এবার অন্যের আচরনকে আপনি কিভাবে বন্ধু হওয়ার উপায় হিসেবে কাজে লাগাবেন – সেটা বলে নেয়া যাক।

মনে করুন নতুন একজনের সাথে পরিচয়ের সময়ে তার আচরনে মনে হচ্ছে যে সে কোনও কারণে অস্বস্তিতে আছে। আপনি তাকে জিজ্ঞেস করার পর সে বলল সব ঠিক আছে – কিন্তু তার আচরন বলছে অন্য কথা। আপনি তার আচরনকে আমলে না নিয়েই এরপর শুরু করলেন একের পর এক কৌতুক বলা – সে হয়তো আপনার কথায় হাসার অভিনয় করবে – কিন্তু মনে মনে ঠিকই বিরক্ত হবে। কাজেই বন্ধু হওয়ার জন্য শুধু মানুষের মুখের কথা নয়, তার আচরন বুঝে আচরন করুন।

২.২/ তাল মেলান:

যদি আপনার ক্রিকেট খেলা পছন্দ হয়, তবে ক্রিকেট পছন্দ করা মানুষদের সাথে আপনার তাড়াতাড়ি সম্পর্ক হবে। অথবা ধরুন আপনি Game of Thrones টিভি সিরিজটির বিরাট ভক্ত; তাহলে অন্য একজন ভক্তর সাথেও খুব তাড়াতাড়ি বন্ধুত্বপূর্ণ একটি সম্পর্ক তৈরী করে ফেলতে পারবেন।

ধরুন আপনার দুইজন বন্ধু; একজন স্কুলের, অন্যজনের সাথে পরিচয় কাজের ক্ষেত্রে এসে। দুজনেই ইঞ্জিনিয়ার – কিন্তু কেউ কাউকে চেনে না। কোনও এক কারণে একদিন দুজনের পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর দেখলেন কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা আপনাকে, যাকে বলে “কাবাব মে হাড্ডি” টাইপের কিছু একটা বানিয়ে নিজেদের মধ্যে তুমুল আলোচনা জুড়ে দিয়েছে। আপনি বসে বসে শুধু তাদের আলোচনা শুনছেন, যার বেশিরভাগ কথাই আপনার মাথার কয়েক হাত উপর দিয়ে যাচ্ছে।

খেয়াল করে দেখবেন, একই ধরনের মানুষদের মধ্যে কথা বলার টপিকের কোনও অভাব হয় না। এবং তারা খুব সহজেই নিজেদের মধ্যে একটা দারুন সম্পর্ক তৈরী করে নেয়।

এর কারণ হচ্ছে আমরা সাধারনত এমন মানুষদের সাথে থাকতে বেশি পছন্দ করি যাদের চিন্তাভাবনা, পছন্দ-অপছন্দ, লাইফস্টাইল অনেকটাই আমাদের নিজেদের মত। আর সবসময়ে না হলেও, বেশিরভাগ সময়ে নিজেদের চেয়ে আলাদা মানুষের সাথে আমাদের ততটা ‘জমে না’।

এই কারণেই যদি কারও সাথে আপনার একটি ভালো সম্পর্ক তৈরী করার প্রয়োজন পড়ে, সেই মানুষটির সাথে নিজের একটি মিল খুঁজে বের করুন। আর তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে থাকুন।

এখন মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে প্রতিটি মানুষের চিন্তা ভাবনা তো আলাদা আলাদা ধরনের; তাহলে প্রতিটি মানুষের চিন্তার সাথে তাল মেলানো কিভাবে সম্ভব?

আসলেই সেটা একটু কঠিন, এবং তার দরকারও নেই। একজন মানুষের সাথে তাল মেলাতে চাইলে শুধু যে তার সাথে কথা বলার মাধ্যমেই তা করতে হবে, এর কোনও মানে নেই। তাল মেলানোর জন্য আসলে তিনটি উপায় রয়েছে : ১. দেখা, ২. কন্ঠ, ৩. মৌখিক কথা।

২.২.১/ দেখা

একটি বাংলা প্রবাদ হয়তো আপনি শুনে থাকবেন “আগে দর্শনধারী, পরে গুণ বিচারী” – অর্থা‌ৎ আগে আমরা চোখের দেখায় সবকিছুকে বিচার করে তারপর তার আসল গুনাগুণ বিচার করতে যাই।

গবেষণায় দেখা গেছে আমাদের সম্পর্কগুলো গড়ে ওঠার পেছনে ৫৫% থাকে চোখের দেখা। একজন মানুষ প্রথমেই অন্য একজন মানুষকে চোখের দেখায় বিচার করে – তারপর বাকি সব।

তবে এখানে আপনি কতটা সুদর্শন বা সুন্দরী – তারচেয়ে আপনার দেহের ভঙ্গী দেখে মানুষ আপনাকে বিচার করবে। আপনি দেখতে কেমন তা এই ক্ষেত্রে খুবই কম অবদান রাখবে।

তো সামনের মানুষটির দেহভঙ্গীর সাথে তাল মেলাতে প্রথমেই আপনি যে পদ্ধতিটি কাজে লাগাতে পারেন সেটাকে বলে “আয়না পদ্ধতি” ইংরেজীতে “Mirroring”। হয়তো এটুকু শুনেই মোটামুটি এটি সম্পর্কে একটি ধারনা করতে পেরেছেন। আবার এটাও হয়তো ভাবছেন, ব্যাপারটা কি এত সহজ নাকি? – ব্যাপারটা কিন্তু আসলেই সহজ।

এই পদ্ধতিতে আপনাকে শুধু সামনের মানুষটির দেহের ভাষাকে কপি করতে হবে। যেমন ধরুন কথা বলতে বলতে সামনের মানুষটি যদি মৃদু হাসে, আপনিও মৃদু হেসে সেই হাসির উত্তর দিন। আরও সূক্ষ্ণ ভাবে, যদি সামনেরজন কথা বলতে বলতে এক হাতের ওপর আরেক হাত রাখে, তাহলে আপনিও একটু পর কথা বলতে বলতে সেভাবেই হাতের ওপর হাত রাখুন।
যদি কথা বলতে বলতে সে আপনার দিকে কিছুটা ঝুঁকে আসে, আপনিও তার দিকে ঝুঁকুন। যতটা পারা যায়, সামনের মানুষটির শরীরী ভাষা বা Body language কে কপি করার চেষ্টা করুন। কিন্তু এটাও মনে রাখবেন, সামনের মানুষটি যদি কোনও ভাবে টের পায় যে আপনি ইচ্ছা করে তার ভঙ্গীকে নকল বা কপি করছেন, তাহলে কিন্তু আপনার ওপরে তার ধারনা আরও কয়েক গুন খারাপ হয়ে যাবে। বন্ধু ভাবার বদলে, সে আপনাকে উদ্ভট মানুষ বলে ধরে নেবে।

কথা বলতে বলতে আপনার সামনের মানুষটি যদি হাতের ব্যাথা কাটানোর জন্য হাত ম্যাসাজ করতে থাকে – আপনার সেটা কপি করার দরকার নেই। তাহলে তার বুঝে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে যে আপনি তাকে কপি করছেন। আপনি যেটাই কপি করুন সেটা যেন স্বাভাবিকই মনে হয়।

২.২.২/ কন্ঠ

আগেই বলেছি, শুধু কথা বা চিন্তার সাথে তাল মেলাতে হবে এমন কোনও কথা নেই। একজন মানুষের কন্ঠের লেভেলে কন্ঠ নামিয়ে বা উঠিয়ে কথা বলেও তার মাঝে একটি আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারবেন আপনি। আর এর ওপরে আপনার সাথে তার কেমন যোগাযোগ হবে তার ৩৮% নির্ভর করে।

কন্ঠের সাথে তাল মেলাতে প্রথমে যে কাজটি করতে পারেন তা হল সামনের মানুষটির কন্ঠের টোনটি নিজের কন্ঠে নিয়ে আসুন। সে যদি খুব আনন্দিত হয়ে কথা বলে, নিজের কন্ঠেও সেই আনন্দের রেশ নিয়ে আসুন। সে যদি খুব আবেগের সাথে বলে, আপনিও কন্ঠে সেই আবেগ নিয়ে আসুন। দেখবেন ম্যাজিকের মত কাজ হচ্ছে। দারুন ভাবে সে আপনার সাথে connect করছে। মানুষের কথার টোন আসলে তার ভেতরের আবেগ আর অনুভূতির একটি প্রকাশ। কাজেই একজনের কথার টোনের সাথে তাল মেলানোর মানে হচ্ছে তার আবেগ আর অনুভূতির সাথে বেশ ভালো মাত্রায় তাল মেলানো। Image result for voice

কথার টোনের সাথে তাল মেলানোর পাশাপাশি আরও যে জিনিসটির সাথে তাল মিলিয়ে ভালো ফল পাবেন তা হচ্ছে সামনের মানুষটির কথার গতি ও মাত্রা (volume) – আমরা যখন কারও সাথে ঝগড়াও করি, সামনের মানুষটি যদি আমাদের সমান ভলিউমে না চি‌ৎকার করে তবে কিন্তু ঝগড়া করারও মজা থাকে না। (এই কথাটি শুধুই উদাহরন দেয়ার জন্য, আপনাকে ঝগড়া করতে কোনওভাবেই উ‌ৎসাহিত করছি না। )

আপনার সামনের মানুষটি যদি দ্রুত কথা বলতে থাকে, আপনিও চেষ্টা করুন তার কাছাকাছি দ্রুততার সাথে কথা বলতে। সে যদি ধীরে ধীরে কথা বলে, তো আপনিও ধীরে ধীরে কথা বলার চেষ্টা করুন।

দুইজন মানুষ যখন একই ছন্দে কথা বলে তখন সেখানে দুজনেই নিজেদের মধ্যে একটি অন্য রকমের স্বস্তি অনুভব করে। connection তৈরীর জন্য যা বেশ কাজে দেয়।

২.২.৩/ মৌখিক কথা

যদিও আপনার সাথে একজন নতুন মানুষের বন্ধু সুলভ সম্পর্ক তৈরীর ক্ষেত্রে এর অবদান মাত্র ৭% – তবে একে ছোট করে দেখার কোনও কারণ নেই। একজন মানুষের সাথে কথার পিঠে কিভাবে কথা বলতে হবে, কিভাবে কথার বিষয় নির্বাচন করতে হবে, কিভাবে তাকে প্রশ্ন করতে হবে যাতে করে অনেক্ষণ কথা চালিয়ে নেয়া যায় – এসব আমরা ৩ নম্বর মূলপয়েন্টটি আলোচনা করার সময়ে বিস্তারিত ভাবে আপনাকে জানাবো। তার আগে চলুন গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি করতে আরও যে জিনিসটির প্রয়োজন হয় সেটি জেনে নিই।

২.৩/ সংগতি:

আমরা যখন কোনও সিনেমা বা টিভি শো দেখি, তার সবই অভিনয় অথবা কাল্পনিক এটা জানার পরও সেখানে ঘটা কোনও কোনও ঘটনায় আমরা ঠিক বাস্তবের মতই প্রতিক্রিয়া দেখাই। সিনেমায় বা টিভিতে বা গল্পে প্রিয় কোনও চরিত্র মারা গেলে আমরা অনেকেই রীতিমত কেঁদে ফেলি। না কাঁদলেও বেশিরভাগ মানুষেরই খারাপ লাগে। তেমনি ভাবেই আমরা সিনেমায় কোনও হাসির ঘটনা দেখলে হেসে উঠি। অন্যায় দেখলে রেগে উঠি, প্রিয় চরিত্রের বিপদে ভয় পাই। – কিন্তু, এটা কেন হয় কখনও ভেবে দেখেছেন?

Image result for reacting to cinema

এর কারণ যারা খুব ভালো অভিনেতা তারা অভিনয়ের সময়ে তাদের দেহের নড়াচড়া, কথার টোন, কন্ঠস্বর -এইসব ডায়লগ এবং সিনের সাথে সব সময়ে সংগতিপূর্ণ রাখেন। আর এই কারণেই আমাদের কাছে ব্যাপারগুলো এতটা সত্যি আর বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।

সেই একই ভাবে আপনি যদি চান মানুষ আপনার ওপর বিশ্বাস করে এবং আপনার সাথে একটি বন্ধু সুলভ সম্পর্ক সৃষ্টি করে, তবে আপনিও এই তিনটি ব্যাপারে সংগতি রাখুন।

মুখে শোনা যাচ্ছে সাহসের কথা, কিন্তু চোখে প্রকাশ পাচ্ছে ভয়, তাহলে কিন্তু মানুষ আপনার ওপরে ভরসা করবে না, বিশ্বাসও করবে না। কাজেই সব সময়ে লক্ষ্য রাখুন মুখ দিয়ে যা বলছেন, শরীরী ভাষা অর্থা‌ৎ ‘body language’ -এও তা প্রকাশ পাচ্ছে।

০৩/ মৌখিক যোগাযোগ:

সবকিছুর পর একজন নতুন মানুষের বন্ধু হওয়ার জন্য যে জিনিসটা আপনার প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে মানুষটির সাথে ঠিকমত কথা বলা।

অনেকেই নতুন কারও সাথে কথা বলতে গিয়ে কথা খুঁজে পান না। হার্টবিট বেড়ে যায়, গলা দিয়ে স্বর বের হয়না, শীতের মধ্যেও ঘাম ঝরতে থাকে – ইত্যাদি ইত্যাদি।

তবে এতকিছু না হলেও, কথা খুঁজে না পাওয়াটা একটা ‘জাতীয় সমস্যা’। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, অল্প কয়েকটি উপায় ও কৌশল খাটিয়ে সহজেই নতুন একজন মানুষের সাথে অনেক্ষণ ধরে কথা চালিয়ে নেয়া যায়। এমনকি কথা কম বলা মানুষের সাথেও অনেক্ষণ আলাপ করা যায়।

তো এখন যে কয়টি উপায় বা কৌশলের কথা বলব, সেগুলো যদি ঠিকমত কাজে লাগাতে পারেন – তাহলে যে কারও সাথে কোনও রকমের অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি না করে, বা খুব বেশি চিন্তা ভাবনা ছাড়াই অনেক্ষণ ধরে আড্ডা জমাতে পারবেন। চলুন তাহলে শুরু করা যাক:

৩.১/ বন্ধ এবং খোলা প্রশ্ন:

শিরোনামটি দেখে হয়তো আপনার একটু খটকা লাগতে পারে। “এ আবার কি জিনিস?” – আরে ভাই/আপু, একটু ব্যাখ্যা করলেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে।

অনেক সময়েই এমনটা হয় যে আমরা কারও সাথে কথা বলার সময়ে অনেক সুন্দর সুন্দর প্রশ্ন করি এবং বেশ ভালো ভালো কথা বলি – কিন্তু ওপাশ থেকে ‘হ্যাঁ’, ‘না’, ‘ওয়াও – তাই নাকি!’, ‘ভালোতো’ – ইত্যাদি ছোট ছোট উত্তর আসতে থাকে। এর ফলে এক সময়ে গিয়ে আপনার আর কথা বলার আগ্রহ থাকে না। আড্ডা বা কথপোকথন ওখানেই শেষ হয়ে যায়।

বন্ধু বানানোর প্রশ্ন

অনেকেই বোঝে না যে আসলে তার ভুলটা কোথায় হয়েছে। ভুলটা আসলে হয় প্রশ্নের ধরনে। এখানে যেগুলোকে ‘বন্ধ প্রশ্ন’ বলা হচ্ছে, সেগুলো আসলে এমন প্রশ্ন যার উত্তরে ছোট ছোট কথা বললেই চলে। কিন্তু এমন কিছু প্রশ্ন আছে যেগুলোকে ‘খোলা প্রশ্ন’ বলা যায় – সেগুলোর উত্তর এক-দুই কথায় দেয়া সম্ভব নয়। এখানে একটি তথ্য আপনাকে জানিয়ে রাখি, মানুষ নিজের ব্যাপারে কথা বলতে খুব পছন্দ করে – কেউ হয়তো স্বীকার করে, আর কেউ করে না। কিন্তু ব্যাপারটা এটাই। আর একটু খোলাসা করলে ব্যাপারটা আপনার কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে।

ধরুন আপনি আপনার এক নতুন পরিচিত বন্ধুর এক পার্টিতে গিয়েছেন। পার্টিতে আপনি শুধু তাকেই চেনেন। তো আপনার বন্ধু (ধরা যাক তার নাম রাজিব) খাওয়াদাওয়া ও অন্যান্য আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, এবং আপনি ভবঘুরের মত পার্টির এখানে সেখানে ঘুরছেন। খুবই বেদনাদায়ক একটি ব্যাপার। এখন ধরা যাক আপনি ঠিক করলেন কারও সাথে কথা বলে সময়টা পার করবেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেলেন আপনার সমবয়সী একজনও একা একা এক কোনে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে কথা শুরু করলেন:

আপনি: হাই

সে: হাই

আপনি: পার্টিটা বেশ ভালোই না?

সে: হ্যাঁ, ভালোই…

আপনি: আপনি রাজিবের বন্ধু?

সে: হ্যাঁ…

আপনি: আমিও… আচ্ছা আপনি খেয়েছেন?

সে: না…

আপনি: আচ্ছা, আমিও না

সে: (বিব্রত হেসে) ও… ঠিক আছে… আচ্ছা আমি একটু ওদিকটায় যাই, কথা বলে ভালো লাগল

আপনি: (বিব্রত হাসি) ওকে

এই কথপোকথনে ভুলটা কোথায় হয়েছে, এটা হয়তো অনেকেই ধরতে পারবে না। কিন্তু এটা বুঝতে না পারার কারণেই আসলে অনেকেই মানুষের সাথে প্রথম দেখায় আলাপ জমাতে পারি না।

আবার যদি ভেবে থাকেন, শুধু প্রশ্ন করে যাওয়ার কারণে আলাপটি জমেনি, তাহলেও কিন্তু ভুল করবেন। আসলে শুধু মাত্র প্রশ্ন করে করেই একজন মানুষের সাথে দীর্ঘ আলাপ জুড়ে দেয়া যায়। কিন্তু সেজন্য আপনাকে সঠিক ধরনের প্রশ্নগুলো করতে হবে।

আগেই বলা হয়েছে, প্রশ্ন আসলে দুই ধরনের: বন্ধ এবং খোলা প্রশ্ন। এই নাম দেয়ার পেছনের কারণ হল, ‘বন্ধ’ প্রশ্ন গুলো কথা এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে কথা বন্ধ হওয়ার দিকে নিয়ে যায়। অন্যদিকে ‘খোলা’ টাইপের প্রশ্ন গুলো মানুষকে মন খুলে কথা বলতে উ‌ৎসাহিত করে। – চলুন আগের সেই একই দৃশ্যে এবার খোলা প্রশ্ন করার ফলে কি ঘটে দেখি:

আপনি: হাই, আমার নাম x… আপনি?

সে: হাই, আমি Y

আপনি: পার্টি তো ভালোই চলছে …

সে: হ্যাঁ, বেশ ভালো পার্টি

আপনি: আমার তো পার্টির ডেকোরেশন খুবই ভালো লেগেছে.. আপনার কোন জিনিসটা সবথেকে ভালো লেগেছে?

[এখন, এই ধরনের খোলা প্রশ্নে এক কথায় উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। কাজেই উত্তর বড় আসবে। আর আগেই বলেছি, মানুষ নিজেকে তুলে ধরতে সব সময়েই পছন্দ করে। – Y এর উত্তরটা কি হতে পারে তার একটা আইডিয়া নেয়া যাক-]

Y: আমার তো পার্টির সবকিছুই ভালো লেগেছে, গানগুলো বেশ ছিল

[এরপর আপনি গান নিয়ে তার সাথে কথা বলতে শুরু করতে পারেন। কোনও ধরনের গান তার পছন্দ, তার প্রিয় শিল্পী কে – ইত্যাদি ইত্যাদি]

এরপর আসা যাক আগের বারের দ্বিতীয় প্রশ্নে। প্রশ্নটি ছিল, Y রাজিবের বন্ধু কি-না? – প্রশ্নটি এভাবে না করে, যদি বলা হত রাজিবের সাথে তার কিভাবে পরিচয় হয়েছে – তাহলে কিন্তু “হ্যাঁ” এর থেকে আরও বড় একটি উত্তর পাওয়া যেত।

আবার খাবারের ব্যাপারেও কিন্তু আপনি কথা বাড়াতে পারতেন। আজকের মেন্যুতে তার প্রিয় খাবার কোনটি, এবং কেন সেটি প্রিয় – এই বিষয়ে আলোচনা শুরু করে। – মোটের উপর প্রশ্নগুলো এমন হওয়া চাই যাতে করে সামনের মানুষটি নিজেকে বিস্তারিত ভাবে প্রকাশ করার সুযোগ পায়।

৩.২/ সূত্র ধরে কথা বলা:

আশা করা যায় আগের টিপসের থেকে আপনি ‘খোলা প্রশ্ন’ করার ব্যাপারে একটি ভালো ধারনা পেয়েছেন। কিন্তু এই কৌশল শেখার পর যদি সামনের মানুষটিকে একে একে খাপছাড়া ভাবে প্রশ্ন করতে থাকেন, তাহলে দেখা যাবে পুরো ব্যাপারটাই খাপছাড়া হয়ে গেছে। – তাহলে কি উপায়?

খোলা প্রশ্ন বা ‘open question’ করার পর সামনের মানুষটির উত্তরটি আপনাকে খুব মনযোগের সাথে শুনতে হবে। একজনের কথা ভালোমত না শুনতে আপনি তার অনুভূতিগুলো পুরোপুরি বুঝতে পারবেন না। আর এভাবে শুধু প্রশ্ন করার খাতিরে প্রশ্ন করে গেলে সেটা কখনওই বন্ধু সুলভ সম্পর্কে রূপ নেবে না।

এর মানে এই নয় যে প্রশ্ন করা বন্ধ করে দিন। খোলা প্রশ্ন করে যান, তবে সেটি একটি বিশেষ পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে। ইংরেজীতে এই পদ্ধতিকে বলে ‘Threading’ – ব্যাপারটা আসলে অনেকটা দড়ি পাকানোর মত। একটির সাথে আরেকটি সুতা ও আঁশ পেঁচিয়ে যেভাবে দড়ি পাকানো হয়, আপনিও আপনার সামনের মানুষটির আগের উত্তরের সূত্র ধরে নতুন প্রশ্ন করুন।

এই উপায় কাজে লাগিয়ে কথা চালালে যতক্ষণ ধরে কথা চালাতে চান, চালাতে পারবেন। আর কথা চালানোর পাশাপাশি, সামনের মানুষটির সাথে আপনার একটি সুন্দর সম্পর্কও সৃষ্টি হয়ে যাবে। মনে রাখবেন আমরা তাদেরই বন্ধু বানাই, যাদের চিন্তা আমাদের সাথে মেলে এবং যারা আমাদের প্রতি মনযোগী।

যেমন ধরুন Y এর সাথে আপনার কথার এক পর্যায়ে তার প্রিয় খাবারের প্রশ্ন আসল। সে বলল যে তার প্রিয় খাবার পাস্তা। এখন যদি ‘আচ্ছা’ বলে এরপর তার প্রিয় ফুল নিয়ে কথা বলতে শুরু করে দেন, তাহলে কিন্তু ব্যাপারটি খাপছাড়া হয়ে যাবে। এবং তারও হয়তো মনে হবে আপনি শুধু কথা বলার খাতিরেই কথা বলছেন।

কিন্তু যদি তার কথাটি শুনে তারপর সেই সূত্র ধরে আরেকটি প্রশ্ন করেন তাহলে ব্যাপারটির ভেতরে ভালো একটি ছন্দ থাকবে।

যেমন, সে বলল তার প্রিয় খাবার পাস্তা। আপনি তখন বলতে পারেন “বাহ, তাহলে তো আপনি নিশ্চই বেশ ভালো পাস্তা বানাতে পারেন – কোনও স্পেশাল রেসিপি জানা আছে আপনার?”

এখন সে যদি উত্তরে বলে যে তার জানা আছে, তাহলে তো হয়েই গেল। আর যদি না জানা থাকে, তাহলেও সমস্যা নেই, তাকে জিজ্ঞেস করুন কোন রেস্টুরেন্টের পাস্তা তার সবচেয়ে প্রিয় – এরপর শুরু করুন রেস্টুরেন্ট নিয়ে কথা। তারপর আবার সেই সূত্র ধরে অন্য প্রসঙ্গ। দেখবেন কথা শেষই হতে চাইছে না।

সংক্ষেপে এই উপায়টি হল সামনের মানুষটির কথা থেকে কোনও একটি নতুন প্রসঙ্গ বের করে সেই প্রসঙ্গ ধরে কথা চালিয়ে যাওয়া। এটিঠিকমত কাজে লাগাতে পারলে আপনার কখনওই কথা খুঁজে পেতে খুব বেশি মাথা ঘামাতে হবে না। যে কোনও অবস্থাতে, যে কারও সাথে গল্প জুড়ে দিতে পারবেন।

৩.৩/ প্রশ্নবোধক শব্দ (Question words):

প্রশ্নবোধক শব্দ বা ‘Question words’ মূলত ছয়টি: ১. কেন? ২. কি? ৩. কোথায়? ৪. কিভাবে? ৫. কে? ৬. কখন?

এই ছয়টি প্রশ্নবোধক শব্দ কথা চালিয়ে নিতে দারুন সাহায্য করতে পারে। এই শব্দগুলো দিয়ে করা প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আপনার সামনের মানুষটিকে সাধারনত যে কোনও বিষয় ব্যাখ্যা করতে হবে। এবং বেশিরভাগ সময়ে মানুষ যখন কিছু ব্যাখ্যা করতে যায়, তখন সে তা উপভোগ করতে শুরু করে এবং তার মাঝে আবেগের মাত্রা কিছুটা হলেও বাড়তে থাকে। আর এর ফলে তার সাথে একটি সম্পর্ক তৈরী করা সহজ হয়ে যায়।

এইসব শব্দ দিয়ে করা প্রশ্নগুলো বেশিরভাগ সময়েই সুন্দর ‘খোলা প্রশ্ন’ হয়। যেমন ধরুন : আপনি চা ‘কেন’ খান না?, ‘কিভাবে’ ব্যাপারটা ম্যানেজ করলেন?, এই মূহুর্তে কোথায় যেতে পারলে আপনার সবথেকে ভালো লাগত?, আপনার জীবনে দেখা সবচেয়ে মজার মানুষটা কে? – ইত্যাদি ইত্যাদি

বন্ধু

এমন নয় যে এই ধরনের প্রশ্নই আপনাকে করতে হবে, মানুষ ও পরিস্থিতি বুঝে এই শব্দ গুলো ব্যবহার করে আপনি প্রশ্ন বানাতে থাকুন।

আর একটি কথা, এই প্রশ্ন গুলো করতে করতে খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন, আপনার সাথে তার কোনও জায়গায় মিল আছে কি না। আপনারা দু’জনই যদি কোনও একটি বিষয়ের প্রতি আগ্রহী থাকেন, তাহলে সেই বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করুন। আপনারা দু’জনেই কথা বলে অনেক মজা পাবেন। দেখতে দেখতেই আপনাদের মাঝে একটি বন্ধু সুলভ সম্পর্ক তৈরী হয়ে যাবে।

৩.৪/ ছবির সাথে কথা বলুন:

শিরোনামটি হয়তো আপনাকে একটু ভড়কে দিয়েছে, কিন্তু এখানে আসলে ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলা হচ্ছে না। যখন কথা বলবেন, তখন এমন ভাবে বলুন যেন শ্রোতার মনে একটি ছবি ভেসে ওঠে। আপনার কথাগুলোকে যেন সে অনুভব করতে পারে।

কিছু মানুষ আছে যারা খুব সাধারন ঘটনা এমন ভাবে বলেন যে তা শুনতেও খুব ভালো লাগে। মনেহয় আরও শুনি।

আবার কিছু মানুষ দারুন কোনও ঘটনাকেও এমন ভাবে বলেন যে তা শুনতে শুনতে ঘুম চলে আসে।

কিন্তু এমনটা কেন হয়? – এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে, যেমন যে কথা বলছে তার এনার্জি লেভেল, তার আত্মবিশ্বা, কথা বলার ধরন – ইত্যাদি। তবে এতসব কারণের মধ্যে সব থেকে বড় কারণটি হচ্ছে কথার মাঝে ছবি না থাকা, কথার মাঝে রঙের অভাব থাকা।

বন্ধু বানানোর গল্প

আপনার কথা শোনার সময়ে যদি শ্রোতার মনে একটি ছবি ভেসে ওঠে তাহলে সে কথা শুনতে অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে উঠবে।

যেমন ধরা যাক আপনার কোনও বন্ধু এসে আপনাকে বলল: বন্ধু, আজকে রাস্তায় এমন জ্যাম ছিল, পুরো কাহিল হয়ে গেছি।

এই কথা শোনার পর আপনার ওপর তেমন কোনও প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই, কারণ এটি খুবই সাধারন কথা, এবং এই কথায় তার অনুভূতি ও তার পরিস্থিতি খুব ভালোমত বোঝা যায়না।

এখন সেই একই কথা যদি আপনাকে সুন্দর করে বর্ণনা করে বলা হয় তাহলে কিন্তু আপনার প্রতিক্রিয়া অন্যরকম হবে। আপনার প্রতিটি ইন্দ্রিয়কে স্পর্শ করে এমন ভাবে কোনও কিছু বলা যায়, তাহলে তা অন্য রকমের একটি প্রভাব ফেলতে বাধ্য। প্রতিটি ইন্দ্রিয়কে স্পর্শ করার মানে আপনি শোনার সাথে সাথে কল্পনায় কথাগুলো, আপনার চোখ, কান, নাক, ত্বক – ইত্যাদির মাধ্যমে অনুভব করতে পারবেন।

জ্যামে পড়ার সময়ে আপনার বন্ধুটির চারপাশের পরিবেশ কেমন ছিল, সে কি দাঁড়িয়ে না বসে ছিল, কি ধরনের গন্ধ তার নাকে আসছিল, আশপাশে কেমন কোলাহল ছিল – ইত্যাদি সহ বললে আপনি আপনার সামনে মোটামুটি একটি ছবি ভেসে উঠতে দেখতে পেতেন। এমনটা হলে ব্যাপারটা আপনার মাঝে একটা অনুভূতি সৃষ্টি করত।

এক কথায় না বলে আপনার বন্ধুটি যদি এমন ভাবে বলত : “বাসা থেকে বের হয়েই দেখি রোদ পড়ে গেছে, রাস্তায়ও লোকজন তেমন একটা নেই। সুন্দর বাতাস গায়ে লাগছিল। খুব মজা করে সাইকেল চালাতে চালাতে মেইন রোডে এসে দেখি ভয়াবহ জ্যাম। সাইকেল নিয়েও সেই জ্যাম থেকে বের হতে পারলাম না। সামনের গাড়ি থেকে ভক ভক করে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। একদম যাচ্ছেতাই অবস্থা…”

ঠিক এভাবে না হলেও, আপনার কথায় যদি পরিস্থিতির ভালো একটা বর্ণনা থাকে তাহলে শ্রোতার আপনার কথা শুনতে বেশ ভালো লাগবে। নতুন কারও সাথে কথা বলার সময়ে খেয়ার রাখবেন, সে যেন আপনার কথার পুরো ব্যাপারটা ধরতে পারে – তাহলে সম্পর্ক সৃষ্টি করাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে।

পরিশিষ্ট:

বন্ধু বানানোর উপায় নিয়ে এই লেখাটি হয়তো একটু বেশিই বড় হয়ে গেছে। তবে সেটা করা হয়েছে যাতে আপনি ব্যাপারটি ভালো মত বুঝতে পারেন। এই আর্টিকেলের টিপসগুলো নেয়া হয়েছে বিখ্যাত লেখক নিকোলাস বুথম্যান এর How to Make People Like You in 90 Seconds or Less” বই থেকে। যোগাযোগ দক্ষতা বা communication skill এর ক্ষেত্রে বইটিকে একটি মাস্টারপিস হিসেবে ধরা হয়। অনেকেই এই টিপসগুলো থেকে দারুন উপকার পেয়েছেন। আপনিও এই টিপসগুলো কাজে লাগিয়ে একজন দক্ষ communicator হয়ে উঠতে পারবেন, এই আমাদের আশা।

লেখাটি ভালো লাগলে লাইক, শেয়ার ও কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের উ‌ৎসাহিত করুন। কোনও পরামর্শ বা মতামত থাকলে অবশ্যই আমাদের জানান। সাফল্যের পথে লড়াকু সব সময়ে আপনার পাশে আছে।

পোস্টটি শেয়ার করুন !

2 thoughts on “বন্ধু বানানোর উপায়: মাত্র ৯০ সেকেন্ডেই যে কাউকে বন্ধু বানিয়ে ফেলুন! – (বুক রিভিউ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *